• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বিটলসের কিংবদন্তী শিল্পী

শুভ জন্মদিন বাংলাদেশের নিঃস্বার্থ বন্ধু জর্জ হ্যারিসন

'শুধু সংগীতটা নাও, উত্তমটুকু কারণ এটাই সবচেয়ে ভালো এবং এটাই আমি সাগ্রহে দেই'

  এস এম সোহাগ

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৭:১০
জর্জ হ্যারিসন
যে মানুষটা বাংলাদেশের মানুষের বিপদে এগিয়ে এসেছিলেন, যে শিল্পী সংগীতকে আত্মিকভাবে ধারণ করেছিলেন, সেই কিংবদন্তি জর্জ হ্যারিসনকে জন্মদিনে শ্রদ্ধা বাংলাদেশের। ছবি : সংগৃহীত

'আমার মনে হতো যারা সত্যিকার অর্থেই সংগীতের মধ্যে জীবনযাপন করতে পেরেছে তারা পৃথিবীকে বলছে, "আমার ভালোবাসা পেতে পারো, আমার হাসি পেতে পারো। খারাপ দিকটা ভুলে যাও, তোমার তা প্রয়োজন পড়বে না। শুধু সংগীতটা নাও, উত্তমটুকু কারণ এটাই সবচেয়ে ভালো এবং এটাই সেই অংশ যা আমি সাগ্রহে দেই"- জর্জ হ্যারিসন।

পৃথিবীতে সত্য শুদ্ধ বলতে যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা যে গান তা অধিকাংশ মানুষই স্বীকার করবে অবলীলায়। আধুনিক সংগীতের ধারা থেকে আধুনিক ব্যান্ড মিউজিকের দিকে বিশ্ব যাদের হাত ধরে যোগদান করেছিল তাদের একজনের নাম জর্জ হ্যারিসন। বিশ্বে সর্বকালের সেরা কয়েকটি ব্যান্ডের নাম করলে যেভাবে বিটলস চলে আসে সেভাবেই সেরা তারকাদের নামের মধ্যে উপরের দিকেই সন্ধান মিলবে ব্রিটিশ এই তারকার।

ইংল্যান্ডের ল্যাংশায়েরর লিভারপুলের ওয়্যাভারট্রি'র ১২ আরনোল্ড গ্রোভ রোমান ক্যাথলিক এক পরিবারে ১৯৪৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন জর্জ। হোয়াইট স্টার লাইনের বাস কন্ডাক্টর হ্যারোল্ড হার্গ্রিভিস হ্যারিসন এবং আইরিশ বংশোদ্ভুত এবং লিভারপুলের একটি দোকানের সহকারী লুইসে ফ্রেঞ্চের ৪র্থ সন্তান জর্জ। লুইস একজন মা হিসেবে তার সন্তানের সংগীতপ্রেমের সমর্থন জুটিয়েছেন সর্বদা, বয়ন্ডের মতে, হ্যারিসনের মা সব সময়েই চাইতেন যেন তারা সুখী হয় এবং যখন তিনি বুঝতে পারলেন, গান সৃষ্টির চেয়ে বিশ্বে কোনো কিছুই জর্জকে বেশি আনন্দিত করতে পারবে না, তিনি একজন সঙ্গীতপ্রেমী হিসেবে, মা হিসেবে সন্তানকে সর্বদা অনুপ্রেরণা জুটাতেন।

ছবি ; সংগৃহীত

বিখ্যাত গান 'পেনি লেন' শুনেনি এমন সঙ্গীতপ্রেমী খুঁজে খুব কমই মিলেবে, সেই পেনি লেনের কাছের ডাভেডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন জর্জ। এই সেই বিদ্যালয় যেখান থেকে বিশ্ব দুজন কিংবদন্তীকে পেয়েছিল, জন লেনন ছিলেন এখানেরই ছাত্র। স্কুলেই জর্জের পরিচয় হয়েছিল আরেক কিংবদন্তী পল ম্যাককার্থীর সঙ্গে, যিনি জন লেননের সঙ্গে হ্যারিসনের পরিচয় করিয়েছিল। পরিচয়ের পরেই 'দা কোয়ারিম্যান', প্রি-বিটলস ব্যান্ড হিসেবেই পরিচিত, সেখানে গিটার বাজানোর জন্য আমন্ত্রণ পেয়ে গেলেন জন্ম থেকে সংগীতপ্রেমী এই মানুষটা। জর্জ হলো বিটলসের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, 'দা ইয়াঙ্গেস্ট বিটল', তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ যখন লেননের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ব্যান্ড মিউজিকের দুনিয়ায় 'বিটলস' ইতিহাসের শুরুটা এভাবেই হয়েছিল।

১৯৬০ সালে তার জন্য মোক্ষম সুযোগটা এসে গেল, বিটলসের সঙ্গে জার্মানি যেতে হবে কাজ করতে, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সুযোগ লুফে নিলেন। ১৯৬৩ সালে ইউকে ফিরে আসার পর, বিটলস জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে - জনপ্রিয় সঙ্গীত বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়।

সত্তরের দশকে যেখানেই বিটলসের পা পড়ত সেখানেই ব্যাপক জনস্বার্থ তৈরি করেছিল। সে সময়ে সাংস্কৃতিক ও বাদ্যযন্ত্রের প্রপঞ্চ ব্যাখ্যা করার জন্য প্রচলন ঘটেছিল এক শব্দের 'বিটলম্যানিয়া'। লেনন এবং ম্যাককার্থির চেয়ে তুলনামূলক কমই জনপ্রিয় ছিলেন (মাঝে মাঝে তাঁকে 'শান্ত বিটল' হিসেবে উল্লেখ করা হয়)। জর্জ হ্যারিসন তবুও খুব জনপ্রিয় ছিলেন, বিশেষত মেয়েদের কাছে।

ছবি ; সংগৃহীত

জর্জ হ্যারিসন প্রথম বিবাহ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ২১ জানুয়ারি জনপ্রিয় মডেল প্যাটি বয়েডকে। ১৯ বছরের প্যাটি বয়েড তখন একজন স্কুল গার্ল। তবে এই সম্পর্ক তাদের বেশিদিন টেকেনি। ১৯৭৪ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। এ বছরই ডার্ক হর্স রেকর্ড কোম্পানির সেক্রেটারি অলিভিয়ার সাথে পরিচয় হয় এবং ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন। ১৯৭৮ সালের ১ আগস্ট তাদের একমাত্র পুত্র ধ্যানি হ্যারিসনের জন্ম হয়।

বিটলসের রেকর্ডিংয়ের জন্য গান লিখত মূলত লেনন ও পল, যদিও ১৯৬০ এর পর থেকে হ্যারিসনের গান লেখায় আগ্রহ বাড়তে থাকে। 'হেল্প এন্ড আব্বে' কিংবা 'হিয়ার কামস দা সান এন্ড সামথিংয়ের মতো হ্যারিসনের লেখা কয়েকটা গান তারা রেকর্ড করলেও তার অধিকাংশ লেখাই ব্যবহার করতেন না বিটলসের অন্য সদস্যরা। আর এখান থেকেই তার নিজস্ব ক্যারিয়ারের প্রতি ঝোঁক তৈরি হতে শুরু করে, ধীরে ধীরে বিটলসের একটা ফ্যাক্টর হিসেবে প্রতীয়মান হয় জর্জের নাম।

জর্জ হ্যারিসন ভারতীয় সংগীত এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার মধ্যে একটি মহান আগ্রহ অনুভব করতেন। তিনি অন্যান্য ব্যান্ড সদস্যদের হরি কৃষ্ণ এবং মহর্ষি মহেশ যোগী আন্দোলনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ভারতীয় সংগীত এবং লোক-শিল্পে জর্জের আগ্রহ পরবর্তীতে বিটলসের অ্যালবামের প্রভাব রেখেছিল, যা বিটলসকে সংগীতের বিস্তৃতি করতে সাহায্য করেছিল।

জর্জ হ্যারিসনের প্রথম স্ত্রী মডেল প্যাটি বয়েড (বামে) এবং দ্বিতীয় স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত

জর্জ হ্যারিসন ও বাংলাদেশ

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে বাঙালি-ভারতীয় সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শঙ্করের সঙ্গে হ্যারিসনের পরিচয় ঘটে। এর কিছুদিন পর, হ্যারিসন ভারতে আসেন এবং শ্রীনগরে রবি শঙ্করের কাছে ৬ সপ্তাহ সেতারের তালিম নেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি বিটলসের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। অবশ্য এই সময়ের ভেতর হ্যারিসনের 'ওয়ান্ডারফুল মিউজিক' এবং 'ইলেকট্রনিক সাউন্ড' নামক দুটি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। এর ভেতরে 'ওয়ান্ডারফুল মিউজিক' অ্যালবামে, পণ্ডিত রবি শঙ্করের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাশ্চাত্য সংগীতের সাথে ভারতীয় রাগ সংগীতের মিশ্রণ ঘটান। বিটলসের বাইরে এসে তাঁর তিনটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামের গানগুলোকে তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের নিদর্শন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই অ্যালবামগুলোর ভিতরে 'মাই সুইট লর্ড', 'হোয়াট ইজ লাইফ', 'ওয়াল অব সাউন্ড' অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে।

রবি-হ্যারিসনের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে যে সময়টাতে, তখন প্রাচ্যে, রবি শঙ্করের দেশ বাংলাদেশের ওপর পাক হানাদার বাহিনী ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য হামলা চালাচ্ছিল। কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় ১ কোটি শরণার্থী, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। শেকড়ের টানে মর্মান্তিক এই অবস্থা নাড়া দিয়েছিল রবিকে, বিশ্বে যুদ্ধের জন্য অর্থ জোগানে কনসার্টের আয়োজন করার মতো ধারণা জন্ম নেয় তখনই। অন্তত ২৫ হাজার মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বন্ধু হ্যারিসনের সাহায্য চাইলেন।

নিজ দেশের জন্য রবির কিছু করার তাড়না দেখে, মানবতার তাগিদে হ্যারিসন বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কনসার্টটির জন্য কাজ শুরু করেন। তাঁর বই 'আই-মি-মাইন' হতে জানা যায়, পরবর্তী তিন মাস তিনি টেলিফোন যোগাযোগ করতে থাকেন অন্যদের সাথে, তাদের কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করতে। তখন বিটলস ভেঙে গিয়েছিল এবং অন্য সদস্যদের সাথে আগের মতো সর্ম্পক ছিল না হ্যারিসনের। তারপরেও তাঁদের এ কনসার্টে যোগ দিতে বলেন হ্যারিসন। রিঙ্গো স্টার রাজি হয়ে গেলেন। পল ম্যাককার্টনি রাজি হননি, আর জন লেননের যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও পরে কিছু কারণে আর যোগ দেননি। এছাড়া এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, বব ডিলান, ব্যাডফিঙ্গারসহ আরও শিল্পীদের যোগ দিতে বলেন হ্যারিসন।

দা কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। ছবি : সংগৃহীত

প্রস্তুতি শেষে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই তার বিখ্যাত 'বাংলাদেশ' গানটি মুক্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সংকটের কথা তুলে ধরেন। ঐ দিনই এক প্রেস কনফারেন্সের মধ্য দিয়ে হ্যারিসন ও রবি শঙ্কর কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ঘোষণা দেন। হ্যারিসন কেন এ কনসার্ট করতে আগ্রহী হলেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'তাঁর বন্ধু চেয়েছিল, তাই'। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয় নিউইর্য়কের বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন আর তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১ আগস্ট।

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইর্য়কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ঐতিহাসিক এ কনসার্টটি সম্পন্ন হয়। সেদিন ২টা কনসার্টের আয়োজন করা হয়, প্রথমটি দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে এবং দ্বিতীয়টি সন্ধ্যা ৮ টায়। কনসার্ট ফর বাংলাদেশে ছিল সকল শিল্পী, খ্যাতনামা তারকা। তাঁদের এই লাইনআপকে বলা হয়েছিল 'সুপার গ্রুপ'। কনসার্টের পূর্বে সুপার গ্রুপের সকলকে কল করে উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিলেন হ্যারিসন। তবে ডিলান আসবেন কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না তিনি, তাই ডিলানের নামের পাশে এঁকে দিয়েছিলেন প্রশ্নবোধক '?' চিহ্ন।

কনসার্টে আগত হাজার হাজার শ্রোতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতেই জর্জ হ্যারিসন বলেন, 'ভারতীয় সংগীত আমাদের চেয়ে অনেক গভীর।' তারপর পণ্ডিত রবিশংকর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং সহশিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন। কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, 'প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”।’ তিনি ‘বাংলা ধুন’ নামের একটি নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা এবং তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী। তাঁদের ৪৫ মিনিটের পরিবেশনা শেষে একটি সংক্ষিপ্ত বিরতি দেয়া হয়।

ছবি : সংগৃহীত

৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানের কনসার্টিতে এক বিরতিতে ডাচ এক টিভি চ্যানেলের ধারণ করা পাক হানাদারদের নৃশংস অত্যাচার ও বিপর্যস্ত বাংলাদেশের ফুটেজ দেখানো হয়। এ ফুটেজটি উপস্থিত দর্শকদের বাংলাদেশে চলা সংকটের এক বাস্তব ধারণা দেয়। এরপর ছিল হ্যারিসনের পরিবেশনা, তাঁর সাথে ছিলেন রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্লাপটন (যিনি অসুস্থ ছিলেন), বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ক্লাউস ভোরম্যান, জিম কেল্টনারসহ ১৮ জন মিউজিশিয়ান। এটি ছিল হ্যারিসন ও ক্লাপটনের বেশ কয়েক বছর বিরতির পর প্রথম কোনো কনসার্টে পরিবেশনা।

হ্যারিসন ডিলানের স্লটের সময় হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখেন ডিলান উপস্থিত হয়েছেন। ডিলানের উপস্থিতি শুধু হ্যারিসনের জন্য নয়, দর্শকদের জন্যেও এক বিশাল চমক ছিল। হ্যারিসনের 'বাংলাদেশ' গানটি দিয়ে প্রথম কনসার্টটি শেষ হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রথম কনসার্টটির সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় হ্যারিসন-ডিলান সহ সকলে দীর্ঘ আগ্রহের সাথে দ্বিতীয় কনসার্টটি করেন। দ্বিতীয় কনসার্টটিতে পরিবেশনা তালিকায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এবারও কনসার্টের সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায় এবং কনসার্ট শেষে ডিলান হ্যারিসনকে বলেছিলেন, আমরা হয়তো আরও একটি কনসার্ট করতে পারতাম।

পৃথিবীর ইতিহাসে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শুধু একটা সফলতম কনসার্টই নয়, এটা মানবিকতার সঙ্গে সংগীতকে সরাসরি যুক্ত করার সেই দ্বার যাকে অনুসরণ করে এখন প্রায়ই মানুষের কল্যাণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে দেখা যায় বাংলাদেশের পথে পথেও। ঐতিহাসিক এই কনসার্টটি হ্যারিসনের জীবনকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়, বন্ধু রবির ভাষায়, 'হ্যারিসন বাংলাদেশের বিপর্যয়ের কথা শোনা মাত্রই রাজি হয়ে যান কনসার্টটি আয়োজন করার জন্য'। পাকিস্তানকে যে দেশ তখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সরাসরি সমর্থন দিয়েছিল, সামরিক-আর্থিক-কূটনৈতিক সমর্থনকারী যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই ব্রিটিশ-বাঙালি দুই শিল্পী সৃষ্টি করলো ইতিহাসের। সেই কনসার্ট থেকে তৎকালীন অর্থে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার অনুদান সংগ্রহ হয়েছিল।

ছবি : সংগৃহীত

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শুধু কনসার্টের মধ্যেই আবর্তিত ছিল না, হ্যারিসনের এই কনসার্টকে কেন্দ্র করে লেখা 'বাংলাদেশ', এরপরের ৩ টি অ্যালবাম এবং একটি ফিল্মের থেকে প্রাপ্ত প্রায় ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ইউনিসিফের তহবিল জমে। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে যেই অর্থে বিশ্বের বিপর্যস্ত স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, অ্যাঙ্গোলা থেকে রোমানিয়ার বিপর্যস্ত মানুষকে সহায়তা করেছে এমনকি হর্ন অব আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যে ব্যয় হচ্ছে এখনও। বাংলাদেশ, হ্যারিসন নাম দুটো তাই সংগীত আর মানবিকতার সঙ্গে জড়িত থাকবে অনন্তকাল। 'দা গার্ডিয়ান'

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে বীরেরা রণাঙ্গনে থেকে দেশের জন্যে লড়াই করেছে, নিজের, পরিবারের মানুষদের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদের আখ্যা দিয়ে সম্মান দিচ্ছি। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে যে মানুষগুলোর কোনোভাবে কোনো সম্পর্ক নেই, সেসব মানুষগুলো বিশ্ব দরবারে মানবিকতার জন্য বাংলাদেশের নামটি তুলে ধরেছিল নিঃস্বার্থভাবে, তাদের কি আমরা যথাযথ সম্মান দিতে পেরেছি?

এসব মহাত্মা, বাংলাদেশের নিঃস্বার্থ বন্ধুদের ধন্যবাদ জানাতে বাংলাদেশের লেগে গেছে অনেক বছর, তাও এত সহসা সেই গুরুতর দায়িত্বটিও আমরা পালন করিনি। হ্যারিসন ও এডওয়ার্ড কেনেডি নামক এক মার্কিন কূটনৈতিককে সরকারিভাবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বাংলাদেশি এক আইনজীবীর করা মামলা নিয়ে ২০০৮ সালের ১১ ডিসেম্বর 'বিবিসি নিউজ'র 'বাংলাদেশের "বিটল হিরো" মুভ' শিরোনামে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।

মাসুদ সোভাহান নামক এক সাংবিধানিক আইনজীবী 'বিবিসি নিউজ'কে বলেছিলেন, 'এটা ঠিক আমার জন্য না, প্রতিটা বাংলাদেশির জন্য কতটা গুরুতর দায়িত্ব এসকল মানুষকে সরকারিভাবে ধন্যবাদ জানানো, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।' তাদের ধন্যবাদ না জানানো আমাদের জন্য কতটা অকৃতজ্ঞতার, দুঃখজনক তা সরকারকে অতিদ্রুত খতিয়ে দেখা উচিত।

ছবি : সংগৃহীত

'১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা নিউ ইয়র্কে কনসার্টের মাধ্যমে জর্জ হ্যারিসন বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন। তার প্রচেষ্টা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের সে সময়ের সয়ে যাওয়া অত্যাচারগুলো বিশ্বের কাছে অলক্ষিতই থেকে যেত। আরও লাখ লাখ মানুষ মারা যেত, হাজারো নারী ধর্ষিত হতো তা এখন আমাদের চিন্তাতেও আসবে না। সোভাহানের সেই মামলাটি আমলে নিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে শুনানি হয়েছিল।

১৯৯৯ খৃস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ৩৬ বছর বয়সের মাইকেল আব্রাম ব্রোক নামের এক দুর্বৃত্ত হ্যারিসনের ফ্রায়ার পার্কের বাড়িতে ঢুকে তাকে কিচেনের চাকু দিয়ে বুকে এবং মাথায় আঘাত করেন। এ সময় তার স্ত্রী অলিভিয়া তাকে রক্ষা করেন। এতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হোন এবং মাইকেল ব্রোক পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হোন। তখনকার সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়, মাইকেল তার জবানবন্দিতে বলেন, ঈশ্বর আমাকে হ্যারিসনকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি কেবল ঈশ্বরের নির্দেশ পালন করেছি।

ছবি : সংগৃহীত

২৯ নভেম্বর ২০০১ আমেরিকার লস এঞ্জেলসে দীর্ঘ দিনের বন্ধু এবং একসময়ের সহকর্মী পল ম্যাককার্থির বাড়ি তিনি কিছুদিনের জন্য থাকতে যান। সেখানেই স্থানীয় সময় ১টা ৩০ মিনিটে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে এক সময়ে সাড়া জাগানো ব্যান্ড বিটলসের সাবেক সদস্য, বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন জনপ্রিয় গায়ক এবং গিটারিস্ট, বিশ্ব মানবতার প্রতীক, বাঙালির দুঃসময়ের বন্ধু জর্জ হ্যারিসন।

জর্জ হ্যারিসন ১৯৬৬ সালে ভারতে এসে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন। তাই তার মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী হলিউডের হিন্দু সমাধিক্ষেত্রে দেহ দাহ করা হয় এবং তার ভস্ম ভারতের বেনারসে গঙ্গা এবং যমুনা নদীবাহিকায় ভাসিয়ে দেয়া হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড