• রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ভারতে কৃষক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা নারীরা

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৩:২১
ভারতে কৃষক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা নারীরা
দিল্লির সড়কে আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে প্রতিবাদকারী নারীরা (ছবি : দ্য হিন্দু)

জীবনের বেশিরভাগ সময় কৃষিকাজে কাটিয়েছেন বলজিৎ কৌর। ৫০ বছর বয়সী এ নারীর কাছে শস্য উৎপাদন আর জমির যত্নআত্তি যেন আশীর্বাদ। কৃষিকাজ শুধু পেশাই নয়, এটি তার রক্তে মিশে গেছে। আর দশটা সাধারণ দিনে হয়তো মাঠে কাজ করেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন বলজিৎ, কিন্তু আজ দিল্লির প্রবেশদ্বার তিকরি সীমান্তে ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছেন তিনি। শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে হাজারও কৃষকের সঙ্গে নেমেছেন ‘কালো আইন’ বাতিলের আন্দোলনে।

বয়স্ক এ নারী কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে কালো আইন করেছেন তার বিরুদ্ধে আমরা আমাদের জমির জন্য আন্দোলন করছি। বলজিতের ভয়, ভারতে পাস হওয়া নতুন কৃষি আইনে তাদের জমির মালিকানা ঝুঁকিতে পড়বে। কিন্তু দেহে প্রাণ থাকতে এটি তিনি কিছুতেই হতে দিতে পারেন না।

ভারতীয় কৃষকদের মতে, দেশটিতে পাস হওয়া নতুন আইনগুলোতে শস্যের সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া নেই। তাদের শঙ্কা, এর কারণে কৃষকদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতে বাধ্য করা হতে পারে, প্রতিষ্ঠানগুলোর কথামতোই তাদের শস্য উৎপাদন করতে হতে পারে। নতুন আইনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কৃষিজমি কেনা ও পণ্য মজুতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এসব আইনকে কৃষিখাত আধুনিকায়নের জন্য বলে দাবি করেছেন। যদিও কৃষকদের বিশ্বাস, এর মাধ্যমে সংকটাপন্ন খাতটিতে চুক্তিভিত্তিক কাজের বিস্তার এবং ব্যাপক বেসরকারিকরণের দুয়ার খুলে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন : এবার লাদাখের লেহ অঞ্চলে প্রবেশ করল চীনের সেনারা (ভিডিয়ো)

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতে চলছে কৃষকদের এই আন্দোলন। দেশটির তিন কৃষি প্রধান রাজ্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশ থেকে লাখ লাখ কৃষক এসে জড়ো হয়েছেন ভারতীয় রাজধানীর প্রধান প্রবেশপথ সিংহু ও কিতরি সীমান্তে। সরকারপক্ষ আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করলেও কৃষকদের এক কথা, এক দাবি, ক্ষতিকর আইন বাতিল চাই।

পুরুষের চেয়ে নারীদের কাজ বেশি

সারা ভারতেই পুরুষরা কৃষিকাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলেও এক্ষেত্রে নারীদের অবদানও কম নয়। বরং কাজের ক্ষেত্রে তো বটেই, নতুন আইনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে নারীদের। ভারতীয় সংগঠন মহিলা কিষাণ অধিকার মঞ্চের (মাকাম) হিসাবে, দেশটির ৭৫ শতাংশ কৃষিকাজ নারীরা করলেও ভূমির মালিকানায় তাদের অংশ মাত্র ১২ শতাংশ।

পাঞ্জাবের জালান্দর থেকে প্রায় ৬৪৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তিকরি সীমান্তে এসেছেন কুলবিন্দর কৌর ও পরমিন্দর কৌর। আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে রাত কাটাচ্ছেন একটি ট্রাকের ওপর। সেখানেই তাদের সঙ্গে আল-জাজিরার প্রতিনিধির কথা হয়।

সরকারের নতুন কৃষি আইনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে কুলবিন্দর বলেন, যদি নির্ধারিত মূল্য বা বাজার না থাকে, আমরা সন্তানদের রুটি খাওয়াব কি করে? শস্য বিক্রি করব বা কি করে?

আরও পড়ুন : রুশ সীমান্তে ন্যাটোর ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের জবাব চান পুতিন

পরমিন্দর বলেন, কোনো কাজই সহজ নয়। খাবার জোগাতে আপনাকে কাজ করতে হবে। কিন্তু কাজ করার পরেও যদি আমরা খাবার না পাই, সেটাই হবে সমস্যা।

৬০ বছরের জীবনে প্রায় ৩০ বছরই কৃষিকাজে কাটিয়েছেন মুলকিৎ কৌর। তার দাবি, পাঞ্জাবে তার গ্রামে অনেক নারীই পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করেন। এমনকি এই আন্দোলনের মধ্যেও অনেক নারী কৃষককে পরিবারের দেখাশোনার জন্য বাড়িতে থেকে যেতে হয়েছে। তবে পুরোপুরি নিবৃত্ত হননি, সেখান থেকেই আন্দোলনে মূল্যবান সমর্থন দিচ্ছেন তারা।

আন্দোলনরত মুলকিৎ পরের দিন বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও এ বৃদ্ধা জানান, তিনি যাওয়ার পর পরিবারের কোনো সদস্য এসে তার জায়গা নেবেন। তার মতে, আমরা এত দূর এসেছি। আশা করি, ঈশ্বর আমাদের ডাক শুনবেন।

‘শিশুরা কষ্ট পেলে বেঁচে থেকে লাভ কি?’

ভারতের অনেক বয়স্ক নারী কৃষকের কাছেই এই আন্দোলন শুধু জমির মালিকানা বা অর্থের ইস্যু নয়। তাদের কাছে কয়েক প্রজন্ম ধরে থাকা জমি পূর্বপুরুষদের চিহ্ন, তাদের সংস্কৃতির অংশ, সন্তানদের ভবিষ্যৎ।

আরও পড়ুন : দ্রুত ব্রিটিশদের জন্য সীমান্ত খুলেবে ফ্রান্স : জনসন

বলজিৎ বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি বলবে, আমরা আওয়াজ তুলিনি? এর জন্যই রাস্তায় বসে রয়েছি, আমাদের নাতি-নাতনিদের জমি রক্ষা করতে।

তিকরি সীমান্তে আরও দুই নারীর সঙ্গে মাটিতে বসে ছিলেন জসপাল কৌর। তার কথায়, নাতি-নাতনিদের সম্পদ চুরি ঠেকাতে এসেছেন তারা। ৫৮ বছর বয়সী এ নারী বলেন, আমাদের সন্তানরা যদি কষ্ট পায় তাহলে জীবনের আর কি দাম থাকল?

অবশ্য তার এই কথা শুধু মুখের বুলি নয়, এর গুরুত্ব অনেক। দরিদ্র্যতা আর ঋণে জর্জরিত হয়ে ২০১৯ সালে ভারতে ১০ হাজারের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন।

জসপাল বলেন, আমরা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাব। তার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল, এ ধরনের মানুষগুলো এত সহজে পিছপা হওয়ার পাত্র নয়।

যৌথ রান্নাঘর আর নিঃস্বার্থ সেবা

সরকারের নতুন আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন স্থলে একসঙ্গে নেচে, গেয়ে, অভিনয়ের মাধ্যমে চলছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আন্দোলনকারীরা থাকছেন দলবেঁধে, রান্না-খাওয়া সবই করছেন এক সঙ্গে।

আরও পড়ুন : নামাজে যাওয়ার পথে আফগান সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা

স্বঘোষিত কৃষককন্যা জাসসি সাংহা বলেন, আন্দোলনের একাধিক স্থানে লঙ্গর (সাম্প্রদায়িক রান্নাঘর) খোলা হয়েছে। সেগুলো চলছে শিখদের স্বপ্রণোদিত সেবায়। বিক্ষোভকারীরা কয়েক সপ্তাহের খাবার নিয়ে এসেছেন। তারা এত খাবার এনেছেন যে স্থানীয়রাও তাদের সঙ্গে খাচ্ছেন।

পাঞ্জাবের অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী সোনিয়া মানও যোগ দিয়েছেন কৃষকদের আন্দোলনে। তিনি বলেন, হরিয়ানা, রাজস্থানসহ অন্য রাজ্যের কৃষকরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তারা সবাই এক সঙ্গে এসেছেন এবং এক সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তারা সবাইকে সম্মান করেন। হিন্দু, মুসলিম, শিখ- সবাই এখানে এসেছেন।

নিজে কৃষক আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে সোনিয়া বলেন, আমি কৃষকের মেয়ে। আমার বাবা ছিলেন কৃষক ইউনিয়নের নেতা। তিনি কৃষকদের জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এজন্য আমিও এখানে এসেছি।

টিয়ারগ্যাস ও জলকামান

ভারতে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আন্দোলনরত কৃষকদের ‘দেশবিরোধী’ বলে উল্লেখ করছে। এমনকি তাদের কিছু নেতা কৃষকদের ‘সন্ত্রাসী’ পর্যন্ত বলেছেন।

আরও পড়ুন : করোনা ভ্যাকসিন নিলেন বাইডেন (ভিডিয়ো)

সোনিয়ার মতে, তারা (বিজেপি) আমাদের আন্দোলন নষ্ট করতে চায়। তার বিশ্বাস, সরকার ও গণমাধ্যম কৃষকদের আন্দোলনকে ধর্মীয় ও দেশবিরোধী প্রমাণের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

এ জন্য আন্দোলনরত কৃষকরা ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হলেও একইসঙ্গে তারা যথেষ্ট ধৈর্য ও সতর্কতা অবলম্বন করছেন। কৃষকদের পক্ষে কে কি বলছেন, তা খুব সাবধানতার সঙ্গে খেয়াল রাখা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের কথায়, মাত্র একটিবার ‘খালিস্তান’ (শিখ বিদ্রোহীদের দাবি করা স্বাধীন রাষ্ট্র) শব্দের উচ্চারণ গণমাধ্যম ও সরকারের জন্য কৃষক আন্দোলন ধ্বংসের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।

আন্দোলন স্থলে দায়িত্বরত সাংবাদিক নিকিতা জেইন বলেন, মতামত থাকা মানেই সে দেশবিরোধী নয়। যে কৃষকরা সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক, তাদেরই কীভাবে আপনারা দেশবিরোধী বলতে পারেন?

শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারগ্যাস ও জলকামান ব্যবহারের প্রতিবাদ জানিয়ে জাসসি বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারত। কিন্তু সেখানে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে যা হয়েছে, তা স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন।

‘সরকারের ঘাড়ে পা আমাদের’

ভারতীয় পুলিশের তথ্য মতে, দেশটিতে কৃষক আন্দোলনে এপর্যন্ত অন্তত ২৫ জন মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, হাইপোথারমিয়া ও সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন : এশিয়ায় প্রথম ভ্যাকসিন পেল সিঙ্গাপুর

আন্দোলনকারী কৃষকদের অনেকেই রাতে তীব্র শীতের মধ্যে মাটিতে ঘুমচ্ছেন, কেউ ঘুমচ্ছেন ট্রাকের ওপর। টয়লেট ব্যবহার করছেন স্থানীয়দের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও সনোবল হারাননি নারী কৃষকরা।

গত সপ্তাহে কৃষক ইউনিয়নের নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ষষ্ঠ আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। দুই পক্ষই নিজ নিজ দাবিতে অনড়। কিন্তু কৃষকদের ইচ্ছাশক্তি প্রবল এবং তাদের পক্ষে ক্রমাগত জনসমর্থন বাড়ছে।

পরবিমন্দর ও কুলবিন্দর বলেন, আমরা যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানেই রয়েছি। আমরা এখানেই থাকব। কোনো সমস্যা নেই, আমাদের বাড়ির কথা মনে হচ্ছে না।

পরিবারের সদস্যরাও আন্দোলন চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছেন জানিয়ে কুলবিন্দর বলেন, তারা আমাদের ফোন করে বলছে, শক্ত থাকো, হাল ছেড়ো না।

আরও পড়ুন : আজারবাইজানের হামলায় ১৪ হাজার সেনা নিহতের স্বীকারোক্তি আর্মেনিয়ার

আন্দোলনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে পরমিন্দর ও কুলমিন্দর দু’জনই জোর গলায় বলেন, আমরা যখন তাদের ঘাড়ে পা দিয়ে রেখেছি, তারা এটা (নতুন আইন) ফেরাবে না কেন?

জাসসির কথায়, জমি মায়ের মতো। আর ভারতের মা, মেয়ে, কন্যারাই এই আন্দোলনের মেরুদণ্ড।

আরও পড়ুন : এবার রিলে অনশন করে মোদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কৃষকরা

দৃঢ় কণ্ঠে বলজিৎ বলেন, আমরা আওয়াজ তুলেছি। আমরা আমাদের অধিকার নেবই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড