রিফাত হোসেন
দুপুরের আগেই শুভ, সুমাইয়া, জ্যোতি আর আদিত্য ছাড়া সবাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। শুভ মিস্টার জনকে বলল, ‘মিস্টার জন, চট্রগ্রাম রিসোর্টে আমাদের জামা-কাপড়সহ অফিসের কাগজপত্র আছে। এগুলো প্লিজ ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিবেন। কাগজপত্রগুলো খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। আর আমাদের ব্যাগে, আমাদের ব্যক্তিগত কিছু জিনিস আছে।’
- এই নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না মিস্টার শুভ। আমি চট্রগ্রাম গিয়েই আপনাদের সবকিছু ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করব। আপানারা নিশ্চিন্তে ঢাকায় ফিরে যান।
মিস্টার জনও চলে গেল তার ম্যানেজারের সাথে। বিকেলের দিকে শুভ আর সুমাইয়াকে রিলিজ করে দিলো হাসপাতাল থেকে। জ্যোতি অরিনের কাছে গিয়ে কানে কানে ফিসিফিস করে কিছু একটা যে বলল, তা চোখ এড়ায়নি আদিত্যর। শুভ আর সুমাইয়া গাড়িতে গিয়ে বসার পর আদিত্য জ্যোতির কাছে গিয়ে বলল, ‘আপনার বন্ধুর কানের কাছে কী বললেন তখন?’
জ্যোতি বুঝতে পেরেও না বুঝার অভিনয় করে বলল, ‘আমি আবার কখন অরিনের কানের কাছে কী বললাম?’
- আমি দেখেছি আপনি উনার কানে ফিসফিস করে কিছু বলেছেন। সত্যি করে বলুন তো, কী বলেছেন।
- আমাদের বিয়ের পর এখানে আবার আসবো হানিমুন করতে। সেটাই বলেছি।
আদিত্য কিছু বলল না। গাড়িতে গিয়ে বসল ওরা দু'জন। শুভ আর সুমাইয়া মাঝে। আদিত্য ড্রাইভারের সাথে আর জ্যোতি পিছনে। ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো ওরা।
মাঝরাতে ঢাকায় ফিরল ওরা সবাই। শুভদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
ঘরে গিয়ে একে একে সবাই গোসল করে নিলো। শুভ বলল, ‘খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিন্তু বাইরের সব দোকানপাট এখন বন্ধ।’
জ্যোতি বলল, ‘তুমি আর ভাবী ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমি নুডুলস রান্না করে নিয়ে আসছি।’
- এত রাতে রান্না করতে হবে না তোর। অনেকটা পথ গাড়িতে এসেছিস।
- আমার কোনো সমস্যা হবে না ভাইয়া। তোমরা গিয়ে বিশ্রাম নাও। আদিত্যও নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিক। রান্না শেষ হলে আমি ডাকবো সবাইকে।
শুভ ওর কথায় সম্মতি জানালেও আদিত্য বলল, ‘আমিও আপনার সাথে রান্না করব। আপনার কিছুটা সাহায্য-ও হয়ে যাবে।’
- আপনার বোন বলেছে, আপনি খুব অলশ টাইপের ছেলে। সেই আপনি নিজে থেকে আমাকে রান্নায় সাহায্য করতে চাইছেন। বেশ অদ্ভুত বিষয়টা।
শুভ আর সুমাইয়া মুখ টিপে হাসল। আদিত্য কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। জ্যোতি আবার বলল, ‘ঠিক আছে। আসুন আমার সাথে।’
জ্যোতি আর আদিত্য রান্নাঘরের দিকে গেল। শুভ আর সুমাইয়া ঘরে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আদিত্য নিজের হাত ধুয়ে বলল, ‘বলুন কী করতে হবে আমাকে?’
- মরিচগুলো কেটে দিন আপনি। আমি পেঁয়াজগুলো কেটে নিচ্ছি।
আদিত্য বলল, ‘ওকে।’
দু'জনে দু'টো ছুরি হাতে নিয়ে কাটা শুরু করল। পেঁয়াজের ঝাঁজে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে জ্যোতির। আদিত্য ওর অবস্থা দেখে হাসছে। জ্যোতি রাগী কণ্ঠে বলল, ‘এভাবে না হেসে আমার চোখের জলটা মুছিয়ে দিন তাড়াতাড়ি।’
- আমার হাতে মরিচ লেগে আছে। আপনার চোখ জ্বালা করবে।
- আমি এত কিছু জানি না। আপনি আমার চোখের জল মুছিয়ে দিন। হাত ধুয়ে নিন প্রয়োজন হলে।
হঠাৎ করে আদিত্য কিছু না বলেই জ্যোতিকে নিজের কাছে টেনে আনলো। থতমত খেয়ে গেল জ্যোতি। আদিত্য নিজের ঠোঁট দিয়ে জ্যোতির চোখ স্পর্শ করল। শুষে নিলো জ্যোতির চোখের নোনা জলটুকু। জ্যোতি আদিত্যকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। আদিত্য নিজের ঠোঁটটা চোখ থেকে নিচে নামিয়ে নিলো। জ্যোতির ঠোঁটে স্পর্শ করতে চেয়েও কেন জানি থেমে গেল ও। জ্যোতির কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে ওকে ছেড়ে দিলো।
জ্যোতিও আদিত্যকে ছেড়ে দিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে মুচকি হাসি দিতে লাগল। আদিত্য কিছু না বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সোফায় বসে টিভি অন করল। কিছুক্ষণ পরেই রান্নাঘর থেকে নুডুলস ভরা বাটি নিয়ে বেরিয়ে এলো জ্যোতি। চোখাচোখি হতেই নিজেদের চোখ নামিয়ে নিলো দু'জনেই। জ্যোতি আবারও মুচকি হাসি দিলো। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা দু'জনের মাঝে। নীরবতা ভেঙে জ্যোতি বলল, ‘কাঁচা মরিচ মাখা হাতটা ধুয়ে আসুন আপনি। আমি ভাইয়াদের ডেকে আনছি।’
আদিত্য বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল। জ্যোতির দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে হাত ধোয়ার জন্য চলে গেল। জ্যোতি শুভ আর সুমাইয়াকে ডাক দিলো। ওরা দু'জনে বাইরে চলে এলো। সুমাইয়া বলল, ‘সরি রে। এত রাতে তোদের কষ্ট করতে হলো।’
আদিত্য হাত ধুয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কোনো ব্যাপার না ভাবী। আপনাদের বিশ্রাম নেওয়াটা খুব প্রয়োজন। তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি যে ঘরে থাকি, জ্যোতি আজ সেখানেই থাকবে। আমি সোফায় শুয়ে বাকি সময়টা পাড় করে দিবো।’
পাশ থেকে শুভ বলল, ‘সুমাইয়া আর জ্যোতি আমার ঘরে ঘুমাবে। আমি আর তুই পাশের ঘরটাতে ঘুমাবো। শুধু শুধু সোফায় শুয়ে কষ্ট করতে হবে না তোকে।’
আদিত্য বলল, ‘আপনারা নিজেদের ঘরে গিয়ে ঘুমান ভাই। ভোর হতে খুব বেশি সময় নেই আর। আমি ড্রয়িংরুমেই শুয়ে পড়ব।’
শুভ আর কিছু বলল না। খাওয়া শুরু করল সবাই। খাওয়া শেষে শুভ আর সুমাইয়া নিজেদের ঘরে চলে যাওয়ার পর জ্যোতিও ঘরে চলে গেল। আদিত্য কিছুক্ষণ বসে থেকে ড্রয়িংরুমের লাইট অফ করে দিয়ে সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। চোখ দু'টো বন্ধ করে রাখলেও ঘুম আসছে না আদিত্যর। বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সম্ভবত আর ঘন্টা দুই-এক এর মধ্যেই ভোর হয়ে যাবে। হঠাৎ কারোর স্পর্শ পেয়ে চকমে উঠল আদিত্য। কিছু বলতে যাবে, তখনই ওর মুখ আটকে দিলো নরম, শীতল একটা হাত। হাতটা সরানোর কোনো চেষ্টাই করল না আদিত্য।
ও জানে এটা জ্যোতির হাত। এই স্পর্শ আগেও অনুভব করেছে আদিত্য। আদিত্য কিছু না বলে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। জ্যোতি আদিত্যর পাশে বসল। তারপর ওর বুকে একটা চুমু দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আদিত্য তবুও কিছু বলল না। মুখ টিপে হাসছে ও। একসময় জ্যোতি ওর বুকেই ঘুমিয়ে পড়ল। আদিত্যও জ্যোতিকে বুকে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে সূর্যের তাপে ঘুম ভেঙে গেল সুমাইয়ার। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে শুভকে একবার ডাক দিয়ে দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে দেখে একটা সোফায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে আদিত্য আর জ্যোতি। ওদের এভাবে দেখে হেসে দিলো সুমাইয়া। তবে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ওদের কাছে গেল। এরপর রাগী কণ্ঠে বলল বলল, ‘এগুলো কী হচ্ছে এখানে?’
আদিত্য চোখ মেলে তাকালো। জ্যোতিকে নিজের বুকের উপর দেখেই আতঙ্কে উঠল ও। রাতের কথা মনে পড়তেই ও কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আবার সুমাইয়ার দিকে তাকালো। জ্যোতি তখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সুমাইয়া জ্যোতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই যে মহারানী, অন্যের বুকে ঘুমিয়ে খুব আরাম পাচ্ছেন বুঝি?’
সুমাইয়ার কথায় আদিত্য কিছুটা লজ্জা পেলেও তা প্রকাশ করল না। হঠাৎ জ্যোতি একটা হাত কানের কাছে নিয়ে বলল, ‘ওই হারামী, বজ্জাত মেয়ে একটা। এত জ্বালাতন করিস কেন? প্রতিদিন সক্কাল সক্কাল ফোন না দিলে তোর ভালো লাগে না, তাই না? আজকে ইউনিভার্সিটিতে আয় একবার, তারপর তোর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ব। উফ্, কত আরামেই না ঘুমোচ্ছিলাম। কী শীতল স্পর্শ। আহ্, ইচ্ছে করছে সারাজীবন এভাবেই শুয়ে থাকি।’
জ্যোতি একা একাই বিড়বিড় করে যাচ্ছে। ওর আবোলতাবোল কথা শুয়ে হো হো করে হাসছে আদিত্য আর সুমাইয়া। ঘুম ভাঙতেই আদিত্যর বুক থেকে মাথা তুলল জ্যোতি। সুমাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘তুমি এখানে কী করছ ভাবী?’
হাসি থামিয়ে সুমাইয়া বলল, ‘তার আগে বল তুই নিজের ঘর ছেড়ে এখানে কী করছিস?’
জ্যোতি চোখ কচলাতে কচলাতে নিজের অবস্থান দেখে নিলো। এখনো আদিত্যর বুকে শুয়ে আছে। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকালো ও। আদিত্য অনবরত হেসেই যাচ্ছে। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জ্যোতি বলল, ‘আপনি এভাবে হাসছেন কেন? আর আমার ঘরে কী করছেন আপনি?’
সুমাইয়া বলল, ‘ও তোর ঘরে যায়নি। বরং তুই ড্রয়িংরুমে চলে এসেছিস।’
জ্যোতি আশেপাশে ভালো করে তাকালো। নিজের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের জন্য, নিজের মাথায় একটা টোকা দিয়ে বলল, ‘সরি ভাবী। সরি আদিত্য। আসলে রাতে ঘুমের ঘোরে হেঁটে হেঁটে কোত্থেকে যে কোথায় এসেছি, তা আমি জানি না।’
আদিত্য বলল, ‘শুধু কী হাঁটেন? আপনি তো ঘুমের ঘোরে আবোলতাবোল ও বলেন।’
- মানে?
- একটু আগেই তো কানে হাত দিয়ে কীসব উল্টো পাল্টা বললেন। কাকে যেন বকছিলেন। আর বলছিলেন, ইউনিভার্সিটি আয়, তোর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ব।
জ্যোতি শব্দ করে হাসল। তারপর বলল, ‘আসলে ওইসব ইরাকে বলছিলাম। ও প্রতিদিন সকালে ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। ফোন তো হারিয়ে গেছে। কিন্তু অভ্যাসটা রয়েই গেছে। তাই কেউ ফোন না দিলেও নিজের অজান্তেই সকালবেলা হাতটা কানের কাছে চলে এসেছে। তাই ওইসব উল্টো পাল্টা বলেছি।’
আবারও হো হো করে হেসে উঠল সবাই।
বেশ কিছুক্ষণ পর জ্যোতি বলল, ‘আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি ভাবী।’
- হুম যা। তারপর আমাকে রান্নার কাজে সাহায্য করবে।
- ওকে।
জ্যোতি চলে গেল। আদিত্য নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় বসল। ওয়াশরুমে জ্যোতি আছে বলে ও যেতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর জ্যোতি বের হয়ে এলে আদিত্য ভিতরে যায়। জ্যোতি রান্নাঘরে চলে যায় সরাসরি।
রান্না শেষ হওয়ার পর সবাই একসাথে খাবার খেয়ে নেয়। শুভ নিজের ঘরে গিয়ে রেডি হয়ে নিলো।
তারপর জ্যোতিকে বলল, ‘তুই তো এখন হোস্টেলে ফিরবি, তাই না জ্যোতি।’
- হ্যাঁ ভাইয়া।
- একটা কাজে আমিও বাইরে যাবো। তোকে নামিয়ে দিয়ে যাবো হোস্টেলে।
- ওকে চলো।
শুভ আর জ্যোতি চলে গেল। আদিত্য নিজের ঘরে গিয়ে টিভি দেখতে লাগল।
দুপুরের দিকে হাসিমুখে ফিরে এলো শুভ। আদিত্য কাছে এসে বলল, ‘একটা ভালো খবর আছে আদিত্য।’
আদিত্য আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
- আমাদের অফিসে কালকে তোর ইন্টার্ভিউ। সব কাগজপত্র নিয়ে কালকে আমার সাথে অফিসে যাবি। ইন্টারভিউ ভালো হলেই জয়েনিং লেটার পেয়ে যাবি কালকে।
আদিত্য শুভকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, ‘ধন্যবাদ ভাই। আর চাকরিটা হয়ে গেলে একটা ভাড়া বাড়ি নিতে হবে।’
- ভাড়া বাড়ি দিয়ে কী করবি? এখানেই থাক।
- মা আর বোনকে নিয়ে আসবো। যেভাবেই হোক এটা আমাকে করতেই হবে। মামার সংসারে আর কতদিন থাকবে ওরা?
- ওকে। আমি বাড়ি খুঁজে দেবো।
- আচ্ছা।
সারাদিনে আর কোথাও গেল না শুভ আর আদিত্য। নামাযের সময় শুধু নামায পড়তে গিয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী রাতে চা খাওয়ার জন্য রান্নাঘরে গেল আদিত্য। কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে দেখে চিনি নেই। আদিত্য মনে মনে বলল, ‘সম্ভবত চিনিটা শুভ ভাইয়ের ঘরে আছে। বিকেলে ভাবী চায়ে চিনি দেওয়ার জন্য ওটা ঘরে নিয়ে গিয়েছিল।’
প্রথমে ভবল ওদের ডেকে চিনিটা চাইবে। কিন্তু এটা ঠিক হবে কিনা ভেবে পাচ্ছে না ও। অনেকক্ষণ ভেবে আদিত্য সিদ্ধান্ত নিলো বাইরে কোনো দোকানে গিয়ে চা খাবে আজ। দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিয়ে নিচে চলে এলো ও। রাত প্রায় ১টা বাজে। আদিত্যর বাড়ির নিচে দোকানপাট সব বন্ধ এখন। আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা টং দোকানে গেল আদিত্য। বেঞ্চে বসতে বসতে দোকানদার কে বলল, ‘একটা চা দিন আমাকে।’
দোকানদার ‘দিচ্ছি’ বলে চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এই দোকানটা সারারাত খোলা থাকে। দিনে তার স্ত্রী বসে দোকানে। আর রাতে তিনি নিজেই বসে। শুধু চা'ই বিক্রি করে । মধ্যবয়সী লোক, গায়ের রঙ কালো। তবে অচেনা মানুষদের সাথে কথাবার্তায় ভাব জমিয়ে ফেলতে খুব সময় লাগে না লোকটার। আদিত্য যেদিন প্রথম এই দোকানে এসেছিল, সেদিনই ওর সাথে ভাব জমিয়ে দিয়েছিল।
দোকানদারের কথায় বাস্তবে ফিরল আদিত্য। দোকানদার চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। একরাশ হাসি দিয়ে আদিত্যর দিকে চা এগিয়ে দিলো লোকটা। আর বল, ‘এতদিন পর এলেন যে। সেই অনেকদিন আগে শেষ এসেছিলেন। তারপর তো আর দেখা পেলাম না আপনার।’
আদিত্য মলিন হাসি দিয়ে বলল, ‘একটু ব্যস্ত ছিলাম কাকা। তাক আসতে পারিনি।’
- ঠিক আছে। যখনই সময় পাইবেন। আমার দোকানে আইবেন।
- আচ্ছা। দোকানদার চলে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিলো আদিত্য। হঠাৎ মেয়েলী কণ্ঠে কেউ একজন ডাক দিলো। প্রথমবার তেমন গুরুত্ব দিলো না আদিত্য। কারণ এত রাতে কোনো মেয়ে যে ওকে ডাক দিবে না, তা শিওর ও। মেয়েলী কণ্ঠে আদিত্য নামটা আবারও শুনতে পেলো। পিছন ফিরে তাকালো।
ওর পিছনেই একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। ভিতর থেকে কেউ একজন হাত ইশারা করে ডাকছে। আদিত্য চায়ের কাপটা বেঞ্চিতে রেখে সিএনজি এর দিকে এগিয়ে গেল। সিএনজির ভিতরের মেয়েটাকে দেখে থমকে গেল আদিত্য। এত রাতে ইরাকে এখানে দেখবে, তা ওর কল্পনারও বাইরে ছিল। ইরার প্রতি ঘৃণা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল আদিত্যর। ওর কাধে মাথা রেখে বসে আছে একটা লোক। পরনে সাদা-কালো রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট। ইরা নিজের ওড়নার কিছু অংশ দিয়ে লোকটার কপাল ঢেকে রেখেছে। তাই ওড়নার জন্য মুখটা দেখা যাচ্ছে না লোকটার। আদিত্য রাগে ফুসছে। ইরা বলল, ‘সিএনজিতে ওঠে বসো তাড়াতাড়ি।’
রাগী কণ্ঠে আদিত্য বলল, ‘বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে এত রাতে রোমান্স করতে গিয়েছিলে। এখন বাড়িতে ফিরছ নিশ্চয়৷ তা বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে বাড়িরে যাচ্ছ যাও, আমাকে ডাকছ কেন?’
- ভদ্রভাবে, বুঝে কথা বল আদিত্য। কিছু না জেনে-বুঝে উল্টো পাল্টা কথা বলো না।
আরো রেগে গেল আদিত্য। একেই রাগে ওর শরীর জ্বলছে। তার উপর আবার ইরার এইরকম কথা। ইরাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘আর একটা কথা বললে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিবো। বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে যেখানে ইচ্ছে, সেখানে যাও। আমাকে ডাকলে কেন? আর এভাবে ওড়না দিয়ে ওর মুখটা ডেকে রেখেছ কেন? আচ্ছা এটা কী আয়ান, নাকি অন্য কেউ? আয়ান তো আরো লম্বা। আর চিকোন। কিন্তু এই লোকটা তো পেট মোটা, আর অনেকটা খাটো মনে হচ্ছে। একসাথে কতগুলো ছেলের সাথে ডেটিং এ যাও তুমি। বাড়িতে কিছু বলে না তোমাকে। নাকি তারা আরো প্রশ্রয় দেয়। চরিত্রটাও ঠিক রাখতে পারলে না। এভাবে নিজের শরীর সবাইকে ভোগ করতে দিচ্ছ। তোমার চেহারাটা দেখলেই ঘৃণা হয় আমার।’
আদিত্যর কথা শুনে ইরা কেঁদে দিলো। লোকটার মাথা থেকে নিজের ওড়না সরিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হতে পারে আমি তোমার আর আমার সম্পর্কটা ভেঙে দিছি। তুমি থাকাকালীন অন্য একজনকে ভালোবেসেছি আমি। কিন্তু আমাকে নিয়ে তোমার মনে যে এত খারাপ চিন্তাভাবনা আছে, তা আমি আগে থেকে জানলে কখনোই তোমাকে ডাকতাম না। আমার বাবার বয়সী এই লোকটা। সবচেয়ে বড় কথা ইনি তোমার বড় কাকা। যে দেশের বাইরে থাকে। নিজের কাকাকে নিয়ে এইরকম কথা বলতে তোমার মুখে আটকালো না।’
কথা বলতে বলতে ইরার কান্না আরো বেড়ে যাচ্ছিল। আদিত্য থমকে গেল ওর কথা শুনে। সিএনজি ড্রাইভার পিছনের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বলল, ‘যা করার একটু তাড়াতাড়ি করেন আপনারা। লোকটার অবস্থা বেশি ভালো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’
লোকটার দিকে তাকাতেই আদিত্যর বুকটা কেঁপে উঠল। অস্থির কণ্ঠে বলল, ‘কী হয়েছে বড় কাকার? উনার এই অবস্থা কীভাবে হলো? তাছাড়া কাকা তো দেশের বাইরে চলে গিয়েছিল।’
আদিত্যর কাকা ব্যথায় চিৎকার দিলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল - "আজকেই দেশে এসেছি আমি। এয়ারপোর্টে থেকে আসার সময় রাস্তায় হঠাৎ করে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে যায় আমার গাড়িটা।"
ঠিক মতো কথা বলতে পারছিল না আদিত্যর কাকা। ইরা বলল , ‘আমার চরিত্র নিয়ে যত খারাপ কথা বলার পরে বলো। এখন প্লিজ আগে হাসপাতালে চলো। নাহলে তোমার কাকাকে বাঁচানো যাবে না। অনবরত রক্ত পড়ে যাচ্ছে উনার কপাল থেকে।’
আদিত্য তড়িঘড়ি করে সিএনজিতে ওঠে বসল। ড্রাইভার দ্রুত গতিতে সিএনজি চালাচ্চে। পাশের একটা হাসপাতালে গেল ওরা। কাকাকে ধরে ভিতরে নিয়ে গেল আদিত্য। ড্রাইভার সাহায্য করল ওকে। ডাক্তার এসে উনাকে দেখল। তারপর বলল, ‘অপারেশন করতে হবে। রিসিপশনে গিয়ে ফর্মালিটিগুলো পূরণ করুন তাড়াতাড়ি। আমি অপারেশন এর সব ব্যবস্থা করছি।’
ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে চলে গেল আদিত্যর কাকাকে নিয়ে। সিএনজি ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে দিলো আদিত্য। তারপর ধন্যবাদ বিয়ে বিদায় জানালো উনাকে। ইরার দিকে অপরাধের দৃষ্টিতে তাকালো আদিত্য। ইরা উল্টো দিকে ঘুরে চোখ মুছে বেঞ্চিতে বসে পড়ল।
(চলবে...) আরো পড়ুন ‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর ১৯তম পর্ব - ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড