• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রক্তশূন্য নারী শ্রমিকদের কাঁধে চেপে এগোচ্ছে বাংলাদেশ

  রকিবুল সুলভ

১৩ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:৪৯
নারী পোশাক শ্রমিক
বাংলাদেশের নারী পোশাক শ্রমিক (ছবি : আল অ্যারাবিয়া)

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন রেখা। অসুস্থ স্বামী আর দুই সন্তানের ভরণ-পোষণে তাকে এই পেশায় আসতে হয়েছে। সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খাটা-খাটুনি করে যে টাকা আয় হয়, তাতে ঘরভাড়া, স্বামীর ওষুধ ও সন্তানের স্কুলের খরচ দেওয়ার পর ঘরে খাবার কেনার জন্য খুবই অল্প টাকা থাকে।

কাজ করতে করতে হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যান রেখা। সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেয়। বেতনের প্রায় অর্ধেক টাকা খরচ করে করা পরীক্ষায় দেখা যায়, রেখা অ্যানিমিয়ায় বা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। এরপর থেকে কিছুদিন কাজে নিয়মিত হতে পারেননি তিনি।

রাজধানীর বাড্ডায় একটি পোশাক কারখানার কর্মী আফসানা। বেরাইদে একটি টিনের ঘর ভাড়া করে দুই সন্তান আর শাশুড়ি নিয়ে দিন যাপন করেন স্বামীহারা আফসানা। অভাবের তাড়নায় স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারেননি তিনি। ক্যান্সারে আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হন তিনি।

কোনো গতি না দেখে পোশাক কর্মীর কাজ নিতে হয় আফসানাকে। বেতন খুব বেশি নয়। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করে বাসায় এলেই শুরু হয়ে যায় ঝগড়া। শাশুড়ির সাথে অকথ্য ভাষায় গালি বিনিময় হয় তার।

শুধু রেখা কিংবা আফসানা নয়, বাংলাদেশে প্রায় অধিকাংশ নারী গার্মেন্টস কর্মীদের প্রাত্যহিক গল্প অনেকটা এরকমই। বিজিএমইএ বলছে, পোশাক শিল্পের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের এর ৬৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৬ লাখই নারী।

বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিক (ছবি : রয়টার্স)

তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের বার্ষিক আয় ৩ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে শিল্পের ধারাবাহিক ব্যাপ্তি ঘটলেও শিল্পের সঙ্গে জড়িত নারী শ্রমিকরা রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টিতে ভুগছেন। এছাড়া মানসিক বিষণ্ণতায় ভুগছেন তারা।

চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের ওপর প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের ৮০ শতাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।

ঢাকা ও ময়মনসিংহের চারটি কারখানার ২৬০০ শ্রমিকদের ওপর চালানো গবেষণায় আইসিডিডিআরবি দেখিয়েছে, ১৮-৪৯ বছর বয়সী ওই নারী শ্রমিকদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।

আইসিডিডিআরবি'র গবেষণার ফল বলছে, শুধু রক্তস্বল্পতাই নয়, অপুষ্টিজনিত অন্যান্য শারীরিক জটিলতায়ও ভুগছেন নারী পোশাক শ্রমিকরা। কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করার এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতাসহ শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতে উৎপাদনশীলতায় এর প্রভাব পড়ে।

চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, খাদ্যে আয়রনের অভাব, কৃমি, রক্তক্ষরণ, মাতৃদুগ্ধ পান করানো ও পেপটিক আলসারের কারণে মূলত মানুষ রক্তস্বল্পতায় ভুগে।

এ বিষয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানুষ রক্তস্বল্পতায় ভুগলে অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়। একই সাথে কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়। রক্তস্বল্পতার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে আয়রন ও আমিষের ঘাটতি অন্যতম। নারী পোশাক কর্মীদের এই রক্তস্বল্পতা উৎপাদনশীলতায় প্রভাব ফেলে।

তবে এ বিষয়ে কী বলছেন পোশাক কারখানার মালিকরা? এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পোশাক কারখানার মালিকরা দোষ চাপাচ্ছেন নারী শ্রমিকদের জীবনযাপনের পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর। তারা বলছেন, মেয়েরা গ্রাম থেকে আসায় তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। এক সময় পোশাক কর্মীদের দুপুরের খাবার প্রদান করা হতো। এখন তারা খাবার না নিয়ে টাকা নিতে চায়।

আইসিডিডিআরবি'র গবেষণায় বিপরীত চিত্রও উঠে আসে। গবেষণা বলছে, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ফলে নারী শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি ঘটছে।

পোশাক কর্মীদের সংগঠনের নেতারা মনে করছেন, বাংলাদেশে বর্তমান বাজারে কর্মীদের বেতন খুবই কম। যেখানে বেতনের অল্প টাকায় সংসারই চলে না, সেখানে পুষ্টিকর খাবার দুঃস্বপ্ন।

নারী পোশাক শ্রমিকদের পুষ্টির মান উন্নয়নে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন)। প্রকল্পটির আওতায় ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত নারী শ্রমিকদের মধ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল ও আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়। এছাড়াও কর্মীদের পুষ্টিবিষয়ক আচরণ পরিবর্তনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

এই রক্তশূন্য ও অপুষ্ট নারীদের ওপর ভর করে দিন-দিন ব্যাপ্তি পাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ পোশাক শিল্প। এই পুষ্টিহীনতা নিয়েও অতিরিক্ত সময় কাজও করে যাচ্ছে নারী পোশাক কর্মীরা। ২০১৭ সালে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলার, ২০১৫ সাল শেষে আয় ছিল ২ হাজার ৮০৯ কোটি ডলার ও ২০১৪ সালে ২ হাজার ৫৪৯ কোটি ডলার।

বাংলাদেশে পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিক (ছবি : রয়টার্স)

চলতি বছরের আগস্টে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নারী এবং পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ৯৩ ভাগ শ্রমিক কারখানায় হয়রানির শিকার হয় না বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

শুধু অপুষ্টি কিংবা রক্তশূন্যতা নয়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা ও অপর্যাপ্ত মজুরি পোশাক শিল্পের উন্নতিতে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন অনেকেই। দেশের ৯৭.৫ ভাগ কারখানায় কোন ট্রেড ইউনিয়ন নেই। যেগুলা আছে, তারা কার্যত দুর্বল অথবা অকার্যকর।

তবে একটু আশার আলো হচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা ধরে খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। খসড়ায় ৪ হাজার ১০০ টাকা মূল মজুরি ধার্য করা হয়েছে।

বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ৩৫০ এবং খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা। সব মিলিয়ে মোট মজুরি দাঁড়ায় ৮ হাজার টাকা। ২০১৩ সালের নিম্নতম মোট মজুরি ছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা।

১৯৯৬ সালে পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে তা হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা ও ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা ছিল। সবশেষ ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।

পোশাক শিল্পে নারী কর্মীদের স্বাস্থ্য উন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সঠিক সময়ে নির্ধারিত মজুরি প্রদান বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে পারে বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদগণ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড