• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : অন্তরালের রহস্য

  জান্নাতুল ফেরদৌসি মমি

০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৫৪
গল্প
ছবি : নাফিসা সিদ্দিকা

- স্ট্রেঞ্জ! কতদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না আপনার? - হবে প্রায় মাস ছয়েক। ভদ্রলোক বেশ লম্বা চওড়া। সাদা চামড়ায় চিন্তার ভাঁজে চোখ-মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। কথাগুলো আমতা আমতা। বুঝতে পারছি, উনি বেশ ভয় পেয়েছেন ঘটনাটার পর থেকে। কিন্তু মানুষ মারা যাবার পর সত্যিই কি ফিরে আসে? হতে পারে। দুনিয়াতে অলৌকিক অনেক কিছুই তো ঘটে। তবে আমি এখনো এমন কিছুর সাথে পরিচিত হইনি। তাই খুব সহজে এসব বিশ্বাস করি না।

রোজ বিকালে ভয়ার্ত চেহারায় ভদ্রলোক এই পার্কে আসতেন। দেখতাম গুটিসুটি মেরে ওই এক বেঞ্চিতে বসে থাকতেন। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরত। কারও সাথে কথাও বলতেন না। আজ বোধহয় কিছুটা সাহস পেয়েছেন। তাই আমার সাথে গল্প করছেন। ভদ্রলোক বিপত্নীক। স্ত্রী মারা গেছে ছয় মাস হবে। কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না তার। মাথা থেতলে মরেছিল। পুলিশ কেস এখনো চলছে। বউয়ের বাড়ির লোকজন মূল হতা হিসেবে টার্গেট করেছে এই ভদ্রলোককে। অথচ ভদ্রলোক বারবার বলছেন, তিনি স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না। আমি অবশ্য লোকটার কথা বিশ্বাস করেছি। তবে দুনিয়ায় ভালোবাসাকে হত্যা করার ক্ষমতা ভালোবাসার মানুষের আছে। ক্ষেত্রবিশেষে তিনিও তার স্ত্রীকে মারতেই পারেন। কিন্তু আমি কোনো ক্রমেই তা মানতে পারছি না।

ভদ্রলোক হাত চেপে ধরলেন আমার। বললেন, ‘আমাকে বাঁচাবেন?’ আমি এরকম কেসের সাথে আগে কখনো জড়িত ছিলাম না। সাধারণ জ্ঞানটুকুও নেই। তবে, তার আকুতি মিনতি দেখে আমার উনার প্রতি মায়া জন্মাল। কিন্তু ঠিক কীভাবে তাকে আমি সাহায্য করব ভেবে পাচ্ছি না। ভদ্রলোক মাথা নিচু করলেন, আমার হাত ছেড়ে দিলেন। বললেন, ‘বুঝেছি, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন না।’ - না না ঠিক সেরকমটা না। আসলে, আমি একজন সাধারণ মানুষ। আপনাকে এরকম একটা সিচুয়েশনে কীভাবে সাহায্য করবো বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোক আমার দিক থেকে কিছুটা অভয় বার্তা শুনে হাসলেন। বললেন, ‘আমার বাসায় যাবেন?’

নাহ! উনি বোধহয় একটু বাড়াবাড়িই করছেন। অপরিচিত লোকজনকে বাড়িতেও নিয়ে যেতে চান তিনি! তার এ ব্যাপারে কোনো ভয় না থাকতে পারে। সত্যি বলতে আমার একটু একটু ভয় করছে। সেটা লৌকিক কিংবা অলৌকিক যে কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হোক। বললাম, - নাহ ভাই। আজ আর না । দেখছেন না সূর্যটা পশ্চিমে লাল হয়ে ঢলে পড়ছে। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। - ঠিক আছে। তবে আগামীকাল?' আমি তাকে না করতে পারলাম না। বললাম, ‘যাব।’

ভদ্রলোক আর একটা কথাও বাড়ালেন না। মনে শান্তি নিয়ে হেঁটে হেঁটে পার্ক ছেড়ে চলে গেলেন। অদ্ভুত লাগলো সবকিছু। ভাবলাম, যদি সত্যিই অলৌকিক কিছু হয়?

বাড়ি ফিরে রাতে ঘুম আসছিল না। একটা ভয় কাজ করছিল। ভাবছিলাম উনার স্ত্রী অপঘাতে মারা গেছেন। কেউ কেউ বলে এদের আত্মার নাকি মুক্তি হয় না। যদি মুক্তির বদলে তার স্বামীকেই মেরে দেন বিষয়টা সাংঘাতিক হয়ে যাবে। সারারাত ভাবলাম বিকালে আজ আর পার্কে যাব না। এসব উটকো ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়ে লাভ নেই। পরদিন সারাবেলা কাটিয়ে দিলাম। আচমকা আমার মনে হলো পার্কে বোধহয় ভদ্রলোক আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। রাতে মনঃস্থির করার পরও অদ্ভুত এক শক্তি আমাকে বারবার সেখানে টানছে।

ঘটনাটা অলৌকিকই বটে। বিকাল বেলা সেই একই বেঞ্চিতে বসে আছি। সূর্য অস্ত যাচ্ছে অথচ ভদ্রলোক আসছেন না আজ। আমি ঘাবড়ে যাচ্ছি। ভদ্রলোকের কিছু হলো না তো? একটা ভয়ঙ্কর কিছু ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলাম। রাতে গলা দিয়ে খাবার নামলো না। মধ্যরাতে দেখলাম বীভৎস এক স্বপ্ন। সবকিছুই আমার কাছে অদ্ভুতুড়ে লাগতে লাগল। তবুও পরদিন আমি পার্কে গেলাম আবারও। ভদ্রলোক আজ এসেছেন। আমি চুপ করে তার পাশে বসলাম। উনি কোনো কথা বলছেন না। মুখ খুললাম। বললাম, ‘গতকাল আসেননি যে!’

উনি কাঁদতে লাগলেন। উত্তর দিলেন, ‘আমার স্ত্রী আমাকে আসতে দেয়নি।’ বিষয়টা অন্যদিকে মোড় নিল। রাতের স্বপ্ন আর উনার মৃত স্ত্রীর পুনরায় আগমন আমাকে আরও বেশি ভাবিয়ে তুলছে। হাত-পা কাঁপতে লাগলো আমার। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভয় পেয়েছেন?’ আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে উত্তর দিলাম, ‘না।’ উনি হাসলেন। বললেন, ‘চলুন তবে আজ যাওয়া যাক।’ - কোথায়? - কেন আমার বাসায়! এই রহস্যের জট খুলতে আমাকে উনার বাসায় যেতেই হতো। কারণ সত্য ঘটনা না জানা অবধি ভয় এবং প্রশ্ন দুটোতেই আমাকে বাঁচতে দিবে না। তাই ভদ্রলোকের বাড়ি যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলাম।

বেশ সাজানো গোছানো বাড়ি। বড় বড় কামরা সাজসজ্জায় সজ্জিত। স্ত্রী মারা যাওয়ার ছয় মাস পরেও পরম ভালোবাসায় বাড়ির প্রত্যেকটি জিনিস তিনি আগলিয়ে রেখেছেন। আমি ধীর পায়ে উনাদের ঘরের প্রত্যেকটি কোণা দেখছি। ভদ্রলোক চা নিয়ে এলেন। মনে হচ্ছে কেবলই বানিয়ে এনেছেন। চায়ের কাপে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এত জলদি চা বানালেন কীভাবে? মনে হয় রান্নাবান্না কাজেও পটু লোকটা। হাসিমুখে চায়ের কাপটা এগিয়ে নিলাম। ভীষণ ভালো চা বানান তিনি। উনার প্রশংসা করলাম। - আপনি তো বেশ ভালো চা বানান! - আমি আর বানালাম কই! সব তো নিরুপমাই বানিয়ে দিলো। - নিরুপমাটা কে? - কেন আমার স্ত্রী! ভদ্রলোকের মাথা ঠিক আছে তো? নাকি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? মানলাম তার স্ত্রী আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাই বলে চা বানিয়েও খাওয়াতে পারবে? চায়ের কাপটা হাত থেকে পড়ে গেল। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘অসম্ভব।’ ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন। আন্দাজ করতে পারছি এক নরপিশাচ যেমন হাসিতে মশগুল থাকে ঠিক তেমন। বুকের ভেতর ভয়টা বাড়তে থাকল। ভদ্রলোক বললেন, ‘ভয় পাবেন না। আহ কী যেন নাম আপনার?’ - তপু। তপু রায়হান। - দেখুন আমার স্ত্রী কখনো অন্যের ক্ষতি করেনি, কেবলমাত্র আমার ক্ষতি ছাড়া। ঘাবড়াবেন না সে আপনার ক্ষতি করবে না

ভদ্রলোক তার স্ত্রী সম্পর্কে এমন দৃঢ়কণ্ঠে সবকিছু বর্ণনা করছেন তিনি আমার ভেতর আত্মার ভয় দারুণভাবে ঢুকিয়ে ছাড়লেন। পা নড়ছিল না আমার। গলার স্বর আটকে গেছে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। মায়ের ফোন। রিসিভ করে কথা বলতে পারছি না। ভদ্রলোক বললেন, ‘ভয় করবেন না তপু সাহেব। কথা বলুন।’

কথা শেষ হতেই উনাকে বিদায় বলে চলে আসছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোক পেছন থেকে ডাকলেন। বললেন, ‘কাল সকালে একবার আমার বাড়ি আসলে ভালো হতো তপু সাহেব।’ দরদর করে ঘাম ঝরছে আমার। সম্ভবত নার্ভ ঠিকমতো কাজ করছে না। চিন্তার বশবর্তী হয়ে উনার কথায় রাজি হয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলাম।

আজ বেশ আঁধারিয়া রাত। কাঁপন দিয়ে জ্বর এলো আমার। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। মাকে কিছু জানানো হয়নি। তিনি সারারাত আমার পাশে বসে জলপট্টি দিচ্ছেন। এরকম ধুম জ্বরে মাথা কাজ করছিল না অথচ সকালের আলো ফুটতেই গা ঘেমে জ্বর ছেড়ে দিল। মা ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিলেও আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি। সকাল গড়িয়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোকের বাড়ি যাব কি না দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম। অবশেষে ঠিক করলাম আজই শেষ দিন। এরপর উনার সাথে দেখা করা কিংবা সাহায্য করা থেকে বিরত থাকব।

ভদ্রলোকের বাড়ির মূল দরজা একদম হা করে ফাঁক করা। যেন তিনি জানতেন আমি আসবই। উনি সোফায় বসে তখন ম্যাগাজিন ঘাটছিলেন। আমাকে দেখে তাকে বেশ উচ্ছলিত দেখাচ্ছে। খাতির যত্নের ত্রুটি রাখছেন না। ভদ্রলোক আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে গিয়ে দেখলাম বিছানায় উনার শার্ট, প্যান্ট স্ত্রী করা অবস্থায় পড়ে আছে। তা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথাও বেরুচ্ছেন নাকি?'’ ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, ‘নাহ। আমার স্ত্রী নিরুপমার স্বভাবই অমন। প্রতিদিন অফিস যেতেম তো, তাই কোনটা পরে যাব আগেই বিছানায় গুছিয়ে রাখতো। দেখুন না আজও ব্যতিক্রম হয়নি।’ ঘুরে ফিরে আবার তার স্ত্রীর আত্মার প্রসঙ্গ আসলো। সব অস্বাভাবিক ব্যাপার-স্যাপার। হুট করে প্রেশারকুকারের শিটি বেজে উঠল। আমি আরও বেশি চমকে গেলাম। ভদ্রলোক বললেন, ‘ভয় পাবেন না। নিরুপমা মনে হয় গরুর মাংস তুলে দিয়েছে চুলোয়। আমি দেখে আসছি।’

ভদ্রলোক চলে গেলেন। হঠাৎ করে পুরো বিল্ডিং কাঁপতে লাগল। আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো সব আত্মার কারসাজি। বোধহয় রেগে গেছেন ভদ্রমহিলা। তার কিছুক্ষণ পর সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতে আমি ভদ্রলোককে খুঁজতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। সামনেই তালা ঝুলানো একটা ঘর চোখে পড়লো। কাছে গিয়ে দেখি তালা খোলা। ভেতরে যাব কি না এ নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেলাম। কিন্তু মনে হলো যাওয়া উচিত। ভেতরে গিয়ে দেখি বড়সড় একটা স্টোর রুম। ধুলোবালি আর মাকড়সার জালে ভর্তি। কিন্তু একটা কার্টুন বক্স বেশ চকচক করছে। মনে হচ্ছে প্রতিদিন তার ঝাড়পুছ করা হয়। বিষয়টা অদ্ভুত লাগল। আমি বক্সটার সামনে এগিয়ে গেলাম। খুলে দেখি ভেতরে লম্বা রক্ত লাগানো লোহার সাদা রড। রক্ত মরে কালচে হয়ে আছে। আমি তা হাতে তুলে নিতেই অনেক প্রশ্ন জাগলো অজান্তেই। কী এটা? এর এত যত্নই বা করা হয় কেন? হুট করে মনে হলো, ভদ্রলোক এটাই কাজে লাগাননি তো তার স্ত্রীকে মারতে?

এমন সময় ভদ্রলোক দরজা খুলে ভেতরে এলেন। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার। উনি অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন। চোখে পানি ছলছল। বললেন, ‘জানেন তপু সাহেব, ও আমার ভালোবাসা বুঝলো না। কম তো সুখে রেখেছিলাম না তাকে। যা বলতো তাই শুনতাম। তবুও আমাকে ফাঁকি দিয়ে রোজ তার প্রেমিককে প্রেম বিলিয়ে দিতো। ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, একদিন হয়তো ঠিক ফিরে আসবে নিরুপমা আমার কাছে। কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম নিরুপমা প্রায় তার শরীরটাও তার প্রেমিককে দিয়ে আসত তখন মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। অফিস থেকে ফিরেই দেখি ও রান্নাঘরে প্রেশারকুকারে গরুর মাংস রান্না করছে। কিন্তু বিষিয়ে উঠা এ মনে নিরুপমার প্রতি ছিল তখন কেবলই ঘৃণা। আমার ভেতরের পশুত্ব জেগে উঠতেই আপনার হাতের ওই মোটা রডটা দিয়ে ওর মাথায় আঘাত করি। তারপর নিরুপমা তখন আস্তে আস্তে মেঝেতে ঢলে পড়ে। চারদিকে রক্তের স্রোত বয়ে যায়। ওর দেহ যখন নিথর হয়ে গেল, আমি তখন ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।’

ভদ্রলোকের মুখে এসব কথা শুনে চোখটা আমারও ভিজিয়ে এলো। উনি খানিকক্ষণ থেমে পুনরায় বলতে লাগলেন, ‘জানেন, আমি তাকে মারতে চেয়েছিলাম না। ওকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। অথচ সে তার মূল্যই দিল না। তবে সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল যখন জানতে পেরেছিলাম ওর পেটে আমাদের অস্তিত্ব বেড়ে উঠছিল।’

কথাটা বলতেই হুহু করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তবে আপনার স্ত্রীর আত্মা?’ - আছে। নিরুপমা সব সময় আমার সাথে আছে। ওর সাথে কাটানো মুহূর্ত আমি প্রতিদিন আগলে রাখি। ভালোবাসি যে তাকে খুব।

ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তবে পুলিশ কেসটা?’ - নিরুপমার লাস্টটা বাথরুমে ফেলে রাখি। সন্দেহ থাকলেও সবাই মনে করেছে সাবানের পিচ্ছিলে পা ফসকে মাথা থেতলে গেছে। অনেকে বিশ্বাস করেনি। সুরাহাও হয়নি। তাই কেস নিষ্পত্তি হতে দেরি হচ্ছে। - আর এসব ভৌতিক ব্যাপারগুলো? - তা জানি না আপনি কী অনুভব করছেন। তবে আমি জানি নিরুপমা সবসময় আমার সঙ্গে থাকে। - তাহলে আমাকে এভাবে আপনার বাসায় ডাকলেন কেন? ভদ্রলোক আমার হাতে ধরে থাক রডটা নিয়ে বললেন, ‘এই রডটা দিয়ে....... ’ আমি ভয় পেলাম। আমাকেও খুন করতে চান নাকি এই ভদ্রলোক! জিজ্ঞেস করলাম, ‘থেমে গেলেন যে!’ - হ্যাঁ, এই রডটা দিয়ে আমার মাথায় আপনি আঘাত করবেন এখন।

সাংঘাতিক কথা! ভদ্রলোক বোধহয় উন্মাদ হয়ে গেছেন। আমি তাকে এ ব্যাপারে না করাতে উনি প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে বললেন, ‘আপনি যদি আমাকে না মারেন, তবে আমি আপনাকে মেরে ফেলতে বাধ্য হব। আমার আর নিরুপমার কাহিনী কেবল একমাত্র আপনি জানেন। হয় মারুন, আর নয়তো বাঁচুন।’

নাহ এই ভদ্রলোকের মাথা এখন ঠিক নেই। উনার কথা শুনতেই হবে। নইলে আমার মরণ আজ নিশ্চিত। খুবই ধীরেসুস্থে উনাকে বুঝালাম। তবুও তিনি বুঝলেন না। এ দিকে মাংস পোড়ার গন্ধ নাকে এসে লাগল। ভদ্রলোককে বললাম, ‘দেখুন, আমি আপনাকে মারব। তবে চুলোয় রান্না বসানো আছে। মনে হচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে। আপনার স্ত্রী নিরুপমা জানলে ভীষণ রাগ করবেন।’

কথাটা বলতেই ভদ্রলোক নাকটা উঁচিয়ে গন্ধ নিলেন। তারপর রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। আর আমি এ সুযোগে নিজেকে বাঁচাতে বাইরে গিয়ে কয়েকজনকে বিষয়টা জানালাম। ভদ্রলোক রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে দেখলেন আমার চারপাশে আরও মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক। উনি রেগে গিয়ে ছুটে এসে তৎক্ষণাৎ আমার গলা চেপে ধরলেন। সবাই ধস্তাধস্তি করে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে ধরে রশি দিয়ে বেঁধে রাখলো।

ভদ্রলোকের কব্জিতে বেশ জোর আছে বলতে হবে। একেবারে দম বন্ধ করে দিয়েছিল। আর একটু হলে বোধহয় মরেই যেতাম। তারপর ঘণ্টাখানেক পর হাসপাতাল থেকে কয়েকজন লোক এসে উনাকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি উনার দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছি, কতটা ভালোবাসলে মরা স্ত্রীর ভালোবাসাকে আগলে রাখতে পারে মানুষ। আবার কতটা ঘৃণা জন্মালে নিজের চেয়েও প্রিয় সেই মানুষটিকে মেরে ফেলতে পারে!

সত্যিই পৃথিবীতে ভালোবাসার অসীম শক্তি। তাই ভালোবেসেই মরতে হয়। ভালোবাসার মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কখনো বাঁচা যায় না। এমন সময় দেয়াল ঘড়ির কাঁটা ঢংঢং করে বেজে উঠলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি বারোটা বেজে গেছে। হঠাৎ মনে হলো, মা দুপরের আগে বাজার নিয়ে যেতে বলেছিল। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি বন্ধ হয়ে আছে। খুলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাকে ফোন দিলাম। মা বললো, ‘হ্যাঁ রে খোকা তুই ঠিক আছিস?’

আমি চমকে গেলাম। মা এসব কথা জানলো কীভাবে? জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন মা’ - আরে ওই যে কত বড় ভূমিকম্প হয়ে গেল। ফোনটাও তো খোলা রাখিসনি। চিন্তায় চিন্তায় আমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলাম।

তিনদিন ধরে ঘটে যাওয়া সবকিছু আবারও চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সাইকো এই ভদ্রলোক এবং ভদ্রলোকের স্ত্রী নিরুপমার আত্মা। মুখে হাসি টেনে মাকে বললাম, ‘হ্যাঁ মা আমি ঠিক আছি। এখনই বাজার করে বাড়ি ফিরছি।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড