• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া ৫ গুপ্তহত্যা

একটা গুপ্তহত্যায় যখন প্রাণ হারায় দেড় কোটি মানুষ!

  এস এম সোহাগ

২২ জুলাই ২০১৯, ১৬:২৮
গুপ্তহত্যা
সহকর্মীদের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম বিখ্যাত শাসক জুলিয়াস সিজার। ছবি : সংগৃহীত

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট, একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কাছ থেকে যে কৌশলে তাদের প্রাণের নেতা, তাদের স্বপ্নকে কেড়ে নিয়ে, কয়েক দশক পেছনে ফেলে দিয়েছিল, সেই কৌশলই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বা গুপ্তহত্যা বলে পরিচিত। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যার প্রভাব যেকোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ডের থেকে অনেক বেশি হয়ে ওঠে। গেল শতকের এই গুপ্তহত্যার কারণেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগে যায়, একজনকে হত্যার কারণে প্রাণ হারায় দেড় কোটি মানুষ। বিশ্বে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ গুপ্তহত্যা ঘটেছে যা বিশ্বে চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে।

আজকের ইরান, ১২শ শতকের তৎকালীন পার্সিতে একদল ভাড়াটে খুনী যে ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন, তার মূল কারণ হচ্ছে গুপ্তহত্যা। পার্সির হাসান-আই-শাবাব, যার নামের সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের খুব একটা পরিচয় নেই বললেই চলে। যেসব গুপ্তহত্যা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, বিশ্বের মহান মহান নেতারা যে কৌশলে প্রাণ হারিয়েছেন, সেই গুপ্তহত্যার প্রচলনটা তাকে হত্যার মাধ্যমেই হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন। হাসানের আগের গুপ্তহত্যাগুলো ব্যক্তিগত কারণে ঘটলেও এই হত্যাকাণ্ড যেন অন্য কিছু ছিল। বিশ্বকে তাক লাগানো এমন ৫টা হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিবন্ধটি লেখা হবে।

জুলিয়াস সিজার

প্রাচীন রোমে রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই রক্তপাত খুব সাধারণ ছিল। প্রাচীন রোমের এই রক্তপাতের ধারা হ্রাসের পেছনের মানুষটাকে চড়া মূল্য দিয়েই এমন হয়েছিল।

একদা রোমে সামান্য শত্রুতার জেরেই রক্তপাত ঘটত, সে সময়ের মানুষের জীবন ছিল ক্ষণস্থায়ী। শত্রুপক্ষের প্রতিহিংসা, এমনকি বন্ধু-পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে খুন করানো হতো, কোনো ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষই খুন করত। তবে, ৪৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ১৫ই মার্চ জুলিয়াস সিজারের হত্যাকাণ্ড যেন অতীতের সব ধরনকে পাল্টে দেয়।

ছবি : সংগৃহীত

সিজারের ৬০ সহকর্মী মিলে সিনেটে হামলা চালায়, সিজারের দেহে নির্মমভাবে ২৩ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল, যার মধ্যে একটা ক্ষত ছিল মারাত্মক। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড রোমে এক মারাত্মক বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। কুখ্যাত গুপ্তহত্যার মধ্যে এটিই প্রথম বলে বিবেচনা করা হয়, যার প্রভাব ছিল ধারণাতীত।

আর্কডিউক ফার্দিনান্দ

বিংশ শতকের শুরুর দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া ইউরোপে অতি সামান্যই আগ্রাসনের চিহ্ন ছিল, তবে ইউরোপের অবস্থা ভঙ্গুর ছিল। ১৯১৪ সালে, নরকের সব দরজা খোলার জন্য সঠিক দিকে সামান্য একটা ধাক্কারই প্রয়োজন ছিল, আর সেই ধাক্কাটা লেগেছিল তৎকালীন প্রভাবশালী অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান শাসক ফার্দিনান্দের ওপরে।

কনিষ্ঠ বয়সেই অস্থির অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের সিংহাসন বসেছিলেন আর্কডিউক ফার্দিনান্দ, সে সময়ের রাজনীতিতে তার শক্তিশালী প্রভাব ছিল। ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন, তরুণ বসনিয়ার স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী আন্দোলনের মাত্র ১৯ বছর বয়সী এক যুবকের চালানো গুলি যে বিশ্বকে ঠেলে দিবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে তা কেউ আঁচ করতে পেরেছিল না সে সময়ে।

ছবি : সংগৃহীত

সারাজেভো শহরে মধ্যাহ্নভোজে যাওয়ার সময় ফার্দিনান্দকে গুলি করে হত্যা করে গাভরিল প্রিন্সিপ নামের কুখ্যাত আততায়ী। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গুলিটি চালিয়ে শাস্তি এড়িয়ে গিয়েছিল প্রিন্সিপ, টিবি আক্রান্ত হয়ে সে মারা গেলেও তার একটা পাগলামিতে বিশ্ব প্রথম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের পরিণতি হিসেবে পরবর্তীকালে বিশ্বে এমন কিছু ঘটে যায়, যার জন্য কেউই কখনো প্রস্তুত ছিল না। ফার্দিনান্দের গুপ্তহত্যার দু-মাসের মাথায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়, যে যুদ্ধে অন্তত দেড় কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল।

মাহাত্মা গান্ধী

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতির জনক মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীও শিকার হয়েছিলেন গুপ্তহত্যার। ১৯০ বছরের দীর্ঘ পরাধীনতার হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের মাত্র ৬ মাস যেতে না যেতেই এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী উন্মাদের হাতে খুন হয়েছিল দেশটির স্বাধীনতার নায়ক। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লির বিরলা হাউজে পূজার বৈঠকের সময় গান্ধীকে ৩ বার গুলি করে নথুরাম গডসে।

ছবি : সংগৃহীত

ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাগের সমর্থনে উগ্র এই হিন্দুত্ববাদী গডসের কি ধারণা ছিল যে, তার এমন এক জঘন্য কাজের প্রভাব আজও ভারতকে বয়ে বেড়াতে হবে। ব্রিটিশরা উপমহাদেশকে ভারত-পাকিস্তানে বিভক্ত করে দিয়েছিল। ভারতে সহনশীলতার দাবিতে গান্ধী যে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল, সেই পরিবর্তন আর আসেনি ভারতে। গান্ধীর গুপ্তহত্যার পর ভারতের সমাজে কী প্রভাব পড়তে পারে গডসের ধারণায় তা কোনোদিন এসেছিল কি না জানা নাই, তবে এর প্রভাবে আজও ভারত ক্ষতবিক্ষত, তা স্পষ্ট।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

ভারতে পরিবর্তন আনতে গান্ধী যেমন কর্তৃপক্ষকে নিরবচ্ছিন্ন সহনশীলতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তেমন একজন ব্যক্তি কৃষ্ণাঙ্গদের সমানাধিকারের জন্য কঠোর সংগ্রাম করছিলেন। বর্ণের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করা হয়েছিল সেই অনেক আগেই, কালো মানেই যেন দাস আর সাদারা প্রভু। কৃষ্ণাঙ্গদের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দাস বানিয়ে রাখা হয়েছে, এখনও বর্ণবাদ নির্মূল হয়নি। তবে, এর মাত্রাটা কমিয়ে আনার পেছনে যে মানুষটার নাম জড়িত, সেও প্রাণ হারিয়েছিল আততায়ীর হাতে।

বিশ্বে কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে জনপ্রিয় এক নাম মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, কালোদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উকিল বলা হয় তাকে। গেল শতকের শেষার্ধে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী বিক্ষোভ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল, বেপরোয়া কালোদের যেন থামাতেই পারছিল না মার্কিন প্রশাসন। তবে, সেই কালোদের কাছে একজনের আওয়াজ পৌঁছাত, বিক্ষোভের সর্বত্র মার্টিনের কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ত।

ছবি : সংগৃহীত

১৯৬৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল বিশ্বের সর্বকালের সেরা ক্যারিশমাটিক বক্তা মার্টিন লুথার কিং-কে হত্যা করা হয়। যার কাঁধে ছিল বিশ্বে কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব, সেই কাঁধে রাইফেল দিয়ে চালানো হলো গুলি, গুলি খেয়ে ড. কিং জেমস আর্ল রে-এর হাতে লুটিয়ে পড়ে। টেনেসের মেম্ফিসে কালোদের অবিসংবাদিত নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর হত্যাকাণ্ড চাপিয়ে রাখা যায়নি।

এই গুপ্তহত্যা সমগ্র আমেরিকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ে প্রাণ হারানো বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম জাদুকরী এই নেতাকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যায় মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গরা। দেশজুড়ে তাণ্ডব চালায় তারা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মার্টিনকে মারা হয়েছে বলে একাধিক গুজবও প্রতিষ্ঠিত। তবে, যথার্থ প্রমাণের অভাবে এখনও এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি।

জন এফ কেনেডি

মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম লজ্জার ইতিহাস, কেনেডি হত্যাকাণ্ড। যেকজন প্রেসিডেন্টকে মার্কিনরা মনে রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন জন এফ কেনেডি। ১৯৬১ সালে দায়িত্বগ্রহণ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের, মাত্র দুই বছরের মাথায় এক সমাজতান্ত্রিক আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি, সংক্ষেপে জে এফ কে।

দিনটি ছিল শুক্রবার, ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস শহরে এক মোটর শোভাযাত্রায় স্ত্রী জ্যাকুলিন কেনেডিকে নিয়ে খোলা লিমোজিনে করে অংশ নিয়েছিলেন কেনেডি। তাদের গাড়িটি ডিলে প্লাজা অতিক্রমের সময় দুটি বুলেট সরাসরি প্রেসিডেন্ট কেনেডির গলা ও মাথায় আঘাত হানে।

ছবি : সংগৃহীত

স্নাইপার দিয়ে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মাত্র ৪৬ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কম বয়সী ও সুদর্শন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করেছিল লি হার্ভি অসওয়াল্ড নামের সাবেক মার্কিন এক মেরিন কর্মকর্তা। ঠিক কী কারণে কেনেডিকে হত্যা করল লি, তা জানার আগেই কেনেডি হত্যার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই জ্যাক রুবি নামের একজন লিকে গুলি করে হত্যা করে।

কেনেডি হত্যার ৫৬ বছর পার হয়ে গেলেও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে ঘটনাটা। সিআইএ একাধিকবার নানান নথি প্রকাশ করে কেনেডি হত্যার সুরাহা করতে চাইলেও সফল হয়নি এখনও। কেনেডি স্নায়ুযুদ্ধের একদম উত্তপ্ত সময়ে ক্ষমতায় এসেছিল, আর সে কারণেই তার গুপ্তহত্যার পেছনে কেজিবি জড়িত থাকার দাবি করা হয় অনেক তদন্তে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড