• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : ভূত দাদুর সাথে

  নিশো আল মামুন

২৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:২৭
গল্প
ছবি : প্রতীকী

আমি তখন খুব ছোট। তোমাদের মত। শহরে একটা শাদা রঙের দু’তলা বাড়িতে থাকতাম। তিন ভাইবোন মিলেমিশে একটা রুমে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যেতাম। কখনো কখনো খুব জুড়ে হেসে উঠতাম। কি যে আনন্দ! তোমার হয়ত বিশ্বাস করবে না। এক দিন রাতে কোন কারনে আমাকে সেই রুমে একা থাকতে হলো। কেন জানি ঘুম আসছিলো না। এপাশ ওপাশ করছি। দেয়াল ঘড়ি টিক টিক করে অনেক বেজে গেছে। এমন সময় ঘরের কোনে যে মোমবাতি জ্বলছিল, সেটা প্রায় মিনিট পাঁচ ধরে জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ নিভে গেল। এর মধ্যে আমাদের বাসায় দু’একটা ভূতের কান্ড কারখানাও ঘটে গেছে। তাই মোমবাতি নিভে যাওয়ার পর ভয় করতে লাগল। শুধু ভূতের কথা মনে পড়তে লাগল। দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে একটা বেজে গেল। হঠাৎ মনে হল কে যেন অন্ধকারে আমার বিছানার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পায়ের আওয়াজ, ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে। সে যেন কি খুঁজছে। পাচ্ছে না। দ্রুত একবার রুমে একবার বারান্দায় ছুটাছুটি করছে। ধপ করে একটা হাত আমার শরীরে স্পর্শ করল। ভয়ে আমার গাঁ ছমছম করতে লাগল। তারপরও ভয় ভয় গলায় বললাম, কে, কে ওখানে। হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেলো। একটা কথা খুব স্পষ্ট শুনতে পেলাম, আমি দাদু ভাই। ভূত। ভয় পাচ্ছ। গল্প করতে এসেছি তোমার সাথে।

আমি ভয় পেয়ে কূলবালিশটা খুব শক্ত করে ধরলাম, কিছুক্ষন পর আমার ভয়টা একটু কেটে গেলে বললাম, এই রাতে কেউ গল্প করে। বল কী। আমরাতো রাতেই গল্প করি। ঘুরে বেড়াই। কী সুন্দর জোছনা একবার দেখতে ইচ্ছে করে না। আমার ভয় ততক্ষনে আরো অনেক ক্ষানি কেটে গেছে। জানালার পর্দা একটু সরিয়ে দেখি, ঝক ঝকে জোছনা। বললাম,তুমি দেখ। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সে বলল, তুমি একা বুঝি? তবে, তবে তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় বসে গল্প করা যাক। কোথায় ।

ভয় নেই। আমি তোমার দাদুর মত। তুমি আমাকে ভূত দাদু বলে ডাকবে। ভূত দাদু আমাকে সাঁই সাঁই করে উড়ে নিয়ে শহরের শেষ প্রান্তে বসল। বলল,একশ বছর আগে আমিও ঠিক তোমার ছোট ছিলাম। গ্রামে ছ’ভাই আর তিন বোন, মা বাবা মিলে থাকতাম। একটা লম্বা তালগাছে। তালগাছের নীচে উঠোনটা ফক ফক করত। পাশে পুকুরটা চক চক করত। গ্রামটা ছিল রুপসী চাঁদের মত।

তোমার যেমন তিন ভাইবোন গল্প কর, ঠিক তেমন করে আমরা ভাই বোনেরা মিলে গল্প করতাম। এই পঞ্চাশ বছর ধরে শুধু একা একাই শহরে হু হু করে বেড়াচ্ছি। আজ তোমার সাথে আমার সেই ছোট বেলার গল্প করব। নিরুপায় দেখে উৎসাহ নিয়ে বললাম, সেই ভালো।

সব চেয়ে মজার কথা যদি শুনতে চাও তাহলে আমাদের গ্রামের কথা বলি । ভূত দাদু চাঁদের দিকে তাকালো। তারপর বলল, গ্রামটা ম’রে গেছে ।গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে অনেকেই। পালিয়ে এসেছি আমি। ওই গ্রাম আজও স্বপ্নে দেখি । ফেরার আর পথ নেই। পুকুর বাঁধানো ঘাটে ভিড় লেগে থাকত সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। নদীটা একে বেঁকে চলে গেছে বহু দূর । উত্তর দিকটা ছিল বনের মত । সেকথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। শুনছ? কেমন লাগছে। আমি বললাম, মানুষ দাদুর চেয়ে তোমার গল্পের শুরুটি বেশ মজার।

তবে শোন, যখন জোছনায় ভেসে যেত সমস্ত গ্রাম। আমরা সবাই মিলে নদীতে গোসল করতাম। মাঠে নেচে গেয়ে খেলতাম। আমার ভাই বাশিঁ বাজাতো খুব সুন্দর। বোনেরা মিলে উড়ে উড়ে সমস্ত গ্রাম, পুল ঘাট ঘুরে বেড়াতাম। পশ্চিমে মাঝির বাড়িটা ছিল খুব চক চকে ঝলমলে। ইচ্ছে হচ্ছে গ্রামটা তোমার চোখের সামনে দাড় করি। যেন রুপসী, সবুজ, শ্যামল কন্যার মত। তোমার কী মনে হয়।

আমি খুব নীচু স্বরে বললাম, আমিতো গ্রাম দেখিনি। তবে ছবিতে দেখেছি। বুঝেছি ছবির চেয়েও সুন্দর গ্রাম। তোমাকে আর অনেক বলতে হবে না। ভূত দাদু খপ করে আমার ডান হাত চেপে ধরল। বলল, অন্ধকার রাতে বাতাসে বাতাবি লেবুর শাদা ফুলের গন্ধ ভেসে আসত। জোনাকি পোকা জ্বলত নিভত। ঘুগরা পোকা ঝিইইই ঝিই ডাকত। ঝুম বৃষ্টি এলে মাঝি বাড়িতে, মাতবরের বাড়িতে ভোনা খিচুরীর গন্ধ বের হত। তখন আমরা ভাই বোনেরা টিনের চালে ঢিল ছুরতাম। তারা ভয়ে জড়সর হয়ে পড়ত গ্রামের সড়কটা খুব উচুঁ ছিলনা। পিচ ঢালা ছিল না। মাঠ থেকে একটু উচু ছিল। ওই সড়ক ধরে মানুষ যেত। গরু যেত। ভোরবেলায় মক্তবে আওয়াজ উঠত, আলিফ দুইপেশ উন, বে দুই পেশ বুন। খালি গায়ে হেডমাস্টার সাহেব নাদুশ নুদুশ শরীর দুলিয়ে সিসার ঘটি নিয়ে ঘাটে যেতেন। মহাজন বাবু যেতেন সাইকেলে। ফিরে আসতেন সন্ধ্যের পর হলুদ কলার কাদিটা থাকত সাইকেলে। কখনো কখনো আমরা ভাইবোনেরা সাইকেল টেনে ধরতাম। পালকিও যেত দু’একটা। নতুন বউ। শীত এলে গাঁয়ের মা, খালা, নানী দাদীরা পিঠা বানাতো। আমরা আশে পাশে ঘুরতাম। হঠাৎ হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতাম, দে একটা পিঠা। তোমরা তো বেশ দুষ্ট ছিলে।

ভূত দাদু খট খট করে হেসে উঠল। বললাম, গ্রাম ছেড়ে চলে এলে কেন? ভূত দাদু গো গো করে নিশ্বাস ছাড়লো। বলল, আহ্ দাদুভাই গ্রাম আর গ্রাম নেই। আগে সব শোন।

একদিন সকালে দেখি কালো একটা গাড়িএলো। কি সব নামানো হল। ক্যমেরা, দুরবিন। আরো কতকিছু। ইয়া মোটা কালো লোকও নামলো গাড়ি থেকে। চোখ দুটু শকুনের মত। কিছু দিনের মধ্যে মট মট করে গাছ ভাঙল, ঘর ভাঙল, গ্রামটাও ভেঙে গেল। সড়কটাও খুব বেশি উচু হয়ে গেল। মাটিতে বড় বড় দালান উঠল। ঠিক যেন নরপিচাশের কঙ্কালের মত। একদিন তালগাছটাকেও মট করে ভেঙে ফেলল। সমস্ত গ্রামটার মৃত্যু হল। ভূত দাদু কথা শেষ করে কান্না করল। তারপর বলল, সুন্দর রাখি। ফুট ফুটে জোছনা। দক্ষিনের বাতাস আর নেই দাদু ভাই। আমরা সবাই চলে এলাম তোমাদের এই শহরে।

আমারও খুব খারাপ লাগল। ইচ্ছে হল কেদে ফেলি। ভূত দাদু আমাকে একটা কলম দিল। বলল,যখন বড় হবে। মানুষ হবে। গ্রামের মত সুন্দর করে এই নগরগুলো গড়ে তুলবে। গল্পটা কেমন লাগল। আমি বললাম, খুব ভালো।

ভোরে প্রথম কাক ডাকল। বললাম দাদু ভাই আরো গল্প করবে কী। কোন আওয়াজ শুনলাম না। দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। ভোরের আলো ঘরে ঢুকল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড