• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘জল জোছনায় বৃষ্টি’-এর তৃতয়ী পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : জল জোছনায় বৃষ্টি

  এম. ফজলে রাব্বী

০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৮:০৪
কবিতা
ছবি : প্রতীকী

গত কয়েকদিন বেশ জ্বর গেল নাসির আলীর। জ্বরে ভুগে সে একেবারে কাহিল হয়ে গেল। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে অনেক। শরীরে আর আগের মত জোর পাচ্ছে না। পিপাসা লাগে ঘন ঘন। ময়লা তেল চিটচিটে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে সে আকবর আলীর দোকানে বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে তার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। ঘুম ঘুম ভাব তার শরীরে দোলুনি দেয়। দোলুনি খেয়ে সে ঢলে পড়তে চায়। তৎক্ষণাত আবার টের পেয়ে শরীরটাকে স্থির করে ফেলে। ছোট্ট শিশুকে উপর থেকে ফেলে দিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই ধরে ফেলার যে একটা খেলা খেলে বড়রা- বিষয়টা ঠিক সেরকম। এই খেলাটিতে শিশুরা প্রচুর আনন্দ পায়। তবে নাসির আলীর এই ঢলে পড়ার খেলায় পুরো মজাটাই নেয় আকবর আলী। ঠাট্টার ছলে নাসির আলীকে খোঁচা দিয়ে সে বলে ওঠে, ‘কিরে নসের, সারা রাইত কি চুরি করছস নাকি? পুরান গালফ্রেন্ডে ডাকে নাকি মাঝে মইধ্যে।’ আকবর আলীর ঠাট্টা শুনে দোকানের সব ছেলে বুড়োরা হো হো করে হেসে ওঠে। তাদের হাসার যথেষ্ঠ কারণ আছে।

নাসির আলীর চুরিবিদ্যার সুখ্যাতি সবার জানা। বেশ আগে ছ্যাচরা চুরির স্বভাব ছিল। এর ওর বাড়ির লাইট, হাতঘড়ি, মানিব্যাগ সুযোগ পেলেই গায়েব করে দিত সে। পাড়ার মহিলারা ছেলেপেলেদের নাসিরের থেকে দূরে থাকতে বলতেন। কখন কোন ছুতোয় বাড়ি এসে কোন দরকারি জিনিস চুরি করে নিয়ে যায় সেই ভয়ে তারা সব সময় জাবর কাটত। তবে এইসব তার পুরোনো ইতিহাস। বর্তমানে সে কটকটিওয়ালা। গ্রামেগঞ্জে সে ভাঙড়ি, পুরোনো জিনিসের বিনিময়ে বাদাম, কটকটি বেঁচে বেড়ায়। শুটকিও সে বিক্রি করে তবে তা শুধুমাত্র নগদ টাকায়। বেশ কষ্টের কাজই বটে। এ কারণে এতদিন পরে এসে পুরোনো পেশা নিয়ে খোঁটা দিলে তার বড় লাগে। খুব অপমানবোধ হয়। অপমানের চেয়ে অসহ্যকর বস্তু হয়ত দ্বিতীয়টি নেই। ক্ষমতাবান লোকেরা সামনাসামনিই এর জবাব দেয়। শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা দেয় চুপিচুপি, অলক্ষ্যে, নিজের গা বাঁচিয়ে অন্য কাউকে ব্যবহার করে।

দিতে পারে না শুধু নাসিরের মত ছ্যাচরা চোরেরা। কাজেই আকবর আলীর কথায় আপমানবোধ হলেও বিষয়টাকে গায়ে না লাগানোর ভাব করে সে বলে, ‘না রে আকবর ভাই, জ্বর কয়দিন থিকা। খাওয়া পারি না কিছু। মুখ তিত্তা অইয়া আছে। শরীরডায় বল পাই না। খালি ঘুম ধরে।’ নাসিরের কথা শুনে নরম হয় আকবর আলী। মনটা একেবারে গলে যায় তার। দরদের সুরে সে বলে, ‘আহারে, কবে থিকা আইলো জ্বর? বড়িতড়ি খাইস না বড়? হোসেনের বউয়ের পড়া পানি খা কয়দিন। ঠিক আইয়া যাইব।’ এতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে দেওয়া যায় না। ক্লান্ত শরীরে উত্তর দেওয়ার চেষ্টাও করে না নাসির। কথা বলতে বিরক্তি লাগে, শুনতে আরও বেশি। নাসির উঠে দাঁড়ায়। আকবর আলী বলে,‘ যাস নাকি? বয়। এককাপ চা খাইয়া যা। জ্বরের শরীরে ভালো লাগবো।’

নাসিরের চা খেতে ইচ্ছে করে না জ্বর নিয়ে। সে বলে,‘না গো, ভাল্লাগে না কিছু।’ এবার আকবর আলী ঠাট্টার ছলে বলে,‘টাকা দেওয়া লাগবো না। খাইয়া যা।’ তার কথা শুনে দোকানের লোকজন মজা পায়। তারা আবার হো হো করে হেসে ওঠে। নাসির সেদিকে কান দেয় না। বাড়ি ফিরে এসে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।

আজ বাড়ি থেকে বের হয়নি নাসির। বাহির বাড়িতে বসে রোদ পোহাচ্ছে। পাশেই একটু দূরে রাতের কুয়াশায় ভেজা পাতা শুকানোর জন্য ছড়িয়ে দিচ্ছে রহিমের বউ। রহিমের বউ পাতা ছড়াচেছ আর সালেহা বানুর সাথে কথা বলছে। সালেহা বানু এক সময় বেশ তিরস্কার করে বললেন, ‘তোমার স্বভাব বড় ভালো না বউ। ঘরের কথা কেন পরের কাছে কইতে যাও কেন? ঘরের কতা পরের কাছে কইলে সেই ঘরের দাম থাকে? ঘরের জানালা দরজা খুইলা রাইখা ঘুমাইলে যেমন চোরে সুযোগ মত সব চুরি কইরা নিয়া যায় তেমনি ঘরের কতা পর মানুষরে কইলে সুযোগমত ঘরে আগুন দেয়। তহন কিছুই করার থাকে না।’ রহিমের বউ কোনো কথা বলে না এবার। সবটুকু কথা শুনে সে নিশ্চুপ হয়ে যায়। বলার মত কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সে।

এই সময়টাতে নিজেকে খুব অসহায় লাগে তার। কে বোঝে তাকে? রিক্সাওয়ালা স্বামী মাঝরাত অব্দি জুয়া খেলে যখন বাড়ি ফেরে তখন সে থাকে পুরোপুরি মানসিক রোগী। তাকে ভাত খেতে বললে গর্জে ওঠে, শুতে বললে কষে থাপ্পড় মারে, ভালোবাসার বায়না ধরলে অশ্রাব্য শব্দে গালিগালাজ করে। গালাগালির শব্দে প্রতিবেশীর ঘুম নষ্ট হলেই সালেহা বানুর মত সবাই দোষারোপ করে তাকে! কি অদ্ভূতএকটা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে সে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। বিশাল বিস্তৃত পৃথিবীর উন্মুক্ত বায়ু সমুদ্রে বসবাস করেও সে শ্বাস নেওয়ার মত একটু বাতাস সে খুঁজে পায় না।

সালেহা বানু চলে গিয়েছে অনেক আগেই তা খেয়ালই করেনি ফরিদা। একটা সুগভীর চিন্তার সাগরে ভেতরে ডুবে গেছে সে। সেখানে সাঁতরেই যাচ্ছে, সাঁতরেই যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে পাতা ছড়ানো ভুলে গেছে সে, বুকের কাপড় সরে গেছে বুকের উপর থেকে- সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই তার। দূর থেকে বাঁকা চোখে ফরিদার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাসির। খুব বাজেভাবে বললে, আসলে ফরিদার বুকের দিকেই তাকিয়ে আছে নাসির। যৌন চাহিদা মানুষকে বিকৃত রুচিবোধে উদ্বুদ্ধ করে। নাসিরের ক্ষেত্রেও বিষয়টা সেরকম। নারী সম্পর্কিত কোনো বাজে রেকর্ড তার নেই, তবে ঐ যে একটা কথা আছে ‘বয়স তো আর কম হলো না, আর কত?’ সে কারণেই অনেক পুরুষই সময় সুযোগ পেলেই স্বাতন্ত্র হারিয়ে ফেলে। কার বউ, কার বোন সেসব জ্ঞান থাকে না।

এরমধ্যে সালেহা বানু চলে আসে। ছেলের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে সে ফরিদাকে বলে, ‘দ্যাখোছে বউ ভালো মাইয়া পাও নাকি? পুলা বিয়া দেওন লাগবো এইবার।’ সালেহা বানু কিছু পাতা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ফরিদাকে এবার কাছে ডাকলো নাসির। ‘ও পাতাকুড়ানি ভাবি, এইহানে আহো ইট্টু। কতা আছে তুমার সাথে।’ ফরিদাকে রসিকতা করে পাতাকুড়ানি ভাবি ডাকে নাসির। পাড়ায় যত গাছের পাতা আছে একাই কুড়িয়ে এনে জড়ো করে সে। অন্য কেউ কুড়াতে এলে রীতিমত ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। সেগুলো বাড়িতে এনে শুকিয়ে রান্নার কাজে ব্যবহার করে। নাসিরের ডাক শুনে এগিয়ে আসে ফরিদা। ‘কি কইবা কও মিয়া, মেলা কাম পইড়া আছে।’ দাঁড়িয়ে থেকেই প্রশ্ন করলো সে। ‘আরে বহো না, কাম তো সারাজীবনই করবা। কামের কি শ্যাষ আছে? মরার আগেও দেখবা মনে হইবো, আরে ঔই কামডা তো বাকি আছে! তাই না?’ বলে ঔৎসুক দৃষ্টিতে ফরিদার দিকে তাকালো নাসির। ফরিদা উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দিলো, ‘তা তো ঠিক ভাই। তয় কাম কইরা মরলেও তো ভাতাড়ের মাইর থিকা বাঁচন যায় না।’

তার চোখজোড়া শূণ্য আকাশের আকাশের মাঝে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন। সেই সাথে তার ফর্সা মুখ থেকে যেন বেড়িয়ে এলো কালো দীর্ঘশ্বাস। নাসিরের বড় মায়া হলো। কিন্তু কি বলে সমবেদনা জানাবে তা ভেবে উঠতে পারলো না। নিজের পাছার নিচ থেকে একটা বিচুলির আঁটি বের করে এগিয়ে দিতে দিতে সে বলল, ‘বহো, কপালে আল্লাহ যা রাখছে তাই তো অইবো। তার বেশি কিছু তো অইবো না, তাই না?’ ‘হ তাইতো। বান্দির কপাল!’ বলে নিজের প্রতিই অবজ্ঞা ছুড়ে মারলো ফরিদা। নাসির কিছু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু সুযোগ পেল না। ফরিদা অন্য প্রসঙ্গ তুললো। ‘চাচি তো পাত্রি দেখবার কইলো। তা কেমন মাইয়া নিবা তুমি? বাড়ির কাছাকাছি করবা না দূরে?’ হাসিমুখে প্রশ্ন করলো সে। নাসির একটু ভেবেচিন্তে বললো, ‘দূরে দ্যাখো ভাবি। কাছে শ্বশুরবাড়ি অইলে মজা নাই। জামাইজুড়ারে সমাদর করে না।’ ‘হ, তা ঠিক।’ বলে নাসিরের কথাকে সমর্থন দেয় ফরিদা। ফরিদা তার মনের কথাটি বলার সুযোগ খুঁজছিলো। সে একটা অপশন পেয়ে গেছে। এখন তার কথাটি বলা যায়। নাসিরকে খুব খাতির করে দরদের স্বরে এবার সে তার মনের কথাটি বলার জন্য মনস্হির করে ফেললো। তারপর ধীরে ধীরে গলা নামিয়ে নিয়ে সে বললো,‘ জুলেখারে তুমার কেমন লাগে? ঘরের কাজকাম সব এক হাতে করে। আবার স্কুলেও যায়। পড়াশোনারও তো দরকার আছে, নাকি কও? কুনুদিক দিয়া কুনু ভুল ধরতে পারবা না। চেহারা সুরতও মাশাল্লাহ খারাপ না। কি কও?’ ফরিদার কথা শুনে নাসির বেশ বিরক্তই হলো কিন্তু বাইরে সেই ভাবটা প্রকাশ করলো না। কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। মুখে একটা শুকনো হাসি এনে বললো,‘ মা রে কও। দ্যাখো সে কি কয়?’ নাসিরের মুখভঙ্গি দেখে ফরিদার সবকিছু বুঝে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে হাল ছাড়লো না। ‘তুমার পছন্দ আছে তো? তুমার পছন্দ থাকলে কও। চাচির লগে তো কতা কমুই।’ ‘আর আমার পছন্দ অপন্দ!’ বলে নিজের প্রতি একটা তাচ্ছিল্যেও ভাব দেখালো সে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ফরিদাকে বিদায় না দিয়ে দোকানের পথে পা বাড়ালো। হালিমা কিছুক্ষণ নাসিরের চলে যাওয়া পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের রান্নাঘরের দিকে ছুটলো।

দোকানের পথে হাঁটতে হাঁটতে নাসির মনে মনে ফরিদাকে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। জুলেখার নাম শুনে সে বেশ হতাশ হয়ে গিয়েছিল। কালো মোটা মেয়ে। চুল কোকড়ানো, পুরুষালি ভাব। মুখটা তার সুন্দর, গোলগাল মায়া জড়ানো, তবে অনেক ছেলের সাথে মেলামেশা আছে বলে সে শুনেছে। স্বয়ং ফরিদার স্বামী রহিম তাকে এ কথা বলেছে। কাজেই এত কিছু জানার পরে ঐ মেয়েকে বিয়ে করে ঘরের বউ করে আনা চলে না। আর তাছাড়া সে খুব শিঘ্রই প্রচুর টাকার মালিক হচ্ছে। সঠিকভাবে বললে লাখপতি সে হয়েই গেছে। শুধু বাইরে প্রকাশ করছে না। হুট করে প্রকাশ করতে গেলে অনেকে অনেক কিছু বলবে, যারা না বলবে তারা গভীর সন্দেহের চোখে তাকাবে। পুলিশি তদন্তও হতে পারে। সে কারণেই সে কিছুটা চুপ মেরে আছে। সময় সুযোগ বুঝে নিজের গরিবী লেবাসটা খুলে ফেলে দেবে। সে কেন বিয়ে করতে যাবে জুলেখার মত কালো মোটা, দাঁত উঁচু একটা মেয়েকে?

(চলবে..) আরো পড়ুন ‘জল জোছনায় বৃষ্টি’-এর দ্বিতীয় পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : জল জোছনায় বৃষ্টি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড