• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : নীল অপরাজিতা

  অ্যান্থনি সজীব

১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:০০
গল্প
ছবি : প্রতীকী

দক্ষিণ পাশের পূর্ব পশ্চিম বরাবর ব্যলকুনির পূর্ব কোণায় অনেক ভয়ার্ত সুখ আর নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিক্ষার চিহ্ন হয়ে মাটির গোলাকার টবে তিনটে অপরাজিতার চারাগাছ কচি সবুজ পাতা মেলেদিয়ে বাতাসে খেলা করতো। আট দশদিন মাত্র এদের বয়স আর এর মধ্যেই কেমন একটা মায়া জন্মে গেছে। আসলে অপরাজিতা আমি ভালোবাসি। অথচ কখনো জন্মদিয়ে ভালোবাসার স্বাদ আস্বাদন করার কথা মাথায় আসেনি আমার। ব্যালকুনিটা সাজিয়ে রাখার দায়িত্ব মায়ের। মা সব সময়ের জন্যই প্রকৃতি প্রেমী।

শ্রাবণের শেষ দিকে মেঘলা আকাশের মন ভারি করা একটা দিনে জল এসে একটা সিমের মত কি একটা এনে হাতে দিয়ে বলেছিলো, তোমার প্রিয় ফুলের বীজ। দেখো গাছ হয় কিনা। অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি। নিজে তো শুধু ভালোবাসতেই জানো। ফুটে থাকা ফুল ভালোবাসতে সবাই জানে। কিন্তু কজন যত্ন করে, পরিচর্যা করে বীজ থেকে ফুলে রূপান্তর করতে জানে! তাই এবার তোমাকে একটা অপরাজিতার ফল দিলাম। বেশ কিছু বীজ আছে এতে। একটা না একটাতে তো শেষ পর্যন্ত ফুল ফুটবেই। তবে একটা অনুরোধ- এই বীজের গাছ থেকে প্রথম যে ফুলটা ফুটবে সেটা তুমি যাকে সবচেয়ে ভালোবাসো, যে তোমার চিন্তার জগতে সবচেয়ে বেশি আবেশ সৃষ্টি করে, তার হাতে দিয়ে বলবে, ‘ভালোবাসি!’ আমি নীলাকে ভালোবাসতাম। ভালোবাসি বলা অনেক দূরে ছিল, কিন্তু ভালোবাসাটা হয়ে যায় অজান্তেই। কোন অদৃশ্য আন্তঃসংযোগ ইহকাল পরকালের সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে একটা রহস্যময় সম্পর্কের সৃষ্টি করে যেটাকে মানুষ নাম দিয়েছে ভালোবাসা।

নীলাকে প্রথম দেখেছিলাম আনন্দ সমারোহের দৃষ্টি সীমায়, শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে করতে, হাসিমাখা মুখে। সেই যাহ... হাসি যে পৃথিবীর সবচেয়ে সংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে তার প্রমাণ মিলে নীলার হাসি জড়ানো মুখে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই, কখনো ছিলামও না। তাই প্রমাণ শব্দটার সাথে আমার খুব একটা ভালো সম্পর্ক কখনোই ছিল না। কিন্তু কিছু অজানা বিষয় হঠাত খুব জানার প্রয়োজন বোধ হলে মানুষ উদ্দীপ্ত হয়ে তা জানার পথ পাড়ি দিয়ে সুদূরে চলে যায়। নীলার হাসিটা ছিল ঠিক সেই অজানা আবিষ্কারের উদ্দীপনা সঞ্চারকারী সংক্রামক। সেদিন দু-একবার চোখাচোখি যে হয় নি এমন নয়। কিন্তু চোখ আর চোখের অব্যক্ত ভাষার অনুপম শিহরণ উত্তাল ঢেউ হয়ে এসে মনজমিনে যে প্লাবন সৃষ্টি করেছিলো তার প্রতিকার আর কখনোই করে উঠতে পারিনি। কারণ... ঐ যে বললাম সময় কিছু অভাববোধের সৃষ্টি করে যা পূরণ করার তীব্র আকাঙ্খা ভগবান জুগিয়ে দেন। হাতের অপরাজিতার বীজগুলোর দিকে তাকিয়ে সেই কূল-কিনারা খুঁজে চলছিলাম কিছুক্ষণ।

বাসায় এসে মাটির টবে সেদিনই বীজ গুলো পুতে দিলাম। প্রায় চারদিন পর প্রথম চারাটার নিশ্বাস নেওয়া চোখে পড়লো। তার একদিন পর আরও দুটি গাছের। কোন কোন গোধূলি লগ্নে বা এর পরবর্তী উদাস সাঁঝে দক্ষিণের ব্যলকুনিতে হালকা হাওয়া খেলে গেলে খুব নরম শেকড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট চিকন অপরাজিতগুলোর একে অপরের উপর হেলে পড়ার খুনসুটিগুলো বেশ মজা করে দেখতাম আমি। কখনো কখনো মনে হয় সবার আগে গজানো গাছটা একটু আধিপত্য চালায় ছোটগুলোর উপরে। আমি তখন উল্টোপাশের কোণায় থাকা বনসাইটার দিকে তাকালে বনসাইটা তার মাথার দিকের দুএকটা পাতা সগর্বে নাড়িয়ে দেয়। ভাবটা এই যে- ওরা বাচ্ছা চারা, খেলছে খেলুকনা। এটা তো ওদের খেলা করারই বয়েস। এই ভাবটা কেবল আমিই বুঝি। মা বুঝতে পারে কিনা জানিনা। হয়তো বুঝেন, কারণ তিনি তো মা।

প্রথম দিনের সাক্ষাতে তেমন কিছুই জানতে পারিনি মেয়েটা সম্পর্কে। নাম ঠিকানা ছাড়া তেমন কিছুই নয়। আজকের যুগে যোগাযোগ সহজ হয়ে গেছে মোবাইলের ফোনকল আর মেসেঞ্জার, ফেইসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো আর ইন্সটাগ্রামের নিত্যনতুন ফিচার আর আপডেট এর কারণে। শুধু এটুকু জানতে পেরেছিলাম লেখাপড়ায় বেশ ভালো। আমি আবার ঠিক তার উলটো পথের । আমার মাথায় সারা দুনিয়া খুব সহজে ঢুকে গেলেও পড়ালেখা না কাছে আসতে চায় না ঢুকতে চায়। তাই পড়ালেখার দাড়িপাল্লা-ই আমাদের প্রথম দূরত্ব প্রমাণ করে দিল। তবে হাসিমাখা মুখ আমি ভুলতে পারিনি। সাঁঝের দিকে আলো যখন কিছুটা কমে আসলো, আড়ালে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম তো তাকিয়েই থাকলাম। ও তখন অন্য ঘোরে, কারও দিকে তাকিয়ে হঠাত একটা হাসিদিলে বুঝলাম এই টোল পরা গালের হাসি শুধু সংক্রামকই নয়, মরণ ব্যাধীর মত দুঃসহ যন্ত্রণাদয়ক। আরও বুঝে গেলাম যে, সামনের অনেকটা রাস্তা এই সংক্রামক আমাকে আক্রান্ত করতেই থাকবে প্রতিনিয়ত।

মাস দুয়েক পরে আমার লতানো অপরাজিতা গাছের একটিতে দু-তিনটা কলি দেখলাম। আমি মাকে ডেকে দেখিয়ে বললাম- মা দেখ, অপরাজিতা গাছটায় ফুল ফুটতেছে। মা তেমন কিছু চিন্তা না করেই বললেন- এইটা তো তোমার আগেই দেখছি। মার অবশ্য আগেই দেখার কথা। ভার্সিটির রেগুলার ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট, টিউশনী সব মিলিয়ে বাসায় ফিরতে রাত আটটা বা দশটা। আবার পরের দিনেও ঠিক একই রুটিন। আর গাছের দেখাশোনার দায় যেহেতু মায়ের তাই তার সব আপডেট আগে আগে জানাই স্বাভাবিক। আমি মার উপর একটু অভিমান নিয়ে বললা্ম- তাওতো আমারে বললা না যে ফুল ফুটতেছে! মা কিছু না বলে নিজের মতই কাজ চালিয়ে গেলেন। আমি কাছে গিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে রেখে দিলাম কলি গুলার । পরের দিন সকালে আমি অবাক। মা হয়তো কেবল পানি দিয়ে গিয়েছে... দুইটা গাঢ় নীল আর বোটার পাশে হাল্কা সবুজ আর সাদা মেশানো অদ্ভুত সুন্দর অপরাজিতা আমার দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার আনন্দ তখন দেখে কে! মনে মনে জলকে ধন্যবাদ দিলাম অনেকবার। মেয়েটাকে সামনাসামনি ধন্যবাদ দেওয়া যায় না। তাহলে নাকি বন্ধুত্বের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল সৃষ্টি হয়। তাই সামনাসামনি না দিলেও মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ দিয়ে ধন্যবাদের প্লাবণ সৃষ্টি করে দিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই প্রথম ফুল নিয়ে ওর সেই কথাটা মনে পড়লো- ‘যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো তার হাতে প্রথম ফুলটা দিয়ে বলবে, ভালোবাসি। কিন্তু কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি এটা ভাববার জন্য চোখটা বন্ধ করতেই যেন কারেন্টের মত শক খেলাম। চোখে ভেসে উঠলো সেই টোল পড়া গাল, সেই চির পরিচিত হাসি। চিন্তাকরার শক্তি ক্রমশ ঘোরে চলে গেল। বুঝলাম না এখন আমি কি করবো। কোথায় কিভাবে পাবো তাকে। কয়েজন পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করলাম , কেউ সুবিধামতন তেমন কিছুই বলতে পারলো না। আর যাদের কাছে গেলে সুবিধামতন কোন তথ্য বা খোঁজ পাওয়া সম্ভব তাদের কাছে তো লজ্জায় যেতেই পারলাম না। তাই মনে মনে ভাবলাম পৃথিবীটাতো গোল, এইখানে উদাস হয়ে হাটতে হাটতে একদিন ঠিক তার দেখা পেয়ে যাবো। তখন নাহয় শুকিয়ে যাওয়া ফুলটাই হাতে তুলে দিতে দিতে বলবো- ভালোবাসি। পুরোনো হোক বা শুকনো। প্রথম তো প্রথমই। নীলা বুঝবে ফুল শুকিয়ে গেলেও ভালোবাসা দিনান্তরে জমাটবদ্ধহয়ে চিরস্থায়ি হয়ে উঠে। তাই আমার টবে জন্মানো প্রথম অপরাজিতাটাকে তুলে নিয়ে ডায়েরীর এক পৃষ্ঠায় রেখে নিচে লিখে দিলাম-

‘আবার যখন দেখা হবে টোলপড়া গাল ছুতে দিও, এই অপরাজিতা তোমার রবে সৃষ্টি সুখের স্বাদ নিও।’

দোলের দিন ক্যাম্পাসে মোটামুটি একটা উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। যেদিকে তাকাই সবার মুখে-গায়ে কেবল রঙ আর রঙ। সেবারের দোলের দিন বিকেলে ক্যম্পাসে বসে আছি জুনিয়রদের র‍্যাগ দিয়ে রঙ মাখাবো বলে। বিশেষত মেয়ে জুনিয়রগুলোকে। এটা একটা ভার্সিটি ট্রেন্ড। কেউ ভালোভাবে নেয় কেউ নেয় না। আমার এগুলোতে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। হাতে একমুঠো রঙ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যাকে প্রথমে পাবো তাকেই মাখিয়ে দেব। যতই না বলুকনা কেন। শান্ত চত্তরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে যেইনা বিজ্ঞান অনুষদের দিকে তাকিয়েছি- আমার মধ্যে তড়িৎ খেলে গেল মুহূর্তেই। সেই সেদিনের সেই হাসি, সেই টোল পরা গালের হাসি। বন্ধুদের সাথে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। ইহজগত পরজগত কোন জগতে আছি কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না। ভুলে গেলাম দোলের কথা, মুঠোভর্তি রঙ কখন হাত থেকে পরে গেল বুঝতেই পারলাম না। পা দুটি আপনা আপনিই এগিয়ে চলছিলো নীলার দিকে। সে কোন সঞ্চালনা শক্তি আমায় এক দৃষ্টে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো জানিনা। কিন্তু এভাবেই এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। বললাম- আমায় চিনতে পারো নীলা? নিলা একমুহূর্ত যেন একটু থামলো, কয়েক সেকেন্ড এর জন্য টোলগুলো কোথায় মিলিয়ে গেল। আমার কিসের একটা ভয় যেন হয়ে যাচ্ছিলো, যদি নীলা আমায় না চেনে। সে আর বছর দেখা হবার পর একবারের জন্যও দেখা হয়নি। সুতরাং না চিনতে পারা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কিন্তু আমার সব ভয় ভাঙ্গিয়ে দিয়ে নীলা বলে উঠলো, “অরূপ!” আবার গাল দুটিতে টোল ফুটে উঠলো। আমি বললাম তুমি এখানে? তোমায় আমি এখানে এভাবে পাবো কোনদিন ভাবিনি। নীলা কিছু না বলে শুধুই হাসলো। ভার্সিটির বাসের শিডিউল টাইম হয়ে যাওয়ায় আমাদের আর কোন কথাই হলো না। শুধু ওর হাসতে হাসতে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

পরের দিন আমাদের আবার দেখা হলো। পাশে দাঁড়িয়ে বললাম- আমায় তুমি ভুলে যাওনি... কিভাবে সম্ভব নীলা? নীলা বললো- ভুলে আমি কাউকেই যাইনা, কিন্তু জানিনা কেন যেন আমি তোমাকে মনে রেখেছি। আমি বললাম- আমিও তোমায় মনে রেখেছি। ঠিক রেখেছি নয়, রয়ে গেছ। মনে হয় এটা অন্য কোন অর্থ দেয়। মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসি... অনেক দিন থেকে। যেদিন থেকে আমি তোমার হাসিতে সংক্রামিত। নীলা হাসলো। আমি সাথে নিয়ে আসা সেই ডায়েরীটা থেকে অপরাজিতাটাকে বের করে নীলার সামনে ধরে বললাম-

‘ধর যদি ইচ্ছেকরি তোমায় একটি শহর দেব হাত বাড়াবে?’

নীলা হাসলো। আমি আবার বললাম এইটা তোমার জন্য রেখে দেওয়া আমার অপরাজিতা গাছের প্রথম ফুল। এবারে চোখ কুচকালো নীলা। ভালো করে তাকিয়ে ফুলটা নিতে হাতবাড়াতেই বলে উঠলাম- ‘ভালোবাসি।’ নীলা ফুলটি নিয়ে খুব সাবধানে নিজের কাছে রেখে দিল। ওর চোখে আমি একটা অরূপ আকাশ দেখলাম । সেখানে সাদা শুভ্র মেঘের নিত্য অবাধ্য খেলা করা আর অনন্ত অসীমের অভিযাত্রার হাতছানি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড