• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘ফ্ল্যাট নাম্বার নয়ছয়’-এর একাদশ পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : ফ্ল্যাট নাম্বার নয়ছয়

  লামইয়া চৌধুরী

১৭ জুলাই ২০১৯, ১৪:১১
উপন্যাস
ছবি : প্রতীকী

শায়েরী এতটা সময় কি করবে খুঁজে পেল না। তারচেয়ে বরং বসে বসে ছবি আঁকা যায়। শায়েরীর একমাত্র প্যাশন ছবি আঁকা। মন খারাপ হলে, কাউকে কিছু বলতে না পারলেও ক্যানভাসে জল ছিটিয়ে ছবি এঁকে ফেলে। শায়েরী ব্যাক-প্যাক খুলে বড় ড্রয়িং খাতাটা বের করল। তারপর পেন্সিলও বের করল। আনমনে আঁকিবুঁকি করতে লাগল। মৃদুল হাওয়ায় ঘাসের ডগা তিরতির করে কাঁপছে। সেই ফুরফুরে হাওয়ায় বসে শায়েরী বেশ মন দিয়ে স্কেচ আঁকছে। দুটো চোখ, ভীষণ সুন্দর দুটো চোখ এঁকেছে সে, ফিনিশিং দিচ্ছে মন দিয়ে। ঠিক সেসময়েই শায়েরীর পাশে এসে কেউ একজন চুপটি করে বসল। টুঁ শব্দটিও করেনি সে, তাই শায়েরীও পাশে বসা মানুষটাকে খেয়াল করল না। সে এখন ভিন্ন জগতে, যেখানে সব দুঃখ রঙতুলির আঁচরে তারার মতন খসে পড়ে। এখন কি আর এই জ্বালাময় পৃথিবীর খোঁজ নেওয়া চলে!

নক্ষত্র মাথায় উল্টো করে পরা ক্যাপটা টেনে ঠিক করল আবার। ঠিক বলতে উল্টো করেই পরা, সে সবসময় ক্যাপের সামনের দিক পিছনে আর পিছনের দিক সামনে এনে ক্যাপ পরে। নক্ষত্রের জাতীয় পোশাক বলা চলে। নক্ষত্র শায়েরী থেকে আরো একটু দূরে গিয়ে বসল। বলা তো যায় না কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে সে! শায়েরী যখন ছবি আঁকে, তখন শায়েরীকে নক্ষত্রের কাছে আকাশ মনে হয়! স্বচ্ছ- নির্মল, সবাইকে ছায়া দেওয়া রঙধনুময়, বিপুল পবিত্রা এক আকাশ! শায়েরীর তখনও হুঁশ নেই, সে এঁকেই চলেছে। নক্ষত্র আসন করে বসে আছে সেই কখন থেকে! একবারের জন্যও ডাকেনি শায়েরীকে। কি দরকার ডাকার! ডাকলেই তো অপ্সরী,পরী! আসমান থেকে পৃথিবীতে নেমে আসবে! থাকুক না আসমানে, নক্ষত্রের পাশাপাশি! নক্ষত্রের ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে শায়েরীর গাল ছুঁয়ে দিতে। খুব করে ইচ্ছে করছে! ইচ্ছে শুধু এইটুকুতে দমে থাকলেই হতো, কিন্তু ইচ্ছের তো লাগাম নেই! তাই নক্ষত্র আরো একটু দূরে সরে বসল। দূর থেকেই পূর্বদৃষ্টিতে শায়েরী কি আঁকছে দেখতে চেষ্টা করল। এতদূর থেকে দেখতে চেয়ে বিফল হয়ে আবারো নিষ্পলক শায়েরীকে দেখতে লাগল। শায়েরীর আঁকা থেকে স্রষ্টার আঁকা শায়েরী বেশি নিপুণ, শৈল্পিক, জাদুময়ী। শায়েরীর আঁকা শেষ তখন। বাকিটা বাসায় গিয়ে আঁকবে। এখন ঘড়িতে সময় দেখতে হবে। রুচিদের বাসায় যেতে হবে তাকে! শায়েরী খাতা বন্ধ করে ব্যাগে রাখলো। ডান হাতের দিকে তাকিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। বড্ড পিপাসা পেয়েছে তার। ব্যাগে পানি আছে? থাকার তো কথা! শায়েরী ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতল বের করল। বোতলের মুখ খুলে বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করতে লাগল। নক্ষত্রের কাছে কি যে সুন্দর লাগছে এ দৃশ্য! সে মনে মনে বলল, ‘আমি মানুষ না হয়ে এইচটুও হলাম না কেন?’

কিন্তু মনের কথা মনে চেপে নক্ষত্র বাজখাই গলায় শায়েরীকে ধমকে বলল, ‘কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমায় কোনো সাড়া শব্দ নেই কেনো?’

শায়েরী হকচকিয়ে উঠল। ধমক শুনে পানির বোতল হাত ফসকে পড়ে গেল। বিষম খেল সে, কাশতে লাগল অনবরত। নক্ষত্র হাত বাড়িয়ে শায়েরীর মাথায় আলতো করে ছুঁয়ে দিলো কয়েকবার। এই মাথায় ছুঁয়ে দেওয়ার সময়টায় যদি কেউ নক্ষত্রের হাতটা দেখতো, তাহলে কম্পমান হাত দেখেই বুঝে যেত এই কাঠখোট্টা ছেলেটার মাঝে একটা হৃদয় আছে। যে হৃদয়ে প্রতি সেকণ্ডে সেকণ্ডে কারো জন্য ভূমিকম্প হয়। কিন্তু, আফসোস। কেউ তা দেখল না। শায়েরীর কাশি বন্ধ হলো। শায়েরী ঘাবড়ে গেল, নক্ষত্র ভাই আবার দেখেনি তো চোখজোড়া। তাহলে আম্মার কাছে ফোন করে ঝামেলা পাকাবে নিশ্চয়। কুটনা বুড়া একটা!

বোতলের পানিতে শায়েরীর জামার অনেকটা অংশই ভিজে গেছে। সে হাত দিয়ে জামা থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘কখন ডেকেছ? আমি তো শুনিনি।’ - শুনবে কি করে? খাতার মধ্যে ঢুকে যাওয়াই তো বাকি! শায়েরী সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল একবার। কি জানে নক্ষত্র ভাই দেখে ফেলল না তো আবার। আম্মার কাছে আজকেই ফোন যাবে, কি জ্বালা। শায়েরী স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি এখানে যে? - তোমার নাকি শরীর খারাপ? শায়েরী অবাক হয়ে বলল, ‘আমার আবার শরীর খারাপ কখন?’ - কাল রাতে জ্বর হয়েছিল, তাইনা? শায়েরী মনে করে দেখল হ্যাঁ তাই তো জ্বর তো হয়েইছিল। বলল, ‘নক্ষত্র ভাই, তুমি কি করে জানলে? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।’ নক্ষত্র কিছু বলল না আর, চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে শায়েরীর ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, ‘প্রহর গাড়িতে অপেক্ষা করছে, চলো।’ শায়েরী থমথমে গলায় বলল, ‘ব্যাগ রাখো নক্ষত্র ভাই, আমার এখন টিউশনিতে যেতে হবে।’ - প্রহরের প্র্যাক্টিক্যাল খাতা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট কাল। এখন এগুলো এঁকে দিবে কে? - আমার কাছে দিয়ে যাও, আমি বাসায় গিয়ে এঁকে দিব, ড্রাইভারকে পাঠিয়ে নিয়ে যেও রাতে। নক্ষত্র আহত হলো কিছুটা। ড্রাইভার কেন? শায়েরী কি একবারো ওকে এসে নিয়ে যেতে বলতে পারল না! রাগ করল নক্ষত্র। ভয়ানক রাগ, গমগমে গলায় বলল, ‘তুমি একমাসে টিউশনিতে কতো টাকা পাও? যত পাও তোমাকে এখুনি দিয়ে দিচ্ছি। প্রহরের খাতাগুলো একটু এঁকে দাও।’ শায়েরী ঘাসের উপর বসে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে রইল অনিমেষ। কান্না আসছে কেন আবার? একদম কাঁদবে না সে, একদম কাঁদবে না। নক্ষত্র ওয়ালেট বের করে টাকা বের করছে আর তাচ্ছিল্যের সাথে বলছে, ‘প্রহরটাও ভারি নাটক দেখায়। নিজের প্র্যাক্টিক্যাল নিজে করবে না। আচ্ছা না করুক, দোকানে দিলেই তো হয়। নাহয়, আমার বন্ধুকে দিয়েও তো করাতে পারি। আর্কিটেক্ট এ পড়ে, আমাদের বুয়েটেই। না, উনি উনার গুরুমা শায়েরী আপিকে দিয়েই করাবেন!’

নক্ষত্র জানে না শায়েরী টিউশনিটায় কত টাকা পায়, তাও আন্দাজে দশ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলো। শায়েরী হাসল খানিক, সে হাসিতে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর কষ্ট লুকিয়ে আছে। শায়েরী হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলোও। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ব্যাগটা দাও নক্ষত্র ভাই। টাকাটা রাখতে হবে। হাতে থাকলে হারিয়ে যাবে। আমার কাছে দশ হাজার টাকাই অনেক। দশ হাজার টাকা দিয়ে বাবার এক মাসের ঔষধের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

নক্ষত্র ব্যাগটা শায়েরীর দিকে বাড়িয়ে দিতেই শায়েরী ছোঁ মেরে ব্যাগটা নিতে দেরি হলো কিন্তু হাতের টাকা ছুঁড়ে ফেলতে দেরি হলো না। নক্ষত্র থতমত খেয়ে গেল। সে প্রস্তুত ছিল না এর জন্য। শায়েরীর ইচ্ছে করছিল টাকাটা নক্ষত্রের মুখের উপর ছুঁড়ে ফেলতে কিন্তু সেটুকু আর করল না।

হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার মতন টাকাগুলো উড়িয়ে দিয়ে পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করল সে। কলা ভবনের ঘাসের উপর হাওয়ায় উড়া টাকাগুলো অনেকেই দেখল। কিন্তু কেউ দেখল না একটা মেয়ের ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া, আর একটা ছেলের ভয়ানক রাগ থেকে করা ছোট্ট একটা ভুল নামের মস্ত বড় অপরাধ, কেউ দেখল না।

(চলবে....)

আরো পড়ুন ‘ফ্ল্যাট নাম্বার নয়ছয়’-এর ১০ম পর্ব - ধারাবাহিক উপন্যাস : ফ্ল্যাট নাম্বার নয়ছয়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড