• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘মায়াবতী’-এর অষ্টম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : মায়াবতী

  রিফাত হোসেন

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:৩৭
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ভয় আর কৌতূহল নিয়ে মায়াদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে নিশু। পাশে অরিন দাঁড়িয়ে আছে। তবে দু'জনের মাঝে এখন বেশ কিছুটা দূরত্ব। এইসময় গ্রামের লোকজন কাজের জন্য মাঠে যায়। তাই এইদিকে লোকজনের চলাচল একটু বেশিই থাকবে বলে একে অপরের মাঝে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। হঠাৎ নিশু খেয়াল করল গ্রামেই কয়েকজন কৌতূহলী দৃষ্টিতে কিংবা আড়চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। নিশু অরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘উনারা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন বুঝতে পারছি না।’

- গ্রামে নতুন কেউ এলেই উনারা এভাবে তাকিয়ে থাকে। আর বুঝার চেষ্টা পরে এই অপরিচিত লোকটি কে?

মৃদু হাসি দিয়ে নিশু বলল, ‘উঁহু। বরং উনারা এটা বুঝার চেষ্টা করছে এতদিন পর এই খুনি ছেলেটা আবারও গ্রামে এসেছে কেন?’

সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করেই নিশুর দিকে এগিয়ে এলো অরিন। নিশুর হাত ধরে বলল, ‘কেন শুধু শুধু এইসব বলছেন? আমি তো জানি সেদিন আপনার কোনো দোষ ছিল না। শুধু আমি নয়, এই গ্রামের সবাই খুব ভালো করেই সেটা জানে। ওই ছেলেটা আমাদের সবাইকে অপমান করেছিল। এছাড়াও মায়া আপুর শরীরে স্পর্শ করেছিল। সেই সাথে যতসব অশ্লীল কথা বলছিল মায়া আপুকে। আমার নিজেরই ইচ্ছে করছিল ওর মুখটা ভেঙে দিতে। কিন্তু সাহস পাইনি। আপনি সেই সাহস দেখিয়েছেন। নিজের বোনের আত্মসম্মান রক্ষা করেছেন আপনি। আপনার এই দায়িত্ববোধ কে আমি সম্মান করি নিশু। তাই আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, নিজেকে কখনোই খুনি ভাববেন না।’

নিশু অরিনের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে আবারও মৃদু হাসি দিলো। এরপর বল, ‘যেই কারণেই করি না কেন? সত্যিটা কখনোই মিথ্যে হয়ে যায় না। আপনি আমাকে পছন্দ করেন। তাই আমার দোষটা আড়াল করছেন। কিন্তু গ্রামের অন্যরা ঠিকই দূর থেকে আমাকে ‘খুনি’ বলছে।’

আবারও নিশুর হাত ধরল অরিন। তবে এবার আরো শক্ত করে। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আমার এই অনুরোধ অন্তত রাখেন দয়া করে। আর কখনোই নিজেকে খুনি বলবেন না। তাছাড়া এই উসকোখুসকো দাড়ি আর লম্বা লম্বা চুল দেখে আপনাকে চেনার উপায় নেই। আপনাকে অচেনা লাগছে বলেই উনারা তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। আমি নিজেই তো প্রথমে চিনতে পারছিলাম না। এরপর যখন বুঝতে পারলাম আপনি নিশু। তখন তো আমার মুখ ‘হা’ হয়ে গিয়েছিল। আপনি আর সেই চার বছর আগের নিশু নেই। আপনার চেহারায় সাংঘাতিক পরিবর্তন এসেছে।’

- হ্যাঁ। আগের নিশুর আর আজকের নিশুর মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেই চার বছর আগের নিশুর মাঝে যে আকর্ষণ ছিল, আজকের নিশুর মাঝে আকর্ষণের ছিটেফোঁটা-ও নেই। আজকের নিশু নিতান্তই অনুভূতিহীন একজন।

- আমি তো কখনোই আপনার প্রেমে পড়িনি। তাহলে আপনার মধ্যে আকর্ষণ আছে কি না আছে, সেটা দেখে কী করব আমি? আর আপনার অনুভূতি থাক বা না থাক। আমার কিছুই আসে যায় না। কারণ ‘ভালোবাসা’ শব্দটাই একটা অনুভূতি। আর আমি আপনাকে ভালোবাসি। চার বছর আগে যা বলতে পারিনি। আজ তা নির্বিদ্বায় বলছি আমি। আমি আপনাকে নয়, আপনার আত্মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। সুতরাং আপনার আত্মা এই শরীরটায় যতদিন থাকবে। ততদিন আমার ভালোবাসা একটুও কমবে না।

নিশু কোনো কিছু বলল না। তড়িঘড়ি করে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলে ও। কিন্তু অরিন বারবার নিশুর দিকে তাকাচ্ছে। দীর্ঘ সময় প্রিয় মানুষটাকে দেখতে না পারায় আজ নিজের ইচ্ছে মতো দেখছে। তবে এই দেখা আর বেশিক্ষণ রইল না। বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে আসায় অরিন তাড়াতাড়ি হেঁটে ভিতরে গেল। অরিনের বাবা-মা তখন কাজ করছিল। তারা অরিনকে দেখে কাজ বাদ দিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘এত সকালে কোথায় গিয়েছিলি মা? আমরা তো চিন্তা করছিলাম তোর জন্য।’

অরিন কিছু বলল না। অরিনের বাবা কিছু বলতে গিয়েও চুল-দাড়িওয়ালা একটা ছেলেকে বাড়ির ভিতরে আসতে দেখে থেমে গেল। অরিনের বাবা-মা দু’জনের কৌতূহলী আর সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশুর দিকে। নিশু তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। অরিনের বাবা খুবই নিখুঁতভাবে নিশুকে পর্যবেক্ষণ করে দেখছেন। কিছুক্ষণ দেখার পর হঠাৎই তার চোখমুখের আকার পরিবর্তন হয়ে গেল। বিস্ময়কর কণ্ঠে জোরে শব্দ করে বলল, ‘নিশু।’

নিশু মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।’

অরিনের বাবার চোখেমুখে এখনো বিস্ময়। তিনি সেভাবেই বললেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। কিন্তু আমি তো বিশ্বাস'ই করতে পারছি না যে, এতদিন পর তুমি এখানে! তুমি ছাড়া পেলে কবে?’

নিশু মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘গতকাল সকালে।’

অরিনের বাবা বললেন, ‘ওহ্ হো! আমিই ভুলে গিয়েছিলাম তোমার মুক্তির ডেটটা।’

নিশু অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি জানতেন আমি কবে ছাড়া পাবো! কিন্তু কীভাবে?’

- তোমার সাথে দেখা করতে যেতে না পারলেও মাঝে মাঝে খোঁজখবর নিতাম আমরা। তোমাকে যেই থানার অফিসার এরেস্ট করেছিল, সেই অফিসারের মাধ্যমেই তোমার মুক্তির তারিখটা জানতে পেরেছিলাম।

- কিন্তু আপনারা আমার শাস্তির ঘোষণার দিন যাননি কেন? আর মায়া আপু কোথায়? গত চার বছরে সে আমাকে দেখতে যাইনি একবারও। কিন্তু কেন? সে কি আমাকে ভুলে গেছে?

নিশুর কথা শুনে অরিনের বাবা চুপ হয়ে গেলেন। তার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল ছলছল করছে। নিশু অরিনের দিকে এবং অরিনের মায়ের দিকে তাকালো একবার। সবাই নিচের দিকে তাকিয়ে কছে।

নিশু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘কথা বলছেন না কেন? বলুন মায়া আপু কোথায়? সে এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেল কীভাবে? নাকি আমি একজন খুনি বলে সে আমাকে ঘৃণা করে।’

অরিনের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘মায়া তো নিজেকেই ভুলে গেছে।’

- মানে?

- মায়া আর নিজের মধ্যে নেই নিশু। ও উন্মাদ হয়ে গেছে৷ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

নিশুর খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘এইসব কী বলছেন আপনি? আচ্ছা, মায়া আপু কোন ঘরে আছে এখন? আমি নিশ্চিত, আমাকে দেখলেই আবার আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যাবে সে।’

- মায়া এখন কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে, তা আমরা কেউই জানি না।

নিশু এবার আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল। অরিন নিশুকে ধরে রাখল। অরিনের মা একটা চেয়ার এনে নিশুকে বসতে বললে নিশু দ্বিমত পোষণ করে বলল, ‘আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলুন দয়া করে। মায়া আপু কোথায় আছে এখন? কোনো হাসপাতালে?’

নিশুর কোমড়ের পিছনে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে অরিন। ও বলল, ‘এমনিতেই মায়া আপুর বাবা অসুস্থ ছিল। তার উপর সেদিন মায়া আপুকে ওই ছেলেটা অনেক অপমান করেছিল। এতে তিনি আরো কষ্ট পায়। তারপর আপনাকে আবর পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। মামার ভিতরে ভিতরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল তখন। আপনার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার জন্য মামা নিজেই নিজেকে দ্বায়ী করছিল তখন। আপনি চলে যাওয়ার পর মামা অস্থির হয়ে পড়ে। নিশ্বাস নিতে পারছিল না তিনি। আমরা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন বরের বাড়ির লোকজন আমাদের আটকে দেয়। মামার গায়ে হাত তুলতে যায় তারা। অনেক অপমানও করে। গ্রামের লোকজন ওদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিলেও মামাকে বাঁচাতে পারিনি আমরা। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যায় তিনি। এদিকে আপনি জেলে। আর এদিকে নিজের বাবা মৃত্যুতে মায়া আপু পাগলের মতো করতে থাকলো। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল সে। সারাক্ষণ চেঁচামেচি করত আর জিনিসপত্র ছুড়াছুঁড়ি করত। আর মাঝ রাতে আর্তনাদ করে বলতো, আমার মতো কলঙ্কিত একটা মেয়ের জন্য আর আমার বাবা মারা গেল। আমার মতো কলঙ্কিনী বোনের জন্য আমার ভাই জেলে গেল। ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে চলে গেল। হয়তো ওর ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে। দু'টো মানুষকে মেরে ফেললাম আমি। এই কলঙ্কিত জীবন রাখবো না আমি।’

সারারাত এইসব বলতো শুধু। আর এইসব কিছুর জন্যই আমরা কেউ আপনার সাথে দেখা করতে যেতে পারিনি। এছাড়াও আপনার কাছে গিয়ে কী বলতাম? মামার মৃত্যু আর মায়া আপুর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার কথাটা শুনলে তো আপনি আরো ভেঙে পড়বেন। হয়তো আপনি বাঁচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলবেন। তাই আর আপনার মুখোমুখি হইনি আমরা কেউ। এভাবেই কিছুদিন চলার পর হঠাৎ একদিন মায়া আপু উধাও হয়ে গেল। কাউকে কিছু বলেনি। এবং কেউ কোথাও যেতেও দেখেনি তাকে। পুরো গ্রাম তচনচ করে খোঁজা হলো তাকে। পুলিশের সাহায্য নিয়ে ঢাকাতেও খোঁজ হলো। কিন্তু কোথাও পেলাম না। এভাবেই পেরিয়ে গেল চারটা বছর। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। সে বেঁচে আছে কি না মরে গেছে, তাও জানি না আমরা।

নিশুর বুক থরথর করে কাঁপছে অজানা এক ভয় কিংবা শঙ্কায়। কী করবে ও? কোথায় খুঁজবে বোনকে? এতবড় একটা দেশে কীভাবে খুঁজে বের করবে বোনকে? গ্রামে না থাকলে কী ঢাকায়? কিন্তু ঢাকায় কোথায়? আগের বাড়ি থেকেই তো নিশু এলো এখানে। এই চার বছরের মধ্যে একবারও ওখানে যায়নি মায়া। গেলে নিশ্চয়ই বাড়িওয়ালা বলতো ওকে। তাহলে চার বছর ধরে কোথায় থেকে গেল মায়া? আধো কী বেঁচে আছে?

নিশু এইসব ভাবছিল, আর বড় বড় করে ঢোক গিলছিল। শরীরে যতটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল, সেটুকুও শেষ হয়ে গেল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও।

- মিস্টার মাহবুব, মেয়েটাকে মানসিক চিকিৎসা করান। এভাবে আর কতদিন নরমাল ঔষধ-এ পাড় করে দিবেন।

করুণ দৃষ্টিতে সিনিয়র ডাক্তারের দিকে তাকালো মাহবুব। সিনিয়র ডাক্তার বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না আমি। এই ধরণের রোগিকে শুধুমাত্র নরমাল মেডিসিন দিয়ে সুস্থ করা যাবে না।’

সিনিয়র ডাক্তারের কথার প্রতি উত্তরে মাহবুব বলল, ‘কিন্তু স্যার, ও তো পাগল নয়। হয়তো শুরুতে পাগলামি করতো৷ কিন্তু এখন তো আর সারাক্ষণ পাগলামি করে না। শুধুমাত্র রাতে চিৎকার করে। আর উল্টো পাল্টা কথা বলে।’

- আগে যেইসব বলতো, এখনো কী সেগুলোই বলে চিৎকার করে নাকি অন্য কিছু বলে এখন?

আগেও যা বলে চেঁচামেচি করত। এখনো তা বলেই চেঁচামেচি করে। আমি জানি না কে ওর বাবা। আর কে ওর ভাই নিশু। সারারাত না ঘুমিয়ে শুধু বলে, ‘আমি কলঙ্কিনী মেয়ে। আমি আমার বাবাকে মেরে ফেলেছি। আমার ভাইয়ের জীবনটা শেষ করে দিয়েছি আমি। ওর এই কথাগুলোর কোনো মানেই খুঁজে পাই না আমি।’

- আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম মেয়েটার পরিবারের লোকদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। আপনার তো টাকা-পয়সার অভাব নেই। টিভি-পত্রিকায় নিউজ দিয়ে দিন। কোনো এক প্রান্ত থেকে মেয়েটির পরিবার সাড়া দিবে নিশ্চয়ই। দেখতে মাশাল্লাহ ভালো। জামা-কাপড় আর চলাফেরা দেখে বুঝার উপায় নেই যে, ও মানসিক ভারসাম্যহীন। হয়তো কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়েও।

- আমার কাছে টিভি-পত্রিকায় নিউজ দেওয়া কোনো সমস্যা না স্যার। লক্ষ্য লক্ষ্য টাকা খরচ করছি মেয়েটার পিছনে। আর সামান্য নিউজ এর টাকা দিতে পারব না আমি। আসলে মেয়েটার সাথে মিশে গেছি আমি। মেয়েটার ওই মায়াবী মুখটা না দেখে থাকতে পারব না আমি। নামটা-ও অদ্ভুতভাবে ওর সাথে মিলে গেছে। মায়াবতী চেহারার এক তরুণীর নাম মায়া। ও না বললেও আমি বুঝতে পারি যে, ওর অতীত খুবই কষ্টের। আমি চাই না সেখানে ও আবার ফিরে যাক। আমি শুধু চাই ও সুস্থ এবং স্বাভাবিক হয়ে জীবনযাপন করুক। এরপর আমি ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিবো। ওর আমাকে পছন্দ হয়ে গেলে আমরা বিয়ে করে নতুনভাবে জীবন শুরু করব।

সিনিয়র ডাক্তার মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘এটা খুবই স্বাভাবিক মিস্টার মাহবুব। আমি জানি আপনি মেয়েটাকে ভালোবাসেন। কিন্তু মানুষের জীবন একটাই। আর এই এক জীবনে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ওর জন্য হয়তো কেউ অপেক্ষা করে আছে। হয়তো কেউ কষ্ট পাচ্ছে ওকে না পেয়ে। এই চার বছরে অনেক বুঝিয়েছি আপনাকে। কিন্তু আপনি শুনেননি আমার কথা। একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। আপনি শুধু শুধু ওকে আটকে রেখেছেন। আপনি একজন ডাক্তার হয়ে একজন রোগীর সাথে অন্যায় করছেন।’

- ওকে নিজের করে রাখার জন্য আমি এই অন্যায় বারবার করতে রাজি আছি স্যার। আপনি তো অনেক বছর ধরে আমাকে চিনেন। আপনি তো জানেন আমার খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমি শুধু মায়াকে ভালোবাসি। আর সেজন্যই ওকে হারাতে চাচ্ছি না আমি।

- আমি জানি আপনার খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু আপনি ওকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছেন। আপনার এতবড় বাড়িতে শুধু আপনি আর মেয়েটা থাকেন। সমাজের লোকজন জানতে পারলে আপনার সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি দেশ- বিদেশের নামকরা একজন ডাক্তার।

মাহবুব চেয়ার থেকে ওঠে বসল। এরপর সিনিয়র ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই মাহবুব কখনোই সমাজের তোয়াক্কা করেনি। আজও করবে না। আমি একাই বড় হয়েছি। একাই নিজের পেট চালিয়েছি৷ নিজেই রোজগার করে পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছি। ছোট থেকেই আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে এসেছি যে, স্রষ্টা ব্যতীত অন্য কারোর অস্তিত্ব আমার জীবনে নেই। আমার জীবনে একমাত্র স্রষ্টা'ই আছেন। যিনি আমাকে জানেন, বুঝেন। তার দয়ায় খুব অল্প বয়সেই জীবনে সফলতা নিয়ে এসেছি আমি। আজ দেশ-বিদেশের নামকরা একজন আমি। স্রষ্টার প্রতি আমার বিশ্বাস থেকেই এইসব হয়েছে। মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার খরচ কেমন, তা আপনি নিশ্চয়ই জানেন। অদ্ভুতভাবে আমি নিজেই সেই খরচ চালিয়েছিলাম। কিন্তু এখন এই পৃথিবীতে আমার জীবনে আরেকজনের অস্তিত্ব এসেছে। সেটাও স্রষ্টার ইচ্ছেতেই। সুতরাং কারোর সমালোচনায় মাহবুব কাবু হয়ে থাকবে না।’

সিনিয়র ডাক্তার মাথা নিচু করে ফেললেন। কারণ মাহবুব যা বলছে, সবই সত্যিই। তার শিক্ষাকতা জীবনে মাহবুব এর মতো স্টুডেন্ট আর দেখননি তিনি। তিনি নিজে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মাহবুব এর জেদের কাছে পুরো পৃথিবী হার মানতে বাধ্য। ওর জেদ সাংঘাতিক রকমের দৃঢ়।

মাহবুব চলে এলো সেখান থেকে। বিকেল হয়ে এসেছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে ওকে। আজও রাস্তার মোড়ে গাড়ি থামিয়ে বসে আছে ও। কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পেড়িয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাহবুব বলল, ‘মনে হয় আজ আর আসবে না ওরা। এবার বাড়িতে যেতে হবে তাড়াতাড়ি।’

মাহবুব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে এলো বাড়িতে। দু'তলা একটা বাড়ি। প্রথমেই মায়ার ঘরে গেল ও। মায়া তখন বই পড়ছিল। কবিতার বই। মাহবুবকে দেখেই বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালও। মাহবুব মায়ার হাতে আরো দু'টো বই দিয়ে বলল, ‘এই নিন আপনার বই। আজকেই কিনে আনলাম।’

মায়া মুগ্ধতার দৃষ্টিতে বই দু'টোর দিকে তাকিয়ে আছে। মাহবুব কিছু বলার আগেই ওর হাত থেকে বই দু’টো নিয়ে নিলো মায়া। বই দু'টোয় চুমু দিয়ে বুকের সাথে আকড়ে ধরে আবারও বিছানায় বসে পড়ল। মাহবুব করুণ কণ্ঠে বলল, ‘একটা ধন্যবাদ-ও দিলেন না।’

মায়া হেসে দিয়ে বলল, ‘আমার স্টকে আর ধন্যবাদ জমা নেই। যা ছিল, সবই আপনাকে দিয়ে দিয়েছি। তাই এখন থেকে যাই করেন না কেন? আমার মুখ দিয়ে ধন্যবাদ শব্দটা বের হবে না আর।’

শব্দ করে হেসে উঠল মাহবুব। মায়া সেদিকে আর না তাকিয়ে নতুন বই দু'টোর মধ্যে থেকে একটা খুলে পড়তে শুরু করল। মাহবুব বলল, ‘আচ্ছা আপনার কী ইচ্ছে করে নিজের পরিবারে ফিরে যেতে?’

মায়া ধুপ করে বইটা বন্ধ করে অগ্নি দৃষ্টিতে মাহবুব এর দিকে তাকালো। মাহবুব কিছু বুঝে ওঠার আগেই মায়া ওর শার্টের কলার চেপে ধরে কটমট করতে করতে বলল, ‘আপনাকে না বলেছি এই পরিবার নিয়ে কোনো কথা বলবেন না আমাকে। বারবার একই ভুল কেন করেন আপনি? আপনার বাড়িতে থাকতে না দিলে বলেন আমাকে। আমি চলে যাবো। তবুও পরিবার নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না আমাকে।’

মাহবুব ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।’

মায়া আরো শক্ত করে মাহবুব এর শার্টের কলার চেপে ধরল। এরপর চেঁচিয়ে বলল, ‘আর একটা কথা বললে আপনাকে খুন করে ফেলব আমি।’

মায়া অনেকটা জোরেই বলল কথাটা। মাহবুব মায়াকে শান্ত করার জন্য জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে চেপে ধরল । এরপর বিছানার কাছে নিয়ে মায়াকে বসিয়ে দিলো। মায়া রাগে ফুঁসছে। চোখ দু'টো মুহূর্তের মধ্যেই লাল টকটকে হয়ে গেছে ওর। মায়াকে বিছানায় শুইয়ে দিলো ও মাহবুব। মায়া তখনও মাহবুব এর শার্টের কলার চেপে ধরেছিল। মাহবুব ফিসফিস করে বলল, ‘এত চেঁচাচ্ছেন কেন? বাইরে থেকে কেউ শুনতে পেলে কী হবে ভেবে দেখেছেন?’

মায়া মাহবুব এর শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘এই ঘর থেকে যে কোনো কথা বাইরে যায় না, তা আমি খুব ভালো করেই জানি মিস্টার মাহবুব। এখন আমার হাতটা ছাড়ুন। হাতে খুব জ্বালা করছে।’

মাহবুব মায়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে হাতে?’

- জানি না। সকালে ঘুম থেকে ওঠেই দেখি হাত খুব ব্যথা করছে। আর দাগ হয়ে রয়েছে।

মাহবুব একবার মায়ার হাতের দিকে তাকালো। এরপর অপরাধ বোধ থেকেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথাটা নিচু করে ফেলল।

(চলবে...)

‘মায়াবতী’-এর ৭ম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মায়াবতী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড