• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর ৯ম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি

  রিফাত হোসেন

০৪ আগস্ট ২০১৯, ১৩:১০
উপন্যাস
ছবি : প্রতীকী

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। শুভর দু’চোখে ঘুম। সারাদিনে বিশ্রাম নেওয়ার সময় পায়নি ও। তাই এখন না ঘুমালে খুব বড় সমস্যায় পড়ে যাবে। তাই নীরবতা ভেঙে বলল, ‘তোরা যা ইচ্ছে কর৷ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি কেবিনে যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।’

কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না শুভ। হনহনিয়ে কেবিনের দিকে হাঁটতে লাগল। আদিত্য শুভর পিছনে পিছনে যেতে লাগল৷ জ্যোতি আড়চোখে ইরার দিকে তাকাল একবার। ইরার দুই ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি। এই হাসির অর্থ বুঝতে পারল না জ্যোতি। মন খারাপ করে উল্টো দিকে ঘুরে রইল জ্যোতি। ইরা জ্যোতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আহারে! কী কষ্ট।’

জ্যোতি কিছু বলল না। একবার ইরার দিকে তাকিয়েই কেবিনের দিকে হাঁটতে লাগল। ইরা-ও আর দাঁড়িয়ে না থেকে কেবিনের দিকে গেল। কেবিনে গিয়ে বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্যোতি ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘরে বসে সিগারেট খাচ্ছে আয়ান। হঠাৎ করে ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ইরার নাম। মুচকি হাসি দিয়ে ফোনটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে ইরা বলল, ‘কেমন আছো আয়ান?’

- এতক্ষণ ভালো না থাকলেও এখন বেশ ভালো আছি।

ইরা মৃদু হাসি দিলো। আয়ান আবার বলল, ‘কোথায় আছো এখন?’

- কেবিন থেকে বের হয়ে তোমার সাথে কথা বলছি।

- কে কে আছে তোমার সাথে?

ইরা একটু ইতস্ততবোধ করল। মনে মনে ভাবতে লাগল আদিত্যর কথাটা ওকে বলবে কিনা৷ আদিত্য যে ওদের সাথে যাচ্ছে, সেটা কী আয়ানকে বলার উচিত? নাকি ওকে বললে কোনো ঝামেলা করবে আবার।

কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে ইরা ঠিক করল আয়ানকে আদিত্যর কথাটা বলে দিবে। এখন বললে হয়তো আয়ানকে শান্ত করা যাবে। কিন্তু এখন না বলে কথাটা গোপন রাখলে, আর পরে যদি ও কোনোভাবে জানতে পারে তাহলে ভয়ংকর কিছু একটা হয়ে যাবে। তাই যা হওয়ার এখন হওয়াই ভালো। আর কিছু না ভেবে ইরা ডিরেক্ট আয়ানকে বলল, ‘আমাদের সাথে আদিত্যও আছে।’

আয়ানের চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। রাগে কটমট করতে করতে বলল, ‘আদিত্য তোমাদের সাথে আছে মানে? আদিত্য ওখানে কী করছে? তাছাড়া তুমি তো বলেছিল আদিত্যর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না। তাহলে এখন আদিত্য তোমার সাথে কী করে?’

আয়ানকে সবটা বলল ইরা৷ সবটা শুনে কিছুটা শান্ত হলেও আদিত্যর উপর থেকে রাগ একটুও কমেনি। এভাবেই কথা বলছিল ওরা।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল জ্যোতির। চোখ কচলাতে কচলাতে পাশে তাকাল। পাশে ইরাকে না দেখে ভ্রু-কুঁচকে ফোন স্ক্রিনের দিকে তাকাল। অনেকটাই রাত হয়েছে তা বুঝতে পারছে জ্যোতি। কেবিন থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল৷ কিন্তু কোত্থাও ইরাকে দেখতে পেলো না। একরাশ হতাশা নিয়ে নিজের কেবিনে ফিরে গেল। বিছানায় চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ করেই মনে পড়ল জ্যোৎস্নাময় রাতের কথা। কেবিনের দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিয়ে জ্যোতি আদিত্যর কেবিনের কাছে গেল। দরজায় টোকা দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আদিত্য দরজা খুলে দিলো। জ্যোতি ভিতরের দিকে তাকিয়ে দেখল শুভ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। অথচ আদিত্যর চোখমুখ বেশ স্বাভাবিক। ওকে দেখে মনে হচ্ছে না ও এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল। ওর চোখেমুখে ঘুমের আবেশ নেই একটুও।

জ্যোতিকে চুপ থাকতে দেখে আদিত্য বলল, ‘এত রাতে আপনি এখানে কী করছেন? কোন সমস্যা হয়েছে কি?’

- না। আপনি ঘুমাননি এখনো?

- না। কেন?

- একটু বাইরে আসবেন প্লিজ?

অবাক কণ্ঠে আদিত্য বলল, ‘কেন?’

জ্যোতি বলল, ‘একটু ছাদে যাবো।’

মস্তিষ্কে একটা ধাক্কা খেলো আদিত্য। মনে মনে ভাবতে লাগল, এই মেয়ের সাথে কোথাও যাওয়া মানে বোকামি। কখন কি করে বসে ও নিজেও জানে না। জ্ঞান থাকতে এইরকম বোকামি করার কোনো প্রশ্নই আসে না।

অতঃপর আদিত্য ডিরেক্ট বলল, ‘এত রাতে ছাদে যেতে পারব না আমি। আপনি নিজের কেবিনে যান।’

জ্যোতি নাছোড়বান্দা। সে ঠিক করেই এসেছে, যেভাবেই হোক এখন ছাদে যাবেই। তাই আর কোনো উপায় না পেয়ে ও আদিত্যকে অনুরোধের স্বরে বলল, ‘প্লিজ প্লিজ, না করবেন না। একবার চলুন।’

আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ঠিক আছে চলুন। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়।’

জ্যোতির ঠোঁটের কোণে হাসি ফিরে এলো। আদিত্য কেবিন থেকে বের হয়ে দরজাটা লক করে দিয়ে জ্যোতির সাথে ছাদে যেতে লাগল।

ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে জ্যোতি আর আদিত্য। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। জ্যোতি নীরবে আকাশের দিকে মুখ করে আছে। চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। শরীরে এক অদ্ভুত শীতল হাওয়া অনুভব করছে। চোখ দু'টো বন্ধ করে মনোরম পরিবেশ উপভোগ করছে জ্যোতি। হঠাৎ আদিত্যর চোখ পড়ল উল্টো দিকের রেলিঙে। একটা মেয়েটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। একবার দেখাতেই ও চিনে ফেলেছে মেয়েটা আর অন্য কেউ নয়, ও ইরা। আদিত্য বেশ বুঝতে পারছে ইরা আয়ানের সাথেই ফোনে কথা বলছে। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে আদিত্যর। এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না, তাই জ্যোতিকে বলল, ‘নিচে যাই চলো।’

জ্যোতি কোনো উত্তর দিলো না। সে নিশ্চুপ হয়ে চোখ বন্ধ করে প্রকৃতিকে উপভোগ করছে৷ আদিত্য আরো কয়েকবার ডাক দিলো জ্যোতিকে। তবুও জ্যোতির কোনো সাড়া নেই। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে জ্যোতির একটা হাত ধরে বলল, ‘জ্যোতি।’

চমকে উঠল জ্যোতি। বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো করে ওর শরীর কেঁপে উঠল। শরীরে প্রতিটি অঙ্গ হঠাৎ করে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদিত্যর দিকে। আদিত্য ব্যপারটি বুঝতে পেরে জ্যোতির হাত ছেড়ে দিলো। জ্যোতি তখনও আদিত্যর দিকে তাকিয়ে ছিল। আদিত্য বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’

একটা ঘোরের মধ্যে থেকে জ্যোতি বলল, ‘হাতটা আবার ধরুন না প্লিজ।’

অবাক কণ্ঠে আদিত্য বলল, ‘মানে?’

- আপনার হাতের স্পর্শ পেয়ে আমার শরীরে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে৷ বুকটা কেমন ধুকপুক করে। খুব ইচ্ছে করছে আবার আপনার স্পর্শ পেতে।

আদিত্য কিছুটা রাগী কণ্ঠে বলল, ‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি?’

জ্যোতি আবার চমকে উঠল। আশেপাশে একবার তাকিয়ে আবার আদিত্যর দিকে তাকাল। দু'জনের চোখাচোখি হতেই জ্যোতি চোখ নামিয়ে নিলো। আদিত্য স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর বলল, ‘পিছনে তাকিয়ে দেখুন ইরা দাঁড়িয়ে আছে।’

জ্যোতি পিছনের দিকে তাকাল। ইরাও ততক্ষণে ওদের দেখে ফেলেছে। ইরা ফোনটা কেটে দিয়ে ওদের কাছে আসতে লাগল৷ জ্যোতি হঠাৎ করে আদিত্যর হাতটা শক্ত করে ধরল। বিস্মিত দৃষ্টিতে আদিত্য জ্যোতির দিকে তাকিয়ে রইল। ইরা যতই সামনে এগোচ্ছে, জ্যোতি ঠিক ততই আদিত্যর আরো কাছাকাছি যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় এক হাসি জ্যোতির। একসময় আদিত্যর খুব কাছাকাছি চলে আসে জ্যোতি। দু’জনের মাঝে আর খুব বেশি জায়গা থাকে না তখন। আদিত্যর বুকের সাথে মিশে গেছে জ্যোতি। আদিত্য কিছু না বলে শুধু দেখে যাচ্ছে। ইরা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। চোখেমুখে মারাত্মক রকমের রাগ। নিজেকে সামলানো খুব কষ্টের হয়ে যাচ্ছে। রাগে কটমট করতে করতে বলল, ‘তোরা এখানে কী করছিস? আর দু'জনে এভাবে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আশেপাশের মানুষজন কী ভাববে?’

আদিত্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জ্যোতি বলল, ‘আশেপাশের মানুষজন এটাই ভাববে যে আমরা প্রেম করছি।’

ইরার চোখদুটো আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। ও বলল, ‘প্রেম করছিস মানে?’

জ্যোতি মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘দু’জন যুবক-যুবতী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের মানুষজন খুব সহজেই বুঝতে পারবে এরা প্রেম করছে। এই সজহ কথাটা শুধু তুই বুঝতে পারছিস না। এখন আমাদের বিরক্ত না করে এখান থেকে যা তুই। আমাদের আরো কিছুক্ষণ প্রেম করতে দে।’

- তাই বলে এভাবে সবার সামনে এইসব করবি তোরা?

- আরে, আশেপাশের মানুষজন বলতে তো মাত্র এই ক'জন। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ ঘুমাচ্ছে, আর কেউ কেউ ফোনে কথা বলছে। তুই ছাড়া আমাদের প্রেমে ব্যাঘাত ঘটানোর মতো সময় আর কারোর নেই।

জ্যোতির কথা শুনে ইরা হতভম্ব হয়ে গেল। সাথে আদিত্য নিজেও। ইরার বলতে ইচ্ছে করছে - আরে ও তো আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল। তাহলে তুই ওর সাথে প্রেম করছিস কেন? আর ওকে জড়িয়ে ধরেছিস কোন সাহসে?

কথাটা বলতে চেয়েও বলতে পারল না। করুণ দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে ইরা বলল, ‘তুমি কি কিছু বলবে না আদিত্য?’

আদিত্য মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি আর কী বলব?’

কথাটা এবার বলেই ফেলল ইরা, ‘কিন্তু তুমি তো আমার বয়ফ্রেন্ড ছিলে?’

আদিত্যর নিজের ডান হাতটাকে সামলে নিলো। যেকোনো সময় হাতটা ইরার গালে আঘাত করে ফেলতে পারে। ওর কথা শুনে শরীর জ্বলে যাচ্ছে আদিত্যর। হাতটাকে ইরার থেকে বেশ কিছুটা দূরে রাখল। বা হাতটা জ্যোতির হাতের মুঠোয়। তাই ডান হাতটা জ্যোতির কোমড়ে রাখল। হাত দিয়ে জ্যোতিকে আরো কাছে টেনে নিলো আদিত্য। জ্যোতি আর আদিত্য মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরার চোখের কোণে পানি এসে গেল। তবে এটা কাছের মানুষকে হারানোর পানি নয়, এই পানি রাগের। এই পানি নিজের কন্ট্রোলে থাকা অস্থিরতা নামক এক যন্ত্রণা হারানোর বেদনা নয়, সেই যন্ত্রণা হঠাৎ করে অন্যের কন্ট্রোলে চলে যাওয়ার বেদনা এটা। তবে এটা বেদনা হয়, এটা ক্রোধ। আদিত্য বলল, ‘যে কথাটা বললে তা আরেকবার ভেবে দেখ, উত্তরটা নিজেই পেয়ে যাবে।’

কথাটা বলে আদিত্যর দৃষ্টি জ্যোতির দিকে ঘুরে গেল। জ্যোতি তখনও আদিত্যর বাহুডোরে আবদ্ধ। ওর হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আগে কখনোই অপরিচিত কারোর এতটা কাছাকাছি যায়নি ও। ওর ইচ্ছে করছে আদিত্যর বুকে মাথা রাখতে। তাই আদিত্যকে চেপে ধরল জ্যোতি। ওর বুকে মাথা রেখে চোখ দু'টো বন্ধ করল। আদিত্যর বুকের ভিতর থেকে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। এক মনে সেই শব্দ শুনছে জ্যোতি। শব্দটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ নিজের গোলাপি রঙের ঠোঁট দু'টো আদিত্যর বুকে স্পর্শ করল। সাথে সাথে আদিত্য কেঁপে উঠল। জ্যোতি আরো কয়েকগুণ শক্তি দিয়ে আদিত্যকে চেপে ধরল। ওদের কাণ্ড দেখে ইরা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। ওর ইচ্ছে করছে ধাক্কা মেরে দু'জনকেই নদীতে ফেলে দিতে। কিন্তু তা করল না। আদিত্য আড়চোখে ইরার দিকে তাকাল। আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়াল না ইরা। হনহনিয়ে কেবিনের দিকে যেতে শুরু করল। আদিত্য ছেড়ে দিলো জ্যোতিকে। কিন্তু জ্যোতি ওকে ছাড়ছে না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। খুব হাসি পেলো আদিত্যর। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে জ্যোতিকে ডাকল। জ্যোতি সাড়া দিলো না। জ্যোতির হাত থেকে আদিত্য নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘উফফ, এত শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন কেন? আরেকটু হলে তো মরেই যেতাম। আর আপনি আমার বুকে চুমু দিলেন কেন?’

জ্যোতি শব্দ করে হাসল। আদিত্য বিস্ময় দৃষ্টিতে ওর হাসি দেখতে লাগল। মনে মনে বলল, কী অদ্ভুত হাসি। এক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করছে সারাজীবনের জন্য এই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু এটা কী সম্ভব? কি জানি! আল্লাহ চাইলে অবশ্যই তা সম্ভব। মেয়েটার বাচ্চামি স্বভাবটাই আমাকে প্রতিনিয়ত আকর্ষন করে। মুখটা সাংঘাতিক রকমের মায়াবী। একটা মেয়ে ঠিক কতটা অপূর্ব সুন্দরী হলে তার সবকিছুই একটা ছেলেকে আকর্ষন করতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে আমি এটা জানি, সত্যিই জ্যোতি অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে। যার সবকিছুই ভয়ঙ্কর অসাধারণ।

- এই যে মি:, কোথায় হারিয়ে গেলেন?

জ্যোতির কথায় বাস্তবে ফিরল আদিত্য। কল্পনার কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোণে একরাশ হাসি ফুটে উঠল। জ্যোতি আবার বলল, ‘কী হলো চুপ করে আছেন কেন?’

আদিত্য দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তার আগে বলুন আপনি আমার বুকে চুমু দিলেন কেন?’

- অপেক্ষা করুন৷ সময় হলে ঠোঁটেও চুমু পেয়ে যাবেন।

কথাটা বলে জ্যোতি আবার শব্দ করে হাসতে লাগল। আদিত্য উল্টো দিকে ঘুরে মুচকি হাসি দিলো। লজ্জা জিনিসটা যে শুধু মেয়েদের জন্য নয়, তা আর টের পাচ্ছে আদিত্য।

জ্যোতি কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে দিলো। আদিত্য বলল, ‘এবার নিচে যাই চলুন।’

- আরো কিছুক্ষণ থাকি প্লিজ।

- উঁহু। বেশি কথা বললে শুভ ভাইকে সব বলে দিবো।

জ্যোতি কোনো কথা না বলে কেবিনের দিকে যেতে শুরু করল। আদিত্য ওর পিছনে পিছনে যাচ্ছে। দু'জনেই নিজেদের কেবিকে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল জ্যোতি। আদিত্যও ঘুমিয়ে পড়ল। আজ অনেকদিন পর মনে শান্তি লাগছে আদিত্যর। তাই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরের দিকে লঞ্চ ওদের গন্তব্যের কাছাকাছি গেল। চোখেমুখে পানি দিয়ে শুভ জ্যোতি আর ইরার কেবিনে গেল। ওদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিলো। ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে দোকানে গেল। শুভ চারজনের জন্য কফি আর বিস্কুট দিতে বলে বেঞ্চে বসে পড়ল। একটু পরেই কফি দিয়ে গেল একজন। ইরা আর শুভ কফি আর বিস্কুট খেয়ে যাচ্ছে। জ্যোতি একটু একটু করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে, আর আড়চোখে আদিত্যর দিকে তাকাচ্ছে৷ আদিত্য তা বুঝতে পারলেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। লঞ্চ ঘাটে এসে গেছে প্রায়। শুভ বলল, ‘তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর৷ সবাই এবার নামতে শুরু করবে।’

একে একে সবাই খাওয়া শেষ করল। তারপর কেবিনে এসে নিজেদের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে লঞ্চ ত্যাগ করল। লঞ্চ থেকে নেমে গ্রামের মাটিতে পা রেখে জ্যোতি চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘উফফ! এতদিন পর নিজের গ্রামে এলাম। যা ভালো লাগছে বলে বোঝাতে পারব না তোদের। মনে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছি।’

জ্যোতির কথা সমর্থন করে শুভ বলল, ‘আমারও খুবই ভালো লাগছে।’

- তোর ভালোলাগাটা তো আর গ্রামে আসা নিয়ে নয়, তোর ভালোলাছে কারণ দু'দিন পর বিয়ে করবি৷ বাসর রাতে প্রাণ ভরে নিজের বউকে দেখতে পারবি। মোবাইলের দেখায় কী আর মন ভরে। এবার সামনা-সামনি দেখবি৷

জ্যোতির কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল আদিত্য আর ইরা। শুভ জ্যোতির কানে টান দিয়ে বলল, ‘এত পাকনামি করছিস কেন? বড় ভাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারিস না।’

জ্যোতি নিজের কানের কাছ থেকে শুভর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘মি: শুভ, তোমার সাহস তো কম না। আমার এলাকায় দাঁড়িয়ে আমাকেই মারছ তুমি। ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবো কিন্তু।’

ইরা আর আদিত্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। তবে শুভ একটুও অবাক হয়নি। জ্যোতির কথা শুনে ও হাসছে। আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি হাসছেন কেন ভাই? আর জ্যোতি এইসব কী বলছে? ওর মাথা তো দেখি পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে।’

শুভ হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে এটা তো ওর পুরোনো ডায়লগ। গ্রামে আসলেই শুরু হয়ে যায় ওর গুণ্ডিগিরী। যখন যাকে ইচ্ছে মারতে শুরু করে। একবার তো ও আর ওর কয়েকটা বান্ধুবী মিলে এক ছেলেকে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছিল। পেটানোর পর আবার ছেলেটার প্যান্ট খুলিয়ে ছেড়েছিল। এই গ্রামে তো ওকে কেউ কিছু বলতে পারে না। যে-ই উল্টো পাল্টা কিছু বলে, তার সাথেই শুরু করে দেয় ঝগড়া৷ তারপর ঝগড়াটা বেড়ে গেলে ও নিজের সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হাজির হয়ে যায়। মা-বাবাও ওকে কিছু বলতে পারে না গ্রামে।’

হা করে তাকিয়ে শুভর কথা শুনছিল ইরা আর আদিত্য। শুভর কথা শেষ হতেই জ্যোতির দিকে তাকাল ওরা। জ্যোতির দৃষ্টি অন্য দিকে। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে গ্রাম দেখছে। আদিত্য মনে মনে বলল, ‘এই মেয়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে৷ খুব সাবধানে থাকতে হবে গ্রামে যতদিন থাকব। ভেবেছিলাম প্যান্ট খোলানোর ব্যাপারটা মজা করে বলেছিল। কিন্তু শুভ ভাইয়ের কথা শুনে বেশ বুঝতে পারছি সত্যি সত্যিই এই মেয়ে খুব ডেঞ্জারাস।’

জ্যোতি নিজের পা থেকে জুতো জোড়া খুলে ফেলল। তারপর বলল, ‘চল এবার হাঁটা শুরু করি।’

জ্যোতির কথা শুনে ইরা বলল, ‘হাঁটবো মানে? আর কতদূর তোদের বাড়ি৷’

- এখান থেকে অনেকটা দূরেই।

ইরা শুভর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে রিকশা নাও দু'টো। এতটা পথ হাঁটবো কীভাবে?’

শুভ জ্যোতির দিকে আড়চোখে তাকাল। জ্যোতি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ইরার দিকে৷ ইরা কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?’

- এইরকম ঠাণ্ডা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটার সুযোগ জ্যোতি কখনো মিস করে না। তোদের হাঁটতে ইচ্ছে না করলে রিকশা নিয়ে সোজা চলে যা। যেখানে দেখবি বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, বুঝে নিবি সেটাই আমাদের বাড়ি।

কথাটা বলেই হাসতে লাগল জ্যোতি। ইরা শুভর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। শুভ বলল, ‘আমি কিছু বলতে পারব না বোন। এই গ্রামে আসলে ওর পাওয়ার বেড়ে যায়। ফলে ওর সব কথায় সমর্থন করতে হয়। তাছাড়া ও কখনোই এই লঞ্চ ঘাট থেকে রিকশা নিয়ে গ্রামে যায় না। আসলে অনেকদিন ধরেই মাটিতে পা রাখে না তো৷ ক্যাম্পাসে যায় জুতো পড়ে৷ তাছাড়া রিকশা দিয়ে যায় আবার রিকশা দিয়ে হোস্টেলে ফিরে আসে। তাই আর খালি পায়ে মাটি স্পর্শ করার সুযোগ পায় না। আর হোস্টেলে এসেও সেই রুমেই থাকতে হয়। তাই গ্রামে আসলে মাটি স্পর্শ করার লোভটা সামলাতে পারে না৷ আমিও কিছু বলি না। ওর সাথে হেঁটেই বাড়িতে চলে যাই। আমারও বেশ ভালোই লাগে হাঁটতে। বিশেষ করে সকালে।’

ইরা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি যে কেন সবসময় ওর সব কথাকে সমর্থন করো আমি বুঝি না। তোমরা কিছু বলোনা বলেই ও এইরকম হয়েছে। সবসময় নিজে যা বলবে, সবাইকেই তাই করতে হবে। নাহলে কান্নাকাটি শুরু করে দিবে। গ্রামে আসলে তো তাও ঝগড়া করে, কিন্তু ঢাকায় থাকলে ভ্যা ভ্যা করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।’

শুভ হাসি দিয়ে বলল, ‘একমাত্র বোনের এই ছোট ছোট আবদার যদি পূরণ করতে না পারি, তাহলে কীসের ভাই হলাম আমি।’

ইরা আদিত্যর দিকে তাকাল। আদিত্য বলল, ‘আমিও হেঁটেই যাবো।’

পাশ থেকে শুভ বলল, ‘তোকে একটা রিকশায় উঠিয়ে দেই। এবং রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা দিয়ে দেই, সে তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিবে।’

- সবাই যখন হেঁটেই যাবে, তখন আমি আর একা একা রিকশায় যাবো না। চল তাহলে হেঁটেই যাই সবাই।

অতঃপর সবাই মিলে হাঁটতে শুরু করল। জ্যোতি মনের আনন্দে লাফালাফি করতে করতে বাড়ির দিকে যাচ্ছে৷ গ্রামে এসে জ্যোতির পাগলামি আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। শুভ, ইরা আর আদিত্য ওর কাণ্ড দেখে হাসছে।

(চলবে...) আরো পড়ুন ‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর ৮ম পর্ব - ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড