• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৬ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার ঈদ সংখ্যা-১৯

নিঃশ্বাসে তুমি

  রুনা তাসমিনা

০২ জুন ২০১৯, ১০:৩৬
গল্প
ছবি : নিঃশ্বাসে তুমি

চাঁপা ফুলের সুবাসেও আজ মিশে আছে বিষণ্ণতা। ঝিঁঝিঁ পোকারাও নিশ্চুপ। রাতের গায়ে মলিন জোছনার আবরণ। সেই মলিন আলোয় মৃদু বাতাসের সাথে আনমনে খেলছে পুকুরের পানি। শান বাঁধানো ঘাটে নাদিমের হাতে হাত রেখে বসে আছে নিঝুম। নিঝুমের হাত সাবধানে ধরেছে নাদিম। মেহেদী ঝরে গেলে গাড় হবে না। মেহেদীর রঙ গাঢ় না হওয়া নাকি বিয়ের শুভ লক্ষণ নয়। নাদিম চায় না নিঝুমের জীবনে কোন অশুভ ছায়া পড়ুক। নিঝুম চুরি করে দেখা করতে এসেছে নাদিমের সাথে। বিয়ে বাড়িতে এখনও হয়তো অনেকেই জেগে আছে। এদিকে কেউ আসলে ওদের দু'জনকে একসাথে দেখলে তুলকালাম কাণ্ড হবে। কিন্তু আজ নিঝুমের ভয় ডর কিছুই নেই। নাদিমের সাথে দেখা করা নিয়ে বাবার হাতে কত মার খেয়েছে। মোটামুটি অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে নিঝুম। দশম ক্লাসে উঠার পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার পর বাবার নিষেধে আর পড়া হয়নি। বাবার নিষেধ শুনে অনেক কেঁদেছিল নিঝুম। কান্নাকাটিতেও বাবার মন গলে নি। তার এককথা। মাইয়া মাইনষের অত বেশি লেহাপড়া করনের দরকার নাই। যতটুক না অইলে চলব না,অতটুক লেহাপড়া অইছে। সেদিন থেকেই স্কুল যাওয়া বন্ধ হলো নিঝুমের। স্কুলে যাওয়ার পথেই চাষা নাদিমকে দেখে ভালো লাগতো। রোদে পোড়া গায়ের তামাটে রঙ, সুঠাম শরীর নিঝুমকে কেমন যেনো টান তো। চোখাচোখি হলে নাদিম চোখ নামিয়ে নিতো। দলবেঁধে স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিদিনই দেখ তো নাদিমকে। কখনো জমিতে হাল দিতে,কখনো রাস্তার ধারে বসে থাকতে। চাচাতো বোন লিপির চোখ এড়ায় নি নিঝুমের চুপিচুপি দেখা। টিপ্পনী কেটে একদিন বলেই ফেলে, কি রে! চাষার প্রেমে পড়লি না কি রে নিঝুম!

দূর মুখপুড়ি! বলে নিঝুম, লিপিকে ধমক দিলেও বুঝেছিল তার কিশোরী মনে চাষা ছেলেটি দোলা দিয়েছে। পড়তে বসে মন চলে যেতো সেই মেঠো পথে,যেখানে সেই চাষা ছেলেটি বসে থাকে। তখনো নাম জানা হয়নি তার। একদিন হঠাৎ তাদের বাড়ির উঠোনে বাবার সাথে ছেলেটিকে দেখে ভয়ে বুক শুকিয়ে এসেছিল নিঝুমের। পরে মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় জেনেছিল নাদিম নামের চাষা ছেলেটিকে তাদের জমি দেখার ভার দিয়েছে বাবা। ছেলেটি নাকি খুব ভদ্র আর বিশ্বাসী। মনে মনে বেশ খুশি নিঝুম। স্কুল বন্ধ হওয়ায় এতদিন মনে যে কান্না ছিল তা বন্ধ হলো নাদিমকে আবার দেখতে পেয়ে। সেদিন বাবার কাছে কি এক কাজে এসেছিল সে। সাহস করে নিঝুম তার হাতে গুঁজে দিল একটি চিঠি। হতবিহ্বল নাদিম ইতিউতি চেয়ে চিঠিটি তড়িঘড়ি করে গুঁজে রেখে দেয় লুঙ্গি কোমরের কাঁছায়। অশিক্ষিত নাদিম সেই চিঠি কাকে দিয়ে পড়িয়েছে নিঝুম জানে না। তবুও ভালোবাসা হয়ে গেলো। বেশিদিন গোপন থাকলো না তাদের প্রেম। কীভাবে পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেলো তাদের প্রেমকাহিনী। গ্রামে এই সম্পর্ক নিয়ে ঢি ঢি পড়ে গেলো। বাবা নিঝুমকে মেরেছে। নাদিমকেও কম শাসায়নি। তাকে কাজ থেকে বিদায় করে দিয়েও বাবার শান্তি মেলেনি। শেষে উপায় না দেখে বিয়ে ঠিক করলো মেয়ের। শাওন মাসটা ভরা বরষার দিন হলেও এ মাসের বিয়েতে নাকি মঙ্গল বেশি। ঠিক হলো শাওন মাসের প্রথম সপ্তাহেই বিয়ে হবে।

আত্মীয় স্বজনে গমগম করছে ঘর। মেহেদী লাগিয়ে নিঝুম অপেক্ষা করছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের। সে আসবে কিনা জানা নেই। তবুও মন বলছে সে আসবেই। দরকার হলে সারারাত পুকুরঘাটে একলা কাটাবে তার অপেক্ষায়। আজ মারের ভয়ও নেই। বাবার পছন্দের ছেলের ঘরেই সে যাচ্ছে বউ হয়ে। সংশয় নিয়ে ঘাটে এসে দেখে নাদিম বসে আছে! একটি মাছ পুকুরে ঘোলা দিতেই যেন বাস্তবে ফিরে এলো।

আইজকার পর তো আর দেহা অইব না। তুমি এমুন কইরা ভালোবাসাবা তো? ছিঃ! কি কস এইসব নিঝুম! আমি কি তরে ভুলতে পারমু? তুই য্যান আমারে ভুইলা যাস হেই দোয়াই করতাছি।

ক্যান? ক্যান গো নাদিম? ক্যান ভুইল্যা যামু তরে? পাপ অইব। তাই। কাইল তুই আরেকজনের বউ অইবি। তহন আমারে মনে কইরলে গোনা অইব।

নাদিমের কথায় বুকের ভেতর মুচড় দিয়ে ওঠে কি যেন। কেউ যেন খাবলা দিয়ে চেপে ধরে হৃৎপিন্ড নিঝুমের। নাদিমের হাত চেপে ধরে বলে, ‘বাজানের কতায় বিয়া বইতাছি। কিন্তুক এইহানে, এই কইলজার ভিত্রে যে তোমারে বাইন্ধা রাখছি তারে ক্যামনে মুক্তি দিই কও?’

বিয়ের লগ্নে এসব অলুক্ষুণে কথা কইতে নাইরে। জমিদারের ঘরে অনেক সুখী হইবি তুই। দেহিস! নিঝুমের চোখের জল গাল বেয়ে পড়ছে বুকে। ভিজে যাচ্ছে নাদিমের হাত। ধুয়ে যাচ্ছে নিঝুমের মেহেদী। চাঁদের আলতো আলোয় খেলছে পুকুরের মাছ। নাদিম বিড়বিড় আকাশের দিকে মুখ করে বলছে, মেহেদীর রঙ গাঢ় হোক।

রাত শেষ হয়ে আসছে। মসজিদ থেকে আজানের শব্দ কানে আসতেই তড়াক করে ঘাটের সিঁড়ি থেকে নেমে নাদিম নিঝুমের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে। লুঙ্গির কোঁচড় মুখের উপর উঠে আসে বার বার। নাদিমের যাওয়া দেখতে দেখতে ধীর পায়ে নিঝুম ফিরে যায় ঘরে।

লাল বেনারসি পরে বউ সেজে পাটিতে বসে আছে নিঝুম। গা ভরা সোনার গয়না আর শাড়ির সোনা রঙ জরি ঝিলিক দিচ্ছে একটু নড়লেই। বরপক্ষ মনে হয় এসে গেছে। কাচারি ঘরের সামনে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে তার একপাশে করা হয়েছে বর বসার জায়গা।

সাজগোজে কোন কমতি রাখেনি নিঝুমের বাবা। শোরগোলে বিয়েবাড়ি সরগরম। মূর্তির মতো বসে আছে নিঝুম। বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি এসে কিছুক্ষণ আগে পান ছুঁইয়ে নিয়ে গেছে। কাজি সাহেব নিঝুমকে পড়ে শোনালেন হবু স্বামীর পরিচয়। শফিউল মওলার চার নম্বর ছেলে হোসেন মওলার সাথে ফিরোজ উদ্দিনের কন্যা উম্মে বিলকিস নিঝুমের বিবাহ ধার্য করা হয়েছে। এই বিয়েতে কন্যার মত আছে কিনা। তিনি পরপর তিনবার কথাগুলো বললেন। জেটিমা পাশ থেকে নিঝুমকে তাগাদা দেয় কবুল বলার জন্যে। নিঝুমের মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না। চোখের জলে ভেসে যায় লাল বেনারসি শাড়ি। গা ভর্তি সোনার গয়না সাপের মতো আঁকড়ে ধরে নিঝুমের গলা, হাত,কান। ইচ্ছে করে একছুটে পালিয়ে যায় এই কোলাহল থেকে। দূরে বহু দূরে। চুপ করে থাকা নিঝুমের সম্মতি বুঝে বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি লাল সুতোয় বাঁধা কয়েকটি পান নিঝুমের হাতে ছুঁইয়ে দিয়ে বলেন, কন্যা কবুল বলছে। নিঝুম ফ্যালফ্যাল করে ঘোমটার পাতলা আড়াল থেকে তাকিয়ে দেখে ওদের চলে যাওয়া। সবাই একসাথে কথা বলছে। তার কিছুই সে বুঝতে পারে না। নাদিমকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কি করছে সে এখন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। সে কি এখনো লুঙ্গির কোঁচড় দিয়ে চোখের পানি মুছছে! নাকি প্রতিদিনের মতো হালের বলদগুলো নিয়ে জমিতে হাল দিচ্ছে! বিয়ে বাড়ির এই হৈচৈ থেকে পালিয়ে নাদিমের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কানে আসে বাবার হাঁকডাক, জমির কাকুর বাতাসা বিলির ব্যস্ত শব্দ,মালা পরিয়ে বরের কাছ থেকে আদায় করা টাকা নিয়ে খুশিতে ডগমগ ছেলেপেলের খুশি মাখা কথা।

সোনার চুড়ি ভরা,গাঢ় মেহেদী রঙের হাত শেষ বিকেলে বাবা তুলে দেয় হোসেন মওলা নামের লোকটির হাতে। অনেক জমি, অনেক টাকার মালিক হোসেন মওলার বউ হয়ে গেলো নিঝুম। পাশ থেকে চাচাতো বোন লিপি কানে কানে বলে, অনেক সুখী হইবিরে তুই। গাঁয়ের লোকের কাছে জমিজমা আর পাকা বাড়ির লোকদের আলাদা কদর! লিপি হয়তো এরকম বরই চায়। আর নিঝুম! সে বুঝতে পারে না কোথায় সুখ! এই জমিদারের ঘরে নাকি ওই চাষা নাদিমের ঘরে! কিন্তু মনের কথাটি ঠিকই বুঝতে পারে। গাঁয়ের মেয়েদের মন বলে কিছু থাকতে নেই। কাউকে তাদের ভালোবাসতে নেই। নাদিমের মতো গরীব লোকের বউ হওয়ার সাধ থাকতে নেই।

মেয়ে বিদায়ের সময় মা বাবার চোখের জলে ভিজে যায় নিঝুমের লাল বেনারসি। বিকেলের শেষ লগ্নে বউ নিঝুমকে নিয়ে হোসেন মওলার গাড়িটি চলতে শুরু করে তার বাড়ির পথে। গাঁয়ের মেঠো পথে ধীরে ধীরে পিছলিয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে নিঝুমের শৈশব, কৈশোর, বাবা-মা, বাড়ি, চাঁপা ফুলের গন্ধ আ-র চাষা নাদিম!

আরও পড়ুন- আবিরের ঈদ আনন্দ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড