• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জাগরণ

জয় শ্রীরাম ও মোদীর ভারত : হিন্দুর ভজন যেখানে মুসলিম হত্যার হাতিয়ার

নারায়ে তাকবীর বললেই জঙ্গি, জয় শ্রীরামে কেন নয়?

  এস এম সোহাগ

১০ জুলাই ২০১৯, ১৮:০১
জয় শ্রীরাম স্লোগান
ভারতের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট সতীশ আচার্যের কার্টুনে বর্তমান ভারতের স্পষ্ট সাম্প্রদায়িক উগ্রতার চিত্র।

গত মাসে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া ভারতের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডে উগ্র হিন্দু পুরুষের দল এক মুসলিম যুবককে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পেটাচ্ছে। তাদের কাছে রক্ত ঝরা মুখে কাঁদতে কাঁদতে ২৪ বছর বয়সী তাবরেজ আনসারী নিজের জীবন ভিক্ষা চাইছে।

ভিডিওতে উগ্র হিন্দুদের দলটি বারবার তাকে 'জয় শ্রীরাম' বলতে জোর করতে দেখা যায়। আনসারী তাদের কথামতো কাজ করেও ছিলেন, তবুও তারা তাকে মেরেছে। একসময় যখন কান্ত হলো, আনসারীকে তখন তারা পুলিশে সোপর্দ করে দিলো। পুলিশ তাকে হাজতে বন্দি করে পরিবারের সঙ্গে দেখাও করতে দেয়নি। হামলার আঘাত নিয়ে চারদিন পর আহত অবস্থায় ই মরে যায় মুসলিম যুবক আনসারী। আনসারীর জীবন কেড়ে নিয়েছে ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক আচরণ।

উপমহাদেশের রাজনীতির সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা অনেক আগে থেকেই ওতপ্রোত জড়িত। ধর্মকে কেন্দ্র করে বাংলা হয়েছে দ্বিখণ্ডিত, সেখান থেকে জন্ম নিয়েছে এক স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের। তবুও, সাম্প্রদায়িকতা অবসান কী ঘটেছে? এ কথা এখন আর চিন্তা করে বলতে হয়না, আমাদের চারপাশে মনস্তাত্বিক সাম্প্রাদায়িকতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে সহিংস সাম্প্রদায়িকতা এখন দিবালোকের মতো উজ্জ্বল।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান এখন অনেক উর্ধ্বে, বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতার মন্ত্র নিয়ে চলা ভার‍ত এখন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এক তীর্থভূমি। দেশটির সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে পরিচিতি পাওয়া 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান বহুত্ববাদী সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে সহিংস উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করছে এখন।

দেশটির সাংবাদিক মালবী গুপ্ত এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, 'বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি শব্দগুলি শুনতে বেশ লাগে। আরো ভাল লাগে তা উচ্চারণ করতে। কারণ 'ভারতীয় ঐতিহ্য'র সঙ্গে শব্দগুলি নাকি ওতপ্রোত জড়িত। এবং দেখছি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই 'ঐতিহ্য'র কথাই দেশের জনসাধারণ ও দেশের শাসকদের সম্প্রতি বার বার যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

এই কারণে কি যে, দেশের শাসকগণ ও দেশবাসী এখন সেই 'ঐতিহ্য'র প্রতি খানিক পরাঙ্মুখ? কিন্তু আমার তো মনে হয় ‌ওই ভাল লাগা শব্দগুলির সঙ্গে একেবারে হাত ধরাধরি করেই চলেছে সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, অস্পৃশ্যতা, পরমত অসহিষ্ণুতা (সে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক যাই হোক) ইত্যাদির মতো মন্দ শব্দগুলিও। যাদের অস্বীকার করবার জো নেই। যাদের কোনো নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় এড়িয়ে যাওয়ারও উপায় নেই।

প্রায়ই দেখছি ভিন জাতে বা ভিন ধর্মে বিয়ে করলে বা বন্ধুত্ব করলে পরিবারই এগিয়ে এসে তাদের শাস্তি দিচ্ছে। এবং পারিবারিক সম্মান বাঁচানোর নামে নব দম্পতিকে সে নিজেদের ছেলে মেয়ে যেই হোক, খুন করে বসছে।

জয় শ্রীরাম না বলায় নির্যাতিত মুসলিমদের প্রতিবাদ। ছবি : সংগৃহীত

দেখছি জাতিসংঘের হিসেব বলছে, এই 'অনার কিলিং' সারা পৃথিবীতে যত হয়, তার প্রতি পাঁচটির একটিই না কি ঘটে ভারতে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো'র পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে ২০১৪ - ২০১৫ এই এক বছরেই ভারতে 'অনার কিলিং' বেড়েছে ৭৯৬ শতাংশ।

এখন তো সরাসরি রাস্তাঘাটেই মুসলিমদের ওপর হামলা চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী উগ্র ভারতীয় দল। আর এক্ষেত্রে হাতিয়ার করা হচ্ছে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগানকে। বিবিসির ভারতীয় সাংবাদিক গীতা পাণ্ডে বলেন, অভিবাদন জানাতে জনপ্রিয় দেবতা রামের নাম নেয়া ভারতের বিভিন্ন অংশের উগ্র হিন্দুরা এখন মানুষ হত্যায় ব্যবহার করছে। সম্প্রতি দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে।

ভারতের এই বর্বর সাম্প্রদায়িকতার শিকার শুধু আনসারী একাই না। জুন মাসে দেশটির মুসলিমদের ওপর এই জয় শ্রীরাম স্লোগান যেন এক মহাকাল হয়ে নেমে আসে।

দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসামের বারপেটা জেলায়, একদল মুসলিম তরুনদের ওপর হামলা করে হিন্দুরা এবং তারপর তাদেরকে 'জয় শ্রী রাম', 'ভারত মাতা কি জয় এবং 'পাকিস্তান মুর্দাবাদ বলতে বাধ্য করা হয়।

দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের একদল উগ্র হিন্দু 'জয় শ্রীরাম' বলানোর জন্য ২৫ বছর বয়সী মুসলিম ট্যাক্সি চালক ফায়জুল উসমান খানের ওপর বর্বর নির্যাতন করে, করা হয় মারধর। ফায়জুলের এক যাত্রী পুলিশকে খবর দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার পূর্বাঞ্চলীয় শহরে ট্রেনে যাত্রার সময় মাদ্রাসা শিক্ষক হাফিজ মোহাম্মদ সাহরুখ হালদারকে জয় শ্রীরাম না বলায় চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। ভারতীয় হিন্দুদের নির্মম এই গল্প জানানোর জন্য সাহরুখ সেদিন বেঁচে গিয়েছিল।

পোশাক ও দাড়ি নিয়ে তারা মজা করছিলেন বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান। এরপরে, তারা এই মাদ্রাসা শিক্ষককেও জয় শ্রীরাম উচ্চারণ করতে নির্দেশ দেয়, যখন তিনি বলতে অস্বীকৃতি জানায় তখন তারা তাকে ধাক্কা মেরে চলন্ত ট্রেন থেকে নিচে ফেলে দেয়।

ছবি : সংগৃহীত

জয় শ্রীরাম স্লোগান নিয়ে চেঁচামেচি-হামলা কেবল সাধারণ ভারতীয়দের রাস্তাঘাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। উদ্বগের বিষয় হলো, এই স্লোগান এখন দেশটির সংসদ ও সাংসদদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে।

গত ১৭ই জুনে দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষে নবনির্বাচিত সাংসদদের অধিবেশনেও জয় শ্রীরাম তাণ্ডব চলেছে। সংসদে মুসলিম ও বিরোধী দলের সাংসদরা শপথ নিতে গেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সদস্যরা জয় শ্রীরাম বলে চেঁচামেচি শুরু করে।

সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ফের ক্ষমতায় আসে, এবং এবার আরও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই নির্বাচনে জয়লাভ করে। জনসংখ্যায় বিশ্বে ২য় বৃহত্তম দেশটিতে প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, অর্থাৎ ১০০ কোটির বেশি হিন্দুদের বাস ভারতে। যার ফলে নির্বাচনে জিততে শুধুমাত্র হিন্দুদের ভোটই দরকার ছিল মোদীর।

২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার মুখ্যমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি যে ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ধর্ষণ করে হিন্দুত্ববাদের মন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে, তা বলাটা খুব ভুল হবেনা। দ্বিতীয়বার মোদী ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে।

সংখ্যালঘুদের ওপর এমন সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা জানিয়েছে দেশটির বিরোধী নেতারা। উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলের হামলায় তাবরেজ আনসারির নির্মম মৃত্যু ভারতের 'মানবতায় কলঙ্ক' এঁকে দিয়েছে ব্যাখ্যা করে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন রাহুল গান্ধী।

এই ধরনের ঘটনাগুলির ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সম্পর্কে দেশটির বিখ্যাত কার্টুনিস্ট সতীশ আচার্যসহ অনেকেই সতর্কতা প্রকাশ করেছেন।

উত্তর ভারতের গ্রামজুড়ে হিন্দুরা ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে 'রাম রাম', 'জয় সীতা রাম' (রামের স্ত্রী দেবী সিয়া বা সিতা) বা 'জয় রাম জি কি'কে অভিবাদন হিসাবে ব্যবহার করেন। দেবতা রামের ন্যায়বিচার ও উদারতার চিহ্ন হিসেবে লক্ষ লক্ষ হিন্দুরা যে নাম নেয়, সেই নামকে ব্যবহার করে এমন হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটনো হচ্ছে। জয় শ্রীরাম এখন এমন এক স্লোগানে পরিণত হয়েছে যা দেশটির সংখ্যালঘুদের ভয় দেখানো এবং হুমকির প্রতিরূপ।

জয় শ্রীরাম কীভাবে সাম্প্রদায়িক হাতিয়ার হয়ে উঠলো?

১৯৮০ সালে ভারতের বিতর্কিত স্থান অযোধ্যায় একটি রাম মন্দির নির্মাণে আন্দোলন চলাকালীন এক সমাবেশে বিজেপি জয় শ্রীরাম' স্লোগানকে প্রথম রাজনৈতিক চেতনা হিসেবে ব্যবহার করে। বিজেপির তৎকালীন সভাপতি এল কে আদভানি মন্দির নির্মাণের সমর্থনে একটি মিছিল চালু করেছিলেন।

জয় শ্রীরাম ভজনের শিকার নিরপরাধ ভারতীয় মুসলিমরা। ছবি : সংগৃহীত

১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে এই স্লোগান উচ্চারণ করতে করতে বাবরি মসজিদের দিকে যাত্রা করে। ষোড়শ শতকে সম্রাট বাবরের নির্মিত মুসলিমদের নিকট পবিত্র বাবরি মসজিদে হামলা করে এবং ঐতিহ্যবাহী মসজিদটিকে ভেঙ্গে ফেলে। বিজেপি বিশ্বাস করে যে, মসজিদটি যেখানে নির্মাণ করা হয়েছিল সেখানে একদা রাম মন্দির ছিল।

এভাবেই বিজেপির হাত ধরে ভারতে জয় শ্রীরাম স্লোগানের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে, যা এখন দেশটির মুসলিমদের জীবনে এক অচিন্তনীয় হুমকি বয়ে এনেছে।

রামকে ব্যক্তিগত থেকে রাজনৈতিক রূপে পরিণত করে বিজেপি হিন্দু ভোটারদের মন জয় করেছিল। তারপর থেকেই, দলটি নির্বাচনের সময় ধারাবাহিকভাবে এই স্লোগান প্রচার করে আসছে এবং ২০১৯ সালের নির্বাচন ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর সংসদের ভেতরে ও বাহিরে আক্রমণ করার পলিসি নিয়েই বিজেপি সর্বশেষ নির্বাচনে ৫৪৩টি সংসদীয় আসনের ৩০০টির ও বেশি পেয়ে টানা ২য়বারের মতো জয়লাভ করে।

মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপির প্রথম মেয়াদেও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নজরে আসে। হিন্দুত্ববাদীরা গো-রক্ষার নামে মুসলিমদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায়। গরু পাচার, গো-মাংস ভক্ষণের অভিযোগ এনে এখানে সেখানে মুসলিমদের হত্যা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী এই ধরনের হামলার কোন নিন্দা তখন করেননি, বরং হামলাকারীদের নিন্দাকারীর সমালোচনা করেছিলেন।

যার মাধ্যমে মোদীর সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক কৌশল স্পষ্ট হয়েছে। যে ভারত বিশ্বে এক বহু ধর্মের রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে জাহির করছে, সেই ভারতের শাসকরা এখন একটা সাম্প্রদায়িক, উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদী কৌশল বাস্তবায়ন করছে। যদিও প্রকাশ্যে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যকেই তুলে ধরছে।

ছবি : সংগৃহীত

মে মাসে বিজেপি'র আশ্চর্যজনক বিজয়ের পর, মোদী স্লোগানটি প্রসারিত করে 'সবার বিশ্বাস' (সবার বিশ্বাস জয়) সহ 'সাবকা সাথ, সাবকা বিকাশ' (সকলের জন্য উন্নয়ন) স্লোগান প্রচার করে। এই মেয়াদ ভিন্ন হবে, সবার মধ্যে এমন আশা জাগাতেই মোদী এমন স্লোগান প্রচার করেন।

তাবরেজ আনসারির মৃত্যুর কয়েকদিন পর মোদী সংসদে দুঃখ প্রকাশ করে জানায় যে, ঘটনাটি তাকে 'যন্ত্রণাগ্রস্ত' এবং তিনি 'দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া উচিত' বলে জানা। যে বা যারা এই ধরনের হামলা চালায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর ব্যবস্থা নেয়া হবে একথা কিন্তু অনেক ভারতীয় সন্দেহ পোষণ করেছে।

২০১৪ সাল থেকে, অর্থাৎ মোদীর প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে সাম্প্রদায়িক হামলায় কয়েক ডজন ডজন মানুষ নিহত হয়েছেন এবং শত শত আহত হয়েছে। কিন্তু, এই অপরাধে খুব কম মামলাই হয়েছে। অভিযুক্তরা প্রমাণের অভাবে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমনকি কয়েকজনকে প্রকাশ্যে মোদীর পতাকা ওড়াতেও দেখা গিয়েছে।

বিজেপি নেতারা প্রায়শই এই ধরনের ঘটনাকে অবমূল্যায়ন করে আসছে। তারা এঁকে 'ছোটখাট' ঘটনা বলে অভিহিত করে এবং 'সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে' গনমাধ্যমকে অভিযুক্ত করে। সম্প্রতি এক বিজেপি সাংসদ জানিয়েছেন, 'সংখ্যালঘুদের প্রতি একটি নির্দিষ্ট পক্ষপাত ও রাজনীতির প্রতিবাদ হিসেবে হিন্দুরা 'জয় শ্রীরাম' স্লোগানটি জনপ্রিয় করে তুলেছে।'

বাবরি মসজিদ। ছবি : সংগৃহীত

কীভাবে এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করা যাবে?

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুধু ভারতে নয় বাংলাদেশের এক মহামারি সংকট বটে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, 'সাম্প্রদায়িকতা শুধু ধর্মের ব্যাপার নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যাপার বটে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বর্তমান আমলেও ধর্মকে ব্যবহার করে লুণ্ঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অবাধে। যে জন্য সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটছে না।'

'সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটা বোঝা গেল। কিন্তু প্রশ্ন হলো এর প্রতিকার কী? প্রতিকার খুঁজবার আগে রাষ্ট্রের ভূমিকাটার দিকে তাকানো দরকার। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক বিরোধকে উস্কানি দিয়েছে। পাকিস্তানের কালে বাংলাদেশের হিন্দুদের শত্রু বলে বিবেচনা করতে চেয়েছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রও যে ধর্মনিরপেক্ষ তা বলা যাবে না। এ রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার কথা ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই এর অভ্যুদয় ঘটেছে।'

'কিন্তু, সংবিধানে এখন ধর্মনিরপেক্ষতা আর নেই। আমেরিকানরা আমাদের রাষ্ট্রকে মুসলিম রাষ্ট্র বলছে, আমরা প্রতিবাদ করছি না। বলছি না যে আমাদের রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক। এখানে সব নাগরিকের রয়েছে সমান অধিকার। আমরা প্রতিবাদ করছি না কথাটার অর্থ হলো আমাদের যারা শাসন করে তারা প্রতিবাদ করছে না।'

তিনি বলেন, 'সংখ্যালঘুরা নিরাপদ বোধ করে না। নীরবে তাদের দেশত্যাগ যে ঘটছে এটা অসত্য নয়। আমাদের রাষ্ট্রে বলতে গেলে কোনো নাগরিকেরই জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নেই। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিশেষভাবে বিপন্ন। মূল কারণ হলো রাষ্ট্রের চরিত্র। যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, যার জন্য সংগ্রাম করেছি, সেই রাষ্ট্র আমরা পাইনি। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য রয়েছে। ধনী-দরিদ্র বৈষম্যই প্রধান, সেই সাথে নারীপুরুষের বৈষম্যও স্পষ্ট এবং সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর মধ্যকার পুরাতন বৈষম্য শেষ হয়ে যায়নি।'

সাংবাদিক মালবী গুপ্ত (ওপরে বামে), গীতা পাণ্ডে (নিচে) এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত

রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে শ্রেণি, ধর্ম, নারীপুরুষ, জাতিসত্তা নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তা না হলে শোষণ, লুণ্ঠন, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিসত্তার নিপীড়ন কোনো ব্যাধিরই শেষ হবে না। আমরা ভুগতে থাকব এবং ভুগতে ভুগতে কেবলি দুর্বল হব বলে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার এক নিবন্ধে জানিয়েছিলেন। ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টা এখন অনেক বেশি ভয়াবহ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় দেয়া ভারতে এখন ধর্মভিত্তিক সহিংসতা চূড়ান্ত।

কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্রের কাঙ্খিত পরিবর্তনটা কীভাবে আসবে? নির্বাচনকে এখন সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি চিহ্নিত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের একশ কোটির হিন্দুর মধ্যে অত্যন্ত ৫০-৬০ কোটির বেশি রয়েছে ভোটার, তাদের ভোটে একটি সাম্প্রদায়িক দল সহসাই ক্ষমতায় চলে আসবে। সাম্প্রদায়িক এমন নির্যাতন বন্ধে দরকার সাধারণ মানুষদের মধ্যে সচেতনতা, আন্দোলন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, আন্দোলন ছাড়া উপায় নাই। সে অনুযায়ী ভারত এখন সাম্প্রদায়িক আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

রাস্তাঘাটে নিরপরাধ মুসলিমদের ওপর দেবতার নাম নিয়ে অত্যাচার চালানো, খুন করা কোন ধর্মীয় অনুষঙ্গ হতে পারে না। যদি তাই হয়য় তাহলে বিশ্বে মুসলিম জঙ্গিদেরকেও আর উগ্র বলে বিবেচনা করা যাবেনা। মুসলিম উগ্ররা যদি 'নারায়ে তাকবির' ব্যবহার করে সহিংসতা চালিয়ে জঙ্গি আখ্যা পায় তাহলে 'জয় শ্রীরাম' ব্যবহার করে সহিংসতা চালালে উগ্র হিন্দুদেরকে জঙ্গি বলা হবেনা কেন?

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড