• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার ঈদ সংখ্যা-১৯

ভ্রূণ

  জান্নাতুল ফেরদৌস

০৩ জুন ২০১৯, ১০:৪২
গল্প
ছবি : ভ্রূণ

রাশেদা ঘর অন্ধকার করে রকিং চেয়ারে দোল খাচ্ছে। চোখ বন্ধ করেও সে যেন নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। আজ তার অষ্টম বিবাহ বার্ষিকী। এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। কিন্তু নাদিম এখনও বাসায় ফিরেনি। রাশেদা ঠিক করেছিল, নাদিমের সাথে আজ রাতে রেস্টুরেন্টে ডিনার করবে। কিন্তু নাদিম যখন রাত নয়টা বাজলেও বাসায় ফিরল না, তখন সে নাদিমকে ফোন দিল। কিন্তু অনেক বার কল দিলেও নাদিম ফোন ধরেনি। এরপর ‘শুভ বিবাহ বার্ষিকী। আজ তোমার সাথে বাইরে ডিনার করবো।আমি রেডি হয়ে অপেক্ষা করছি।’ রাশেদা এসএমএস দিল নাদিমকে।

অনেকক্ষণ পর নাদিম উত্তরে লিখে পাঠালো, ‘আমার দেরি হবে। ঘুমিয়ে পড়।’

রাশেদা নাদিমের অফিসে আগেই খোঁজ নিয়েছে, নাদিম সন্ধ্যা সাতটায় অফিস থেকে বের হয়েছে। ড্রাইভার ইদ্রিসকে কল দিয়েছে কয়েকবার। সেও কল রিসিভ করছে না। ইদ্রিস নাদিমের খুবই বিশ্বস্ত। তার পেট থেকে কোন খবর বের করা যায় না।

এর আগেও নাদিম কোথায় যায়? কারো সাথে ঘোরে কিনা? এরকম বিবিধ প্রশ্ন করে ইদ্রিসের কাছ থেকে কোন উত্তর বের করতে পারেনি রাশেদা। এসব প্রশ্ন করলে, ইদ্রিস উদাস চোখে আকাশ বাতাস পাতাল বিভিন্ন জায়গায় তাকিয়ে, কিছুটা মুখ বেকিয়ে উত্তর দেয়, ‘ভাবি আমার ভুলে যাওয়া রোগ আছে। বেবাক কথা আমি ভুলে যায়।’

- ও তাই। তা বউ বাচ্চার কথাও ভুলে গেছ নাকি? গত তিন বছরে তুমি একবারও ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওনি। শুনলাম তোমার বেতন নাকি সবার থেকে বেশি?

- বাড়িতে টাকা পাঠাই ভাবি। ফোনে কথা হয়। ভালোই আছে তারা।

এটুকুই কথা এগোয় ইদ্রিসের সাথে। ওর বয়স পঁচিশের মতো হবে। এ বাড়িতে সে চাকরি করছে বছর চার হবে। নাদিমের সাথে থাকলে বজ্জাতটা ফোনও ধরে না। নাদিম এখন কোথায় তা জানা সম্ভব না। নানা রকম দুশ্চিন্তাই মনটা অস্থির লাগছে রাশেদার। মাস দুয়েক আগে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে নাদিমের পিছনে লাগিয়েছিল রাশেদা। খবর যা পাওয়া গেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে সামনে মহাসংকট। ডিটেকটিভের ভাষ্যমতে, নাদিম অনেকগুলো নারীর সাথেই ঘনিষ্ঠ সময় কাটায়। তবে কার বিষয়ে সে বেশি সিরিয়াস বোঝা যাচ্ছে না।

রাশেদা ভিষন মুষড়ে পড়েছিল এ খবরে। তার আসলে কী করা উচিৎ বুঝতে পারছিল না। আবার কারো সাথে পরামর্শ করবে তেমন শুভাকাঙ্ক্ষীও নাই।সবাই সুযোগ খোঁজে। ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে আলাপ করলে নিজের দুর্বলতাই প্রকাশ পাবে। ডিটেকটিভ লোকটাই একজন মনোবিজ্ঞানীর ঠিকানা দিয়েছিল। যার সাথে আলাপ করে কিছুটা শান্তি পেয়েছিল রাশেদা।

রাত একটা বাজে এখনও বাসায় ফিরেনি নাদিম। রাশেদা পোশাক বদলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঘরটা এখনও অন্ধকার। কিন্তু রাশেদার চোখে ঘুম নেই।এলোমেলো নানা চিন্তায় রাতটা পার হয়ে গেল।সে রাতে নাদিম বাসায় ফিরলো না।

লাইলি বেগম প্রথম জীবনে অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন। খুব অল্প বয়সে বিরাট এক পরিবারে তার বিয়ে হয়। শশুর- শাশুড়ি, পাঁচ ননদ, চার দেওরের সংসারের সব সাংসারিক কাজের দায়িত্ব বিয়ের দু’দিন পর থেকেই তাকে বহন করতে হয়েছে। গ্রামের চাষাবাদ সম্বল এই পরিবারের কাজের লোক, ক্ষেত- খামারের লোক সবার রান্না তাকেই করতে হতো। তারপর নিজের ছয়জন সন্তান লালন পালন সহজ বিষয় ছিল না। নিজের একান্ত প্রচেষ্টাই ছেলেমেয়েদেরকে তিনি শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন। চার মেয়ে বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে লন্ডন থাকে। ছোট ছেলে ব্যবসা করে বিশাল উন্নতি করেছে। তিনি ছোট ছেলে নাদিমের সাথেই থাকেন। তার স্বামী মারা গেছে আজ বারো বছর হল। যাইহোক এখন তার সুখের জীবন হওয়ার কথা। কিন্তু সুখ বুঝি অধরাই রয়ে গেল। নাদিমের ঘরে কোন ছেলেমেয়ে নেই। বিয়ে হয়েছে আট বছর হল, অথচ একটা বাচ্চা দিতে পারলো না রাশেদা। এ নিয়ে ভীষণ আক্ষেপ লাইলি বেগমের। বড়লোক বাবার সুন্দরী মেয়ে দেখেই নাদিমকে তিনি রাশেদার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়ের আচার ব্যাবহারও ভালো। কিন্তু বাজা। বড় ছেলের ঘরে দুই যমজ মেয়ে হয়েছে। তারা বিদেশ থাকে। যোগাযোগটা শুধু ফোনে কথা বলাতেই সীমাবদ্ধ। দেশের ভিতর একবার বিমানে উঠে ভীষণ ভয় পেয়েছেন তিনি। সেকারণে বড় ছেলের কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি যেতে নারাজ। আর এসব বিবিধ কারণে তিনি বংশধরদের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত। তাই নাদিমের ঘরে একটা ছেলে হবে, শিশুটিকে নিয়ে তার ব্যস্ত সময় কাটবে এসব তার বহুদিনের আশা। কিন্তু সে আশায় পুরোই গুড়ে বালি। বছর দুয়েক হল নানা জায়গায় পির ফকিরের কাছে রাশেদাকে নিয়ে তিনি নিজেই অনেক দৌড়েছেন। তাবিজ, পানি পড়া, তেল পড়া, আরো কতশত নিয়ম পালন করিয়েছেন রাশেদাকে দিয়ে। রাশেদা নিজেও ডাক্তার দেখিয়েছে। পাশাপাশি শাশুড়ির এসব কর্মকাণ্ডও পালন করেছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন আর ধৈর্য্য নেই লাইলি বেগমের। বছর খানিক হল তিনি খেয়াল করেছেন, নাদিমের ভাবগতিক বদলে গেছে। বাইরেই বেশি সময় কাটায়। বউকে নিয়ে আগে যেমন বেড়াতে যেতো, তাও বন্ধ। বাড়িতে ফিরতে হয়, তাই যেন বাড়ি ফেরে নাদিম।

একদিন রাশেদার সামনেই নাদিমকে তিনি বললেন, ‘অনেক তো হল। নাদিম আমি তোকে আবার বিয়ে দেব।’

উত্তরে নাদিম কিছুই বলল না। তার এই নিশ্চুপ থাকা যেন সম্মতিরই প্রকাশ। রাশেদা ঘর থেকে চলে গিয়েছিল। রাশেদাকে নিয়ে আর ভাবতে চাননা লাইলি বেগম। তিনি স্পষ্ট বুজতে পারছেন, এই সংসারের শান্তি এনে দিতে পারে একটি সন্তান। লাইলি বেগম ভালো করেই জানেন, একটি সংসারে বর-বউয়ের ভালোবাসা বলে একসময় কিছুই থাকে না। সন্তানই তখন কেন্দ্রবিন্দু হয়। সন্তানই তখন বর বউকে দায়িত্বর বাঁধনে বেধে রাখে।

সন্তানের টানই তখন বড় টান। বউ যতোই রূপবতী গুণবতী হোক সংসারে সন্তান না থাকলে, সে সংসারের কোন শান্তি থাকে না। এসব বিষয় নিয়ে তিনি একদিন রাশেদার সাথে কথাও বলেছেন। রাশেদা চুপ করে তার কথা শুনেছে। যাইহোক লাইলি বেগম মেয়ে দেখা শুরু করেছেন। এবছরই তিনি নাদিমকে আবার বিয়ে দিতে চান।

নিজেদের মাঝের দূরত্ব নিয়ে নাদিমের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে রাশেদা। কিন্তু নাদিম কোন সহযোগী মনোভাবই প্রকাশ করছে না। সে নিজের মতো বাসত আছে। রাশেদা গাইনির ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নাদিমকে কখনো সাথে করে নিয়ে যেতে পারেনি। নাদিম সবসময় বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছে। প্রথম দিকে সে বলতো, ‘বাদ দাওতো। আল্লাহ দিলে এমনিতেই বাচ্চা হবে। আর আমি যাব কেন? আমার কোন সমস্যা নেই। তুমি চাইলে যাও ডাক্তার দেখাও গিয়ে।’

ফলে রাশেদার চিকিৎসা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। শেষে শাশুড়ির সাথে পির দরবেশের কাছে গিয়েছে। এটাই ছিল শেষ ভরসা। কিন্তু তাও কোন সুখবর হলো না। রাশেদা এরমাঝে একদিন নাদিমকে বললো, ‘তুমি কি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাও?’

নাদিম অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ডেসিনটেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। ঘুরে সে পিছনে দাঁড়ান রাশেদার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শোন একটা বাচ্চা থাকলে ভালো লাগতো, এটা আমি মিস করি। তাই বলে তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা আমি ভাবিনা।’ - তাহলে আরেকটা বিয়ে কর। নাদিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘মেনে নিতে পারবা?’

এরপর ঘর থেকে বের হয়ে গেছে সে। একবার পিছন ফিরে তাকালোও না। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো রাশেদার। চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল। গলায় চিনচিন ব্যথা শুরু হলো। কান্নাকে আর দমানো গেল না। জমে থাকা কষ্ট গুলো অশ্রু হয়ে বের হতে লাগলো।

মনোবিজ্ঞানী রাশেদাকে বলেছিল আপনি ডিভোর্স দিতে চান। রাশেদা তখন বলেছিলো কিছুতেই না। আমি নাদিমকে ছাড়া থাকতে পারবো না। কিন্তু রাশেদা নাদিমকে তার অপকর্ম নিয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। সে শুধু আল্লাহর কাছে একটি সন্তান চেয়েছে। একটি শিশুই সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। নাদিমের অবহেলা, অপকর্ম এসব যদি সে নীরবে মেনে নিতে পারে, সতীনের উপস্থিতি মেনে নেওয়াটা কী খুব বেশি কঠিন হবে? নিজেকেই প্রশ্ন করে রাশেদা।

একদিন শাশুড়ির কাছে গিয়ে সে বললো, ‘মা আমরা যদি একটা বাচ্চা পালক নেই, কেমন হবে?’

লাইলি বেগমের মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেল। এই কথা শুনে ক্ষিপ্ত গলায় তিনি বললেন, ‘শোন আমার কোন ছেলেমেয়ের কোন সমস্যা নেই। সবার বাচ্চা হয়েছে। শুধু তোমার দোষে এই ঘর শূন্য। আমি কেন অন্য লোকের বাচ্চা এই ঘরে আনবো। আমার ছেলেকে আরেকটা বিয়ে দিব। তখন দেখবা আমার বংশধর নিয়া আমি কি করি।’

রাশেদা আর কোন কথা বলার সুযোগ দেয়নি। চলে গেছে নিজের ঘরে।

রুম্পার পরিবার নিম্নবিত্ত। রুম্পা দেখতে অনেক সুন্দর। এই হতদরিদ্র পরিবারে তাকে মানায় না। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিল সে। কিন্তু পড়াশোনা আর আগাবে বলে তার আশা নেই। এটুকু আসতেই তাকে অনেক প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। বড় মামা এর মাঝেই তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। ছেলে বড় ব্যবসায়ী। বিশাল বাড়ি, গাড়ির মালিক। ছেলের মা তাকে দেখে পছন্দ করে আংটি পরিয়ে গেছে। পাত্র আসেনি। কারণ সে ভীষণ ব্যস্ত থাকে। পাত্রের ছবি তাকে দেখানো হয়েছে। খুবই স্মার্ট আর সিনেমার নায়কদের মতো সুদর্শন। তাকে যে আংটি পরিয়ে গেছে পাত্রের মা তাও খুবই দামি।

আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি সবার মাঝেই এখন একটাই গল্প, কি রাজকপাল নিয়ে রুম্পার জন্ম। তা না হলে এমন পরিবারের মেয়ে ঐ রকম বড়লোকের ঘরে যেতে পারে। রুম্পার বাবা নিজে একদিন পাত্রের বাড়ি গিয়ে সব দেখে এসেছেন। তার কাছে বর্ণনা শুনে চেনাজানা সকলে মুখে হাসি দেখালেও অন্তরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছেন অনেকেই। রুম্পার কাছে এখনও সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। একটা বিষয় রুম্পা জানতে পারলো বিয়ের ঠিক একদিন আগে। তাকে সতিনের সাথে মিলেমিশে সংসার করতে হবে। রুম্পার স্বপ্নটাই যেন তছনছ হয়ে গেল। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এমন একটা পাত্রের সাথে জেনেশুনে তার বাবা মা বিয়ে ঠিক করেছে। টাকা-পয়সাই কি সব!

গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। পাত্র পক্ষ থেকে অনেক দামী শাড়ি, গয়না ও আনুষঙ্গিক আরো অনেক কিছু পাঠানো হয়েছে। সবাই হতবাক হয়ে এসব জিনিস দেখছে আর রুম্পার ভাগ্যকে ধন্য ধন্য করছে। কিন্তু রুম্পার সেকল দিকে কোন মন নেই। তাকে ঘটনাটা জানিয়েছে বড় খালা। রুম্পার চেয়ে বয়সে বড় নিজের মেয়েকে এখনও বিয়ে দিতে পারেননি। বড় খালা কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়েই রুম্পাকে এসে বললেন, ‘তোর বাপ মা পারেও। বউ বাজা বলে বেটা আরেকটা বিয়ে করতেছে। টাকা দেখে অন্ধ হয়ে গেছস। কিন্তু সতীনের ঘরের জ্বালা বুঝবি কদিন বাদেই।’

রুম্পার মা তখনই সে ঘরে ঢুকলেন। তারপর বোনকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তখন বাইরের লোক ছিল না। ফলে বিষয়টা ধামাচাপাই রয়ে গেল। কিন্তু আগুন জ্বলছে রুম্পার মনে। তার বাবা ও মা ঘরে ঢুকলো। রুম্পার মা সবাইকে বললো, ‘সবাই বাইরে গিয়ে বস। ওকে একটু গোছানোর সুযোগ দাও।’

সবাই বের হয়ে গেলে দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিলেন রুম্পার মা। রুম্পা বিছানায় বসে আছে। এঘরে একটা পড়ার টেবিল, একটা চেয়ার আর একটা আলনা আছে। ওর বাবা বিছানায় রুম্পার পাসে গিয়ে বসলো। ওর মা চেয়ার টেনে এনে ওদের সামনে বসে রুম্পাকে বললো, ‘তুই মুখ এমন বেজার করে রাখছিস কেন?’

রুম্পা কোন উত্তর দিল না। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। ওর বাবা কথা বলা শুরু করলো, ‘শোন মা, তুই তো জানিস আমাদের সংসার কীভাবে চলে। ওরা কিছুই লুকায় নাই। ঐ বউটার বাচ্চা হয় না। ছেলের এত টাকা পয়সা এগুলা কে খাইবো। আমি নিজে সব দেখে আসছি। তারা কত বড়লোক তুই চিন্তাও করতে পারবি না। আমি যা করতেছি, তোর ভালোর জন্যই করতেছি।’

রুম্পা একদম নিশ্চুপ। ওর মা এবার বললেন, ‘শোন। ঐ বউএর বাপের বাড়িও নাকি বড়লোক। তুই গেলে দেখবি, সে আর থাকবে না। ঠিকই চলে যাবে। তখন তুই একাই হবি রাজরানি। কোন মতে একটা বাচ্চা হইলে আর চিন্তা নাই।’

রুম্পা এতক্ষণ ঘাড় নিচু করে বসে ছিল। এবার সে মাথা তুলে বললো, ‘আমারও যদি কোন বাচ্চা না হয়, তখন কী হবে মা।

রুম্পার বাবা এবার গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘মারে কোন বাপ মাই তার সন্তানের অমঙ্গল চাই না।’

কথা শেষ করে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। রুম্পার মা মেয়ের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। রুম্পা আর নিজেকে থামাতে পারলো না। সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

আজ নাদিমের বিয়ে হল। নতুন বউ নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি এসে পৌঁছে গেছে বরযাত্রীর দল। খুব নিকট আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ জনেরাই এ বিয়েতে উপস্থিত ছিল। যে ঘরে এতদিন রাশেদা ও নাদিম থাকতো, আজ থেকে সেখানে রুম্পা আর নাদিম থাকবে। রাশেদা আজ দুপুরের আগেই নিজের সব কাপড়, জিনিস পত্তর এ ঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বাসর ঘর। রাশেদা এখন থেকে থাকবে ওর শাশুড়ির ঘরটির পাশের ঘরটিতে। এ ঘরটি এতদিন তেমন ব্যাবহার করা হয়নি।

রাত এগারোটা বাজে। মেহমানরা সবাই একে একে চলে গেছে। লাইলি বেগম নাদিমকে বললেন, ‘যা ঘরে চলে যা। অনেক ধকল গেলো আজকে। আর তোরা কোথাও বেড়াতে যা। কয়েকদিন কাজকর্ম থেকে একটু ছুটিনে।’

নাদিম চলে গেল নিজের ঘরে। পাশের ঘর থেকে কথাগুলো শুনলো রাশেদা। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলো। নিজের নতুন ঘরের দিকে এগোলো সে। রাত দুইটা বাজে। বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছে রাশেদা। ওর ভাই গতকাল এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ও যায়নি। ভাইকে বলেছে, ‘আমি এর শেষ দেখতে চাই। যেদিন আমি এ বাড়ি ছাড়বো, তোমাকে জানাবো ভাইয়া।’

কিন্তু ওর এখন মনে হচ্ছে, চলে গেলেই ভালো হত। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো রাশেদা। ঘর থেকে বের হল। আনমনেই হেটে গেল নিজের আগের ঘরটির দিকে। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। দরজায় আস্তে চাপ দিল। ভিতর থেকে দরজা লাগানো। দরজায় কান পাতলো, কোন কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ভিতরে লাইট বন্ধ, বোঝা যাচ্ছে। রাশেদা দরজার কাছে বসে পড়লো। এমনটা কেন আমার সাথেই হল, যেভাবেই হোক একটি সন্তান চাই আমার। কিছুতেই আমি নাদিমকে দুরে সরে যেতে দিবনা। এ বাড়িতে আমার জায়গা অন্য কাউকে দখল করতে দিবনা। তা যেকোনো ভাবেই হোক। মনে মনে এগুলোই ভাবলো রাশেদা।

উঠে দাঁড়ালো সে। নিজের ঘরে গিয়ে আর্কষণীয় একটা নাইট ড্রেস পরলো। তারপর গায়ে একটা চাদর চাপিয়ে দোতলা থেকে চুপিচুপি নিচে নেমে এল।

রাশেদা এখন ইদ্রিসের ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে। আস্তে আস্তে ধাক্কা দিল সে দরজায়।

ইদ্রিস দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল, কেননা রাশেদা তখন চাদরটা খুলে দাড়িয়ে আছে তার সামনে।

আরও পড়ুন- নিঃশ্বাসে তুমি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড