• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

পাণ্ডুলিপির কবিতা

বাচ্চা হাঁসের পালকের মত চোখ তুলে চাও

  আল আমীন

১১ জানুয়ারি ২০২০, ১২:২৭
ছবি
প্রচ্ছদ : কাব্যগ্রন্থ ‘কস্তুরীনামা’

কালো মেয়ে

পুরনো প্রেমে আজো চিরযৌবনা হতে চায় যে, সে প্রেমিক ভাসুক আজ তরল চান্দের ঠোঁটে! প্রেয়সী তোমার প্রিয়ংবদা মুখ চঞ্চল হয়ে উঠুক, আমি আবারও মাতাল হতে চাই ঝিম লাটিমের মত তোমার নাকের ডগায় ঘাম বিন্দুর মত পলকে স্থির হয়ে আবার নামতে চাই কাঁপতে কাঁপতে। গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠো তুমি, তোমার হাসির দমকে বন্ধ হোক আমার দম। এই যে বেশ! পড়েছে এক ফোটা তোমার ঠোঁটের ভাজের মত আমার জিভে। জানতে যেও না আমার রোমকূপের হালচাল নেচে ওঠো হাওয়ার নুপূর, সুর প্রেয়সী, বুকে রাখো হাত, থামাও আমারে! মধ্যরাতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুঁকে দেয়ার স্বরে কাছে আসো তুমি। আজ পুরনো প্রেমের রাত। বয়স্ক প্রেম কখনোবা পায় ক্যাফেইনের শরীর, সে কথা কি জানো? পুরনো প্রেমে সব হারিয়ে যা থাকে সেটা তলানী ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু সেটুকুই যে সিগারেটের শেষ টানের মত! সেটুকুই পেয়ালার শেষ চুমুকের মত স্বাদু! সেটুকুই নাভিশ্বাস ওঠা মানুষটার মত, যে মৃত্যুর মুখে পড়েও হাজারবার চেষ্টা করে আবার বেঁচে উঠতে চায় একবার। মেঘের নাভীর মত একরোখা হয়ে শুয়ে আছি তোমার কটিদেশের প্রতিবেশি হয়ে। মধূর চাকের মত মাৎসর্য তোমার সবটুকুই কেবল আমি মুখে তুলে নিতে চাই। বাচ্চা হাঁসের পালকের মত চোখ তুলে চাও, আমি নধর মাটির দলা হয়ে যাব। আমি সমুদ্রে যাব তোমার সাথে ছেলেখেলা করতে। আমি বালিশও কিনব হেলাফেলা করতে। সুখী হতে আর কী লাগে, যখন তুমি আমায় নিয়ে এত সুখী! গরীবেরও বর্ষপূর্তি হয়, প্রেমিকেরও... বয়স কি আদৌ বেড়েছে প্রিয়তমা? কী মনে হয় তোমার? পাহাড় ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করার দিন, সে-ও কি গিয়েছে চলে? আঙ্গুলে আঙ্গুল গুঁজে পথ চলার দিন, কিছুই হবে না পুরনো; চলো, ওই মেঘেদের দেয়ালে বসে দু'জনে দোলাব পা। তুমি রাঁধতে ভাল জানো, না? আজ আমারে রান্না শেখাবে তুমি এই হাতের তালুতে ঝুঁকে বসো এবার! তোমার চোখে আমার যাবজ্জীবন কারাভোগ হোক, ওই যে জোড়া ভ্রুর পাড়ে দুই চোখ তোমার জমিদারী পুকুর! একটার নাম দিয়েছি রাণীর দীঘী, আরেকটায় রাজা বানাও আমায়, হোক রাজার স্নানাগার! মাঝবরাবর নাকের ডগা দিয়ে ঘামে মোজাইক করা হীরের তৈরী পথ; বেয়ে বেয়ে নেমে এসে বসি আমি তোমার নাকফুল সিংহাসনে। আর তোমার সমস্ত মুখমন্ডল জুড়ে আমার ফুলের সম্রাজ্য! ঠোঁটের শাসনে সেখানে চাষ করি আমি গোপন আলাপন। তোমায় ভালবেসে মেয়ে! তোমার জমিদারী পাক আমার আদরের নহবতে আরো দীর্ঘতম যৌবন। জানো মেয়ে, এমনও আসে একেকটা রাত তুমি ছাড়া কোনো সূরায়ই আর ওঠে না নেশা; কোনো সুরে... যেন কোকিল কোনোদিন গায়নি গান, নাচেনি কখনো কোনো বাঈজীর ঘুঙুর, বুঁদ যেন হয় নি কোনো পেশোয়ারী কামিনী! জমেনি গানের আসর কোনো পানশালায়... কেবল তোমার ঘুমন্ত চোখ ছাড়া, এই রাতে! তোমাকে তসবীহ বানিয়ে জপতে ইচ্ছে করে, পুরো পথ তোমার শরীরে দৌড়ের ঘোড়ার মতো, দমহীন! কালো মেয়ে! এই কালো রাত। তুমি ছাড়া জ্বলে নেই কেউ আলো হয়ে শাহজাদী! তুমি নেশা, নেশার গন্ধ; তুমি দূরে মানে, আমি অভুক্ত, অনাসক্ত, নিদ্রাহীন এক সাপ। মনে হয়, আমি খুঁজে পাচ্ছি না তোমার পায়ের পাতায় শান বাধানো পুকুরের ঘাট; রঙ-বেরঙয়ের ফুল ফুটে সেখানে তোমার নখ... আমার চোখে আঁচল বেঁধে ছেড়ে দাও ওই পুকুরের পাড়ে। আঙুলে তোমার সুখের সখীরা এঁকেছে নদীর বাঁক, হাজারো পঙ্ক্ষীরাজ পায়ে রক্ত-আলতা ঢেউয়ে ঘুমের সমুদ্রে যাচ্ছে নিয়ে তোমায়... আমি মেঘে হারাচ্ছি মেয়ে, এমনও হয়; কখনো আমার নেশা কেটে গ্যাছে, তুমি কাছে নেই তাই! প্রেমিকা আমার! ঘুমে হারাও তুমি, শিথিল হয় তোমার কোমরে আঁচলের গিঁট, আমার পাঞ্জাবিতে শুকায় তোমার কাজলের দাগ। আর রাত বাড়লে আমি মদ হয়ে যাই। আমার শরীরে রঙ ঢালে তোমার গায়ের ছায়া! সোনায় চুবানো জাফরান তোমার গালের পাশের নদী। তুমি বলো নিজেকে কালো মেয়ে! আমি তো জানি জাফরানের অনেক দাম। এই মদের তবে নাম কী দিবেন মাননীয়া? আপনার জমিদারী যে আমার হৃদয়, যতবার ভাবি আপনারে, ততোবারই এই জমিন হয় রঙিন আপনার পায়ের ছাপে। যতবার ভাবি আপনারে, ততোবারই বাড়ে নেশা আমার! কী নাম দিবেন আপনি এই মদের? কালো মেয়ে, শাহজাদী! আপনার চোখের শীতলতার কী নাম? আপনার পায়ের রঙয়ের?... হাতের তালু ছুঁয়ে আমার ঠোঁট যে করে স্তব, সেই কবিতার কী নাম? সোনার কলসী, হাতের অঙ্গুঠি, রুপোর জুতো জোড়ায় আপনার, কে করে সেবা? কে সে মহান প্রেমিক? কী নাম দেবে তুমি তার? একটা গল্প শোনাই তবে, শুনো: স্রষ্টা একদিন এই পৃথিবীতে ফেরেশতা পাঠিয়েছিলেন দুইজন। একজনের হাতে সোনার তরল চাঁদ, আরেকজন নিয়ে বসেছিলেন জাফরান পেয়ালা। আরো শুনো, আমি সেই দুইজন ফেরেশতার একজনের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলাম চাঁদ, আরেকজন আমাকে দান করেই দিয়েছিলেন সেই পেয়ালা! এখন জাফরানের পেয়ালায় তরল চাঁদ ঢেলে সেইখানে স্নানে নামি আমি, আর তুলে আনি সহসা তোমারে বারবার, তোমার আবহ, তোমার ঘ্রাণ, তুমি, তোমার ভালবাসা; আজ শরীর, আশির্বাদ, স্নেহ-মায়া, মহাকামের ঝরণা সব অস্বীকার করে, একটা কথাই বলতে পারি আমি। ভালবাসি কালো মেয়ে! ভালোবাসি বড্ড তোমায়! আমার অলঙ্কার তুমি, তোমার অহঙ্কার হয়েই থাকতে চাই অশরীরী অকালেও!

একজন রুমালী

একজন রুমালী— তুর্কী বোরখায় গোছানো গা; পা সাজানো এমনিতেই; গাল মোড়ানো আতরের নেকাবে; চোখে ছড়ানো জাফরান কালো; জামদানী আঙ্গুল দেখি— কুহকের মত পথের শরীরে হাঁটে তার শরীর; বিবিধ ছায়ায় দ্যাখে সূর্যের আলো; হাঁটাতেও সুন্দরের দোহাই এত! খালি পা দেখেও পড়া যায় প্রেমে? তার মুখ দ্যাখেনি কেউ ।

অতিপ্রাকৃত

আমার সামনে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে দুইটি সাপ।

ওরা বোধহয় স্বামী-স্ত্রী! অথবা প্রেমিক-প্রেমিকা! সৌন্দর্যের ঝলকানীতে মুগ্ধ হয়ে নেমে এসেছে চাঁদ!

সাপ সুন্দর, চাঁদও... কিন্তু অসুন্দর যা, সেটা সাপের বিষ! কিন্তু জানি না, হজম করতে পারলে সেটাও হয়তো মানবীয় যন্ত্রণায় সবচেয়ে অমিয় পথ্য হতো কিনা! আর জ্যোস্নার কথা না-ই বললাম! আসক্তির এক শেষ!

নদীর পাড়ের এই শুক্লাপক্ষের রাত। কূল ছাপিয়ে উপরে ভাসছে জল। গোড়ালি সমান পানিতে হেঁটে হেঁটে চাঁদ দেখছি, আর মনে পড়ছে মেলার মাঠে হারিয়ে যাওয়া মুখ; আমার কাছে পানি খেতে চেয়েছিলো তৃষ্ণায়; সে এগিয়ে গিয়েছিল বস্তিঘরের দিকে! তারপরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি তারে।

রেললাইনের পাশ ধরে চলে যাওয়ার সময়, সবুজে সবুজে আমি যে টান অনুভব করি, তারচেয়েও বেশি সম্মোহন এখানে! বরইতলা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সামনের কলার পাতায় দেখলাম উড়ছে আঁচল। সাদা রংয়ের আঁচলে মসলিন বাতাস, জ্যোস্নার কারুকাজে ভীষণ মনটানা এক সুরঘোর, ওখানে হেসে হেসে কথা বলছে কেউ।

জামগাছের আড়াল সরে যেতেই দেখলাম তারে! মাথায় রুপোর মুকুট! হাসলাম আমি! স্রোতের মিহি ভাঁজের মতো চোখের পলক ফেলে তাকালো সে! আমার শিরদাঁড়ায় বাড়ছে আবেশ!

সাপ দু’টোও এলো! মাথা উচিয়ে জানালো অভিবাদন! আমি তার মেহমান। এখন রাত বাড়বে, ভোরের দ্যাখা মিলবে না। পাথরের আড়ালে আমার দিন হারায়ে যাবে। তার দাঁত জহরতে মোড়ানো, তার পথ সোনার সিঁড়ি! আমি এখন উঠে যাব তার হাত ধরে! সে হাসছে...

আকাশ দেখা স্বভাব

ততোটুকুই ভালো লাগে আমার, যতক্ষণ হাসি-খুশি, মুখরোচক কথায় কেটে যায় দিন—সব মুহূর্তেই আমি একজন সুখী পুরুষ। কিন্তু মুখ কালো ক'রে কেউ বললে, আমি তাকাতেও পারি না তার দিকে...

কাউকে বলি নি আমার একা একা লাগে; শুনলে মানুষ বলবে, ‘মেয়েলী স্বভাব’। কেউ যদি বলেছে, ‘আজ রাতে আকাশটা সুন্দর’। আমি সেদিনের মেঘগুলো মুছে দিতে চেষ্টা করেছি; জানি, —একা মানুষগুলোর বড্ড আকাশ দেখা স্বভাব।

কারো কারো কাছে জিজ্ঞেস করলেও সে— 'কেমন আছে', পাওয়া যাবে না উত্তর—জানি । দেখা হ'লেই তবে কী বলি তা’রে?... যার ভেতরে এক দ্বীপ হাহাকার; দীর্ঘশ্বাসেরা আটকে পড়ে আছে যার কণ্ঠনালীতে, —যিনি হাসির হেরেমে নীরবতা আঁকেন, কথাগুলো যার বলতে যেয়ে বারবার কবলিত হয় নিঃসঙ্গ বাতাসে,—যিনি হাসতে যেয়েও ঠোঁট নামিয়ে নেন আবার; যার জীবনে হাসির কোনো কারণ ঘটেই নি ব'লে মনে হয় সব; আমি অ-শুকরিয়া করছি না।

এইসব মানুষেরা কেমন থাকে তা আমার অজানা নয়। কিছুই বলে নি এরা আমাকে, কিছুই শুনতে দেয় নি; আমাকে বেহায়া বলবেন, আমি যদি বলে দেই এসব? যা আপনি বলতে পারেন নি কাউকে, যা সব চাপিয়ে রেখেছেন নিজের করে, যার সিঁকিভাগও জানতে দিতে চান না পাশের মানুষটাকে! কীইবা করার আছে আমার আর! জোর করে বলতে গেলে মুখ ঢেকে রাগ দেখাবেন, আমি তো মুখ কালা-কালি চাই নি রে!

‘কেমন আছেন আপনি’, তা জানার অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে দিই সেটা, যদি জেনে যাই, যদি বুঝে ফেলি আপনার কুশল! মুখ ঢেকে কী লুকোবেন তখন! আলগা হ'য়ে যাবে যে সব... চোখে পড়ে না দাগ আপনার কান্নায়?— নির্ঘুমে রোদেরাও কিছু জানে না ভেবেছেন? যে মায়া মহামায়া বিলিয়ে যান হেঁটে হেঁটে, এই পৃথিবীর বুকে রয়ে যায় তার ইতিহাস; যেমন কবির জন্য ধরণীর কোণায় কোণায় কবিতা, শিল্পীর জন্য হাতের রেখায় রেখায় ছবি, বাতাসের শিরশিরানিতে যত সুর, কোকিলের রক্ত চক্ষু তাড়নায় যে সম্মোহন— আপনি সেই জগতেরই মানুষ।

আগমন

ডান হাতে সেদিন সমুদ্র এসে শুয়েছিলো ক্লান্ত ষাঁড়ের মতন, পাহাড় আমার বাম হাতে বসেছিলো হাঁটু গেড়ে দিয়ে; সে যেন প্রেমিক প্রবর: জয় করে এসেছে কিশোরীর পুরনো খোঁপার ঘ্রাণ! আমার সেদিন বরেন্দ্র বাতাসে লোভাতুর হয়ে ওঠা মন, কেবল ত্রয়োদশীর বেনুণীর খাঁজে চোখ লটকে থাকা সন্ধ্যেকাল! মাথার উপর হঠাৎ নুয়ে আসে আকাশ, চোখের ধারে ঝর্ণা নাচে ময়ূরীর নাচ; পাহাড়ের খাড়িপথ বেয়ে নেমে আসা সাদা ঘাগরায় চমকাতে দেখলাম তোমায়, মাথায় হীরের মুকুট, তর্জনীতে জড়ানো মতিহার, চোখের সামনে ধরে কব্জির উপর কবজি, বাঁজাচ্ছো হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি সে কোন বেহাগে জানি নি তখন! হাসছো তুমি, দাঁতগুলো জ্বলছে হীরের আলোয়, দুই হাতে ধরে ঘাগরার ঝুল, নেমে আসছো হুরের সখি তুমি আমার দিকেই; পাহাড় তখন কাঁপছে আমার হৃদপিণ্ড ধরে; সাগর তখন উৎসুক ঢেউয়ে; আমার পেছনে উজাড় সবুজে গেয়ে উঠেছে পাখি; বৃষ্টির ঢলে কই আমি! সহসা যেন চিনে ফেলি আমি; হাতে নিয়ে সেই শ্যাওলাপুকুরে খুঁজে পাওয়া রূপোর নুপূর! নেমে এলে তুমি আমার বুকের কাছেই! আশ্চর্য! তোমার এক পায়ে নূপুর ছিলো না! আমিই পরালেম তোমারে আরেক পা কোলে তুলে নিয়ে... আজ আমার বিছানায় পদ্মফুলের ঘ্রাণ।

আরও পড়ুন- মা আমার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছিল

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড