• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘নিস্তব্ধতা’-এর তৃতীয় পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : নিস্তব্ধতা

  রিফাত হোসেন

০২ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:২৬
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ঘরে বসে না থেকে ফারাবী ড্রয়িংরুমে চলে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে দেখে ওর বাবা দরজা খুলে দিচ্ছেন। ফারাবী ড্রয়িংরুমেই দাঁড়িয়ে রইল। দরজা খুলে দেওয়ার পর দু’জন ইউনিফর্ম পরা লোক ভিতরে এলো। লোক দু’টো ভিতরে এসে ফারাবীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ।’

ফারাবী সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আপনারা বসুন।’

ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ বললেন, ‘আপনার মায়ের কাটা মাথাটা কোথায়? বাইরে আমাদের লোক আছে। ওরা মাথাটাকে পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যাবে এক্ষুনি।’

ফারাবী মিস্টার আহসান এর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা, তুমি উনাদের মায়ের কাটা মাথাটা একটু দেখিয়ে দাও। ততক্ষণে আমি ইনস্পেক্টর এর সাথে কথা বলি।’

মিস্টার আহসান সম্মতি জানালো। মাসুদ আহমেদ পাশের ইউনিফর্ম পরা লোকটাকে বলল, ‘ওদের ভিতরে আসতে বলেন। আর সাথে আপনি-ও যান।’

- ওকে স্যার।

লোকটা দরজার কাছে গিয়ে কাদের যেন ডাক দিলো। সাথে সাথে বাইরে থেকে আরো দু’জন চলে এলো। মিস্টার আহসান তাদের নিয়ে দু’তলায় নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলেন। ফারাবী ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ কে সবটা বলতে লাগলেন।

সবটা শোনার পর ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ অবাক কণ্ঠে বললেন, ‘এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার। আপনি লাইফ সাপোর্ট ছাড়া অতবড় রিস্ক নিতে গেলেন কেন? আর কে সেই সন্ত্রাসী, যে এইরকম ভয়ঙ্কর কাজ করে বেড়াচ্ছে?’

- আমার মনে হয় ওই সন্ত্রাসী এই খুনের সাথে জড়িত নন। কারণ যারা লাশটা গুম করার প্ল্যান করছিল, তাদের মধ্যে একজন বলছিল যে, বাবা এসে গেছে, আজ আর লাশ সরানো যাবে না। বাবা যদি জানতে পারে আমরা এইসব ঝামেলায় জড়াইছি। তাহলে আমাদের আর রক্ষা নেই। এটা নিশ্চিত যে সেই সন্ত্রাসী এই খুনের বিষয়ে কিছুই জানে না এখনো। অন্তত এই লোকটার কথা দ্বারা এইটুকু স্পষ্ট। নাহলে বাবা আসছে জেনে, ভয়ে লাশ গুম করার প্ল্যান ক্যান্সেল করতো না তারা।

- সে তো বুঝতে পারছি। বাট ওটা যে আপনার মায়ের লাশ নয়, সেব্যাপারব তো আপনি নিশ্চিত। তাই না?

- আমি নিশ্চিত নই ইনস্পেক্টর। দু'টো সম্ভাবনা আছে আমার কাছে। একটার দ্বারা বুঝা যায়, ওটা আমার মায়ের'ই লাশ৷ আরেকটার দ্বারা আবার বুঝা যায়, ওটা আমার মায়ের লাশ নয়। কখনোই হতে পারে না। একেবারে অসম্ভব।

ইনস্পেক্টর কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘যেমন?’

- হতে পারে মৃত্যুর অনেকক্ষণ পর মায়ের মাথা কেটে আলাদা করা হয়েছে। তাই শরীর পঁচে যাওয়া সত্ত্বেও মাথাটা ঠিকঠাক ছিল। আবার হতেও পারে ওটা আসলেই অন্য কারোর লাশ। আমার মায়ের লাশ অন্য কোথাও আছে।

- দ্বিতীয়টা হওয়ার সম্ভাবনা-ই বেশি দেখছি আমি। কারণ আপনার কথানুযায়ী আপনার মায়ের মাথা থেকে অনেক রক্ত পড়ছিল তখন। মাথা দেখে মনে হয়েছিল, মাত্র কিছুক্ষণ আগে তাকে খুন করা হয়েছে।

- হ্যাঁ। আর রক্ত দেখে মনে হয়েছিল রক্ত দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। একদম তাজা রক্ত।

- তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি।

- হ্যাঁ। আপনি এটাই বলতে চাইছেন যে, পঁচে যাওয়ার শরীরের মানুষের মাথা থেকে কখনোই অতটা তাজা আর প্রচুর রক্ত পড়বে না। মৃত্যুর এতক্ষণ পর মৃত মানুষের রক্ত আর জীবিত মানুষের রক্তের মতো থাকে না।

- ঠিক ধরেছেন।

- কিন্তু ওই বাড়িতে যে একটা লাশ আছে, সেটাতে তো কোনো ভুল নেই। লাশটা যার-ই হোক না কেন, ওদের শাস্তি পাওয়া উচিত।

- সে তো অবশ্যই। আমি নিজে গিয়ে হাতেনাতে ধরব ওদের। লোকটা যতবড় সন্ত্রাসী-ই হোক না কেন, আমার হাত থেকে পার পাবে না।

- তবে এটা মাথায় রাখবেন, খুনটা কিন্তু উনার ছেলে করেছে।

- সেটা তো ওদের এরেস্ট করার পর জানতে পারব। এইরকম ছোটখাটো বহু মাস্তানদের মুখ থেকে আসল কথা বের করেছি আমি। এই লোকের থেকেও পারব। পরে বুঝতে পারব, বাবা খুনি, নাকি ছেলে খুশি। নাকি দু’জনেই খুনি।

- লোকটা মোটেও ছোটখাটো সন্ত্রাসী নয়। আমি শুনেছি সে নাকি শহরের নামকরা একজন সন্ত্রাসী।

- কী নাম লোকটার?

- রেদোয়ান রোহান। তবে আমি শুনেছি তাকে কেউ কেউ শুধু রোহান, আবার কেউ কেউ রেদোয়ান নামে চিনে।

ফারাবীর কথা শুনে ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। এমনভাবে ফারাবীর দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন নামটা শুনে তার গলায় কাঁটা জাতীয় কিছু একটা আটকে গেছে। ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললেন, ‘আপনি কী নামটা ঠিক বলছেন? মানে লোকটার নাম আসলেই কী রেদোয়ান রোহান?’

- হ্যাঁ। আমি যতটুকু জেনেছি, উনার নাম রেদোয়ান রোহান।

ইনস্পেক্টর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘অসম্ভব। আমি কখনোই পারব না উনার বাড়িতে গিয়ে লাশের খোঁজ করতে।’

ফারাবী অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু কেন?’

- উনাকে হয়তো ভালো করে চিনেন না আপনি। উনি যে একজন সন্ত্রাসী, তা আপনি জানেন। কিন্তু আপনি হয়তো এটা জানেন না উনার চলাফেরা কাদের সাথে। উনি নিয়মিত সরকারের সাথে ওঠাবসা করেন। এর আগেও একটা কেইসে উনার বাড়িতে গেছিলাম আমি। যখন পুরো বাড়ি খোঁজ করেও কিছু পেলাম না, তখন তিনি আমার চাকরি খাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। সেই সাথে আমাকে মেরে ফেলার হুমকি। অনেক বড় ঝামেলায় পড়েছিলাম আমি। শেষে মাফ চেয়ে কোনোরকমে চাকরি সহ নিজেরা জীবনটা বাঁচিয়েছিলাম। একই ভুল আমি দ্বিতীয়বার করতে চাই না। উনার জন্য-ই আমাকে শহর ছাড়তে হয়েছে। উনি আমাকে সরাসরি বলেছিল, ভুল করেও যেন উনার শহরে পা না দেই আমি।

- উনার শহরে পা না দেন মানে? উনি তো এই শহরেই আছে এখন। এইতো দু'টো এলাকা পেরোলেই উনার বাসা।

- উঁহু। উনার বাসা অন্যজায়গায়। এটাও হয়তো উনার বাসা, তবে তিনি এখানে থাকেন না। হয়তো মাঝে মাঝে কোনো কাজে আসেন।

- ওহ্। কিন্তু এবার তো ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আমি নিজে শুনেছি এবার অনুভব করেছি ওই বাড়িতে একটা লাশ আছে।

- হয়তো আছে। তবুও ওখানে গিয়ে কোনো লাভ হবে না।

- কেন?

- কারণ আমি এমনি এমনি উনার বাড়িতে ঢুকে সার্চ করতে পারব না। কোর্ট থেকে অর্ডার আনতে হবে। আর ততক্ষণে উনি সেটা টের পেয়ে লাশটা সরিয়ে ফেলবেন। এরপর আমরা ওখানে গিয়ে দেখব কিচ্ছু নেই। ফলস্বরূপ চাকরির সাথে সাথে জীবনটা যাবে আমাদের।

ফারাবী কিছু বলতে চেয়ে-ও থেমে গেল। সিড়ি দিয়ে নেমে আসছে ইউনিফর্ম পরা তিনজন পুলিশ। সাথে মিস্টার আহসান। পুলিশগুলো বাইরে যেতে চাইলে হঠাৎ ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ উনাদের থামতে বলল। ফারাবী একবার মাসুদ আহমেদ এর দিকে তাকালো। মাসুদ আহমেদ বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। এরপর আস্তেধীরে এগিয়ে গেলেন ইউনিফর্ম পরা একজনের দিকে। যার হাতে থাকা একটা সাদা কাপড়ে মোরানো আছে ফারাবীর মায়ের কাটা মাথাটা। তবে মাসুদ আহমেদ এর নরজ সাদা কাপড় ভেদ করে বেরিয়ে আসা ফারাবীর মায়ের চুলের দিকে। মাসুদ আহমেদ চুলগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কাপড়টা একটু সরান তো। আমি উনার মুখটা দেখবো।’

সিনিয়র এর কথা শুনে ঝটপট কাটা মাথাটা থেকে কাপড় সরিয়ে নিলো লোকটা। মাসুদ আহমেদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফারাবীর মায়ের মুখটা দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ মৃদু হাসি দিয়ে সামনে থাকা লোকটাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যান মাথাটা।’

লোকগুলো চলে যাওয়ার পর মাসুদ আহমেদ আবারও সোফায় বসতে বসতে মিস্টার আহসান এর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মহিলাটি কী সত্যিই সত্যি আপনার স্ত্রী?’

মিস্টার আহসান দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘হঠাৎ এই প্রশ্নের কারণটা জানতে পারি কী?’

- আপনার থেকে আপনার স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য অনেক। আর আপনার স্ত্রী বেঁচে থাকা কালিন হয়তো নিয়মিত রূপচর্চা করতেন।

- হ্যাঁ। ওর আর আমার বয়সের পার্থক্য অনেক। ও রূপচর্চা করতো। সে সাথে ও প্রায়ই নাইট ক্লাবে যেতো। নাচানাচি করতো। আমি মানা করলেও কিছু শুনতো না। তাছাড়া ওর চলাফেরা দেখে বুঝাই যেতো না ও আমার মতো মধ্যবয়স্ক একজনের স্ত্রী।

মাসুদ আহমেদ এবার ফারাবীর দিকে তাকালো। ফারাবী মাথা নিচু করে চোখ মুছছে। মাসুদ আহমেদ বলল, ‘স্যার, আপনি নিশ্চয়ই উনাকে ‘মা’ বলেই ডাকতেন। আচ্ছা, আপনার সাথে আপনার মায়ের সম্পর্ক কেমন? সৎ মা আর সৎ ছেলের মতোই কী?’

- না। উনি আমার নিজের মা না হলেও আমি উনাকে নিজের মায়ের মতোই ভালোবাসি। উনার বসয় আর আমার বয়সের পার্থক্য খুবই কম। তাই আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের মতোই ছিল। আমি আদালত আর চেম্বার শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাতে বাড়িতে ফিরতাম। আর রাতের খাবার বাইরেই খেতাম। তাই সকালেই শুধু বাবা আর মায়ের সাথে দেখা হতো। সকাল টুকুতেই আমরা বেশ আনন্দ করতাম। তাছাড়া স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। আমাকে সময় দিতেন তিনি। সৎ মায়ের মতো ব্যবহার করতেন না কখনোই। বাবার কথাতে, মায়ের যে উশৃংখলতা প্রকাশ পেয়েছে, সেটা পুরোপুরি হয়তো সঠিক নয়। আর আমার সাথেও কখনোই খারাপ আচরণ করতেন না।

ফারাবীর কথা শেষ হতেই মিস্টার আহসান হঠাৎ রাগী কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘চুপ কর ফারাবী। তোমার মায়ের সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি। তোমার মা তোমাকে পছন্দ করত ঠিকই। তবে তোমার সামনে যে ভালোমানুষি দেখাতো, সেটা তার আসল রূপ ছিল না। তোমার মা কতটা ভয়ঙ্কর মানুষ ছিল, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তোমার। তুমি তো এটা-ও জানো না, তোমার মা নেশা করত। এছাড়াও আরো অনেক কিছুই তোমার মা করত, যা আমি মুখে-ও আনতে পারব না। তোমার মা নিজের দোষেই খুন হয়েছে। এবং আমি এতে আনন্দিত।’

- শান্ত হও বাবা।

ফারাবীর কথা শুনে মিস্টার আহসান হন-হনিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলেন৷ মিস্টার আহসান চলে যাওয়ার পর মাসুদ আহমেদ ফারাবীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার বাবার সাথে আপনার মায়ের সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল?’

- মা তো সবসময় আমার সামনে বাবাকে নিয়ে স্বাভাবিকই থাকতেন। তবে বাবা মাঝে মাঝে মায়ের উপর রেগে যেতেন।

- কেন রেগে যেতেন?

- সেটা আমি জানি না। কখনো জিজ্ঞেস ও করিনি, কারণ মা সবসময় সেই মুহূর্ত-টা সামলে নিতেন। আমাকে আর কিছু বলার বা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হতো না। তবে আমি তো আর ছোট নই। আমি ভালো করেই বুঝতে পারি, বাবা মা'কে সহ্য করতে পারেন না। মায়ের সাথে সবসময় রাগারাগি করতেন, সেই সাথে মা'কে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও বলতেন।

মাসুদ আহমেদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘স্যার, নিজের দুঃসময়ের জন্য প্রস্তুত হন। আপনি হয়তো সামনের আঘাতটা সহ্য করতে পারবেন না।’

- কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?

- আমি কী বলতে চাচ্ছি তা আপনি হয়তো ভালো করেই বুঝতে পারছেন। কিন্তু আপনি তা প্রকাশ করতে চাইছেন না কারণ, লোকটা আপনার বাবা। আর একজন সন্তান এত সহজের বাবার বিরুদ্ধে যাবে না। তবে আপনি একজন আইনজীবী। আমি আশাবাদী এই কেস সমাধান করতে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।

ফারাবী চুপ করে রইল। মাসুদ আহমেদ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আপনার নিজের মা কীভাবে মারা গেছেন?’

ফারাবী বলল, ‘হঠাৎ করেই মারা গিয়েছিলেন মা। বাবার কাছ থেকে এটাই শুনেছি আমি। তখন অবশ্য আমি অনেকটাই ছোট ছিলাম।’

- এরপর আপনার বাবা আবারও বিয়ে করেন।

- হ্যাঁ। এর কয়েকবছর পর হুট করে একদিন বাবা মা'কে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তারপর বলেন, তিনি আবার বিয়ে করেছেন। আমি তখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছি। নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমার সৎ মা-ও আমাকে নিজের ছেলের মতো দেখতেন। আমি আর আপত্তি না করে তাকে মা ডেকেছি। আমার নিজের নানাবাড়ির লোকজনের সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না আগে থেকেই। আর পরে বাবা যাকে বিয়ে করছেন, তার নাকি বাবা-মা নেই। আমি অবশ্য এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি।

- তার মানে আপনার বাবা নিজেই উনাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন। তাহলে নিশ্চয়ই তারা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করে তাদের মধ্যে কী হলো যে, আপনার বাবা আপনার মা'কে সহ্য-ই করতে পারছে না এখন? এমনকি আপনার মায়ের মৃত্যুতে তিনি আনন্দিত। এটা কী শুধুই আপনার মায়ের উশৃংখল স্বভাবের জন্য?

- আমি জানি না।

- স্ত্রীর মৃত্যুকে একজন স্বামী শোকাহত হবে এটাই স্বাভাবিক, এবার সে যতই উশৃংখল কাজ করুক কা কেন। কিন্তু আপনার বাবা রীতিমতো আনন্দ পাচ্ছেন স্ত্রীর মৃত্যুতে। ব্যপারটি কী আপনার কাছে কৌতূহলী লাগছে না?

- সঠিক কোনো প্রমাণ ছাড়া বাবার উপরে খুনের অভিযোগ চাপাতে পারেন না আপনি।

- আমি উনার উপর খুনের অভিযোগ চাপিয়ে দিচ্ছি না। আমি শুধু লজিক্যাল কথা বলছি। পরপর সব ঘাটনা সাজিয়ে দেখুন, আপনার কাছে-ও সবটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আপনার বাবা-মা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। এরপর হঠাৎ করেই আপনার মা উশৃংখল হয়ে যান। সেজন্য আপনার বাবা আপনার মায়ের উপর ক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। একসময় সেটা বেড়ে গিয়ে নৃশংস রূপ নেয়। যার ফলে আপনার বাবা আপনার মা’কে খুন করে।

ফারাবী রাগী কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক করে কথা বলুন অফিসার। এভাবে আমার বাবার সম্পর্কে আজগুবি কথা বলবেন না। এটা ঠিক, আপনার মতো আমিও কয়েকবার ভেবেছিলাম যে, বাবা-ই মা'কে খুন করেছে। কিন্তু আমি আমাদের অতীতের মুহূর্তগুলোর কথা ভেবেছি। বাবা মানুষ হিসেবে কেমন, তা আমি জানি। তাই আমি বিশ্বাস করি বাবা এইরকম কাজ করবেন না কখনোই। আপনি প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র অনুমান করে বাবাকে এরেস্ট করতে পারবেন না।’

- আমি তো আপনার বাবাকে এরেস্ট করতে আসিনি। কালকের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার আগে যে এই কেসের কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাবো না, তা আমি জানি। তবুও অনুমানের বশে যেটুকু বুঝতে পারলাম, সেটুকুই বললাম।

ফারাবী কিছু বলল না। ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ ওঠে দাঁড়ালেন। এরপর মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘আজকে চলি আমি। আপনি ঠাণ্ডা মাথায় পরপর সব ঘাটনাগুলো সাজিয়ে দেখুন, আমি নিশ্চিত এই রহস্যের জট আপনার সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

ফারাবী এবারও কিছু বলল না। ইনস্পেক্টর মাসুদ আহমেদ চলে গেলেন। ফারাবী সোফাতে বসেই নিঃশব্দে বলল, ‘মায়ের উশৃংখলতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাবা মায়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে থাকতো সবসময়। আমিও মাঝে মাঝে দেখেছি, অনেক রাতে বাড়ি ফিরতো। আবার হুটহাট বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো। নাইট ক্লাবে যেতেন। বাবার কথানুযায়ী মা এর থেকেও আরো ভয়ঙ্কর কিছু করেছিল। তাহলে কী সত্যিই এইসব কু-কর্ম সহ্য করতে না পেরে বাবা মা'কে খুন করে ফেলেছে? কিন্তু কী এমন করেছিল মা? যার জন্য বাবা তাকে খুন করে ফেলবে।’

ফারাবী নিজের মাথার চুল টানতে লাগল। ওর ইচ্ছে করছে টেনেটুনে চুলগুলো ছিড়ে ফেলতে। তাতে যদি মাথার যন্ত্রাণা কিছুটা হলেও কমে। ডিপ্রেশন এর যন্ত্রণা কাকে বলে আজ ফারাবী টের পাচ্ছে। ওর মা’কে খুন করা হয়েছে, যেখানে সবদিক বিবেচনা করে বারবার সন্দেহের তীরটা ওর বাবার দিকেই ইঙ্গিত করছে।

- আচ্ছা, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে যদি এমন কিছু বেরিয়ে আসে, যার দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাবে মায়ের খুন বাবা করেনি। তার পক্ষে এই খুনটা করা একেবারেই অসম্ভব। অন্য কেউ, অন্য কোনো কারণে মা'কে খুন করেছে। কথাটা বলে নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিতে লাগল ফারাবী। কিন্তু আসলেও তেমনটা হবে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

(চলবে...)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড