• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘আমরা স্বাধীন, তারপরও যেন পরাধীন’ : বাগরাম কারাগারের নির্যাতিত বন্দি

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:৫৯
Bagram_odhikar
আফগানিস্তানে আমেরিকা স্থাপিত বাগরাম কারাগার। (ছবি : আল-জাযিরা)

বাগরাম কারাগারের প্রাক্তন বন্দিরা আজও বয়ে চলেছেন নির্যাতনের সেই দগদগে ঘা

হামিদুল্লাহ খানের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা করাচিতেই। তার বয়স ছিল তখন ১৬ বছর। বেশ রোমাঞ্চপ্রিয় এক কিশোর ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের পশ্চিম ওয়াজিরিস্তানের এক জেলা হলো লাধা। সেখানে তার পরিবার তাদের পূর্বপুরুষদের এক গ্রামে সফরে গিয়েছিলেন। হামিদুল্লাহ খান তখন বাসা থেকে পালিয়ে বেরিয়ে পড়েন। হামিদুল্লাহ এবং তার উস্তাদের পরিচয় হয় লাধা’র কাছেই এক বাজারে। সে আফগানিস্তানের একটি মাদরাসায় ধর্মীয় দীক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল।

বাগরাম থেকে মুক্তির পরে কাজে মনসংযোগের ব্যাঘাত ঘটা এবং প্রায়ই সেসময়ের দুঃস্বপ্নগুলো এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় ২৬ বছর বয়সী হামিদুল্লাহ খানকে।

সময়টা ২০০৮ এর দিককার। তখন তেহরিক-ই-তালিবান (টিটিপি) পাকিস্তানি সেনাদের সাথে পশ্চিম ওয়াজিরিস্তানে তাদের শক্তিশালী একটি ঘাঁটিতে যুদ্ধরত ছিল। অবশ্য আফগান তালিবান তখন এবং বর্তমানেও আমেরিকা প্রেরিত ন্যাটো জোটের বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধ করে চলেছে। এই যুদ্ধে টিকে থাকতে সীমানার উভয় পাশেই সৈনিকের দরকার ছিল।

এদিকে হামিদুল্লাহ খান তার সফরের দুইদিনেই মনোবল প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন। পাথুরে পাহাড় বেয়ে বেশ ট্রেকিং করে, তাঁবু গেড়েই চলছিলেন কিন্তু দৃষ্টিসীমার ভেতর কোনো মাদরাসা তাদের চোখে পড়েনি তখন পর্যন্ত।

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে খোস্ত প্রদেশে তারা তাঁবু স্থাপন করলেন। হঠাৎ তাদের পাশের গ্রামের আকাশে তারা একটি হেলিকপ্টার দেখতে পেলেন। এর কিছুদিন আগেই ন্যাটো বাহিনী সেই অঞ্চলে বোমাবর্ষণ করেছিল। ফলে, এখন আবার হেলিকপ্টারের উপস্থিতি সবার মাঝে নতুন করে ত্রাস সৃষ্টি করলো। সবাই বাড়ি ছেড়ে যে যেদিকে পারলো পালাতে আরম্ভ করলো। হামিদুল্লাহও পালাতে চাইলো তবে সে আফগান একটি চেকপয়েন্টে ধরা পড়ে গেলো।

‘সেই উস্তাদের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার এই-ই সুবর্ণ সুযোগ’ হামিদুল্লাহ মনে মনে ভাবলো। ‘আমি সেই সৈনিকদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে আমি আবার বাড়ি ফিরে যেতে পারি?’ করাচি ফিরে যাওয়ার আগে বছর ছয়েক সময় লেগে যেতো হয়তো।

চেকপয়েন্টে আফগান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পরে হামিদুল্লাহ খানকে আমেরিকান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং কোনো অভিযোগ ছাড়াই বাগরাম কারাগারে প্রেরণ করা হয়। বাগরামে তিনি কোনো আইনি সহায়তা বা তার গ্রেফতার আদেশকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ পেলেন না।

হামিদুল্লাহ খানসহ আরো ৪৩ পাকিস্তানিকে বাগরাম কারাগার থেকে মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আজ প্রায় ৫ বছর হতে চলল। এই প্রাক্তন বন্দিদের অনেককেই আমেরিকা এবং আফগান সৈনিকদের করে যাওয়া সেই কারাগারের দিনগুলোর অবর্ণনীয় অত্যাচার, দুঃসহ স্মৃতিগুলো আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী এবং পুলিশের দাখিল করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় পড়ে তাদের অনেকেই এখন দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছে না।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় ৫০ কিঃমিঃ উত্তরে বাগরাম এয়ারফিল্ড আমেরিকা ১৯৫০ সালে স্থাপন করে, যা ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পরে আরো বর্ধিত করে বৃহৎ কারাগারে পরিণত করা হয়।

বাগরামে সর্বোচ্চ ৩২০০ বন্দিকে আটকে রাখা হয় যাদের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনয়ন করা হয়নি কিংবা তাদের আইনি কোনো সহায়তা নেওয়ারও অবকাশ রাখা হয়নি। এদের অধিকাংশই আফগান নাগরিক। এই বন্দিদের মাঝে আরো আছে অন্যান্য দেশের নাগরিক, যাদের “তৃতীয় পক্ষের দেশের নাগরিক” নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এদের কাউকে আফগানিস্তানেই আটকে রাখা হয়, কাউকে আবার দূরবর্তী অঞ্চল যেমন সোমালিয়া বা ইরাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আমেরিকান পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের হাতে ২০০৫ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনীর একটি গোপন নথি আসে যেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাগরাম কারাগারে দু’জন বন্দির মৃত্যুর খবর লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর থেকে কিংবা ২০১৪ সালে আফগান সরকারের হাতে বাগরামের দায়িত্ব প্রদানের পর পর্যন্ত এই পুরো সময়ে বারবার কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের জবানবন্দিতে কারাগারের অভ্যন্তরে মারাত্মক নির্যাতন এবং অপমানের বিভিন্ন চিত্র বিশেষ করে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতনের বর্ণনাসমূহ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।

আল-জাজিরার পক্ষ থেকে যখন এই সংবাদের ব্যাপারে আমেরিকান প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলো, তখন তাদের একজন মুখপাত্র জানায় যে, ওয়াশিংটন থেকে বর্তমানে বাগরামের উপরে কোনো কর্তৃত্ব নেই। এই রিপোর্টারকে ‘ফ্রিডম অফ ইনফর্মেশন’ এর মাধ্যমে আবেদন জানাতে হবে বিস্তারিত তথ্যের জন্যে।

তৃতীয় পক্ষের দেশের কারাবন্দিদের মাঝে প্রথম আশার আলো দেখা দেয় যখন আফগান সরকারের কাছে এর দেখভালের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। আইনত আফগান সরকার আদেশ জারি করলো যে, তারা আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ ছাড়া এভাবে তাদের বন্দি রাখবে না। এতে করে প্রায় ৬০ জনের মতো বন্দিকে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার পথ অনেকটাই সুগম হলো।

পাকিস্তানের একটি আইনি সহায়তা সংস্থা, জাস্টিস প্রটেক্ট পাকিস্তান (জেপিপি), যারা প্রাক্তন বন্দিদের জন্যে কাজ করেছিল, তাদের মতে এই বন্দিদের মধ্যে প্রায় ৪৩ জন ছিলো পাকিস্তানি নাগরিক; যাদের মধ্যে হামিদুল্লাহ খানও ছিল।

জেপিপি আরেকটি নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে কারা-কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বন্দিদের নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা এবং তারা মুক্তিপ্রাপ্তির পরে কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে তার একটি চিত্রও উঠে এসেছে।

এই পাকিস্তানি বন্দিরা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই একটি মামলাতেই ১১ বছর জেল খেটেছে, এর সাথে আমেরিকান এবং আফগান সেনাদের হেফাজতে থেকে জুটেছে শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনা।

‘কালো কারাগার নামে এক জায়গায় তারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। খুব বিপদসংকুল একটা জায়গা ছিলো সেটা। ঠিক কোন সময়ে আমরা ছিলাম, তার ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণাই ছিলো না।’- ২৬ বছর বয়সী হামিদুল্লাহ খান তার করাচির বাসায় বসে তার পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করছিলেন।

‘তারা আমাকে প্রচন্ড মারতো, দেয়ালের সাথে সজোরে মাথা আঘাত করাতো। যখন তারা আমাকে গোসলের জন্যে নিয়ে যেতো তখন প্রহার কিংবা লাথি মারতো।’ তিনি আরো যোগ করলেন।

হালিম সাইফুল্লাহর ঘটনাটি ছিলো আরো মর্মদায়ক। ২০০৫ সালে পারিবারিক ঋণের কিছু টাকা নিয়ে তিনি জাবুলের পূর্বাঞ্চল থেকে করাচির নিজ বাসাতে ফিরে আসছিলেন। ‘তারা আমাকে বন্দুক, বন্দুকের বাট, দড়ি ইত্যাদি দিয়ে আমাকে প্রহার করে। তারা ১০ দিন ধরে এতই মারপিট করে যে, আমি আল্লাহর কাছে দুয়া করছিলাম তিনি যেন আমার মৃত্যু দেন।’- জাবুল অঞ্চলে আমেরিকার সেনাদ্বারা পরিচালিত কারাগারে আফগান সেনাবাহিনী দ্বারা কেমন অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি।

সাইফুল্লাহ বলছিলেন, আমেরিকান সেনাদের হাতে হস্তান্তরের পরে তিনি প্রায় ১০ দিন যাবত নির্ঘুম অবস্থায় ছিলেন। ‘আমেরিকানরা আমাদের ঘুমাতে দিতো না। তারা আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখতো এবং আমার উপরে ঠান্ডা পানি ঢালতো। তারা প্রচুর শব্দ করতো যাতে আমি ঘুমাতে না পারি। তাদের কাছে একটি ধাতব দন্ড ছিলো যেটা তারা আমাদের কক্ষের খাঁচার দন্ডগুলোর সাথে লাগিয়ে জোরে জোরে শব্দ করতো যাতে আমরা ঘুমাতে না পারি’- সাইফুল্লাহ বলে চলেছেন তার অতীত সময়ের কথা।

হামিদুল্লাহ এবং সাইফুল্লাহ বলছিলেন, শারীরিক কষ্ট ছাড়াও তাদের কঠিন অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হতো এবং কারারক্ষীরাও তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতো। একটি কক্ষে ২০ জনের অধিক মানুষ থাকতো। সেখানে এয়ার কন্ডিশনিং এর মাধ্যমে শীতকালে তীব্র শীতের পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতো। একইভাবে, গ্রীষ্মকালে অসহনীয় গরম সৃষ্টি করা হতো। ‘এতটাই ঠান্ডা ছিলো যে, মনে হতো তা যেনো আমার হাড়ে গিয়ে আঘাত করছে’- হামিদুল্লাহর ভাষ্য।

প্রাক্তন কারাবন্দিরা আল-জাজিরাকে বলছিল যে, বন্দিদের মধ্যে কেউ যদি অভিযোগ করতো তবে তাদেরকে বিধি-নিষেধ সম্বলিত একটি রিপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে নিঃসঙ্গ-একাকী একটি কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, যেই কক্ষটি একটি সাধারণ কফি টেবিলের চেয়ে খুব একটা বড় নয়। এ ধরনের নিয়মের নাম দিয়েছিল তারা ‘সেগ্রেগেশান’ বা এক ঘরে করে দেওয়া। ‘তারা আমাদের ৪০ থেকে ৪৫ দিনের জন্যে এক ঘরে করে রাখত। সর্বনিম্ন সময় ছিলো অন্তত ২৮ দিন।’- সাইফুল্লাহ বললেন।

আফগান ভূমিতে গ্রেফতার অপারেশন চালানোর সময় ২০১৩ সালের আমেরিকান প্রতিরক্ষা বিভাগের স্মারকলিপি অনুযায়ী, আমেরিকান সেনাবাহিনীর নিয়ম হলো ৩০ দিনের বেশি কোনো বন্দিকে এক ঘরে করে রাখা যাবে না।

নেই কোনো আশ্রয়, কোনো আশাও আর অবশিষ্ট থাকলো না

সাইফুল্লাহ, হামিদুল্লাহ এবং ফজল করিম নামক আরেকজন পাকিস্তানী বন্দি সবার কন্ঠে একই কথা। ফজল করিম বলছিল, ২০১৪ সালের মুক্তি পাওয়া এবং নিজ দেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তিনি জানতেনই না তাদের অধিকার-ই বা কি কিংবা কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল।

হামিদুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি জানতেন কোন আইন বা নিয়মের বলে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, জবাবে তিনি বলেন, ‘সেখানে যেন কিছুই ছিল না। তারা আমাদের মুক্তির ব্যাপারে কিছুই বলতো না কিংবা এই ব্যাপারে আমাদের নিজেদের মাঝেও কোনো চিন্তা আমাদের মনে আসতো না।’

পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশের প্রাক্তন কারাবন্দিদের যেসব আইনজীবী প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তারা বলেছেন- ২০০১ সালের নভেম্বরে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন, যার মাধ্যমে শত্রুভাবাপন্ন যোদ্ধাদের কোনো অভিযোগ ছাড়াই আমেরিকা আটক করতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে বন্দিরা অল্প কিছু সুবিধা ভোগ করতে পারবে। অথবা, বুশ কোনো রুল জারি করেননি কীভাবে বন্দিদের সাথে আচরণ করা হবে (এর ফলে বন্দিদের সাথে স্বেচ্ছাচারিতার দ্বার পরোক্ষভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো)।

পাকিস্তান কেন্দ্রিক সংস্থা জেপিপির নির্বাহী পরিচালক সারাহ বেলাল সেই দলিল থেকে নেওয়া আইনী স্মারকলিপি এবং নীতিকে আইনের হাত গলে বের হয়ে যাওয়া এক হাস্যকর প্রহসনের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং আন্তর্জাতিক সংঘাত আইন সুনিশ্চিতভাবে এই পর্যায়ে এসে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’ সকল আশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং এতে আপোস করা হয়েছে।

আফগানিস্তানের যুদ্ধকে ‘অ-আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাত’ নামে অবহিত করায়, জেনেভা চুক্তির বড়ো একটা অংশই আমেরিকার তথাকথিত ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’তে ধরা পড়া বন্দিদের জন্যে তা প্রযোজ্য হয় না। এর মধ্যে সেসব এলাকাও আছে যারা ন্যায্য অধিকার, নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিকভাবে কারাগারে বাসযোগ্য সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।

এর মাধ্যমে বন্দিরা প্রথমবারের মতো তাদের বন্দিত্বের এত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো শুনতে পেলো তাদের বিরুদ্ধে আসলে অভিযোগটা কী ছিল। এটা সেসময় সম্ভব হয়েছিল, যখন তাদেরকে আমেরিকান সেনাদের মাধ্যমে গঠিত, আটককৃতদের বন্দিবস্থার সামগ্রিক বিষয় যাচাই-বাছাই করার জন্যে গঠিত বোর্ড [ডিটেইনি রিভিউ বোর্ড] এর সামনে উপস্থাপন করা হল। এখানে তাদের নির্দোষ প্রমাণের একটা সুযোগ দেওয়া হলো।

হামিদুল্লাহ খান বলেন, ‘আমার গ্রেফতারের চার বছর পরে, এক ডিআরবি চলাকালীন আমাকে জানানো হলো যে, আফগান সেনারা আমেরিকান সেনাদের বলেছে আমাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।’

হামিদুল্লাহ খান অভিযোগ করে বলেন যে, স্থানীয় অনুবাদকারীরা একটি লিখিত পত্রকে ভুলভাবে অনুবাদ করে এবং তুলনামূলকভাবে আগেই তার আটকাদেশে সই করে দেন। পত্রটি লিখা হয়েছিলো পাকিস্তানি পশতু ভাষাতে, যা আফগানিস্তানের প্রচলিত পশতু থেকে ভিন্ন একটি উপভাষা।

‘যখন আমরা বলতাম যে, আমরা কিছু করিনি, (অনুবাদকারীরা) বলতো যে, আমরা দোষ স্বীকার করছি। আমি যা লিখেছি, সে তা অনুবাদ করতো এভাবে যেন আমি নিজেই স্বীকার করছি আমি যুদ্ধক্ষেত্রে গ্রেফতার হয়েছি।’- হামিদুল্লাহ খান বললেন।

২০১১ সালে শেষপর্যন্ত হামিদুল্লাহ এমন একজন অনুবাদকের দেখা পেলেন যিনি কিনা তার উপভাষাতেই কথা বলে। সেই অনুবাদক পরে আমেরিকান কর্তৃপক্ষকে বলেন যে, হামিদুল্লাহর স্বীকারোক্তি ইংরেজিতে সঠিকভাবে পূর্বে অনূদিত হয়নি।

এটা এমন একটা সময়ের ঘটনা, যখন ইতোমধ্যে হামিদুল্লাহ তিনছর কারাযাপন করে ফেলেছে এবং এর মধ্যে আমেরিকান সেনাবাহিনীদের দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদের কবলেও পড়েছে। আর এর সবটাই হয়েছিল তার আগের দেওয়া (ভুল অনুবাদকৃত) দলিলের উপর ভিত্তি করে, যেখানে সে স্বীকার করে নিয়েছিল সে আফগান তালিবানের সদস্য।

নয় বছর জেল-খাটা সাইফুল্লাহও ভুল অনুবাদের ফলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি জানিয়েছে।

‘শুরুর দিকে আমরা জানতাম না, আমাদের ফাইলে কী আছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমরা কিছু বিষয় অস্বীকার করতাম তবে অনুবাদকারী বলতো যে আমরা দোষ স্বীকার করেছি।’- সাইফুল্লাহ বললো।

সারাহ বেলালকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এইসব নিয়ম সাইফুল্লাহ বা হামিদুল্লাহর মুক্তির ব্যাপারে কোনো সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল কিনা। তিনি জানালেন, আমেরিকার অধীনে আটককৃতদের জন্যে এসব নিয়ম প্রযোজ্য নয়। ‘এখানে কোনো আইনি প্রক্রিয়া নেই। কিছুই নেই। এটি কোনো আদালত নয়। এখানে কোনো নীতি-নৈতিকতাও নেই’- বলছিলেন সারাহ বেলাল।

বাগরামে আটককৃত বন্দিদের মধ্যে যারা তৃতীয় পক্ষের দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্বকারী, তাদের মাঝে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন আইনজীবিও একই সুরে বললেন যে, অস্পষ্ট এবং অন্যায় একটি প্রক্রিয়া এটি।

সেই আইনজীবি আরো বলেন, ‘যখন আমেরিকার মাধ্যমে বন্দিরা আটক হলো, তাদের কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা হলো না। কোনো শুনানি ছাড়াই তাদের আটক করে রাখা হলো।’ এটা আসলেই পরিষ্কার না কাউকে আটক বা ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকান সেনারা কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। অনেকের মতে, যদি কোনোভাবে কারো মুক্তির ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়েও যায়, তথাপি এর বিনিময়ে অর্থ পরিশোধ করা লাগে।

জেল থেকে বেরিয়ে দরিদ্রতার কবলে

হালিম সাইফুল্লাহর বর্তনাম বয়স ৩৫। তার পোশাকে ঘামের দাগ লেগে আছে। তার সম্পত্তি বলতে আছে দুই কক্ষের একটি বাসা আর এতে ছোটো একটি বিছানা। এইটাও আবার করাচির মেট্রোভিল এলাকার একটি অবৈধভাবে স্থাপিত বসতি।

মুক্তি পাওয়ার পরও হালিম সাইফুল্লাহ তার কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারছেন না। ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। আত্নহত্যার কথাও বিবেচনায় এনেছিলেন তিনি।

‘ফিরে আসার পরে আমি রিকশা চালিয়েছি, পুশ কার্ট ঠেলেছি, কখনও একাজ-কখনও ওকাজ করে আমার জীবিকা নির্বাহ করেছি। কিন্তু, আমি বর্তমানে ফোর্থ স্কেজিউলের (Fourth Schedule) আওতায় আছি। তাই তারা আমাকে যেকোনো সময় ডেকে পাঠাতে পারে। তারা সার্বক্ষণিক আমার মোবাইলের লোকেশান ট্র্যাক করছে। এভাবে একজন মানুষের পক্ষে কাজ করা কঠিন।’

এই Fourth Schedule হলো পাকিস্তানের এন্টি-টেরোরিজম এক্ট (সন্ত্রাস প্রতিরোধ আইন) এর একটি অংশ, যার মাধ্যমে পুলিশকে এমন একটি সক্ষমতা দেওয়া হয় যাতে করে সে যেকোনো সময় আটক, জিজ্ঞাসাবাদ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সাথে যুক্ত সন্দেহে কারো চলাচলে বাঁধা প্রদান করতে পারে। ২০১৪ সালে বাগরাম থেকে পাকিস্তানে ফিরে আসা অধিকাংশ বন্দিদের এই Fourth Schedule এর অধীনে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে আবার অনেকে কয়েক মাস থেকে শুরু করে তিন বছর পর্যন্ত কারাভোগ করেছে।

কোনো অভিযোগ ছাড়াই এই মাসেই সম্প্রতি সাইফুল্লাহ কারাগারে ছয়দিন কাটিয়ে এসেছে। করাচিতে সশস্ত্র বাহিনীর হুমকির পরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ ধরনের আটকাদেশ তার কাছে অনেকটা রুটিনের মতো হয়ে গিয়েছে। এর ফলে কোনো স্বাভাবিক চাকরি জোগাড় করা তার জন্যে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

অন্যান্য প্রাক্তন বন্দিরাও বলেছেন, এভাবে চালিয়ে যাওয়াটা আসলেই কষ্টকর। কারণ যেকোনো মুহূর্তেই পুলিশের কাছে রিপোর্ট করার জন্যে ডাক চলে আসতে পারে। হামিদুল্লাহ খান বলেন, তার ছয় সদস্যের পরিবার সামলানোর চেয়েও বেশি পীড়াদায়ক হলো বাগরাম থেকে নিয়ে আসা কষ্টগুলো। তিনি প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখেন। তিনি প্রায়সময় ভুলে যান, তিনি কী করছেন, কোথায় আছেন, কেনোই বা সবকিছু হচ্ছে। ফিরে আসার কিছু সময় পরে তার পিতা মারা যান, যা তার অন্তরকে বেশ ঝাঁকুনি দেয়। তার বাবা নিজেই মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবারের দেখভাল করতেন।

সাইফুল্লাহর বয়স যখন মাত্র ১৫ তখন তিনি গ্রেফতার হন। আর বর্তমানে এসে তিনি তার অভিজ্ঞতা এভাবে বর্ণনা করছেন যে, ‘আমি এর আগে কখনই জানতাম না চিনির দাম কত, ময়দার দাম কত। একটা পরিবারকে সামলানো বেশ বড়ো একটা দায়িত্ব বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। আমার এখন সকলকেই দেখভাল করতে হয়। পুরো বাড়ি আমাকেই চালানো লাগে। আমি প্রায়ই ভাবি, হয়তো বাগরামে থাকাটাই আমার জন্যে ভালো হত, যেখানে আমার একটা নির্দিষ্ট জীবন-যাপনের রীতি গড়ে উঠেছিল।’

নয় বছর পরে জেল থেকে মুক্তির পরে সাইফুল্লাহর কাছে একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে সমাজে মানিয়ে নেওয়াটাই বরং এখন বেশ অস্বাভাবিক লাগে। বাগরাম থেকে মুক্তির কয়েক মাস পরে তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি চিৎকার করে উঠি, দারোয়ান! আমাকে পানি দিয়ে যাও। তখন আমার পরিবারের সদস্যরা হেসে উঠে এবং বলে যে, তুমি এখন বাগরামে নেই। তুমি বাসায় আছো।’ রাতের বেলা তিনি বাগরাম নিয়ে স্বপ্ন দেখেন।

‘মাঝে মাঝে আমি যখন ঘুমাই, আমি স্বপ্ন দেখি আমি বাগরামে আছি। আর সেটাই আমার বাড়ি। এটা খুবই আশ্চর্য লাগে। এর সব স্মৃতি আমার সাথে অনেক দিনের জন্যে থেকে গিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যেনো স্বপ্ন দেখছি। এর কোনো কিছুই সত্য নয়।’- সাইফুল্লাহ বলে চলেছেন।

অন্যদের জন্যে বাগরাম তাদের জীবনের আরো বড় কিছু কেড়ে নিয়েছে। করিমের ছোটোভাই ফজল নাইম বলছিলেন, ‘বাগরামে যাওয়ার আগে করিমের জীবন বেশ ভালোই কাটছিল। যখন সে ফিরে আসলো, তখন অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ ছিল। আর বর্তমানে তার মানসিক অবস্থা আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়ে গেছে।’

করিমের কথাগুলো যেনো জড়িয়ে পড়ছিল, তিনি এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে কথা বলছেন এবং নিজে নিজে আবার তা পুনরাবৃত্তি করছেন। কথা বলার সময় তিনি তামাক চিবুচ্ছিলেন, বলছিলেন কীভাবে তিনি সবকিছু ভুলে যেতে চান। আবার পরমুহূর্তেই বলছেন, তাকে কীভাবে অপদস্থ করা হয়েছিল অথবা কীভাবে তিনি জেল থেকে পালাতে চেয়েছিলেন।

করিমের ভাই নাইম তার পাশেই বসা ছিল। তিনি লক্ষ্য রাখছিলেন, করিম হঠাৎ করেই কোনো সহিংস্র আচরণ করে বসেন কিনা।

তিনজন প্রাক্তন কারাবন্দির জন্যেই একটি নির্দিষ্ট চাকরি জোগাড় করাটাই দীর্ঘস্থায়ী একটি সমস্যা বলে মনে হচ্ছে।

সাইফুল্লাহ বসেছিলেন তার সবুজ রঙের দেয়াল থেকে রঙ ঝরে পড়া জীর্ণ রুমটিতে। তিনি বলছিলেন, মুক্তির পরে কীভাবে ৩০০,০০০ পাকিস্তানি রুপিরও (১৯০০ ইউএসডি) বেশি ঋণ তাকে পরিশোধ করতে হয়েছিল।

ফিরে আসার পরেই তিনি বিয়ে করেন এবং চার সন্তানের পিতা হন। তাদের প্রত্যেকেই চিকিৎসার অভাবে মারা যায়, যেহেতু তার সেই ব্যয় বহন করার ক্ষমতা ছিলো না। ‘আমরা হয়তো স্বাধীন, কিন্তু আসলে আমরা এখনও বন্দি হয়ে আছি। আমাদের জীবনে কেবল আছে দুশ্চিন্তা। মাঝে মাঝে মনে হয়, এখন হয়তো বাগরামে থাকলেই জীবনটা ভালো উপভোগ্য হত।’- সাইফুল্লাহ বললেন।

আল-জাযিরা ইংলিশ থেকে অনূদিত।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড