• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

তামিল টাইগারদের পরে কি তাহলে 'এনটিজে'!

ধর্মান্ধদের পাশবিকতায় রক্তাক্ত যিশু!

৩ সন্তান হারাল স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটি

  এস এম সোহাগ

২২ এপ্রিল ২০১৯, ১৮:৩৮
শ্রীলঙ্কা হামলা
ধর্মের ওপর আঘাত কোনো ধর্মের মানুষই করতে পারে না, উগ্র ধর্মান্ধরা কখনো কোনো ধর্মের হয় না, যারা মানুষকে নির্বিচারে মারতে পারে তারা পশু বৈ কিচ্ছু না। ছবি : সংগৃহীত

ইস্টার সানডে, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র একটি দিন, বরাবরের মতো শ্রীলঙ্কার নাগরিকের গির্জাগুলোতে জড়ো হতে থাকেন এই দিনটিকে উৎযাপন করতে। পৃথিবীর স্ব স্ব ধর্মাবলম্বীদের নিকট উপাসনালয়গুলো খুব নিরাপদ স্থান, কিন্তু আকস্মিক বিকট শব্দে সব নিরাপত্তাই যেন উড়ে গিয়ে একদম নীরব করে দিল পবিত্রস্থানগুলো। কেড়ে নিল ২৯০টি প্রাণ, আহতাবস্থায় রয়েছে আরও পাঁচ শতাধিক। ধর্মভিত্তিক এই নির্মমতার আড়ালে রয়েছে অমানবিক কিছু আদর্শ, ধর্মে বিভক্ত হয়ে নিরপরাধ মানুষগুলোকে নির্বিচারে মেরে ফেলা মানবতার জন্য পরম হুমকি।

মাত্র ১০ বছর আগেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি একটা গৃহযুদ্ধ থেকে মুক্ত হয়, ১০ বছরের মধ্যে আকস্মিক এমন আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়নি। রবিবার (২১ এপ্রিল) দেশটির বিভিন্ন গির্জা ও হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলার ভয়াবহতায় দেশজুড়ে জরুরি অবস্থায় চলছে, বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইন্টারনেটসহ প্রধান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম 'দা টেলিগ্রাফ' জানায়, শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ৬টি স্থানে প্রায় একই সময়ে বোমা বিস্ফোরণ হয়। ইস্টার সানডে উপলক্ষে ধর্মাবলম্বীরা উপাসনালয়গুলোতে যখন জড়ো হলো, তখনই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক সেইন্ট ক্যাথলিক গির্জাসহ কলম্বোর ৩টি আধুনিক হোটেলেও শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে যার মধ্যে রয়েছে সাংরি-লা কলম্বো, কিংসবারী হোটেল এবং দা সিনামন গ্রান্ড কলম্বো। সকালের এই ৬টি বিস্ফোরণ প্রায় একই সময়ের মধ্যে ঘটে, হতাহতের নির্মমতায় সবাই যখন হতবাক হওয়া শুরু করবে তখনই রাজধানীর বাহিরে আরও দুটো বোমা বিস্ফোরণ ঘটে।

ছবি : সংগৃহীত

কী ঘটেছিল?

বার্তা সংস্থা 'রয়টার্স' এর কাছে সোমবার (২২ এপ্রিল) জ্যেষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, শ্রীলঙ্কার গির্জা ও বিলাসবহুল হোটেলে সাত আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৯০ জন নিহত এবং ৫ শতাধিক আহত হয়েছে। সরকারের ফরেনসিক বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা আরিয়ানন্দা ওয়েলিয়ানগা বলেন, কলম্বোর সমুদ্রবন্দরের সাংরি-লা বিলাসবহুল হোটেলে দুজন আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। অন্যরা তিনটি গির্জা এবং দুটি অন্যান্য হোটেল হামলা চালিয়েছে।

রাজধানী কলম্বো উপকূলের চতুর্থ একটি হোটেল এবং একটি বাড়িকেও লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল, তবে কারা এই হামলা চালিয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি বলে তিনি জানান।

হামলার শিকার কারা?

ইস্টার সানডের হামলায় নিহত ২৯০ জনের অধিকাংশই শ্রীলঙ্কার নাগরিক হলেও তাদের মধ্যে ৮ জন ব্রিটিশ নাগরিক রয়েছে যাদের আবার দুজন যৌথভাবে মার্কিন নাগরিক। রাজধানী কলম্বোর ৫ তারকা হোটেল সাংরি-লার দ্বোতলায় অবস্থিত রেস্তোরাঁতে বসে ব্রিটিশ নাগরিক অ্যালেক্স নিকলসন-২ ও তার মা আনিতা সকালের নাস্তা খাওয়া অবস্থায় প্রাণ হারায়।

ছবি : সংগৃহীত

ব্রিটিশ এক বিলিওনিয়র তার তিন সন্তানকে হারিয়েছেন এই বোমা হামলায়। যুক্তরাজ্যস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশনার মানিশা গুনাসেকারা বলেন, আগে ৫ ব্রিটিশ নাগরিক নিহতের কথা বললেও বর্তমানে আমাদের নিকট ৮ ব্রিটিশ নাগরিকের প্রাণহানির তথ্য এসেছে।

নেদারল্যান্ডের সবচেয়ে ধর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ও ড্যানিশ ফ্যাশন টাইকুন আন্দ্রেস হোলস পোভলসেন তার ৩ সন্তানকে হারিয়ে শোকাস্তব্ধ। ৪ সন্তানের জনকের এক মুখপাত্র 'দা টেলিগ্রাফ'কে ৩ সন্তান নিহতের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়। তারা ইস্টার সানডের ছুটিতে শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছিল। জনাব পোভলসেন যুক্তরাজ্যের ৩য় স্কটল্যান্ডের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিগত ভূমি মালিক।

ব্রিটিশ হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্নের লেবার সাংসদ টিউলিপ সিদ্দিক হামলার নিন্দা জানিয়ে টুইট করেছেন। সে এই ভয়ানক হামলায় তার এক স্বজনকে হারিয়েছেন বলে জানান। টুইটারে এই হামলাকে অত্যন্ত বিধ্বংসী এক ঘটনা আখ্যা দিয়ে শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

আন্দ্রেস হোলস পোভলসেনের পরিবার। ছবি : সংগৃহীত

ইস্টার সানডের হামলায় নিহত ও আহতদের মধ্যে বেশিরভাগই শ্রীলঙ্কান ছিল, যদিও সরকারি কর্মকর্তারা জানান, ব্রিটিশ, মার্কিন, তুর্কি, ভারতীয়, চীনা, ড্যানিশ, ডাচ ও পর্তুগিজ নাগরিকসহ ৩২ জন বিদেশি মারা গেছে।

হামলার পেছনে কারা থাকতে পারে?

শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুওয়ান উইজেবার্দেনা এই হামলাকে একটা উগ্র ধর্মীয় আগ্রাসন হিসেবে ব্যাখ্যা করেন এবং দেশটির পুলিশ সন্দেহভাজন ২৪ জনকে আটক করেছে বলে নিশ্চিত করেন। শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান পুজুথ জয়াসুন্দরা হামলার ১০ দিন আগে পুলিশকে একটা গোয়েন্দা সতর্কবার্তা জারি করেছিলেন বলে জানায় বার্তা সংস্থা 'এএফপি'। সেই সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, দেশটির বিখ্যাত গির্জাগুলোতে আত্মঘাতী বোমা হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

একটি বিদেশি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সেই সতর্কবার্তায় জানানো হয়, জাতীয় তোহিদ জামায়াত নামক স্থানীয় একটি মৌলবাদী মুসলিম গোষ্ঠী কলম্বোস্থ ভারতীয় হাই কমিশনসহ বিখ্যাত গির্জাগুলোতে হামলার পরিকল্পনা করছে। এনটিজে দেশটিতে গত বছরে বৌদ্ধমূর্তির হামলার পেছনে দায়ী ছিল।

ছবি : সংগৃহীত

গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো সপ্তাহ পার হয়ে গিয়ে হামলার আগেও শ্রীলঙ্কার সরকারের নিকট পৌঁছায়নি। দেশটির প্রধানমন্ত্রী রানিল উইক্রেমেসিঙ্গে রবিবারের শেষের দিকে স্বীকার করে যে, সম্ভাব্য হামলার ব্যাপারে 'সতর্কবার্তার তথ্য সেখানে ছিল' সত্যিই তবে তা কেন 'হামলার পূর্বে কেন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি সে ব্যাপারেও আমাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।'

কারা এই এনটিজে?

ইস্টার সানডের বিধ্বংসী হামলার দায় স্পষ্টভাবেই কেউই গ্রহণ করেনি, তবে ২০১৬ সালে দেশটির বৌদ্ধমূর্তির ওপরে হামলা চালিয়েছিল। ইসলামি গোষ্ঠীটির সেক্রেটারি আবদুল রাজিককে বর্ণবাদের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভারত মহাসাগরের দেশটিতে ২০০৯ সালে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে, যদিও এখানে জঙ্গি সংগঠনের হামলার সামান্যই ইতিহাস আছে।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীলঙ্কার সরকার দেশটিতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ তামিল টাইগারদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহী তামিলদের মধ্যে মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য স্টাইল অফ ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজমের পরিচালক অ্যান স্পিকার্ড বলেন, জাতীয় তৌহিদি জামায়াতের লক্ষ্য বিদ্রোহ নয়। এর পরিবর্তে, এটি শ্রীলঙ্কায় বিশ্বব্যাপী জিহাদি আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে এবং সমাজে ঘৃণা, ভয় ও বিভাজন তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে। তিনি বলেন, 'এটা কোনো বিচ্ছিন্ন আন্দোলন নয় বরং এটা ধর্মীয় ও শাস্তির বিধান প্রতিষ্ঠা করতে চায়।'

ছবি : সংগৃহীত

রবিবারের সংখ্যালঘু রোমান ক্যাথলিক এবং বিদেশি পর্যটেকদের হোটেলকে লক্ষ্য করে আত্মঘাতী সন্ত্রাসী বোমা হামলাটি যেভাবে পরিচালনা করা হয় তা অন্যত্র ইসলামিক জঙ্গি হামলার মতোই দেখা যায়।

তিনি বলেন, 'এই হামলাকে বেশ আলাদা বলে মনে হচ্ছে এবং তারা আইএসআইএস, আল কায়েদা, বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদী জিহাদি প্লেবুক থেকে সরাসরি এসেছে বলে মনে হয়। হামলাটি একটি ধর্মের পবিত্র দিবসে গির্জাগুলোকে লক্ষ্য করে চালানোয় একে বেশ ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো বলেই মনে হয়।

এই তামিলরাই বিশ্বে প্রথম আত্মঘাতী বোমা হামলাগুলোকে একটি সাধারণ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। প্রায় এক দশক আগে শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক সেনা অপারেশন পরিচালনা করে এবং এলটিটিইর নেতাকে হত্যার মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল।

শ্রীলঙ্কার সরকারের প্রতিক্রিয়া?

এক দশক আগে সহিংসতার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া দেশটিকে আকস্মিক এমন হামলায় স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই সেই পবিত্র দেশ যেখানে অধিকাংশ ধর্মের প্রথম মানব সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। খ্রিস্টান-মুসলিম উভয়ের কাছে শ্রীলঙ্কার এডামস পিকের আবেদন অনেক বেশি।

ইস্টার সানডের এমন দিনে উপাসনালয় ও বিলাসবহুল হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলার শিকার দেশটির কিংসবারী হোটেলের এক কর্মী 'রয়টার্স'কে জানায়, সকালের নাস্তা করা গেস্টদের রক্তে পুরো মেঝে ভরে গিয়েছিল, সবাই মেঝেতে পড়েছিল। আমরা সবাইকে, যারা মৃত কিংবা জীবিতাবস্থায় পড়েছিল তুলে নিয়েছি।

দেশটির মন্ত্রিপরিষদ সচিব রজিথা সেনারত্নে এই হামলার সংঘে একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সংযোগ থাকার কথা জানালেও দলটির সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেননি। তিনি বলেন, 'শুধুমাত্র এই দেশে অবস্থিত মানুষের দ্বারা এমন হামলাগুলো চালানো হয়েছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না। এখানে নিশ্চয়ই কোনো বিদেশি নেটওয়ার্ক যুক্ত আছে, তাছাড়া এমন হামলা হতে পারে বলে বিশ্বাস করি না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তদন্তে বিদেশি সহায়তার আহ্বান জানাবেন বলে দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা জানান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জানান সোমবার (২২ এপ্রিল) মধ্যরাত থেকে দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করা হবে এবং পুলিশের পাশাপাশি হামলার পেছনে দায়ী ও সন্দেহভাজন সব শক্তিকে খুঁজে বের করতে সেনা মোতায়েন করা হবে।

বিশ্বে ধর্মকে কেন্দ্র করে হামলা পাল্টা হামলার পেছনে যদি ধর্মীয় বিভাজনই মূল কারণ হয় তাহলে মানুষ একসময় হারিয়ে গিয়ে থেকে যাবে শুধু ধর্ম। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে প্রার্থণারত নিরাপরাধ মুসলিমকে হত্যা করা হলো, এবার শ্রীলঙ্কার গির্জায় প্রার্থনারত নিরপরাধ খ্রিস্টানদের হত্যা করল। ক্রাইস্টচার্চের হামলাকারী ছিল খ্রিস্টান শ্রীলঙ্কায় হয়তো বের হয়ে আসবে কোনো ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের নাম। ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষ মারাটা একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে মানুষ মারলে একসময় ধর্ম থেকে যাবে তা পালনে মানুষ মিলবে না।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড