• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৩ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

অনিকে উৎসর্গীকৃত

ছোট গল্প : ব্যক্তিগত রুদ্র

  শ্রাবণী মজুমদার

২০ জুলাই ২০১৯, ১৪:৪১
ছবি
ছবি : প্রতীকী

অনি হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। না, তাকিয়ে সময় দেখছে না। জানে, সময় দেখে কোনো লাভ নেই। এমনিতেই এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে রুদ্রের দেওয়া সময়।

ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অনি’র মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা। বরাবরের মতো সেদিনও রুদ্র দেরি কোরে এলো। আজ ৪ বছর তাই আর খারাপ লাগে না অনি’র। অভ্যস্ত হয়ে গ্যাছে। এসেই পকেটে হাত দিয়ে এই ঘড়িটা বের কোরে অনি’র হাতটি নিজের হাতে নিয়ে পরিয়ে দিলো। ভাবখানা এমন এটাই ঘটার কথা ছিলো।

‘জানো গতকাল আমার পাঠিকা দেখা করলো আমার সাথে। মেয়েটির হাতে ঘড়িটা দেখে মনে হলো এই ঘড়িটা ওর হাতের জন্য নয় তোমার হাতের জন্য তৈরি। আমি তাকে খুলতে বললাম ঘড়িটি। যদিও সে একটু অবাকই হলো। কিন্তু খুলে আমার হাতে দিলো। আমি ঘড়িটা হাতে নিয়ে বললাম, আপনার হাতে মানায়নি ঘড়িটি। এটা যার হাতে মানাবে তাকে আমি দিয়ে দেবো। মেয়েটি আর একটিও কথা না বলে চলে গেলো।’

এই কথা বলতে বলতে সেদিন রুদ্র অনেক হেসেছিলো। অনির অনেক রাগ হয়েছিলো সেদিন রুদ্রের উপর কিন্তু এই হাসির উপর রাগ করা যায় না। তাই সেদিন বলেছিলো, ‘মেয়েটির ফোন নাম্বারটি দিও আমাকে, ঘড়ির দামটি দিয়ে দেবো।’

ঘড়িটি হাত থেকে খুলে পড়ে গেল। এই নিয়ে ১৫১ বার খুলে পড়লো। মাটি থেকে তুলে নিয়ে আবার পরলো অনি। রুদ্র আসবে কিনা তাও জানে না অনি। ফোন করলেই পারে। করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। যদি করার পর রুদ্র ফোন না ধরে বা ধরেই যদি বলে, ‘ঘুমাচ্ছি’ তখন আশা কোরে বসে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে যাবে। বরং অপেক্ষাটা ভালো লাগছে।

পাশেই বসা একজোড়া কপোতকপোতি গল্প করছে। ছেলেটি কিছু সময় পর পর মেয়েরির হাত ধরছে। মেয়েটি একটু লজ্জা পাচ্ছে। অনি’র মনে পড়ে না, রুদ্র সেদিন ছাড়া আর কোনদিন হাত ধরেছিলো কি না।

রোদের তাপ কমে এসেছে, অনি আজ একটু অস্থির হয়ে আছে ভেতরে ভেতরে কিন্তু বাহিরে তার বিন্দু পরিমাণ প্রকাশ নেই। - আপা ফুল নিবেন? নেন না? শাড়ীর সাথে ভালো লাগবো দেখতে। অনি মনে পড়লো রুদ্র মাত্র একবার ফুল কিনে দিয়েছিলো অথচ কবিতায় সে কতো রোম্যান্টিক। কবিতার ভেতরের প্রেমিকার জন্য তার সকল প্রেম। কবিতা পড়েই অনি রুদ্রের প্রেমে পড়েছিলো। ‘এতো রোমান্টিক হয় কেউ’— চিন্তা করেছিলো সেদিন যখন এক বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া রুদ্রের লেখা কবিতার বই পড়েছিলো সে। ফেসবুকে নাম সার্চ কোরে পেয়েও গিয়েছিলো সহজে। বন্ধু না হয়েও তার প্রোফাইল, কবিতা, মন্তব্য দেখতে লাগলো দিনের পর দিন। কমেন্টগুলো পড়ে মনে হতে থাকলো আহা, এই মানুষটির জন্যই বোধহয় তার জন্ম।

স্বল্পভাষী অনি নিজ থেকেই ইনবক্সে নক করেছিলো সেদিন রুদ্রকে। না, বেশী সময় নেয়নি রুদ্র। অল্প দিনেই কথা বলা শুরু করলো অনি’র সাথে৷ একসময় অনি বুঝতে পারে কী ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলে সে রুদ্রকে। কিন্তু বলতে পারে না সে কথা। এদিকে রুদ্র ইনবক্সের প্রায় পুরোটা সময়ই অনি’র সাথে কথা বোলে কাটালেও কখনো বলেনি ভালোবাসি।

অনি ভেতরে ভেতরে আশা কোরে থাকে রুদ্র তাকে বলুক, ‘হে মানবী আজ পর্যন্ত যতগুলো কবিতা আমি লিখেছি তা তোমাকেই চিন্তা কোরে।’ কিন্তু রুদ্র বলে না।

এই ভালোবাসি মুখে না বলা হলেও, বলা হয়ে যায় অনেক কিছু। কথা বলার ৩ মাস পর দ্যাখা হয় রুদ্রের সাথে। রুদ্রই দ্যাখা করতে চাইলো নিজ থেকে। প্রথম দিন থেকেই রুদ্র লেইট লতিফ। সেদিন অবাকই হয়েছিলো অনি। এখন হয় না। সেদিন রুদ্র, ওকে দুটো বেলীর মালা কিনে দিয়েছিলো। আজও আছে অনির কাছে পরম যত্নে।

আফা নেন না একটা মালা? অনি অতীত থেকে ফিরে আসে৷ পাশে বসা ছেলেটা মেয়েটার চুলে মালা পরিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার মুখে লাল আভা ফুটে উঠছে।

অনি, দু’টো ফুল কিনলো। ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে গিয়ে চিঠিখানা চোখে পড়লো। রুদ্রের লেখা প্রথম চিঠি। এর আগের বার দ্যাখা হবার সময় দিয়েছিলো। বাচ্চাটাকে টাকা দিয়ে চিঠিটা বের করলো সে। হাতে নিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকালো। সাদা সাদা এক ঝাক মেঘ নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ তার নিচে উড়ছে চিল আর কাক।

- বাহ, তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে। অনি একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো। হঠাৎই কানের ঠিক কাছে এমন শব্দ শুনে ভয় পেয়ে সে চিৎকার করে ওঠে। এই দেখে রুদ্র হেসে ওঠে উচ্চস্বরে। এক নিমিষেই অনি’র ভয় চলে যায়। সেখানে স্থান নেয় ভালো লাগা। রুদ্র পাশে বসে পড়ে৷ এমনভাবে গল্প করা শুরু করে যে, মনে হয় যেন সে এখন নয় অনেক ক্ষণ আগেই এসেছে।

- জানো, সময় হাতে একদমই কম কিন্তু তোমাকে না দেখে বাড়ী যাই কী কোরে বলো? শোনো, এটা তোমার জন্য। বোলেই ব্যাগ থেকে একটি ডায়রী বের কোরে দেয় রুদ্র। এতে এতদিন না বলতে পারা সকল কথা লেখা আছে। বলেই আবার সেই ভুবন ভুলানো হাসি।

যতটুকু সময় থাকলো বরাবরের মতো রুদ্রই কথা বললো। রুদ্রের বাস ৭টার সময়। এখন বাজে ৬টা। শাহবাগ থেকে গাবতলি যেতে সময় লাগবে তাই উঠে পড়লো দু’জনই৷ অনিকে রিক্সা ঠিক করে দিলো বকশীবাজারের। তারপর উল্টো পথে হাঁটা ধরলো। অনিও আর পেছন ফিরে তাকালো না। তখনো হাতে ধরে আছে রুদ্রের দেয়া চিঠি। এবার খুললো চিঠিটা৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকবার খোলা হয়েছে চিঠিখানি।

প্রিয়, কী নামে সম্বোধন করি বলোতো? এতদিনে তোমাকে একটি নাম দেওয়া উচিত ছিলো আমার কিন্তু তোমাকে দেওয়া যায় এমন কোনো নামই খুঁজে পেলাম না আমি৷ তোমাকে ছুঁতে পারে এমন কোনো নামই আমার জানা নেই এবং এই প্রথম আমি আবিষ্কার করলাম আমি তোমার জন্য কতোটা উপযুক্তহীন৷ কবিদের প্রেমে পড়তে হয়৷ সেই প্রেমে বিরহ তৈরি করতে হয়৷ প্রেমিকার জন্য নতুন নাম ঠিক করতে হয়৷ সেই নামে ভালোবাসা, বিরহের কবিতা লিখতে হয়৷

আমিও লিখেছি অনেক কবিতা অনেক প্রেমিকার জন্য৷ কিন্তু তোমার জন্য! আচ্ছা তুমি কি আমার প্রেমিকা! এতো দিন যাবার পর মনে হলো তুমি আমার প্রেমিকা নও৷ প্রেমিকারা কবিকে কষ্ট দেয়, দিতে হয়৷ কবিরা তাই বেছে বেছে এমন মেয়েদের প্রেমেই পড়ে৷ তোমার সাথে আমার পরিচয়ের পর প্রথম বরষায় তুমি একদিন বৃষ্টির ভেতর বসেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে কী আগ্রহই না নিয়ে। নীল রংয়ের সবুজ পাড়ের শাড়ী৷ কী মায়াবতী লাগছিলো তোমায়৷ সেদিন বুঝতে পারি আমি ভীষণভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি৷ কিন্তু তা কী কোরে সম্ভব! আমি তো কবিতাকে ভালোবাসি৷ কবিতা আর ভালোবাসার ভেতর একটিকে সারা জীবন সঙ্গে রাখতে হয়৷ কবিতা বড়ই হিংসুটে৷ সেদিনই বুঝেছি আরো ভালো কোরে৷ আমার কবিতা চলে গেলো আমার কাছ থেকে রাগ কোরে৷ আমি তোমায় ভালোবাসি মানবী৷ প্রতিদিন নতুন কোরে ভালোবাসি৷ তবে আমার ভালোবাসা তোমার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ৷ আমার মতো ছেলে তোমার যোগ্য নয়৷ আমার জন্য কবিতাই একমাত্র যোগ্য সাথী৷ বছরখানেক ধরে বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলছে৷ বিয়ে কোরলে নাকি আমি সংসারী হবো৷ এতো দিন ‘চাকরীর টাকায় নিজেরই চলে না’ বোলে কাটিয়ে যেতাম৷ এবার আর ‘না’ করিনি৷ বলেছি মেয়ে দেখতে৷ আমার পছন্দ করার প্রয়োজন নেই৷ তারা করলেই হবে৷ তারাও চিঠিতে জানিয়েছে মেয়ে পছন্দ হয়েছে৷ এই শুক্রবার বাড়ি যাচ্ছি আমি৷

জানি, অবাক হবে কিন্তু আমায় ঠিক বুঝতে পারবে৷ আমার মতো অগোছালো মানুষের জীবনে তুমি আসো সেটা আমি চাই না৷ তোমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মনের মানুষটি অপেক্ষা কোরে আছে৷

শুক্রবার তোমার সাথে একটু দ্যাখা কোরে যেতে চাই৷ নীল রংয়ের সবুজ পাড়ের শাড়ীটি পরে আসো সেটা চাই যদিও চিঠিটি হাতে পাবে সেদিনই।

তোমার ব্যক্তিগত রুদ্র

আকাশে সাদা মেঘের পরিবর্তে কালো মেঘ ভাসতে লাগলো। বৃষ্টি শুরু হবে একটু পর। অনির গাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে মনের মেঘের বৃষ্টি। ভাসিয়ে দিচ্ছে পরে থাকা নীল আকাশ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড