• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘অদ্ভুত নিয়তি’-এর প্রথম পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : অদ্ভুত নিয়তি

  রিফাত হোসেন

২৩ জুলাই ২০১৯, ১৫:৫৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

- দু’টো খুনের বিনিময়ে তোকে দুই লাখ টাকা দিতে চাচ্ছি, তবুও তুই রাজি হচ্ছিস না! আরে আমার কোনো লোককে শুধু একবার বললেই কাজটা করে দিতো। এত টাকা দিতে হতো না ওদের।

- তাহলে উনাদেরই বলুন এই কাজটা করতে। আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

- বেশি কথা বললে একদম মেরে ফেলবো। তোর দ্বারা সম্ভব না মানে কী? তাহলে এখানে কেন এসেছিস তুই?

আদিত্য করুণ কণ্ঠে বলল, ‘ভাই, আপনি যা ভাবছেন আমি তা নই! আমি শুধুমাত্র একটা কাজের জন্য আপনার কাছে এসেছিলাম। আমি কোনো খুন-টুন করতে পারব না।’

- একবার যে আমার ডেরায় ঢুকে পড়ে, তাকে এত সহজে ফিরে যেতে দিই না আমি।

- ভাই প্লিজ, একটু বুঝার চেষ্টা করেন। আমি খারাপ কোনো কাজ করতে পারব না। আমি ওইরকম ছেলে নই। একটা লোক আপনার ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে বলল, এই নম্বরে ফোন দিয়ে কথা বলতে, না হয় ডিরেক্ট এই ঠিকানায় যোগাযোগ করতে। আমি ভাবলাম সামনাসামনি কথা বলি, তাই এখানে চলে আসলাম।

- হ্যাঁ, কাজ দিলাম তো তোকে। খুব বড় একটা কাজ দিলাম তোকে, যার বিনিময়ে তোকে এতগুলো টাকা দিতে চাচ্ছি।

- আমি এইরকম কাজ করতে আসিনি ভাই। ছোটখাটো একটা চাকরি পেলেই হয়ে যাবে আমার।

- শোন, আমি এত কথা বলতেও চাই না, আর শুনতেও চাই না। সোজাসাপ্টা উত্তর চাই আমার, তুই এই কাজটা করবি কিনা?

আদিত্য কড়া গলায় বলল, ‘মাফ করবেন ভাই, আমি কাউকে খুন করতে পারব না।’

আদিত্য’র কথা শুনে লোকটা সম্ভবত রেগে গেল। মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও তার দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ বুঝা যাচ্ছে। পাশ থেকে এক লোক বলল, ‘ভাই, আপনি একবার অনুমতি দেন খালি। হালারে এহনি শেষ কইরা দেই।’

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আদিত্য’র দিকে চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তোকে পরে দেখে নিবো আমি। এখন তুই যা এখান থেকে।’

- তাহলে আমি কি এখন যেতে পারব?

- হ্যাঁ!

আদিত্য ডেরা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হাঁটতে লাগল। একটু সামনে এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে তাকাল। তারপর অনেকটা কৌতূহল নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, যাকে আপনারা খুন করতে চাচ্ছেন, সে কে? আর আপনার লোকদের দিয়ে উনাকে খুন না করিয়ে আপনি আমাকেই এই খুনটা করার কথা কেন বলছেন? আমি তো প্রফেশনাল না এইরকম কাজ এ! তবুও আমাকে কেন এত বড় একটা কাজ দিচ্ছেন? আবার এতগুলো টাকা অফারও করছে। কারণ কী এর?’

লোকটা বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল, ‘তোকে এত কথা বলতে পারব না আমি। ভালোই ভালোই বলছি এখন থেকে যা, নাহলে এই পিস্তলের সব কয়টা গুলি তোর মাথায় ভিতরে ঢুকিয়ে দিবো।’

আদিত্য আর কিছু না বলে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। বেশ বড় একটা ঝামেলায় পড়েছিল ও। ভাগ্য ভালো থাকায় জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছে।

ভাগ্যের কথাটা বলতেই আদিত্য খুব অবাক হলো! ওর ভাগ্য তো কখনোই ভালো ছিল না, তাহলে কাল আর আজ কী এমন স্পেশাল দিন যার কারণে ওর ভাগ্যটা অন্যান্য দিনগুলোর মতো ছিল না!

কাল রাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল আদিত্য। উদ্দেশ্য ছিল রাস্তার পাশের কোনো এক দোকানে বসে চা খাবে আর একাকী কিছুটা সময় কাটাবে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় ১১ টা বাজে। একা একা নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছিল আদিত্য। হঠাৎ করে সামনে একটা গাড়ি এসে থামে। আদিত্য চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল শুধু। গাড়ির ভিতর থেকে দু’জন লোক নেমে আদিত্য’র দিকে পিস্তল তাক করে বলে, ‘গাড়িতে উঠ তাড়াতাড়ি।’

ঘটনাটা বুঝতে বেশ কয়েক মুহূর্ত সময় লেগেছিল আদিত্য’র। আদিত্যকে চুপ থাকতে দেখে লোক দু’টো আবার বলল, ‘কী হলো উঠ গাড়িতে।’

নরম কণ্ঠে আদিত্য উনাদের প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কারা? আর আমাকে গাড়িতে উঠতে বলছেন কেন?’

ওদের মধ্যে একজন পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে আদিত্যকে দেখায়। কার্ডটা দেখে আদিত্য বুঝতে পারে এনারা পুলিশ। আর এটাও বুঝতে পারে ওর সাথে এখন কী হতে চলেছে!

আদিত্য বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘স্যার, আপনারা শুধু শুধু আমাকে গাড়িতে তুলতে চাইছেন। আমি কোনো অপরাধী নই। প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন।’

এইরকম আরও অনেক কথা বলে উনাদের। অনেক অনুরোধ করার পরও আদিত্যকে উনারা ছাড়ছিল না। এবং ওর কোনো কথাও উনারা বিশ্বাস করছিল না। ঠিক তখন ওখানে আরেকজন লোক উপস্থিত হয়। যে অনেকটা সাহসীকতার সাথে দু’জন পুলিশের মধ্যে একজনের সাথে কথা বলছিলেন। লোকটা কিছুক্ষণ পর পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে পুলিশের হাতে দিয়ে আদিত্য'র কাছে এলো। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আদিত্য লোকটার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘আপনি টাকা দিয়ে আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচালেন, এর কারণ কী? কে আপনি? আর হঠাৎ করে অচেনা একটা ছেলেকে সাহায্য করলেন কেন?’

লোকটা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘আমার নাম রোহান। পাশের এলাকাতেই থাকি। দেখলাম আপনি বিপদে পড়েছেন, তাই সাহায্য করলাম। তাছাড়া আমি জানতাম ওরা টাকার জন্যই আপনার সাথে এইরকম করছে। এই রাস্তায় প্রায়ই ওরা কাউকে না কাউকে এভাবে ধরে নিয়ে যায়, তারপর কিছু টাকা খেয়ে আবার ছেড়ে দেয়।’

- সবাইকেই কি আপনি সাহায্য করেন?

- সবাইকে সাহায্য করা তো আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হলো আপনি এই এলাকায় একেবারে নতুন। আর বেশ বিপদে পড়েছেন , তাই এলাম সাহায্য করতে।

আদিত্য কিছু বলল না। রোহান আবার বল, ‘আপনি নিশ্চয়ই নতুন এসেছেন এই এলাকায়, তাই না?’

- হুম। কিছুদিন হলো মাত্র আমি এখানে এসেছি। সামনেই আমার বাসা। ভালো লাগছিল না বলে চা খেতে এসেছিলাম এখানে। আর তখনই উনারা এসে যায়।

- হুম। আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবে এরপর থেকে রাতে বের হবেন না। আচ্ছা আপনার বাড়িতে কে কে থাকেন? আর আপনি কী কাজ করেন?

- এখানে আমি একাই থাকি। আর আপাতত আমি কোনো কাজ করছি না, একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করছি।

আদিত্য’র কথা শুনে লোকটা সঙ্গে-সঙ্গে একটা ঠিকানা আর একটা ফোন নম্বর হাতে দিয়ে চলে গেল। আর যাওয়ার সময় বলে গেল এই নম্বর আর ঠিকানায় যেন যোগাযোগ করি।

এই কারণেই আদিত্য সকালে ওই ঠিকানায় গিয়েছিল। একবার মনে হয়েছিল, এবার বুঝি আমার ভাগ্যটা খুলল। সবসময় তো আমার ভাগ্য খারাপ ছিল, কিন্তু আজ ভাগ্য ভালো ছিল বলে একটা কাজের সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে মনে হয়েছিল আমার ভাগ্য কখনোই ভালো ছিল না, এবং আজও আমার ভাগ্য ভালো হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই কোনভাবে যেন ওই লোকগুলোর হাত থেকে বেঁচে গেলাম।

আদিত্য আর এইসব কথা মনে করতে চায় না। তাই মন থেকে এই ভাবনাগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। এখন প্রায় ১০ টা বাজে। আজকে ইরার সাথে দেখা করতে হবে। বেশ কয়েকদিন হলো ওর সাথে দেখা করতে যায় না আদিত্য। কিন্তু কালকে রাতে ইরা ফোন করে বলে দিয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করতে। অন্যথায় ও আদিত্য'র বাড়িতে চলে আসবে। কিন্তু আদিত্য সেটা চায় না। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে ইরার ইউনিভার্সিটির দিকে যেতে লাগল আদিত্য।

প্রায় আধাঘণ্টার মতো লাগল ইরার ইউনিভার্সিটির সামনে যেতে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ইরা বলেছিল এইসময় এখানে আসবে।

বেশ কিছুক্ষণ পর ইরা এলো আদিত্য’র সামনে। সাথে অবশ্য একটা মেয়েও আছে। হয়তো ওর বান্ধবী। আদিত্য সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে ইরার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরা সামনে এসে কড়া গলায় বলল, ‘এত সময় লাগল এখানে আসতে?’

আদিত্য স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ‘আমি তো আরও বেশ কিছুক্ষণ আগে এসেছি এখানে।’

ইরা রাগী কণ্ঠে বলল, ‘বাহ্, বেশ কথা বলতে শিখেছ তো। তা এতদিন পর দেখা করতে এলে, কী এনেছ আমার জন্যে?’

আদিত্য অপ্রস্তুত স্বরে বলল, ‘আসলে, তোমাকে কিছু জরুরি কথা বলতে এসেছি আমি।’

আদিত্যকে থামিয়ে দিয়ে ইরা বলল, ‘ওয়েট, ওয়েট। যা শোনার পরে শুনবো, আগে বল আমার জন্য কী এনেছ?’

নিচু স্বরে বলল, ‘কিছু আনতে পারিনি আমি। আসলে বেশ কিছুদিন ধরে একটা ঝামেলার মধ্যে ছিলাম।’

আদিত্য’র কথা শুনে ইরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল মুহূর্তের মধ্যেই। আদিত্য মাথা নিচু করে ফেলল। ইরা রাগে কটমট করতে করতে চেঁচিয়ে বলল, ‘তাহলে কী এখানে মজা দেখতে এসেছ? এতদিন পর দেখা করতে এসেছ, কোথায় ভাবলাম আমার জন্য দামি কিছু উপহার নিয়ে আসবে! তা না করে তুমি খালি হাতে এসেছ আমার সাথে জরুরি কথা বলতে। ফাজলামি কর তুমি আমার সাথে?’

আদিত্য আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অনেকেই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ইরার একটা হাত করে বল, ‘প্লিজ ইরা, এভাবে চেঁচামেচি না করে একটু শান্ত হও। ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথাগুলো শোন। আমি নিশ্চিত, আমার কথাগুলো শোনার পর তোমার আর এই রাগ থাকবে না। প্লিজ অন্য কোথাও গিয়ে আমরা বসে কথা বলি একটু। চারিদিকে তাকিয়ে দেখ, অনেকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আবার কেউ কেউ হাসাহাসি করছে।’

- হাসবে না তো কি কাঁদতে! তোমার মতো একটা ফকিন্নি কে ভালোবেসেছিলাম আমি, এতেই তো আমার সম্মান সব শেষ করে গেছে।

অবাক কণ্ঠে আদিত্য বলল, ‘এইসব কী বলছ তুমি? প্লিজ আমার কথাগুলো একবার শোন?’

পাশ থেকে ইরার বান্ধবী বলল, ‘ইরা একটু শান্ত হয়ে উনার কথাগুলো শোন। তাছাড়া এতগুলো মানুষের সামনে উনাকে এভাবে অপমান করছিস কেন তুই?’

- ওর আবার অপমানবোধ আছে নাকি? শোনো আদিত্য, আমি এত কথা শুনতে চাই না। এখন থেকে তোমার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। সো তুমি আর আমার সামনে আসবে না।

আদিত্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ইরা হনহনিয়ে ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একবার ভাবল ইউনিভার্সিটির ভিতরে যাবে, আবার ভাবল এখন ইউনিভার্সিটির ভিতরে গিয়ে ইরার সাথে কথা বলা ঠিক হবে না। রাগ কমে গেলে পরে অবশ্যই যোগাযোগ করবে ইরা।

আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আদিত্য বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। তবে নিজের বাড়ি নয়, এক বন্ধুর বাড়ি। কিছুদূর যাওয়ার পর আদিত্য থেমে গেল, সামনে ওর মা, মিসেস আয়েশা দাঁড়িয়ে আছেন। তাড়াতাড়ি করে মিসেস রোকসানার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আদিত্য।

ছেলেকে দেখে মিসেস রোকসানা বিষণ রেগে গেলেন। চোখেমুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ ফুটে উঠেছে তার। আদিত্য করুণ কণ্ঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ মা, আমাকে আর কষ্ট দিও না। তোমাদের ছাড়া আমি থাকতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হয় তোমাদের না দেখতে পেলে। বাড়ি থেকে চলে আসার পর এখন পর্যন্ত, একমুহূর্তের জন্যও আমি শান্তি পাইনি। কোনো রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। নির্ঘুমে কাটিয়ে দিয়েছে গত কয়েকটা রাত। সারাক্ষণ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে আমার।’

মিসেস রোকসানা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার সামনে থেকে সরে যা। তুই একটা বিশ্বাসঘাতক। তোকে নিজের ছেলে হিসেবে মানতে কষ্ট হয়। তোর মতো মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক আমাকে মা বলে ডাকুক, তা আমি চাই না। তুই এখান থেকে চলে যা।’

কান্না করতে করতে আদিত্য বলল, ‘তোমাদের সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি মা। খুব বড় একটা ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছি আমি। আমি কোনো অন্যায় করিনি মা। তবুও তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমাকে মাফ করে দাও মা।’

- তোর কোনো কথা আমি বিশ্বাস করি না। তোর বিরুদ্ধে যা প্রমাণ আমি পেয়েছি, তাতে আমার একবারও মনে হয়নি কেউ ষড়যন্ত্র করছে তোর বিরুদ্ধে। তাই বলছি এইসব নাটক বন্ধ করে আমার সামনে থেকে সরে যা। আর কখনো আমার সামনে আসবি না তুই।

- প্লিজ মা আমার কথাটা একটু শোনো, আমি কারোর কোনো ক্ষতি করিনি।

হঠাৎ করে মিসেস রোকসানা আদিত্য’র গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো। আদিত্য গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। বিশ্বাস করতে পারছে না ওর মা ওর গায়ে হাত তুলেছে। টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে আদিত্য’র দুই চোখ বেয়ে। মিসেস রোকসানা চলে গেলেন আদিত্য'র সামনে থেকে। আদিত্য তাঁর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। মায়ের কাছ থেকে এরূপ মারাত্মক ব্যবহার আশা করেনি ও। নিজের মনে মনে বলল, ‘নিজের ছেলেকে একটুও বিশ্বাস করছ না মা। যে অন্যায় আমি করিনি, তাঁর সাজা পেতে হচ্ছে আমাকে। খুব জঘন্যতম একটা ষড়যন্ত্র চলছে আমার বিরুদ্ধে। আমি যে কারোর কোনো ক্ষতি করিনি তা আর কেউ না জানলেও আমি আর আল্লাহ জানেন। তিনি সবটা দেখছেন এবং জানেন। আমি জানি কোনো একদিন সত্যিটা সবাই জানতে পারবে। আমার উপর সবার খারাপ ধারণাগুলো পাল্টে যাবে সেদিন।’

চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়িতে চলে এলো আদিত্য।

রাত ১১ টা বাজে। ছাদে দাঁড়িয়ে আছে আদিত্য আর মাহিন । কারোর মুখে কোনো কথা নেই। আদিত্য চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে আজ কোনো তারা নেই। চাঁদ ও মেঘেদের কাছে বন্দী হয়ে আছে, তাই তো আজ চাঁদের দেখা নেই। ঘন কালো হয়ে আছে চারিদিকটা। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আদিত্য বলল, ‘এই বিশাল আকাশে আজ জ্যোৎস্নার আলো নেই। নেই কোনো তারা, কিংবা চাঁদ। আচ্ছা, এই বিশাল আকাশ ও কী অভিমান করেছে আমার উপর! তাই হয়তো প্রতিদিনের মতো আজ চাঁদ আর তারা দেখা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্নাময় সেই রাত আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না আজ। অনুভূতিগুলোও কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। উফফ, এত অসহায় লাগছে কেন!’

আচ্ছা, ‘আকাশের অভিমান তো ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু তোমার! তোমার অভিমানও কি ক্ষণিকের জন্য? নাকি চিরদিনের জন্য তুমি আমার উপর অভিমান করেছ। আকাশের অভিমান ভেঙে গেলে যেমন ঘন কালো মেঘলা হারিয়ে যাবে জ্যোৎস্নার আলোর আড়ালে। চাঁদ-তারাদের দেখা মিলবে। তেমনি তোমার অভিমানও কী ভেঙে যাবে? তোমার হৃদয়ে কি আমার জায়গা হবে? তোমার মায়াবী চোখদুটোর গভীরে যেতে পারব তো আমি! নাকি গভীরে যাওয়ার আগেই তোমার মায়াবী চোখের এক অদৃশ্য আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবো আমি।’

ছাদের ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল আদিত্য। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল ও। একদিকে নিজের ভালোবাসার মানুষটা, আরেকদিকে নিজের পরিবার, সবাই ওকে দূরে ঢেলে দিচ্ছে। সবাই ওকে ভুল বুঝছে। কেউ ওর কোনও কথা শুনতে চাইছে না। খুব কান্না করছে আদিত্য। মাহিন হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে আদিত্যকে ধরল। তারপর বসা থেকে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘মনে হচ্ছে এক্ষুণি বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে, নিচে চলে যেতে হবে এবার’

আদিত্য কোনো কথা বলছে না, অনবরত শুধু কেঁদেই চলেছে। মাহিন ওকে ধরে নিচে নিয়ে এলো।

বেশ কিছুক্ষণ পর আদিত্য স্বাভাবিক হলো। এখন আর কান্না করছে না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পিছন থেকে মাহিন আদিত্যকে বলল, ‘আদিত্য, এই বাড়ির মালিক চলে আসবে কালকে দুপুরের দিকে।’

- ‘ওহ।’

- আসলে, এই বাড়িটা আমার এক বন্ধুর। ও পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে গেছে। কালকে দুপুরের দিকে ফিরে আসবে ওরা। আমি ভেবেছিলাম তোর পরিবারের সবার রাগ কমে গেলে উনারা তোকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, তবুও তোর পরিবারের কারোর রাগ এখনো কমেনি। এদিকে আমার বন্ধুরাও চলে আসবে এই বাড়িতে। আমি নিজেই গ্রাম থেকে এসে উনাদের আশ্রয়ে থাকি। এখন তোকে কীভাবে রাখবো আমি বুঝতে পারছি না!"

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আদিত্য। তারপর পিছন ফিরে মৃদু হাসি দিয়ে বল, ‘অদ্ভুত নিয়তিঠিক আছে। কাল সকালে আমি চলে যাবো এখান থেকে।’

মাহিন কিছু বলল না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো মাহিন। আর আদিত্য সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে দিলো।

সকালে কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আদিত্য’র। বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে আসে। দরজা খুলার পর সামনের যুবক ছেলেটিকে দেখে ওর চোখ কপালে ওঠে যায়। ভ্রু-কুঞ্চিত অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে আদিত্য।

(চলবে...)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড