• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৪০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ছোটগল্প : ওলটপালট

  মাহবুব নাহিদ

১৭ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:১৩
গল্প
ছবি : প্রতীকী

অনেকদিন পর শাওন সাহেব ছুটি পেলেন। এবার একদম পাক্কা এক সপ্তাহ ছুটি। এই শুক্রবার থেকে একদম পরের শনিবার পর্যন্ত। মেয়েটা এবার ক্লাস ফাইভের পরীক্ষা দিলো। পরীক্ষার সময় বাসায় যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন তিনি কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি। যাই হোক এখন পরীক্ষা শেষ। এখন তিনি চাইলেই মেয়েকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারবেন এদিক সেদিক। একবার ভেবেছিলেন বাসায় জানাবেন না কিন্তু এই বিষয়গুলো না জানালেও মনের মধ্যে খুতখুত করে। তাই জানিয়েই দিলেন সে, তার স্ত্রীকে ফোন করে বলার সাথে সাথে তার মেয়েটা শুনে গেছে। সে শুনেই নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটা তখন কথা বলতে চায় কিন্তু শাওন সাহেব ওই সময় স্টেশনে ঢুকছিলেন। তিনি বললেন যে ট্রেনে পৌঁছে কল দিবেন। ওইদিন বৃহস্পতিবার হওয়ায় স্টেশনে অনেক ভীর। মানুষ সবাই যে যার গন্তব্যে যাচ্ছে। সামনে তিনদিন বন্ধ হওয়ায় অনেকেই বাড়িতে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা মুখে হাসির প্রলেপ। প্রিয়জনের কাছে ছুটে যাওয়ার যে সীমাহীন আনন্দ তা প্রকাশ করার কোনো ভাষা নেই। প্রত্যেকটা মুখ, প্রত্যেকটা চোখ বলে দিচ্ছে সেই অসীম আনন্দ, সুখানুভূতির গল্প। এ এক দারুণ জীবনাবেগ, দারুণ এক জৈবিক শান্তি।

শাওন সাহেবও তাদের দলে। এখানে কেউ ধনী, কেউ গরীব। একেকজন একেক জায়গা থেকে এসেছে, একেক জায়গায় যাবে। কিন্তু প্রত্যেকের মনের চাহিদাই এক! প্রিয়জনের মুখের হাসিটা একবারের জন্য দেখা!

অনেক কষ্টে তিনি পৌঁছালেন ট্রেন পর্যন্ত। পৌঁছে ফোন করলেন বাসায়। এবার তার মেয়েই ধরলেন। মেয়ের কন্ঠে প্রথম কথা, ‘আব্বু তুমি আসতেছো?’ - হ্যাঁ মা, আমি আসতেছি। - আব্বু তুমি কিছু ভুলে যাওনি তো! - কি ভুলে যাবো মা? - নাহ তুমি ভুলে গেছো! - ভুলে যাইনি তো আম্মু। - হুম তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে যে এবার আসলে আমার জন্য বড় একটা পুতুল আনবে যেটা আমি ধরে ঘুমাবো। এনেছো তো! - হ্যাঁ মা, এনেছি! এখন রাখি। সকালে দেখা হবে। - আচ্ছা আব্বু বাই বাই! শাওন সাহেব একদম আকাশ থেকে পড়লো। নিজের উপর নিজের এমন ঘৃণা হচ্ছে তার তা বলার কোনো ভাষা নেই। এমন একটা জিনিস ভুল করার কোনো কথাই ছিলো না তার। তার জীবনের অনেকটা জুড়েই তো তার মেয়ে। আর সেই মেয়ের একটা আবদার তার মনে নেই! এটা মোটেও ঠিক হয়নি তার। তার উপর মেয়েকে বলেছেন যে পুতুল কিনেছেন। এখন যে ভাবেই হোক তাকে পুতুল একটা জোগাড় করতে হবে। কারণ সকালে গিয়ে দোকান খোলা পাওয়া যাবে না, আবার কাল শুক্রবার! তিনি কোনো চিন্তা না করে দিলেন দৌঁড়। স্টেশনের বাহিরে এসে একটি দোকান খুঁজে পেলেন অনেক কষ্টে। পুতুল তিনি কিনেও ফেললেন। কিন্তু এই পর্যন্ত যতটা স্ফজ ছিল তার চেয়েও কঠিন এর পরের ধাপ। এবার তার স্টেশনের ভিতরে যেতেই খবর হয়ে গেল। ওদিকে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। সে মানুষের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে তার ট্রেন ছেড়ে দেয়াও ঘোষণা হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে ট্রেনের কাছে পৌঁছে দেখল ট্রেন তখন ছেড়ে যাচ্ছে। দৌঁড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠলো সে। ট্রেনে উঠে আবার আরেক বিপদ। মানুষ একদম কিলকিল করছে। সিট পর্যন্ত যাওয়াও মুশকিল এখন। একা মানুষ যাওয়াই কঠিন তার উপর আবার সাথে একটা পুতুল। অনেক মানুষ তার উপর বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু কিছুই তো আর করার নেই। তার তো যেতেই হবে।

সিট পর্যন্ত পৌঁছাতে একদম যুদ্ধ করতে হলো তার। অবশেষে সিটে গিয়ে বসলো সে। কিন্তু পুতুল রাখার তো কোনো জায়গা নেই। সেটা কি করবে! কোনো জায়গা না থাকলে কি হয়েছে! সে তো আছে! মেয়ে যেহেতু জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে বলেছে, সেও সারারাত জড়িয়ে ধরেই ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো।

শাওন সবসময় ট্রেনে যাতায়াত করে। ট্রেনে যাত্রা তার কাছে ভালোই লাগে। বাসের মতো দাঁড়িয়ে থাকা লাগে না জ্যামে। আর ভ্রমণক্লান্তিও অনেক কম তুলনামূলক ভাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ট্রেনে দুর্ঘটনা কম হয় বাসের চেয়ে। এটা একটা বড় কারণ। বাসে উঠলেই তো বাস দুর্ঘটনা হয়। প্রতিদিন খবরে কোনো না কোনো বাসের দুর্ঘটনা থাকেই!

শাওন ট্রেনে যাওয়ার সময় ঘুরে ঘুরে সবার কর্মকাণ্ড দেখে। এটা তার একটা সখ। কিন্তু আজ তো এসব করার সুযোগ নেই। আজ তাকে জায়গায় বসেই থাকতে হবে শুধু। বসে বসেই সে আশেপাশে মানুষজনের কর্মকাণ্ড দেখছে। সকলের মধ্যেই উচ্ছ্বাস। পাশে অবশ্য একটা ছেলে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়ায় মত্ত্ব হয়ে আছে। সবাই আবার তাদের ঝগড়াকে উপভোগ করছে। ছেলেটার কানে হেডফোন থাকায় সে বুঝতেই পারছে না যে তার কথা সবাই শুনছে। শাওন ছেলেটাকে ইশারা দিলো। ছেলেটা হেডফোন খুলে শাওনকে বলল, ‘জ্বি বলুন।’ - যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি? - জ্বি বলুন। - আপনার কথাগুলো সবাই শুনছে। আপনার হেডফোন থাকায় আপনি বুঝতে পারছেন না। - ওহ আচ্ছা। ধন্যবাদ ভাইয়া। আমার মানসম্মান তো সব গেছে। আপনি আমাকে বাঁচালেন। আবারো ধন্যবাদ। - আচ্ছা। কিন্তু এভাবে চিল্লাপাল্লা করছেন কেন? কি হয় আপনার? - আমার গার্লফ্রেন্ড। ভার্সিটি থেকে বাড়িতে যাচ্ছি, এখন কি একটা সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া লাগাচ্ছে। - আপনার গার্লফ্রেন্ড কি একই সাথে পড়ে? - হ্যাঁ ভাইয়া। - তাহলে তো ঝগড়া তো লাগাবেই। - বুঝলাম না ভাইয়া, কি বলছেন এসব! - মেয়েদের মন তো, দুরে যাচ্ছেন তাই মানতে পারছে না। ওরা সরাসরি কিছু বলতে পারে না। অভিমান করেছে। একটু সুন্দর করে বলেন যে, মাত্র কয়দিনের জন্য যাচ্ছি। আবার তো তোমার কাছে ফিরে আসছি। দেখবেন ঠিক হয়ে যাবে। আর দুইজন রাগ করলে পরে সংসার করতে পারবেন না। একজন ঠান্ডা থাকতে হয় ধৈর্য্যশীলরা পুরষ্কৃত হয়।

শাওনের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ছেলেটার ঝগড়া থেমে গেলো। ছেলেটা তো বড্ড খুশি। সে ফোন রেখেই শাওনকে আবারো ধন্যবাদ জানাতে শুরু করলো। গল্প জুড়ে দিলো দুজন। গল্প করতে করত্র কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো তারা তা কেউ জানে না।

শাওন পুতুলটা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিলো। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ টের পেলো সবাই। শুধু শব্দটুকুই শুনলো শাওন ও অন্য সবাই। তাদের ট্রেনের উপর উঠে গেছে আরেকটা ট্রেন। ভয়ংকর দুর্ঘটনা হয়ে গেছে৷ তাদের ট্রেনটা একদম দুমড়েমুচড়ে গেছে। কত শত আনন্দ বুকে নিয়ে স্বজনদের কাছে যাচ্ছিলো সবাই। কিন্তু চলে যেতে হলো ওপারে, প্রায় সবাইকেই। মুহূর্তের মধ্যে একটা মৃত্যুপুরী হয়ে গেল জায়গাটা। যেন কোথাও কোনো প্রাণ নেই, কোথাও কোনো জীব নেই। একদম মস্ত একটা শ্মশ্মানে পরিণত হয় রেললাইন। চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়লো। পুলিশ আসলো, ফায়ার সার্ভিস আসলো। কিন্তু কি করবে তারা? লাশ সরানো ছাড়া কোনো কাজই নেই বাকি! স্বজনরাও সবাই টের পেয়ে গেলো। লাশগুলো চেনার জন্য কারো শরীর থেকে কিছুই সরানো হয়নি। শাওনের পাশে যে ছেলেটা ছিলো ওর গার্লফ্রেন্ড এসেছে, বাবা-মা এখনো এসে পৌঁছাতে পারেনি। তবে সে তার প্রিয় মানুষটিকে চিনতে ভুল করেনি। কারণ শরীরে ঝুলছে তারই দেয়া হেডফোন।

এসেছে শাওনের স্ত্রী আর মেয়েটাও। মেয়েটা এসেই দুর থেকে দেখতে পেল তার বাবাকে। বাবাকে নয়। প্রথমে দেখলো পুতুলটা। তার বাবা পুতুলটা জড়িয়ে ধরে আছে। বাবার কাছ থেকে পুতুলটা ছিনিয়ে নিয়ে ফেলে দিলো দুরে। নিজেই চলে গেলো বাবার কোলে। বাবার দেয়ার পুতুলটা হয়তো কখনো জড়িয়ে ধরে ঘুমানো হবে মেয়েটার। কিন্তু বাবা যদি পুতুলটা আনতে গিয়ে ট্রেন মিস করতো তবে কি তার বাবা বেঁচে যেতো?

পুনশ্চ : গল্পটি কাল্পনিক। উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা এক্সপ্রেসের সংঘর্ষে নিহত সকলের মাগফেরাত কামনা করছি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড