• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আল-জাজিরা'র তদন্ত প্রতিবেদন

মার্কিন অস্ত্র সংস্থার 'গণহত্যা' বিক্রির কৌশল

৩ বছরের তদন্তে উঠে আসে বৈশ্বিক অস্ত্র রাজনীতির নগ্নচিত্র

  এস এম সোহাগ

২৬ মার্চ ২০১৯, ১৬:৫৬
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন
অস্ত্র ব্যবসা চালাতে মারা হয় মানুষ, ব্যবহার করা হয় মিডিয়াকে, রাজনীতিকে, মানুষ মারার এই যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে বৈশ্বিক শান্তির পদ্ধতি। ছবি : সংগৃহীত

চীনের গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে এক জরুরি সভায় ১৯২৭ সালের ৭ই আগস্ট এক প্রবাদের প্রচলন করেছিলেন বিশ্ব কমিউনিজমের অন্যতম বিখ্যাত নেতা মাও সেতুং। তার বলা উক্তিটি প্রতিটি সময়ে সমান সত্যতা ধারণ করেছে। বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস। 'পলিটিকাল পাওয়ারস গ্রো আউট অব দ্যা ব্যারেল অফ আ গান' অমর উক্তিটি আজও সত্য। নানান ভঙ্গিতে নানান ব্যবহারে একইভাবে সত্য।

অর্থের, রাজনীতির সামনে মানুষের প্রাণ মূল্যহীন। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ুক, গণহত্যা চলুক, প্রার্থনারত আরও মানুষের শরীর বিদ্ধ করে গুলি চলুক। বিশ্বে মানুষের ক্ষমতাকে বন্দুকের নলে রাখার জন্যে নিয়ত চলছে রাজনীতি। দেশে দেশে মানুষের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে এই মারণযন্ত্র, এই ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে একেক দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে বন্দুকের ব্যবসায়ীরা। পৃথিবীতে সবকিছুই মুনাফাকে কেন্দ্র করে ঘটে, ক্রাইস্টচার্চের ঘটনাও তেমন কোনো মুনাফার ক্ষেত্রফল। 'আল-জাজিরা'র অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই মুনাফাকেন্দ্রীক বন্দুক ব্যবসা ও অস্ট্রেলিয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের নীলনকশা উঠে এসেছে।

যদি আপনি একজন বন্দুক অধিকার আইনজীবী হয়ে থাকেন তাহলে একটি ম্যাস শুটিং এর প্রতিক্রিয়াতে কী করবেন? প্রথমত, 'কিছুই বলবেন না'। এরপরেও যদি গণমাধ্যমের প্রশ্ন অব্যাহত থাকে তাহলে? শুধু বলবেন, 'অপরাধ, অপরাধ, অপরাধ'। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ দলকে ধুয়ে দিবেন এক বার্তার মাধ্যমে। সেখানে বলবেন, 'আপনি কোন সাহসে ওইসব শিশুদের গোরস্থানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সূচি বাস্তবায়ন করছেন?' মার্কিন সর্বাধিক শক্তিশালী বন্দুক লবি অস্ট্রেলিয়ার ওয়ান ন্যাশনাল পার্টিকে এমনটাই পরামর্শ দিয়েছিলেন।

'আল-জাজিরা'র অস্ট্রেলীয় আন্ডার কভার রিপোর্টার রজার মুলার। ছবি : আল-জাজিরা

অস্ট্রেলিয়ার উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলটি দেশের ক্রমবর্ধমান কঠোর অস্ত্র আইনের ওপর থেকে যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল তখন, মার্কিন ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশনের (এনআরএ) কাছে পরামর্শ চায়। আর এই পুরো প্রক্রিয়া বিগত ৩ বছর ধরে তদন্ত করে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করেন 'আল-জাজিরা'র অস্ট্রেলীয় আন্ডার কভার রিপোর্টার রজার মুলার। তিনি তার তদন্তের জন্যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন ডিসি'তে এনআরএ এবং ওয়ান ন্যাশন প্রতিনিধিদের মধ্যে এক সিরিজ মিটিং গোপন ক্যামেরায় ধারণ করেন।

মুলার গোপনে ধারণকৃত ফুটেজে মার্কিনদের অস্ত্র বাণিজ্যের এক বিরল বাস্তবতা সংগ্রহ করেন। ম্যাস শুটিংগুলো কীভাবে গণ্য করা হয় এবং এনআরএ মিডিয়া কভারেজগুলোকে কী নিপূণভাবে ব্যবহার করে তাদের প্রো-বন্দুক এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করে।

১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার আর্থার বন্দর শহরে এক বন্দুকধারীর গুলিতে ৩৫ জন নিহত হয়েছিল। দেশটির ইতিহাস এমনকি বিশ্বের ইতিহাসে ওটা জঘন্যতম এক অধ্যয় হিসেবেই পরিচিত, এরপরেই অস্ট্রেলিয়ান সরকার অস্ত্র আইনে কঠোরতা আনেন। ১৯৯৬ সালে সব ধরনের স্বয়ংক্রিয়, আধা স্বয়ংক্রিয় এবং রাইফেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আইন করে, দীর্ঘকাল ধরে এই আইন শিথিল করতে আহ্বান জানিয়ে আসছে দেশটির ওয়ান ন্যাশন পার্টির নেতা পৌলিন হ্যানসন।

ওয়ান ন্যাশন পার্টির চিফ অফ স্টাফস জেমস অ্যাশবি (উপরে বামে) এবং দলটির কুইন্সল্যান্ড শাখার স্টিভ ডিকসন (উপরে ডানে)। ছবি : সংগৃহীত

১৯৯৬ সালের পরে অস্ট্রেলিয়াতে কোনো গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি। তবুও, এনআরএ অস্ট্রেলীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে 'কমন সেন্সের সঙ্গা না' বলে অবমূল্যায়িত করে।

'আল-জাজিরা'র গোপন তথ্যদাতা মুলার নিজেকে বন্দুকধারীদের আইনজীবী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, তিনি ওয়ান ন্যাশন পার্টি'র চিফ অফ স্টাফস জেমস অ্যাশবি এবং দলটির কুইন্সল্যান্ড শাখার স্টিভ ডিকসনকে গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন ডিসির এনআরএ অফিসে নিয়ে যান। অ্যাশবি এবং ডিকসন মার্কিন বন্দুক লবির সমর্থকদের কাছ থেকে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান আশা করেছিলেন।

এনআরএর ভার্জিনিয়া সদর দফতরের সভায়, কর্মকর্তারা অস্ট্রেলিয়ার বন্দুক আইন পরিবর্তনে জনসমর্থন আদায় জোরদার করার জন্য অ্যাশবি এবং ডিকসনকে পরামর্শ করেছিলেন এবং গণমাধ্যমকে ম্যাস শুটিংয়ের প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য যুগলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার উগ্র ডানপন্থী নেতা। ছবি : সংগৃহীত

এনআরএ মিডিয়া লিয়াজন অফিসার ক্যাথরিন মর্টেনসেন মতে, গণহত্যার জেরে মিডিয়া অনুসন্ধানের সম্মুখীন করতে সেরা পদ্ধতিটি ছিল 'কিছুই না' বলা। কিন্তু যদি মিডিয়া তদন্ত অব্যাহত থাকে, তিনি তাদের এক আগ্রাসী যোগাযোগ কৌশল সুপারিশ করেন। যার মধ্যে বন্দুক নিয়ন্ত্রণে জনউদ্বেগকে বিচ্ছুরিত করে জনমত পরিবর্তনের পরামর্শও ছিল।

এনআরএর জনসংযোগের অন্যতম সদস্য লারস ডালসাইড বলেন, 'শুধু তাদের পুরো ধারণাটির জন্য লজ্জিত হন। যদি আপনার নীতিটি কার্যকরে যথেষ্ট ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে আপনি কীভাবে তাদের মৃত্যুকে ব্যবহার করে এই নীতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস করবেন। আপনার রাজনৈতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এই শিশুদের গোরস্থানে দাঁড়াবেন কি করে, সেই সাহস কই পাবেন।' ডিকসন প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, 'আমি এই কৌশলকে ভালোবাসলাম, আপনাকে ধন্যবাদ।'

তারপরে, এনআরএ কীভাবে মিডিয়া কভারেজকে কাজে লাগিয়েছে তা ব্যাখ্যা করে। ডালসাইড ওয়ান পার্টি ন্যাশনকে সহযোগী-বন্ধুত্বপূর্ণ সাংবাদিকদের তালিকা করতে বলেন। ডালসাইড বলেন, 'আপনার অবশ্যই এমন কোন সাংবাদিক আছেন, যারা আপনাদের মতাদর্শেই বিশ্বাসী, সে হয়তো সিটি হল কিংবা অপরাধ প্রতিবেদন করছেন।'

ছবি : আল-জাজিরা

তিনি আরও বলেন, 'যারা ডাকাতির শিকার হয়েছে, তাদের বাড়িতে হামলা হয়েছে কিংবা উচ্ছেদ করা হয়েছে, মার খেয়েছে কিংবা এমন যেকোন কিছু যা তাকে একটি বন্দুক থাকাতে সাহায্য করত। এসব ঘটনাগুলোকে খুঁজে বের করুন এবং একে কেন্দ্র করেই আপনি গণমাধ্যমে প্রচার করার জন্য গল্প প্রস্তুত করুন এবং এসব কিছুকে আপনাদের সেই সাংবাদিকের মাধ্যমে সপ্তাহে ২ থেকে ৫ বার প্রচার করুন।'

এনআরএ প্রো-বন্দুক আইন নিয়ে গোস্ট কলাম লেখার পরামর্শ দেন। মরটেনসান বলেন, 'আমরা স্থানীয় কাগজপত্রে গেস্ট কলাম প্রচার করতে থাকি। অনেক বার, আমরা উইসকনসিনের বা যাই হোক না কেন, কোনো স্থানীয় শেরিফের জন্য সেগুলি লিখব এবং সে এটি খসড়া করবে অথবা আমাদের এটি খসড়া করতে সহায়তা করবে। আমরা অনেকগুলি কাজ করব কারণ এই লোকেরা ব্যস্ত। এবং এটিই আমাদের কাজ। সুতরাং, আমরা তাদের সাহায্য করব এবং তারা তাদের নাম দিয়ে এটি জমা দেবে যাতে এটিকে মৌলিক আর আসল দেখায়। আপনি জানেন যে, এরা সেই সম্প্রদায় থেকে আসছে। আমাদের ভূমিকা এই দৃশ্যগুলির পেছনে থাকবে।'

আত্মপ্রতিক্ষার জন্য বন্দুক থাকাটা কতটা জরুরি, তা ক্ষুদ্র ভিডিও আকারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে। মরটেনসান বলেন, 'এইগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং টুকটাক মেসেজগুলো কাজ করে। আপনি জানেন, স্থানীয় মুদি দোকানের ক্যাশিয়ার 'জো ব্লো' তার সাথে একজন সশস্ত্র দেহরক্ষী রাখতেন এবং তাকে এই বন্দুক রক্ষা করেছিল'। এভাবেই বন্দুকের প্রয়োজনীয়তা জনমনে ছড়িয়ে দেয়া হয়।

এনআরএ'র জনসংযোগের অন্যতম সদস্য লারস ডালসাইড (বামে) এবং এনআরএ মিডিয়া লিয়াজন অফিসার ক্যাথরিন মর্টেনসেন (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত

একই বৈঠকের সময়, ডিকসন এনআরএ'কে বলেন যে, 'আফ্রিকান গ্যাংগুলি অস্ট্রেলিয়ায় আসে এবং সেই দেশে ধর্ষণ এবং চুরির ঘটনা ঘটায়। তারা বেসবল ব্যাট ব্যবহার করে আপনার গাড়ি চুরি করে।'

ডালসাইড এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিল। 'আফ্রিকান গ্যাংগুলি বেসবল ব্যাট নিয়ে আসার বিষয়ে প্রত্যেক সময় একটি গল্প আছে, সেখানে আপনি একটি ছোট্ট জিনিস দেখাতে পারেন, সম্ভবত একটি টুইট বা ফেসবুক পোস্টের শীর্ষে বা যাই হোক না কেন, সেখানে ফলাও করে প্রচার করবেন, 'আমাদের বাড়ির প্রতিরক্ষা করার অনুমতি নেই ', ' আমাদের বাড়ি রক্ষা করার অনুমতি দেয় না '। বুম।'

এই প্রতিবেদনে নামকরণ করা এনআরএ কর্মকর্তারা, ওয়ান ন্যাশন পার্ট, ডিকসন এবং অ্যাশবির মন্তব্যের জন্য 'আল-জাজিরা'র অনুরোধ জানালেও তারা কোনো জবাব দেননি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড