• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বই আলোচনা

‘লণ্ঠনের গ্রাম’ হীরক জ্যোতির আলোক বিকিরণ

  আশ্রাফ বাবু

১৩ জানুয়ারি ২০২০, ১৫:১০
কবিতা
প্রচ্ছদ : কাব্যগ্রন্থ ‘লণ্ঠনের গ্রাম’

বঙ্গ রাখাল মূলত কবিতা লেখলেও কাজ করেছেন বাউল, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। তার কবিতায় সমাজ, মা-মাটি, মানুষের জীবন সম্পর্কের নানা টানাপড়েন এবং ফিরে যাওয়া গ্রামের কথা উঠে আসে। সম্প্রতি তার প্রকাশিত হয়েছে চার ফর্মার ‘লণ্ঠনের গ্রাম’ কাব্যগ্রন্থটি। নিজের সামনে মেলে ধরেছি কবির এই নতুন কাব্যগ্রন্থটি। যা সমীরণে ভেসে আসা হাসনাহেনার পাগল করা আবেগময় রাতের পূর্ব অনুভূতির মন ছোঁয়া কিছু সময় ধরে একটু নাড়াচাড়া করছি। এই কাব্যগ্রন্থটি আলতো হাতের স্পর্শে এপিঠ-ওপিঠ করে দেখলাম। গ্রন্থটিতে কবি সৃজনশীলতার নতুন এক প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন। যা আমাকে পড়ার সাথে সাথেই মুগ্ধ করেছে।

কবি দশক বিবেচনায় দ্বিতীয় দশকের কবি। এই গ্রন্থে তিনি নিখুঁত অনুভূতিকে দৃশ্যমান করে ফুটিয়ে তুলেছেন, ভেসে উঠেছে প্রকৃতির পেলবসুর, জীবন প্রলোভ বারুদের ঘ্রাণ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত অসহায় রক্তের দাগ লেগেছে বিদগ্ধ কৃষকের গতরে। এই কবির কবিতাই যেন বাস্তবজীবনের বহুমাত্রিক দার্শনিকতা প্রজন্ম থেকে উদঘাটন হয়েছে দিন হতে দিনে। গ্রাম বাংলার রূপকে কবি নিজস্ব চিন্তা দিয়ে সমকালের কবিতায় নতুন-দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘যে রাতে চাঁদ উঠে ডুবে যায় সে রাতেই হারিয়ে গেল কামিজের শূন্যফল, পা-এক মৃত শরীর’... (হারানো পা অথবা ঝলসে যাওয়া নূপুর)

এই পঙক্তিটি চরম ভাবাবেগের কবিতা। আমি যদি কবিতা না বুঝি তাইলে আমার কাছে তা যত্রতত্র শব্দ লাগানো বাক্য মনে হবে। কিন্তু কবিতার আপ্যায়নে কবি যে আধুনিক চেতনার উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ। কবির কল্পনা যে জায়গা থেকে শুরু আর যে জায়গাতে শেষ তা একটি গল্পও হতে পারতো। কবি তা করেননি। হঠাৎ কোন অত্যাধুনিক গদবাঁধা পাঠক যদি শীর্ষক পঙক্তিটি পড়েন তাইলে তার কাছে এটি কবিতা নাও হতে পারে। মনে হতে পারে সভ্যতার অবাঞ্ছিত উপলব্ধি। গদ্যভাষ্যের শব্দঝংকারে যে স্বল্পদৈর্ঘ্যতা বঙ্গ রাখাল তার কবিতায় সৃষ্টি করেছেন পাঠক তা লক্ষ করতে পারেন। তিনি সুষম শব্দ চয়নে নিজস্ব কাব্যশৈলী তৈরিতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন- ‘নরম আলোর ঝুলে থাকে শূন্যতার পাপেট।’ (হারানো পা অথবা ঝলসে যাওয়া নূপুর)

সন্ধ্যারাত হতে ছেড়ে পালাতেই কবির এতচিত্র, এতো অনুভূতি মিশে গেল আমার হৃদয়ে। তাই কবি বললেন- ‘সন্ধ্যারাত পার হতেই পায়ের নিচেই ধানের মলিন শৈশব- উচ্ছ্বাসের বিছানা মেলে ধরে। সোনাবউ মুগ্ধতার পুতুল হয়ে হাঁস পুষে রাখে চোখের পাতায় আর আগুনের জলে পাখিপাড়া কুমারী হয়ে নদীতে সাঁতরে মরে।’ (শীতবুড়ি মৃতের ঘুম ঘুমিয়েছিল) বঙ্গ রাখালের উপস্থাপন দেখে ডুবে গেলাম বাস্তব অনুষঙ্গে। হারিয়ে গেলাম নতুন কবিতাস্বাদে। কবিতার নতুন পোশাক পেয়ে সুঘ্রাণ নেই আর অভিবাদনে উল্লেখ করি কবির কবিতা। আমার প্রত্যহ হারিয়ে যাওয়া সেই ফেরিঘাটের চাঁদ প্রান্তিক চাষির দরজা পেরিয়ে ছুঁয়েছে ‘লন্ঠনের গ্রাম’।

‘রুপালি চাঁদের নিঃশব্দে চলে যাওয়া ছায়াস্রোত হয়ে যায় নদীর বুক। শূন্যতা নদীর জলের নিশ্চিহ্নের সহসা আবছা আলোয়, ঘুমন্ত গাছের শরীরে তোলে দীর্ঘের আয়ু ...তীব্রতার খেলাঘর আজো তোলে বুকের মাঝে, চোখের কোণে ভৈরবী সুর। বিধ্বস্ত দুপুরে দৃশ্যের জাল বুনে যায় প্রান্তিক চাষির গোলাঘরে লুকিয়ে রাখা ঘরকুনো ব্যাঙ।

কালো ছায়ার সাহায্যে পাটাতনে লুকিয়ে রাখে রাত্রির নিঝুম রহস্য’... (শম্ভুনাথ জ্বালিয়ে দেয় লণ্ঠনের গ্রাম)

একটি আঞ্চলিক কবিতায় কবি যে উপমা এনেছেন নিঃসন্দেহে তা কবিতার ভারসাম্য রক্ষা করেছে। আল মাহমুদের কবিতায় যেমন শক্তিশালী সমৃদ্ধ ফলন ফলেছে বঙ্গ রাখালের চিত্র কল্পে ধারালো বাস্তবতায় তেমনই ফলন পাওয়া যায়। কিছু পাঠক হয়তো বলতে পারেন এটি আবার কেমন কবিতা! আসলে আমরা বেশিরভাগ পাঠকই এমন কবিতা বুঝার চেষ্টা করি না। জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শব্দ কুড়েকুড়ে কবি কবিতার ভাস্কর্য তৈরি করেন প্রতিনিয়ত। বঙ্গ রাখাল স্বল্প সময়ের মধ্যে তার কাব্যভাষা তৈরিতে এনেছে স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা। যা ইতিমধ্যে পাঠক উপলব্ধি করেছেন তার মধুময়রূপ। জীবনের উপলব্ধি প্রাসঙ্গিক কবিতার শক্তিতে কবি বলিয়ান-

‘আমি আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকি। ক্ষতদেহের প্রহসনে তুলে ধরি শরীরের ঠুনকো পুরুষালী ভাব। এক অন্ধবালক ভৈরবী ধরে...ইতিহাস নয়, লাল ঘোড়া আমাকে তাড়া করে এদিক থেকে ওদিকÑ শহরের পথে মা আমাকে অস্তিত্ব লড়াইয়ের কথা বলে...

শুনেছি আমার বাবা অন্ধ ছিলেন-মুখে ভেসে উঠত শ্মশানের মানব পরস্ত্রীর ছায়া। পরমানন্দপুরের জেলেরা সন্ধ্যা হলে নাকফুল পরে আসত ঈশ্বর নামের মহাজনের বুকের আমিকে আজীবন করে পেতে।’ (জীবনের মত করে) একটা সচেতন অভিপ্রায়ে কবির ধারণায় উপস্থিত হয় জীবন ধারণের নানা অনুষঙ্গের উন্মোচিত সত্য। রাখাল সত্যশীল ভাষাতেই উপস্থাপন করেছেন লুকিয়ে থাকা আমিকে অনুভবের দৃষ্টি দিয়ে। একটা মৌলিক যাপিত জীবনবোধের কণ্ঠস্বরে কবি লড়াইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি অনিবার্য চিন্তাকে প্রকাশ ঘটিয়েছে নতুন নিজস্বতার মধ্য দিয়ে। ‘মুখে ভেসে উঠত শ্মশানের মানব পরস্ত্রীর ছায়া’ মন্তব্যটা কয়েকদিন আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। জীবনের টানাপড়েনের এক দৃষ্টিভঙ্গি কবি তার কাব্যভাবনা পূর্ণাঙ্গরূপে সাহিত্যের চৌকাঠে এনে দাঁড় করিয়েছে অনুভূতি শক্তি দিয়ে।

‘লণ্ঠনের গ্রাম’ কাব্যগ্রন্থটি আমি পড়েছি কিছুটা বিজ্ঞানের বই মনে করে। আমি যেহেতু আবিষ্কার পছন্দ করি সেহেতু বঙ্গ রাখালের শব্দময় বয়ান আমার কাছে আবিষ্কার মনে হয়েছে। শব্দসৃজন, বাক্যবিন্যাস আর নিজস্ব উঠোনে সৃষ্টি অর্থাৎ অজানা নির্ভরশীল স্থির উপলব্ধি কবির এক আলো আধারিত খেলা, যা সচেতন পাঠক মাত্রেই বুঝে নিতে হয়। কবি নিজের দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে ফিরে পেতে চেয়েছেন এ গ্রামের ভবিষ্যৎ, নিজের সম্প্রীতির গ্রাম। অস্থির এই যান্ত্রিক সময়ে এসে কবি কতো যত্ম করে শব্দের কারুকাজে ভরিয়ে দিচ্ছেন আমাদের বাল্যজীবনের ব্যক্তিগতবোধ।

‘এখন আমি আগের মতো চলতে পারি না, হতে পারি না প্রিয় তোমার। কেবলই রূপের মধ্যে এক নিজেকে আটক রাখার ছবি। নিঃসঙ্গ আমি এখন একা একটু একটু করে চলি...

অভিযোগ ছিল না কিছু। রাতে চুমু খেয়ে লুকিয়ে সকালে বাড়ি ফিরিনি আজও। পিদিমের আলোতে আমার অনেক ভয়, মা বলতেন- রসালো আলোয় চোখ নামিয়ে বলতে হয় আমরা এখন রাত জাগি না, প্রতিটি প্রান্তজন আজ আমার সহকর্মী।

পদ্ম নিভে গেলে আমি জ্বলে থাকি। কাজী পাড়ার পালদের মুখে জলপাই প্রেমিকের গল্প... সংসার কি সোজাকথা। সবকিছু জ্বালিয়ে দেয় অন্ধের ব্যক্তিগত বারুদ।’ (অন্ধের বারুদ)

মৃদু সাধুসঙ্গ রাতে অজস্র চোখ দেখে নেই মুগ্ধতার সকাল। মানুষ কখন কিভাবে মুগ্ধ হবে, কোন মুহূর্তে তীব্র তৃপ্তি পাবে, ভাষা কিংবা সাহিত্যের প্রামাণ্য সৌন্দর্যের উঁচু মানের কবিতা পড়ে, তা স্বপ্নচাঁপা কুসুমরাত্রির নদী হয়ে যাওয়া গল্প পড়ে কেউই বলতে পারে না। সীমিত শব্দের টানাগদ্যে রচিত কবিতা সত্যিই আমাকে একভিন্ন স্বাদের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল। আমার কাছে কখনও কখনও একেকটা লাইন এক একটা কবিতা হয়ে অবস্থান করেছে ‘লন্ঠনের গ্রাম’ কাব্যে। পাঠকে কাছে টেনে নেবার মত কবিতা সৃষ্টি করেছেন রাখাল।

‘নিঃসঙ্গ পৃথিবীর রোগশয্যায় মহা পিতা, ঐশ্বর্যের প্রতীক ঝুলিয়ে দৌড়ে গেলেন মাঠের দিকে-জানা নেই বিষাদের ভাষা কিংবা স্মৃতির মিনারে অপ্রকাশ্য আকাশ পাখির সময় হারানো সুলতার চিঠি, স্বপ্নচাঁপা কুসুমরাত্রির নদী হয়ে যাওয়া গল্প...

বাঁশির সুর চুরি করে পাখিদের ঠোঁটে ওঠে মাউথওয়ার গানের চাঁদবুড়ির চারকাকাটা গল্পের বিস্মিত আয়নার উটপাখি, প্রশস্ত যাত্রার গাড়ি দাঁড়িয়ে যায় পিতার কাচারি ঘরে প্ল্যাকার্ড দুঃখের পল্লবিত শোভায় মগ্ন হলো শশীবৃক্ষের পিতা...অলিন্দে আরশিনগরের পড়ছি ফিসফিসিয়ে বলে- টুকে নেও জীবনের নোট।’ (টুকে নেও জীবনের নোট)

কবির জন্ম হওয়া কবিতায় আস্বাদন নিতে চাই সুষম পাঠক রূপে। সৃষ্টিশীলতার অভিযোগ পর্ব যদি কেউ সৃষ্টি করে তাইলে ডুবে যাবে, মুছে যাবে শিল্পের সার্বিকবোধ। আমিতো একজন পাঠক মাত্র। কিন্তু শিল্পরস- শিল্পস্বর পেয়েছি বলেই আমাকে মানতে হয় শব্দসৃষ্টি কৌশলের বিভিন্ন জীবন উপলব্ধি নিয়মকানুন। তাইতো সমকালকে চিনেনিতে কবি এমন কিছু উপাদান যুক্ত করেছেন ‘লণ্ঠনের গ্রামে’ তা সত্যিই উপলব্ধি করার মত।

বইটি পড়তে পড়তে কিছু চমৎকার লাইন পেয়ে যাবেন পাঠক, যা ভুলিয়ে দেবে অনাগ্রহী পাঠকদের বিষাদীচোখ। প্রবল উৎসবমুখরতা এনে দিবে সচেতন পাঠকের মনে-

ক. মাদুরে মোড়ানো দেহ টুকরো করে কাটা, মাটির ঘ্রাণ এতো সুন্দর কেন? (পাখিরাজ্যে সকলেই পাখিচাতক)

খ. তুমি ধুলোমেঘ চাষার অবারিত স্বপ্নের ক্ষেতপোড়া ধান... (রোমালে থাকে কৃষকের রক্ত ঘামের ঘ্রাণ) গ. ব্যথিত করে ভাতঘুমে ছেড়ে আসা ধানের প্রহরশোভিত গ্রাম। (গ্রাম) ঘ. চন্দন মাখি ঘুম কিংবা মরণ ভেবে। (অসহায় রক্তের দাগ) ঙ. রক্ত ঝরাই...খুঁজে নেয় নিজের রক্তের বাকিটা আয়ু... (রক্তের আয়ু) চ. বুকের উঠোনে রোপিত আছে অনেক না বলা গল্প... (আমি কবে নারী হবো) ছ. হায়রে নারী তুই ব্রেসিয়ারের নিচেও লুকিয়ে রাখিস ছলনার বহুরূপী ছল। (প্রিয় অন্ধতা আমার)

‘লণ্ঠনের গ্রাম’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠের পর আমার আশাবাদ কাঙ্ক্ষিত হয়েছে। শূন্যতা নিয়ে পড়তে বসলেও পূর্ণতা নিয়ে ফিরে এসেছি। নিজেকে কবিতার যাত্রী করে স্টেশন মাস্টারের (বঙ্গ রাখাল) সাহায্য নিয়ে প্রকৃত শব্দের স্বাদ পেয়েছি ‘লণ্ঠনের গ্রামে’। কবির কবিতা শক্তি আমাকে নানাভাবে বাক নিতে শিখিয়েছে। কখনো আমাকে উত্তপ্ত করেছে, কখনো বা শীতল বাতাসে মনে পূনতার জ্ঞান ভরে দিয়েছে ভালোবাসার কলস। কবির বহুল সিদ্ধান্তের উপমায়, শব্দগঠনে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছি মন ভরে। তার কাব্য শক্তির ব্যাপারে আমার নিজস্ব মন্তব্য- হীরক জ্যোতির আলোক বিকিরণ।

আরও পড়ুন- সূর্য দীঘল বাড়ী : মানুষ, না মানুষের গল্প

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড