• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ (৩১তম পর্ব)

  রিফাত হোসেন

০৬ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:৪৬
গল্প
ছবি : প্রতীকী

এক সপ্তাহ পর..

আজ থেকে ঠিক সাতদিন আগে ইতি আর ফাহাদের বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল। আজকে গায়ে হলুদ। দু’বাড়িতেই আয়োজনে হুলস্থূল কাণ্ড। তবে সায়েমদের বাড়িতে মানুষজন বেশি থাকলেও ফাহাদের বাড়িতে তেমন মানুষজন নেই। পাড়া-মহল্লার কিছু লোকজন, আর কিছু ক্লোজ বন্ধুবান্ধব। ইতিকে হলুদ লাগানো হচ্ছে। কিছুটা দূরে সায়েম আর সারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখছে তাকে। ইতির পরনে সায়েমের পছন্দের আকাশী-নীল রঙের শাড়ি। কেউ কেউে এই শাড়ির প্রতিবাদ করেছিল অবশ্য, তবে ইতির সরাসরি জবাব, ‘বিয়েতে যা যা হবে, সব ভাইয়ার ইচ্ছেতে। ভাইয়া যা বলবে, সেটাই মানতে হবে সবাইকে।’

সায়েম বেশ খুশি হয়েছির ইতির কথা শুনে। বোনের কাছ থেকে পাওয়া এই ছোট্ট ছোট্ট উপহারই একজন ভাইয়ের কাছে পৃথিবীর সেরা সব উপহার এর থেকে বেস্ট। ইতিও বেশ আনন্দ পেয়েছিল সাহস করে এই কথা বলতে পেরে। আজ ও জীবনে এতকিছু পেয়েছে এবং পাচ্ছে, তার পিছনে সায়েমের অবদান যে অনেকটা। সেটা তো আর টাকা-পয়সা দিয়ে শোধ করা যাবে না। তাই ভাইকে একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা। তবে আনিস উদ্দিন নাক কুঁচকেছিলেন বেশ খানিকক্ষণ। ইতি বাবাকে তখন গুরুত্ব দেয়নি।

সারা হঠাৎ সায়েমের একটা হাত ধরল। সে চমকে ওঠে ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকাল। সারাকে দেখে শান্ত গলায় বলল, ‘ইতিকে বেশ অদ্ভুত দেখতে লাগছে আজ, তাই না? শাড়িতে বধূর সাজে সজ্জিত হয়েছে একেবারে। হাতে, কপালে, আর গালে হলুদ লাগানো। এর আগেও ওকে এই অবস্থায় দেখেছিলাম আমি। কিন্তু আজকের মতো ভালো লাগেনি সেদিন। সে দিনের ইতি আর আজকের ইতির মধ্যের পার্থক্যর পরিমাণ কম্পিউটারের হিসেবের বাইরে। সেদিন মুখটা ছিল ফ্যাকাসে। চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। হাত-পায়ে জোর ছিল না। মনে হচ্ছিল কেউ একটু বাতাস দিলেই পরে যাবে। অথচ আজ ঠিক তার উল্টো। আজ সারাক্ষণ ওর চোখেমুখে লেগে আছে আনন্দ। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি যেন গ্লু’র মতো লেগে আছে।’

সারা মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলে সায়েম নিজেই আবার সারার হাতটা মুঠোবন্দি করে নেয়। প্যান্ডেলের একপাশে হেলান দিয়ে, সারার হাতটা নিজের বুকের উপর রেখে বলল, ‘অনুভব করুন, আমার বুকের ভিতর কি হচ্ছে?’

সারা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘হাত দিয়ে কীভাবে অনুভব করব? অনুভব তো মন দিয়ে করতে হয়। আমি আমার মনের তীক্ষ্ণতা কীভাবে আপনার বুকের ভিতর নিয়ে যাবো? আর কীভাবে জানবো আপনার বুকের ভিতর চলছে টা কি?’

সায়েম চারিদিকে একবার চোখ বুলালো। এরপর সারার হাতটা ধরে আরো টান দিয়ে বলল, ‘এবার হয়েছে।’

সারা মুচকি হাসি দিয়ে সায়েমের বুকে মাথা রাখল। সায়েম সারাকে নিজের সাথে জাপটে ধরে বলল, ‘কিছু অনুভব করতে পারলেন?’

সারাও জড়িয়ে ধরল সায়েমকে। সায়েমের বুকে আলতো করে চুমু এঁকে দিয়ে বলল, ‘হুম।’

- কি?

- বলা বারণ আছে।

- তাই নাকি? তা কে বারণ করেছে শুনি?

সারা কিছু বলল না। - ভাতিজা আর ভাতিজী কি এখানে কাবাডি দেখছ? যে এভাবে জড়াজড়ি করে একে অপরকে ধরে রেখেছ।

হঠাৎ কোত্থেকে যেন বাড়িওয়ালা এসে কথাটা বলল। সায়েম আর সারা একে অপরকে ছেড়ে দিয়ে দু’জন দু’দিকে মুখ করে তাকালো। সারা জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, ‘হায় আল্লাহ! এই লোকটার কি খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই? যেখানেই যাই, সেখানেই হাজির হয়।’

সায়েম উল্টো দিকে ঘুরে মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বলল, ‘ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছেন তো আঙ্কেল? খাবার ভালো হয়েছে তো?’

লোকটার হাতে দাঁত খোঁচানোর একটা কাঠি। তিনি সেটা দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে বললেন, ‘দাওয়াত খেতে এসে ফ্রিতে লাইভ শো দেখার সুযোগ পাচ্ছি। খাবার যেমনই হোক, নিন্দে করা যাবে না।’

সায়েম মনে মনে বলল, ‘লুচ্চামি কম করেন মিয়া। আপনার নজর যে ভালো না সে আমি ভালো করেই জানি। নাহলে যখনই আমরা প্রেম করি, তখনই আপনার উদয় হতো না।’

মুখে বলল, ‘জি আঙ্কেল, অতিথিরা যাতে আনন্দ করতে পারে, তার সবরকম ব্যবস্থাই আমরা করেছি। আপনি এখনি আবার চলে যাবেন না যেন। সন্ধ্যার পর যাবেন। আরো অনুষ্ঠান বাকি আছে। ওই বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। তাদের সাথে আলাপ করবেন।’

লোকটা গম্ভীর-মুখে চলে যেতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে আবার পিছন ফিরে বলল, ‘কাবাডি খেলা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী। ভালো করে খেল। এই ক্লাস আমি অনেক বছর আগেই পাস করে এসেছি।’

সায়েম প্রতিউত্তরে কিছু বলার সুযোগ পেলো না। সারা ফিক করে হেসে দিলো। সায়েম রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘বজ্জাত টাক ওয়ালা, আপনি যেই পরীক্ষা দিয়ে এই ক্লাস পাস করেছিলেন, সেই পরিক্ষার খাতা আমিই দেখেছিলাম।’

রাফা মনমরা হয়ে বসে আছে নিজের ঘরে। ওর কয়েকজন ফ্রেন্ড-ও এসেছে ফাহাদের বিয়েতে। ওরা রাফাকে অনেক অনুরোধ করেছে নিচে যাওয়ার জন্য, কিন্তু রাফা যায়নি। গত সাত দিনে, এক মুহূর্তের জন্যও ও বাড়ির বাইরে পা রাখেনি। বারান্দা, নিজের ঘর আর ড্রয়িংরুম, এই করেই সাতটা দিন কেটেছে ওর। একদম ঘরোয়া হয়ে গেছে। সায়েমকেও ফোন দেয়নি। সারারাত, সারাদিন শুধু কেঁদেছে। মাঝ রাতের কান্নার পরিমাণ বেড়ে গেলে ওর শ্বাসকষ্ট হয়। প্রচণ্ড শীত থাকা সত্ত্বেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নিয়ে গোসল করে। ফাহাদ অনেক চেষ্টা করেও ওকে স্বাভাবিক করতে পারেনি। প্রায় সময়ই রাফা জ্বরে কাঁপতে থাকে। শ্বাসকষ্ট হয় ওর। ফাহাদ তখন ওকে আগলে রাখে। ওর যত্ন নেয়। কিন্তু যে মানুষটা নিজেই নিজেকে কষ্ট দিতে চায়, তাকে শুধুমাত্র সেবাযত্ন করে সুস্থ করা যায় না। তার মনের জোর, ইচ্ছেশক্তি খুবই প্রয়োজন হয়।

রাফা বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গেল। হাতে-মুখে পানি দিয়ে ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কি করব আমি? না পারছি কাউকে সহ্য করতে, আর না পারছি কাউকে মেনে নিতে। এমনভাবে সবকিছুর সাথে জড়িয়ে পড়েছি যে কোনোদিকেই যেতে পারছি না। একবার ইচ্ছে করছে সায়েমের কাছে ফিরে যাই। সায়েমকে ভালোবাসি। আবার সায়েমের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। আর ইতি আপুকেও সহ্য করতে পারছি না আমি। অথচ সে আমার শত্রু নয়। আমার বাইরের মানুষটা বলছে ইতি আপু আমার চিরশত্রু। তাকে শেষ করেই দিলেই সায়েম ভেঙে পড়বে। আর আমারও রাগটা কমবে। তখন যেভাবেই হোক সায়েমকে আমি নিজের করতে পারব। কিন্তু আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে ইতি আপুকে আমার ভাইয়া ভালোবাসে। তাদের বিয়ে হচ্ছে। ইতি আপুর কিছু হলে ভাইয়া কষ্ট পাবে। ভাইয়া তো নিঃস্বার্থভাবে আমাকে ভালোবেসেছে৷ আমাকে আগলে রেখেছে এতগুলো বছর ধরে। তাকে কষ্ট দেওয়ার তো কোনো অধিকার আমার নেই?’

রাফা মাথাটা চেপে ধরে বিছানায় এসে বসল আবার। এরপর বিড়বিড় করে বলল, ‘ওই বজ্জাত সারাকে আমি খুন করব৷ ও হুট করেই আমাদের মাঝে এসে পড়েছে। সায়েম আর সারা আপুর প্রেমের সম্পর্কে সবচেয়ে বড় সাপোর্টর ইতি আপু। সারা আপুই যদি না থাকে, তাহলে ইতি আপুও আর সায়েমকে সাপোর্ট করবে না এই সম্পর্কে। কারণ তখন তো এই প্রেমটাই থাকবে না। কিন্তু কীভাবে? সারা আপুকে আমি কীভাবে মারব? রোদের সাহায্য নিবো? উঁহু, সে উল্টো আমাকেই জ্ঞান দিবে। সে তো এখন ধোয়া তুলসীপাতার মতো হয়ে গেছে। নাহলে আমাকে ফোন করে বলতো না, ‘আমি আর এই শত্রুতা মনে রেখে ঝামেলা করতে চাই না। তুমিও এইসব বন্ধ কর এবার। বোকা ছেলে একটা। একবার হেরেছে বলে কি বারবার হারবে নাকি? বেচারা রোদ, সায়েমের লাথি খেয়ে একেবারেই শুদ্ধ হয়ে গেছে।’

রাফা ভাবনা থামালো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফাহাদ বলল, ‘এখানে বসে না থেকে আমার সাথে চল। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে এবার।’

রাফা ঘুরে তাকালো দরজার দিকে। ফাহাদকে দেখে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে দিয়ে বলল, ‘তোমাকেই এই পাঞ্জাবিতে বুড়ো বুড়ো লাগছে ভাইয়া? ইতি আপু তো দৌড়ে পালাবে।’

ফাহাদ ঘরে এলো। হেসে দিয়ে বলল, ‘বুড়ো বুড়ো লাগলে লাগবে। ইতি এই বুড়োকেই বিয়ে করবে।’

রাফা ঠোঁট বাঁকা করে উত্তর দিলো, ‘সে দেখা যাবে।’

- আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন আমার সাথে চল তো নিচে।

- তুমি যাও। আমি যাবো না।

- আরে বোন আজকে অন্তত এইরকম করিস না। আমার এই অনুরোধ রাখ প্লিজ।

রাফা চুপ থেকে দুই মিনিট ভাবল। এরপর রাজি হয়ে গেল হঠাৎ করে।

সন্ধ্যার ফাহাদের বাড়ির লোকজন ইতির বাড়িতে এলো। সাথে রাফাও। রাফা এসেই সায়েমকে খুঁজতে লাগল। সায়েমের বাড়িটা দু’তলা। বেশ অনেকটা জায়গা আর অনেকটা বড়োসড়ো বাড়ি ওদের। রাফা পুরো বাড়ি এখনো ঘুরে দেখেনি। সবাই যখন ইতির সাথে কুশল বিনিময় করছিল, সেই সুযোগে রাফা সায়েমকে খুঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক তলা পেরিয়ে দু’তলায় উঠতেই সে সব তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। এত মানুষজনের ভীরে সায়েমকে খোঁজা টাফ হয়ে পড়ল ওর দ্বারা। বাড়িতে গেস্ট এসেছে। সায়েমের উচিত বড় ভাই হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করা। অথচ ওর পরিবর্তে, ওর খালাতো ভাই এইসব দেখাশোনা করছে৷ দু’তলার কয়েকটা ঘর পেরোতেই বেশ কয়েকজনের হাসাহাসির শব্দ শুনতে পেলো রাফা। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সেদিকে। দরজা খানিকটা খোলাই ছিল। রাফা ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভিতরে তাকাতেই দেখল সায়েমকে৷ পাশে বসে আছে সারা। আরো তিনটা মেয়ে। এই তিনটা মেয়েকে রাফা চিনে। এরা সায়েমের কাজিন। রাফা দরজায় টোকা দিলো। ভিতর থেকে সায়েম বলে উঠল, ‘কে?’

রাফা কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল, ‘রাফা।’

ভিতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। সবাই কেমন যেন হুট করে স্তব্ধ হয়ে গেল। রাফা বুঝতে পারল ভিতরের সবাই বিরক্ত হলো। আর সায়েম হয়তো বিব্রত হলো। সেজন্যই ও চুপ করে আছে। নাহলে ওর বিরক্ত হওয়া মানেই রাগারাগি করা। অন্যদের মতো চুপ করে থাকা নয়। হঠাৎ দরজা পুরোটা খুলে গেল। রাফা সামনে তাকাতেই দেখল সারা দাঁড়িয়ে আছে। সারা রাফার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, ‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো ভিতরে।’

রাফা একটু খুঁচিয়ে দেওয়ার মতো করে বলল, ‘খুব অবাক লাগে যখন দেখি কোনো ভদ্র মেয়ে অন্যের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে৷ অন্যের অধিকারে ভাগ বসাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এটা ভদ্রতার আড়ালের নিচু স্তরের মানুষের মুখোশ। আজ যেখানে তুমি ভিতরে আসতে হলে আমার অনুমতি নিতে হতো , সেখানে আমাকে তোমার অনুমতি নিতে হচ্ছে ভিতরে আসার জন্য। ইউ আর গ্রেট ওমেন।’

সারা মাথা নিচু করে দরজার সামনে থেকে সরে গেল। ভিতর থেকে সায়েম কড়া গলায় বলল, ‘বাজে কথা বাদ দিয়ে সরাসরি বল এখানে তোমার কি কাজ?’

- তোমার সাথেই দেখা করতে এসেছি।

- ভিতরে উঁকি দিয়ে একবার দেখে গেট আউট হয়ে যাও। আর সারা, আপনি এতটা চেঞ্জ কীভাবে হয়ে যেতে পারলেন? আমি আপনাকে এভাবে দেখতে চাই না। আপনার সেই প্রতিবাদী জেদ, সেই রাগী রাগী ভাব, সেই কড়া কণ্ঠস্বর আমি ভীষণ মিস করি। আমি আপনাকে সেভাবেই দেখে অভ্যস্ত।

সারা কিছুটা মাথা তুলে তাকালো। আড়চোখে সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মানুষের চাওয়া-পাওয়া যখন অনিশ্চিত হয়ে যায়, তখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও কিছু অভ্যাস বিসর্জন দিতে হয়। অনেক সময় আবার অটোমেটিক সেগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়।’

সায়েম কিছু বলার আগেই ভিতর থেকে ওর এক কাজিন রাফাকে উদ্দেশ্য করে বলল - " আরে ভাবীজান, বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে ভিতরে এসো তো। এসো জমিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা মারি।"

রাফা ভিতরে চলে এলো। সায়েম মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কে কার ভাবী? হুহ! তোদের তো কিছুক্ষণ আগেও বললাম এই বিয়েটা একটা ভুল বুঝাবুঝি। ছেলেমানুষিও ভাবতে পারিস৷ কিছুদিনের মধ্যে জীবনের এই ছোট্ট পথের সমাপ্তি হবে।’

- আহা, যতদিন ডিভোর্স না হয়, ততদিন তো ও-ই আমাদের ভাবী, তাই না? ডিভোর্স হয়ে গেলে তো অন্য কথা। সো ডেয়ার আজাইরা বাসী, আমার পরবর্তী প্ল্যান কি?

রাফা হুট করে প্রতিবাদের স্বরে, ‘আজাইরাবাসী মানে? এটা আবার কি’

- শোন, যখন একদল লোক শয়তানি প্ল্যান করার জন্য, নিজেদের মাথাগুলো একত্র করে, তখন নিঃসন্দেহে ধরে নেবে এদের কোনো কাজ নেই। এরা সবাই আজাইরা সেই সময়টা। দেখছ না, বাড়িতে এত কাজ থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোনো কাজ নেই। সুতরাং কোনোরকম গবেষণা ছাড়াই আমি ১০০% গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, উই আর আজাইরা বাসী।

রাফা শব্দ করে হেসে উঠল। সায়েম বিরক্তির চোখে তাকালো রাফার দিকে। রাফা সায়েমের শরীর ঘেঁষে বসে বলল, ‘আমার বরটা কি খুব বিরক্ত হচ্ছে? নাকি আমার উপর রেগে আছে বলে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?’

সায়েম কড়া গলায় বলল, ‘নাটক বন্ধ করে এখান থেকে যাও রাফা। তুমি ফাহাদের বোন, মানে পাত্র পক্ষের লোক। সুতরাং পাত্রী পক্ষের লোকজনদের প্ল্যান তোমাকে জানানো যাবে না।’

- আমি তো পাত্রী পক্ষের-ও একজন, তাই না? ইনফ্যাক্ট বর্তমানে এই বাড়ির সবকিছুতেই আমার ভূমিকা বেশি থাকার কথা। ওটা আমার বাপের বাড়ি। আর এটা স্বামীর বাড়ি। বিয়ের পর সব মেয়েরা স্বামীর বাড়ির প্রোপার্টি হয়ে যায়৷ সুতরাং এই বাড়ির সবকিছুতে থাকাটা ধরে নাও আমার ফুল টাইম জব। আর নিজের বাবা-মায়ের বাড়ির সবকিছুতে থাকা আমার জন্য জাস্ট পার্ট টাইম জব।

সায়েম বিছানা থেকে নামতে নামতে বল, ‘তাহলে তুমি থাক ফুল টাইম জব নিয়ে। আমিই চলে যাচ্ছি।’

সায়েম ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছন থেকে সারা ডাক দিতে গিয়েও থেমে গেল। সায়েমের যাওয়ার পর একে একে সবাই চলে গেল। ঘরে শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে রইল রাফা আর সারা৷ রাফা সারাকে একা পেয়ে বলল, ‘তা কতদূর এগোলো?’

সারা বুঝতে না পেরে বলল, ‘মানে?’

- এই যে তোমাদের কাঁঠালের আঠার মতো প্রেম। একবার যে এমন ভাবে লেগেছে, আর ছুটতেই চাইছে না।

সারা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘তাহলেই বুঝে নাও আমাদের ভালোবাসা কতটা গাঢ়। কতটা গভীর সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি আমর। আমাদের এই বন্ধন ছুটবার নয় রাফা।’

- কাঁঠালের আঠা যতই জোড়ালো হোক না কেন? একে ছাড়ানোর জন্য-ও কিছু একটার অস্তিত্ব আছে সারা আপু। ওই যে বলে না, ভাইরাস যতই ভয়ঙ্কর হোক, একে ধ্বংস করার জন্য এন্ট্রি ভাইরাস সর্বক্ষণ প্রস্তুত।

সারা বিড়বিড় করে বলল, ‘স্টুপিড একটা। পুরাই সাইকো মেয়ে।’

সারাকে বিড়বিড় করতে দেখে রাফা বলল, ‘তুমি কি কোনো কু-মন্ত্র পড়ছ?’

- মানে?

- এই যে বিড়বিড় করছ।

সারা মুচকি হেসে দিয়ে বলল, ‘আমি কু-মন্ত্র জানি না। বাট তোমাকে শায়েস্তা করার সবরকম মন্ত্র আমি জানি। তোমার প্রতি আমার যে ভালোলাগা ছিল, সেটা কমতে কমতে আজ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে, তোমার এই মুগ্ধতার আড়ালে কুৎসিত মুখটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। আর সেটা দেখে আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। মানুষের মনের সাথে রূপের পার্থক্য যে কতটা দীর্ঘ, তোমাকে না দেখলে আমি বুঝতেই পারতাম না এই এক জীবনে। তোমাকে দেখতে ঠিক যতটা আকর্ষণীয়, তোমার মনটা ঠিক ততটাই নৃশংস। নাহলে এইটুকু বয়সে এত অঘটন ঘটাতে না। এত খারাপ পথ বেছে নিতে না। এটা ঠিক যে, ভালোবাসার জন্য লড়াই করতে হয়, বাট সেই লড়াইটা সৎ পথে থেকে করতে হয়। লড়াইয়ে তুমি জিততে না পেরে হয়তো কোনো একদিন হাল ছেড়ে দিবে। বাট কথায় আছে না, সৃষ্টির ইচ্ছে যেখানে শেষ, স্রষ্টার ইচ্ছে সেখানেই শুরু। তোমার এই সৎ লড়াইয়ের জন্যই হয়তো তুমি ভালোবাসার জিনিসটা ফিরে পেতে কোনো একদিন। বাট নিজেই ভুল করে অসৎপথ বেছে নিলে।’

রাফা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘কখনো হেরে গিয়েও জেতার আনন্দ উপভোগ করেছ মিস সারা?’

সারা কৌতূহলী হয়ে তাকালো রাফার দিকে। রাফা আবার বলল, ‘আমিও কখনো এই সুখ উপভোগ করিনি, তবে খুব শীঘ্রই সেইদিন আসছে, যেদিন আমি হেরে গিয়েও জেতার আনন্দ উপভোগ করব।’

রাফার বলা এই কথাটার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেলো না সারা। আর রাফাও সেভাবে কোনো উত্তর দিলো না। চলে গেল হুট করেই। সারা আরো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ড্রয়িংরুমে চলে এলো। সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই ইতির বাড়ির লোকজন ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। তখন হঠাৎ রাফা বলে উঠল, ‘কালকে তো সেই আবার আসতে হবে। তাই আমি আর ওই বাড়িতে যাচ্ছি না আজ। আজকে এখানে থাকবো, কালকে একেবারে বউ নিয়ে ফিরব।’

সবাই রাজী হয়ে রাফাকে রেখেই বাড়িতে চলে যায়। এদিকে রাফার এখানে থাকার ব্যপারটি নিয়ে ইতির মনে একটা ভয় ঢুকে যায়। মনে পড়ে যায় এক সপ্তাহ আগে রাফা থ্রেট দিয়েছিল। কি যেন একটা ধামাকা দেখাবে বলেছিল। ইতি কোনো একটা বিপদের পূর্বাভাস পাচ্ছে। প্রতি মুহূর্ত ওর ভয়ে ভয়ে কাটছে৷ বারবার মনে হচ্ছে, এই বুঝি রাফা কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলল।

পরেরদিন শেষ দুপুরের। সবাই অপেক্ষা করছে বর আসার।

(চলবে...)

আরো পড়ুন ৩০তম পর্ব- ধারাবাহিক উপন্যাস : মেঘ বর্ষণ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড