• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘জল জোছনায় বৃষ্টি’-এর প্রথম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : জল জোছনায় বৃষ্টি

  এম. ফজলে রাব্বী

২১ আগস্ট ২০১৯, ১৪:৩১
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে জমির আল ধরে হেঁটে চলেছে গফুর আলী আর তার ছেলে নাসির আলী। শীতের রাতের ঘন শিশিরে ঘাসের সরু রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে গেছে। অন্ধকারে চলতে গিয়ে সাবধানে পা ফেলতে হয়। পা একটু এদিক-ওদিক হলেই পিছলে পরে যেতে হবে নিশ্চিতরূপে। তবু এই রাস্তা ধরেই অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার ভেদ করে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে ওরা। সাথে চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে গফুর আলী। চারপাশ একদম জনশূন্য। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক। এই ডাকের তীব্রতা এতটাই যে এই বুঝি কানের পর্দা ফেটে যাবে। কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে চলে ওরা। সামনে থেকে একটা ধোরা সাপ ফোঁস করে উঠে আবার দ্রুত সরে পরে। নাসির আলীর কলিজাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেঁপে ওঠে। পেছন থেকে গফুর আলী ছেলেকে তাড়া দেয়, ‘তাড়াতাড়ি যা নবাবের পুত, আকাশ ধুয়া হইয়া গেলে বুঝবি ঠেলা’।

নাসির আলী কোন জবাব দেয় না। বাবার কথা মত হাঁটার গতি বাড়ায়। এর মাঝে কাঁধের বাঁশটা ডান কাঁধ থেকে বাম কাঁধে চালান করে দেয়। ছেলের দেখাদেখি গফুর আলীও কাঁধ পরিবর্তন করে নেয় ভারসাম্য রক্ষার জন্য। বাঁশের সাথে বাঁধা চটের বস্তাটার দিকে একবার তাকায় সে। বিড়বিড় করে বলে, ‘শালার ওজন এত ক্যা? গরীব চুইষ্যা খাইয়া চর্বি জমাইছে শুয়ারের জাতেরা’।

হাঁটতে হাঁটতে বিলের পাড়ে চলে আসে ওরা। বিরাট বিল। নাম ধুলিয়ার বিল। সমস্ত বিল কচুরিপানায় ভরে আছে। বর্ষাকালে বিলের আকার আরো বেড়ে যায়। কচুরিপানা কমে যায়। চারিদিকে তাকালে শুধু পানি আর পানি। পানিতে বিল সংলগ্ন গ্রামের কিয়দংশ ডুবে যায়। কোন কোন বাড়ির আঙ্গিনায় কই-মাগুর-টাকি মাছ পাওয়া যায়। মাছ ধরার উৎসব লেগে যায় রীতিমত। ছেলে বুড়োরা জাল, পোলো, দারকই নিয়ে সারাদিন মাছ ধরে। সেই মাছ বিক্রি করে পাশের পুলিশলাইন্স আর মাছের আড়তে। শীতকালের শেষে বিলের পানি শুকিয়ে এলে এখানে বোরো ধানের চাষ হয়। শহরের শেষপ্রান্তে এই বিল। বিলের পর থেকে গ্রাম শুরু হয়েছে। এই বিলের উৎপত্তির এবং নামকরণের একটা ইতিহাস আছে। একসময় এই বিলের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত ছিল একটি স্রোতস্বিনী নদী। বড় বড় নৌকা এই নদী দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করত। মহাজনদের ধান, পাট, গমের সাথে সাথে গরু, ছাগল, ভেড়ার চালান যেত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। কথিত আছে এই নদী দিয়ে রাতের বেলা ডাকাতেরা ঢোল বাঁজাতে বাঁজাতে ডাকাতি করতে যেত। সেই থেকে এই নদীর নাম ধূলিয়া নদী। কালক্রমে নদী মরে গিয়ে বিল হয়ে গেছে। বর্ষার পানি বের করে দেওয়ার জন্য বিলের মাঝ দিয়ে খোঁড়া হয়েছে খাল। এই খালের দখল নিয়ে আবার বাঁধে বড় রকমের গণ্ডগোল।

বিলের পাড়ে এসে একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকা পেয়ে যায় গফুর আলী। নৌকার অবস্থা বেগতিক। শ্যাওলা পড়ে পাটাতন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। তলা ফুটো হয়ে পানি ঢুকে আছে অনেকটা। কাঁধের বস্তা নামিয়ে দু’ই বাপ বেটা লেগে যায় নৌকার পানি অপসারণের কাজে। বাড়ি থেকে একটা ছোট বাটি আনলে সুবিধা হত। উপায় না দেখে দুই হাতের অজলা দিয়ে নৌকা থেকে পানি ফেলছে ওরা। যতটা সম্ভব শব্দ না করা যায় সে চেষ্টা করছে। মিনিট দশেকের মধ্যে নৌকার সব ফুটো বন্ধ করে পানিশূন্য করে ফেলল নৌকাটা। ভারি বস্তাটা দু’জনে টানাটানি করে নৌকায় তুলে নিল। গফুর আলী নৌকার মাথায় গিয়ে বসলো। নাসির আলী ভারের বাঁশটাকে নৌকার লগি করে নিল। নৌকা এগিয়ে চলল সামনের দিকে। গফুর আলী নৌকার সামনে বসে কচুরিপানার প্রতিবন্ধকা সরাতে লাগলো। কলমির গন্ধভরা জলোবাতাস নাকে আসতেই একটা দমবন্ধকর অনুভূতি হলো গফুর মিয়ার। সেই সাথে বাড়তে থাকলো হৃদয়ের হৃদকম্পন। চারপাশে অনুসন্ধিৎসুর দৃষ্টিতে আবারো তাকালো সে। চারপাশে অমাবস্যার নিঃসীম অন্ধকার ছাড়া আর কেউ নেই কোথাও।

নৌকাটা বিলের একপ্রান্তে যেখানে কচুরিপানার আধিক্য বেশি সেখানে এনে থামালো ওরা। কচুরিপানা সরিয়ে ছোট সরু একটা পথ বের করে নিলো। তারপর বস্তাটাকে কাঁধে করে টেনে একটা দুর্গম জায়গায় নিয়ে কচুরিপানা চাপা দিয়ে দিল। এরপর দ্রুত নৌকায় উঠে এলো ওরা। নিঃশব্দে নৌকা চলতে থাকলো ঘাটের দিকে। শুধু পানির ছলাত ছলাত শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। নৌকাটা পাড়ের কাছাকাছি এনে ডুবিয়ে দিল নাসির আলী। গফুর আলী তাকে সাহায্য করলো। পাড়ে উঠে একবার পেছনে ফিরে তাকায় গফুর আলী। বাবাকে হারিয়ে মায়ের হাত ধরে একদিন এই বিলের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। তারপর খেয়ে না খেয়ে দিন গেছে। বিলের মাছ ছাড়া উপার্জনের আর কোন পথ ছিল না। মাছও বিক্রি হত পানির দামে। বিলের শাপলা, ড্যাপের ভাত খেয়ে দিন গেছে। এই বিলের পাড়েই সে আরও একটি মহাকাব্য রচনা করে গেল আজ, এ কাব্য বিভীষিকাময় প্রতিশোধমূলক মহাকাব্য।

নাসির আলী তখন হাত পায়ে বিলের পচা পানির কামড়ে দিশেহারা। যতদ্রুত সম্ভব বাড়িতে গিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে তাকে। সেদিকে খেয়াল নেই গফুর আলীর। নাসির আলী তাড়া দেয় বাবাকে, ‘তাড়াতাড়ি যাইবা, নাকি জেল খাটনের ইচ্ছা আছে?’ ছেলের কথা শুনে সম্ভিত ফিরে পায় গফুর আলী। লুঙ্গিতে গাজীর কাছা মেরে দ্রুত পায়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয় ওরা। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পূব আকাশ উজ্জ্বল হয়ে এসেছে সুবহে সাদিকের আলোয়। বাতাসে একটা পবিত্র পবিত্র ভাব। এই প্রাকৃতিক নির্মল পবিত্রতার মাঝে মানব সভ্যতার সবচেয়ে ভয়ংকর আদিম হিংস্র কর্মটি ঘটে গেল। পৃথিবীতে অনেক বর্বরতাকেই পবিত্র কোন না কোন আবরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনটি ঢেকে গেছে চিরতরে, কোনটি উন্মোচিত হয়ে পড়েছে দিনের আলোয়। কোনটির সাক্ষ্য দিয়েছে সৃষ্টি, কোনটির শাস্তি বিধানের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং চির অন্তরীক্ষের অধিবাসী।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড