• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : মৃত্যু আয়োজন

  মুহাম্মদ বরকত আলী

২৪ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:১১
ছবি
ছবি : প্রতীকী

কাসেম ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। কাসেমের বৌ ঘরের দরজায় খিড়কি লাগিয়ে উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগল। এটা তার নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গেছে। এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর মাস পেরুতে না পেরুতেই তাদের সংসার জীবনে যোগ হয়েছে এই কান্না। পাড়ার লোকের ভয়ে নতুন বৌ হিসেবে প্রথম প্রথম গলার স্বর নামিয়ে চুপিচাপি কাঁদতো। কিন্তু নতুন বৌ আর কত দিনই বা নতুন থাকে, সে একদিন পুরোনো হয়, ভয় লজ্জা দূর হয়। সময়ের সাথে সাথে আলেয়াও বদলেছে। সে এখন এই বাড়ির পুরোনের বৌ, তাই কান্নার স্বরটাও বদলেছে। এখন সে মিনমিন করে কাঁদে না, গলার ভোকাল বাড়িয়ে উচ্চ স্বরে কাঁদে। মকবুলকে শোনায়, পাড়া পড়শিদের শোনায়। সবাইকে বোঝাতে চাই সে কত কষ্টে আছে। এতক্ষণ মকবুল বারান্দায় বসে চুপচাপ শুনেছে ছেলে-বৌয়ের সংলাপ। মকবুলের সমস্ত দুঃখকে ছাপিয়ে এখন এই একটাই দুঃখ তার। কত শত চেষ্টা করেও ছেলেটাকে নিজের বসে আনা গেল না।

কাসেমের মায়ের জন্য ছোট কাল থেকে শাসন-বারণ করতে পারেনি কখনো। তাদের বড় আহ্লাদে একমাত্র ছেলে কাসেম। পরপর চারটা কন্যা সন্তানের পর আল্লাহর কাছে চাওয়া পর ঘর আলো করে এসেছিল এই কাসেম। ছেলের বাবা হওয়ার আনন্দে সারা গ্রামে মিষ্টি বিলিয়েছিল মকবুল। ন’এর কামানের দিন নিজের খচরে শশুর বাড়িতে কিযে আয়োজন করেছিল তা আজো মানুষের মনের কোনে স্মরনীয় হয়ে আছে। সেই আদরের ছেলেই কিনা আজ অশান্তির কারণ। মকবুলের তার বাবার কোনো সম্পত্তি ছিল না। নিজের রক্ত পানি করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাত দিন গায়ে গতরে খেটে আজ তার সোনার সংসার হয়েছে। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, বিঘে দশেক আবাদি জমি করেছে মকবুল। গ্রামে আরও দশজনের জনের মত নাম ডাক আছে মকবুলের। সংসারে যখন সুখের ভরা যৌবন ঠিক তখনি এই সুখের কালে হঠাৎ একদিন বৌটা সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে গেল। গানের ভাষায় বলতে হয়, ‘সবার কপালে নাকি সুখ সয় না।’

এখনি ছিল তার সুখের কাল। কিন্তু সেই সুখ তার কপালে জোটেনি। ফেলে আসা কষ্ট গুলো মনে পড়ে আর বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে মকবুল হোসেনের। এখন তার বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এই ছেলে। কিন্তু ছেলেটা যদি কিছুটা কর্মঠ্য হত তাহলে তার কোনো দুশ্চিন্তা থাকত না। যে সম্পদ-সম্পত্তি সে তিলে তিলে দাঁড় করিয়েছে সেই সম্পদ-সম্পত্তি গুনধর পুত্রের হাতে পড়লে স্রোতের মুখে পড়া বালির বাঁধের মতই হারিয়ে যেতে সময় লাগবে না। চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছে বুনিয়াদি ঘর দেখে। আল্লাহর রহমতে জামাই মেয়েদের কোনো কিছুর কমতি নেই।

মকবুলের কাছ থেকে তারা কিছু আশাও করে না। মকবুলের সহধর্মীনি মহুয়া বেগমের বিয়োগ কালের কয়েক মাস পর একমাত্র পুত্র কাসেমের বিয়ে দিয়ে বৌ নিয়ে আসে ঘরে। সব কিছুই ঠিক ঠাক চলছিল। হঠাৎ ছেলের মাথায় আগুন এই জন্য যে, এই সংসার এখন থেকে সে নিজেই দেখাশোনা করবে। মকবুল হোসেন ছেলের এই প্রস্তাবে বেশ খুশি হলেন। বাবার বসয় হয়েছে। এখন ছেলেকেই সংসারের ভার দিতে হবে এটাই প্রকৃতির নিয়োম। কিন্তু ছেলে সুর বদলিয়ে বলল, ‘গাধার মত এভাবে খাটুনি করে চলতে পারি না, সয় সম্পত্তি যা আছে সব আমার নামে লিখে দিতে হবে।’ তখন থেকেই আনো পানি, ঢালো পানির মত অবস্থা মকবুলের। অমানুষ খাটুনি খেটে এই সম্পত্তি তার ছেলের জন্যই ধরে রেখেছে। কিন্তু মকবুল হোসেনের মনে আশংক্ষা তার ছেলের বাউন্ডুলিপনা ছেলেকে একদিন ভয়ংকর অবস্থায় দাঁড় করিয়ে ছাড়বে। সারাদিন এপাড়া ওপাড়া ঘুরে ফিরে যার দিন কাটে তার আবার সংসার। ছেলে সংসারি হলে মকবুলের মত খুশি কে বা হত। কিন্তু কাসেম সেই ধাচের ছেলে না যে সংসারে মন দেয়। এই সংসার তার হাতে পড়লে বছর গড়াতে না গড়াতেই এই সম্পত্তির কানা কড়িও থাকবে না সেকথা মকবুলের শত ভাগ বিশ্বাস। তাই মকবুল চাই তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই সংসারের হাল নিজের কাধেই রাখবে। মৃত্যুর পর ছেলেকেই তার সংসার চালাতে হবে। যা কর্ম করবে সেটাই তার প্রাপ্য হবে।

সারাদিন কেটে গেল, সন্ধ্যা হলো, রাত হলো, কাসেম বাড়ি ফিরল না। বিয়ের আগে এভাবে কত দিন রাত পার করেছে বাইরে। ভেবে ছিল বিয়ের পর হয়তো বা তার এই বাউ-ুলিপনা কেটে যাবে। কিন্তু সে আশার মুখে ছাই ঢেলে বরাবরের মত স্বভাব রয়েগেছে। আলেয়া স্বামীর অপেক্ষায় থেকে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মকবুল মাঠে বেরিয়েছিল সেই সকালে। সারাদিন মাঠে কাজ করে ফিরেছে বিকেলে। ছেলের বৌকে জিজ্ঞেস করেছিল কাসেম বাড়িতে ফিরেছিল কিনা। আলেয়া এর কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব দেয়নি। মকবুল গোসল সেরে খাবার খেয়ে বারান্দায় বসে অপেক্ষা করেছে ছেলে ফিরবে। না, ফেরেনি সে। তখন না হয় বয়স ছিল রাতেই কোথাও না কোথাও থেকে খুজে বের করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতো। এখন বয়সের ভারে শরীর আর আগের মত চলে না। রাতেকালে চলতেও পারে না। চোখে কম দেখে। কাসেম ফিরবে ফিরবে করে অপেক্ষায় থেকে সেও ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালের সূর্য ওঠার আগেই মকবুল হোসেন বের হলেন ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে। এত পাড়া ওপাড়া খোজাখুজির পর পাওয়া গেল উত্তর পাড়ার কছিমদ্দিনের চায়ের দোকানের। মাঝ রাত পর্যন্ত চা, পাউরুরি, কলা, খেয়ে আর ক্যারাম বোর্ড খেলে কাটিয়েছে সময়। আড্ডা শেষে সবাই বাড়ি ফিরলেও কাসেম বাড়ি ফেরেনি। বাশের মাচানে বিচালি বিছিয়ে ঘুমিয়েছে সারারাত। ঘুমন্ত কাসেমের মাথায় হাত রাখে মকবুল। মাথায় হাত পড়তেই চোখ মেলে কাসেম। চোখ জোড়া জবা ফুলের মত লাল হয়ে আছে। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে। মনের মধ্যে না জানি কত মান অভিমান পুষিয়ে রেখেছে। অভিমান ভাঙ্গিয়ে কাসেমকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরল মকবুল। মকবুলের বিশ্বাস ছিলো যে, ছেলে যাই করুক না কেনো অন্তত মকবুলের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে না। কিন্তু এখন সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। এপর্যন্ত যা হয়েছে সব কাসেম তার বৌয়ের সাথে শলামর্শ করেই করেছে। নিশ্চয় গ্রামের কিছু লোক ছেলেকে খেপিয়েছে। এরপর থেকে সংসারে মাঝে মধ্যেই কারণে অকারণে রেষারেষি আর ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা মকবুলকে ধরে বলে, ‘ছেলের হাতে সংসারের হাল ছেড়ে দাউ, দেখবে সংসারের চাপে তার এই বাউ-লিপনা কেটে যাবে। সংসারি হবে।’ কিন্তু ভয় হয়, তবুও ভয় হয় মকবুলের। কথায় আছে, ‘যে বিড়াল শিকারি হয়, তার গোফ দেখলেই চেনা যায়।’

নিত্যদিন এই রেষারেষির হাত থেকে মুক্তি পেতে একদিন ছেলের হাতে সমস্ত জমির দলিল তুলে দিয়ে মকবুল হোসেন বলল, ‘এ পর্যন্ত যা কিছু করেছি তা তোমার জন্যই করছি। এই সম্পত্তি, এই সংসার, এই হর্তাকর্তা আজ থেকে তোমার কাছে হস্তান্তর করলাম। আমাকে দুবেলা দুমুঠো ভাত দিলেই চলবে। আজ থেকে আমার মুক্তি।’ এতটুকু বলেই বারান্দায় পাতানো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল মকবুল হোসেন। কত কষ্টের নিজ হাতে সাজানো সংসার আজ অন্যের হাতে। একদিন তার নিজের হাতেই সাজিয়ে উঠেছিল এই সংসার। নিজের বলতে নিজেকে ছাড়া কিছুই খুঁজে পেল না মকবুল।

মকবুল হোসেন সেই যে বিছানায় পড়ল আর উঠল না। সংসার হারোনোর শোকে নাকি ছেলের ভবিৎষ্যত নিয়ে চিন্তায় আজ বিছানাগত সেকথা একমাত্র মকবুল হোসেনই জানেন। তার এত শোক হত না, যদি ছেলেটা ঠিক মত সংসার করতো। এমন বেখেয়ালিপানা ছেলের হাতে আত্মসমার্পন করা মানে নিশ্চিত তার কষ্টের সম্পদ বানের জ¦লে ভাসে যাওয়া। এছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। ছেলের কাছে হার মানতেই সে বাধ্য। ক’দিন হলো খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে মকবুল হোসেন। খবর পেয়ে জামাই মেয়েরা এলো। কত রকমের ফলমূল, জুস আর মিষ্টান্য নিয়ে হাঁজির হলো আত্মীয় স্বজন। মকবুলের শিওয়েই পড়ে রইল সেসব। মেয়েদের আপ্রাণ চেষ্টায় কোনো মতে বেচেঁ থাকার মত কিছু মুখে দিত মকবুল। শরীরের অবস্থা দিন দিন অবনতি হতে থাকল। কত কবিরাজ, ডাক্তার দেখানো হল। কত পথ্য খাওয়ানো হল। তবুও মকবুল বিছানা ছাড়ে না। শহরের বড় বড় ডাক্তারেরা ধরতে পারলো না তার আসলে কোন অসুখে ধরেছে। মনের অসুখ ধরতে পারে এমন যন্ত্র বোধ করি আজ অব্দি কোথাও আবিষ্কার হয়নি। বাড়িতে আত্মীয় -অনাত্মীয় ভরে গেছে। যে যার মত কানাকানি করতে লাগল যে, বেচারা কার পানি পান করার আশায় বেঁচে আছে কে জানে। দিন দিন শরীর শুকিয়ে যায়। কথা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হলে কথা বলে আর ইচ্ছে না হলে একটি শব্দও বের করে না। আজ দুদিন এক ফোটাও পানি পান করেনি। চোখের পাতা মেলে তাঁকায়নি। মাথার কাছে বাটি ভর্তি ডাবের পানি। একে একে অনেকেই এক চা চামচ করে মুখে ঢেলে দিচ্ছে ডাবের পানি। কিছুটা গলা দিয়ে নামছে আর কিছুটা কলসা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে পাঁচ দিন অতিবাহিত হবার পর কিছুটা চোখ মেলে তাকাল মকবুল হোসেন। মেয়ে জামায়ের সাথে কথাও বলল। মেয়েরা বাবাকে নিয়ে যেতে চাইল। মকবুল কিছুতেই গেল না। বাবার সুস্থতা দেখে মেয়েরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিদায় নিল। মেয়ে জামাই আত্মীয় স্বজন সবাই চলে গেছে। মকবুল হোসেন এখন কোনো মতে উঠে বসতে পারে। নিজ হাতে দু’মুঠো ভাতের দলা মুখে তুলতে পারতে। প্রসাব-পায়খানায় যে কষ্ট হলেও একাই কোনো মতে যাওয়া আসা করছে। এভাবে দু দশদিন চলার পর আবার পড়ল বিছানায়। এবার আগের চেয়েও খারাপ অবস্থায় গিয়ে পৌছাল। রাতের বেলা কাসেমকে ঘরের ভিতর ডেকে নিয়ে আলেয়া চুপিচুপি বলল, ‘মানুষের মৃত্যুর আগে কিছু ইচ্ছে থাকে। যেমন ধর কিছু খেতে ইচ্ছে করা। কাউকে দেখতে ইচ্ছে করা। আত্মীয় স্বজন সবাইতো এসে দেখে গেছে। আমার মনে হয় আব্বা কিছু খেতে চাই। জিজ্ঞাসা করে দেখো না কিছু খেতে মন চাই কিনা। শুধু শুধু বেচারা কষ্ট করছে। ছেলে বৌয়ের ফিসফিসানি মকবুলের কানে এসে পৌছায়। সব কথা স্পষ্ট শুনতে পায় মকবুল। একেকটা কথা যেন একেকটা বিষ মাখানো তীর হয়ে মকবুলের কলিজায় এসে আঘাত করে। কাসেম আর দেরি করে না। ঘর থেকে বের হয়ে বাবার পাশে এসে বসে। আলেয়া দরজায়র পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘আব্বা কিছু খেতে মন চাচ্ছে? কিছু খাবেন? কোনো ফলমূল, মিষ্টি বা অন্যকিছু?’ মকবুল চোখের পাতা খুলে ধীরে ধীরে তাঁকাল কাসেমের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। ভাঙ্গা স্বরে বলল, ‘আম খেতে মন চাই বাপ।’ এতটুকু বলেই চোখ বন্ধ করল। চোখের দুকোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুফোটা অশ্রু। এই অশ্রু দেখার মত সময় কাসেমের নেই। কাসেম বৌয়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘আব্বা আম খেতে চায়।’ কাসেমের বৌ বলল, ‘আমি বলছিলাম না, জানে-মনে কিছু একটা চাচ্ছে? আম না খাওয়া পর্যন্ত হয়তো আল্লাহ তাকে তুলে নিচ্ছেন না। তুমি তাড়াতাড়ি আমের ব্যবস্থা কর।’ সকাল হতে না হতেই কাসেম আমের সন্ধানে বের হল। সারা মোকাম খুঁজেও আমের সন্ধান পেল না। এখন আম পাওয়া এত সহজ না। আমের মৌসুম শেষ হয়েছে সেই কবে। কাসেম মনে মনে ভাবে, ‘আব্বা তো নিজেও জানেন এই সময়ে আমের মৌসুম না, তবুও কোন আক্কেলে আম খেতে মন চাইল? আরও কত কিছুই তো আছে সেগুলোর একটা বললেইতো পারত। রঘু কাকার দোকানে বিখ্যাত রসগোল্লা, মিঠায়, সন্দেশ, কিছু একটা বলতে পারত। ওগুলো মনে চাইল না, মনে এখন চাই আম। আম খেতে মন চাই, আম। একটা কথা হলো?’ কথা গুলো মনে মনে আওড়ায় আর আমের সন্ধান করে। বাবার শেষ ইচ্ছেটা তাকে পুরণ করতেই হবে। তানাহলে সারা জীবন মনের মধ্যে একটা কষ্ট থেকে যাবে তার আব্বা আম খেয়ে চেয়েছিল, কিন্তু খাওয়াতে পারেনি। এটা তার বাবার প্রতি ভালোবাসা নাকি বাবার জন্য মৃত্যু আয়োজন? মোকামে কোথাও আমের দেখা মিললো না। অবশেষে একজনের পরামর্শে শহরের উদ্দেশ্যে ছুটল। আমের মৌসুম না হলেও শহরে নাকি কোথাও কোথাও সারা মাস আম পাওয়া যায়।

মাগরিবের আজান হচ্ছে চারিদিকে। বেশ মোটা সোটা একটা আম হাতে বাড়ি ফিরল কাসেম। কাচা হলুদ রঙ্গের আমের কয়েকটা ফালি মকবুলের সামনে হাঁজির করা হলো।

মকবুল ছেলে বৌয়ের কথাগুলো শুনে দুঃখে অভিমানে ইচ্ছে করেই বলেছিল আম খেতে মন চায়। তার ভালোই জানা ছিল যে, মাথা ঠুকলেও এখন কোথাও আম পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু মকবুলের এটা জানা ছিলো না যে, আজ কালকার দুনিয়ায় অনেক কিছুই বদলে গেছে। ছেলে-বৌয়ের হাতে মৃত্যুর আয়োজন দেখে মকবুলের বুক আটকিয়ে আসছে। কাসেম পাশে বসে আমের একটা টুকরা মকবুলের মুখে ধরে বলল, ‘আব্বা আম খান।’ মকবুলের ঠোট কেপে উঠল। ঐ কাপা কাপা মুখে গুজে ধরল আমের এক ফালি। মকবুলের গলা দিয়ে কেমন করে নামবে এই মৃত্যুর পথ্য? গলা যেন আটকে যাচ্ছে।

আম খাওয়ানোর আয়োজন শেষে আরও দুই দিন অতিবাহিত হয়েছে তবুও মকবুল দিব্বি বেঁচে রইল। এই দুইদিনের মধ্যে একটি বারের জন্যেও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি। কাসেমের বৌ বিরক্ত স্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘এভাবে আর কতদিন? আমি আর পারছি না। জানি না কার পানি মুখে নেওয়ার আশায় আছে।’ মকবুল অসাড় দেহে পড়ে আছে। চোখ দুটো জেগে আছে। কানে স্পষ্ট শুনতেও পাচ্ছে। কথাগুলো শোনা ছাড়া আজ আর কোনো উপায় নেই তার। কথা বলতে গেলে বুক আটকিয়ে আসে। তার ভাবনায় ছিল গুণধরপুত্রের হাতে সম্পত্তি অর্পণ করলে সেগুলো আর ঠেকানো যাবে না। কিন্তু কখনো ভাবতেও পারেনি যে, একদিন তারই আদরের দুলাল তার মৃত্যু কামনার জন্য কত বিচিত্র আয়োজন করবে। কথাগুলো ভাবতে থাকে আর দুচোখের কোনা দিয়ে কান্না নামের নদীর দুই শাখা নিরবে বয়ে চলে। সেই নদীর এখন ভরা যৌবন। সব সময়ই প্রবাহমান।

আজ মকবুলের অবস্থা ভিষন রকমের খারাপ। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেছে পনের বিশ দিন হল। চোখ মেলেও তাঁকাচ্ছে না। সকাল থেকেই বাড়ি ভর্তি লোকজন। মেয়ে জামাই আত্মীয় অনাত্মীয়ের আবারও আগমন। পূর্বের মত আজও সবাই একে একে লাইন ধরে চা চামচে করে মুখে পানি দিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মক্তব থেকে তালেবুল এলেমদের ডেকে দিয়ে আসা হয়েছে। কোরআন তেলোয়াত করা হচ্ছে। মক্তবের মৌওলানা সাহেব এসে দোয়া দরূদ পাঠ করছেন। সবার মনে একটাই কথা, না জানি কার পানি পান করে মকবুল হোসেন চির বিদায় নিবেন। কাসেমকে পাশে বসানো হল। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল এক চামুচ পানি। মকবুলের মুখে ধরতেই মকবুল কোনো মতে চোখ তুলে তাকালো ছেলের দিকে। ঐ একবারই চোখ তুলে তাঁকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নিবর হল। কাসেম কাঁপা কাঁপা হাতে পানি ভর্তি চামুচ মুখে ধরল। কিছুটা অসাড় গালায় নেমে গেল আর কিছুটা দুকলসা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। দিন পেরিয়ে রাত হল। আয়োজন শেষ। তবুও মকবুল মরে না। কথায় আছে, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে।’

মকবুল হোসেন অসাড় দেহে নিস্তব্ধ পড়ে রইল। বাড়িতে এখন শুধু মেয়ে জামাই, ছেলে, ছেলের বৌ। সকাল বেলা মসজিদের ইমাম সাহেব এসে কাসেম ও জামাইদেরকে সাথে নিয়ে বসল। ইমাম সাহেব বলল, ‘বাবা কাসেম তোমাকে একটা পরামর্শ দিই, তোমার বাবার আত্মার খুব কষ্ট হচ্ছে। জানের বদলে জান কুরবানি করতে হবে। মানে, একটা জানের সাদকা দিলে ভালো হয়। একটা গরু জবাই করে গ্রামের মানুষদের মাঝে বিলি কর। দেখবে আল্লাহর ইচ্ছা হলে ভালোই ভালোই চলে যাবে। ইমামের প্রস্তাবে কাসেম সম্মতি দিল। গোয়াল থেকে একটা মোটাতাজা ষাঢ় গরু বের করে জবাই করা হল। গোস্ত বিলি করা হল সারা গ্রামে। মসজিদে দোয়া করা হলো মকবুলের মৃত্যু কামনায়। এসবই হল মকবুলের মৃত্যু আয়োজন। তবুও মকবুল মরে না। সপ্তাহ খানেক পর একদিন মকবুলের বাড়িতে কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। কাসেমের বৌয়ের গলা ফাটানো কান্নার আওয়াজ। মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে ‘একটি শোক সংবাদ...।’

মকবুল হোসেন এই সংসারের মায়া ছেড়ে চলে গেছেন চির নিদ্রায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড