• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধারাবাহিক গল্প : এক পলকের একটু দেখায় (৬ষ্ঠ পর্ব)

  সাবিকুন নাহার নিপা

১৫ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৪৪
গল্প
ছবি : প্রতীকী

শেষ বিকেলে শহর থেকে একটু দূরে ঘুরতে গেল প্রমা আর তাওসিফ। প্রকৃতিতে এখন হেমন্তের ছোঁয়া বহমান। ঠাণ্ডা বাতাস যেটা বইছে সেটা একদম গায়ে লেগে যাচ্ছে। দু’জনের কেউই শীতের পোশাক আনেনি। প্রমাকে হাতের তালু ঘষতে দেখে তাওসিফ জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কি শীত করছে?’ প্রমা মৃদু হেসে না বলল। - তুমি সামনে আসলে এত চুপচাপ কেনো হয়ে যাও? - আসলে কি বলবো খুঁজে পাই না। তাওসিফ হাসলো। বলল, ‘বেশ তো। নিজের কথা বলো।’ - আমার তেমন কোনো কথা নেই। - তোমার বয়ফ্রেন্ডের কথা বলো? প্রমা শব্দ করে হেসে ফেলল। প্রমাকে হাসতে দেখে তাওসিফ জিজ্ঞেস করল, ‘হাসছো যে?’ হাসি থামিয়ে প্রমা বলল, স্যরি ইয়ার। আসলে তুমি নিজেকে বাঙালি ছেলেদের মতো ভাবো না। কিন্তু তোমার ওই প্রশ্নটা কেমন যেন টিপিক্যাল বাঙালি ছেলেদের মতো হয়ে গেলো না! তাওসিফের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। অল্পতেই রেগে যাওয়া তাওসিফের ছোটবেলা থেকেই স্বভাব। ইদানীং রাগটাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তাওসিফ আগের মতো স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?’ - না। - ওহ। - তোমার কি ছিলো নাকি? তাওসিফ কিছু না বলে চুপচাপ হাটতে লাগলো। প্রমাও আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব থাকলো। তাওসিফ প্রমাকে বলল, - আমার ব্যাপারে তুমি কখনো কিছু জানতে চাও নি কেন? - তুমি নিজে থেকে বলোনি তাই। - হ্যাঁ সেটা ঠিক যে আমার কখনো নিজের কথা বলতে ভালো লাগেনি। - ঠিক আছে ভালো না লাগলে বলবে না। তাওসিফ আবারও চুপ হয়ে যায়। - প্রমা! - হু। - আমাকে তোমার কেমন ছেলে মনে হয়? প্রমা একটু হাসে। তারপর বলে, - ভীষণ ট্যালেন্টেড আর ইন্টিলিজেন্ট। তাওসিফ এক পলক প্রমাকে দেখে আবারও সামনের দিকে তাকায়। উদাস গলায় বলে, - কখনো খারাপ মনে হয় না? যখন যেচে তোমাকে ম্যাসেঞ্জারে নক করতাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমার সাথে কথা বলতাম তখনও কি তোমার খারাপ লাগে নি? প্রমার বুক কাঁপে মিথ্যে বলতে। আমতা আমতা করে বলল, - না মানে প্রথমে ভেবেছিলাম যে..... প্রমাকে শেষ করতে না দিয়েই তাওসিফ বলল, - প্রথমে ভেবেছিলে আমি খারাপ ছেলে। মেয়ে দেখে তোমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলি? প্রমা উত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। তাওসিফ আবারও বলে, - তোমার সাথে যখন আমার আলাপ হয় তখন আমি একা ছিলাম। ভীষণ একা। রোজ রাতে কাঁদতাম কারণ কথা বলার মতো কেউ ছিলো না তাই। প্রমা ব্যথিত চোখে তাকিয়ে দেখে তাওসিফকে। কেন ওর এতো খারাপ লাগছে! -আমি আমার বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তান যেমন বাবা মায়ের অতি আদরের থাকে তেমন ই থাকে এক্সপেরিমেন্টের। আমিও তেমন ছিলাম। আমার জন্মের পর আমার বাবা ঠিক করলেন আমাকে উচ্চশিক্ষিত করবেন। এইজন্য সাত বছর বয়সে আমাকে শহর থেকে দূরে হোস্টেলে রেখে পড়াতে শুরু করলেন। আমি তখনও মাকে ছাড়া খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা। আমাকে তখন থেকে নিজের মতো করে বেঁচে থাকতে শিখতে হয়েছে। অসুখ হলে নিজের খেয়াল নিজেকে রাখতে হয়েছে। প্রতি শুক্রবার বাবা মা দুই ঘণ্টার জন্য আসতেন। আর আমি ছুটি পেতাম দুই ঈদে।

আমার রুটিন এরকম ছিলো যে আমি ঘুমানোর সময় ও পেতাম না। এরপর একদিন সাহস করে একটা কাজ করে ফেললাম। - কি? - আমি পালিয়ে বাড়ি চলে আসলাম। - তারপর? - বাবা খুব মারলেন। মা একটু নরম হলো। আমাকে যেতে দিলেন না। - ওইটুকু বয়সে পালিয়ে এসেছ?? - না। ১১ বছর বয়সে এসেছি। আর না পেরে পালিয়েছিলাম। - তারপর? - আমাদের বাড়িতে আমার খালাতো ভাই সৈকত থাকতো। ও আর আমি একই বয়সী ছিলাম। ওকে কেউ শাসন করতো না। ও নিজের মতো থাকতো। পড়াশোনা, ছবি আঁকা, গান সবকিছু চালিয়ে যেত। আমার ভীষণ ইচ্ছে করতো সৈকতের মতো হতে। মাঝেমধ্যে আফসোস করতাম কেন যে বাবা মায়ের ছেলে হলাম! - তারপর কি হয়েছিল? - আবারও বাড়ি ছেড়ে ঢাকা কলেজে এসে ভর্তি হলাম। সেখানে একটা মেয়ের সাথে প্রেম হয়ে গেল৷ বাবা তখনও ফোন হাতে দেয়নি। আমরা চিঠি আদান প্রদান করে প্রেম চালিয়ে নিতাম। বাবা মা সপ্তাহে একদিন আসতেন। একদিন এসে আমার ব্যাগ খুঁজে বাবা চিঠিগুলো পেয়ে গেলেন। তাওসিফ এইটুকু বলে চুপ করে থাকে। প্রমার খুব ইচ্ছে করলো পুরো টা শুনতে। প্রমা জিজ্ঞেস করে এরপর কি হয়েছিল, - মেয়েটা স্কুলে পড়তো। হলিক্রসে, ওর বাবাও ছিলেন সেখানকার আরবি টিচার। চিঠি পাওয়ার পর বাবার সাথে সাথে মা ও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মায়ের চোখে স্পষ্ট ঘৃণা। ছেলে পড়াশোনা না করে এসব করছে এর থেকে মরে যাওয়া ভালো। এরকম ভেবেছে মা। এরপর প্রচণ্ড মার খেলাম। সেখান থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো৷ মেয়েটার নাম ছিলো আশা। আশার সাথে কি হয়েছিল জানিনা তবে বাবা ফিরে এসে আমাকে বলেছিল, - স্কুল কলেজে পড়তে গেলে ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রির সাথে ওরকম ভুত মাথায় চেপে বসে। আর সেই ভুত ছাড়ানোর উপায় ও আমি জানি। তাতেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে বাবা আশার সাথে কি করেছে।

এরপর আমি বাবা মাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালাম যে, আমি তাদের কথা শুনবো, মন দিয়ে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট ও করবো কিন্তু আমার শর্ত তাদের মানতে হবে। - শর্ত কি ছিলো? - শর্ত ছিলো আমার বিয়ে আর ক্যারিয়ার এই দুটো ব্যাপারে তারা তাদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিতে পারবে না। তারা কথা দিয়েছিল কিন্তু সেকথা রাখেনি। গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর বাবা ব্যবসা করার জন্য চাপ দিতে লাগলেন। আমি রাজি হলাম না। আমি চেয়েছিলাম মিডিয়ায় কাজ করবো। বাবা রাজি হলেন না। দীর্ঘদিন একা একা রইলাম। বাবা আমার সব বন্ধুদের কাছে আমার ব্যাপারে উল্টা পাল্টা বলল। ওরাও আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে গেলেন। একা থাকার যন্ত্রণা আবারও টের পেলাম। এরমধ্যে মা আমাকে কথা দিলেন যে আমাকে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশনে ডিপ্লোমা করতে বিদেশে পাঠাবেন। আমি রাজি হলাম। সবকিছু ঠিক করলাম বাবাকে না জানিয়ে। আর কেউ জানতো না মা ছাড়া। কিন্তু যাওয়ার কিছুদিন আগে মা বললেন বিয়ে করতে হবে তার পছন্দের মেয়েকে। প্রমা একটুখানি কেঁপে ওঠে। শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, - তারপর? তাওসিফ বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, আজ আর বলতে ইচ্ছে করছে না। চলো উঠি।

দুজনেই নিশ্চুপ হেটে চলে নিরিবিলি রাস্তায়। তাওসিফ বিষণ্ণ গলায় বলে, -আমার কেউ নেই প্রমা। যার সাথে একটু মন খুলে কথা বলবো। প্রমা তাওসিফের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। কিন্তু শীতল হাতে তাওসিফের হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে হাটতে থাকে।

সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেকক্ষণ আগে। দুজনেই চুপচাপ হেটে যাচ্ছে। প্রমা শক্ত করে তাওসিফের হাত চেপে ধরে নিচু গলায় বলল, - আমি এরপর থেকে যখন তোমার কাছে আসবো তখন অনেক কথা বলবো। অনেক কথা! অন্ধকারে তাওসিফের অবাক হওয়া মুখ টা দেখতে পেলো না প্রমা।

২ এনামুল চৌধুরীর রাতে ঘুম হয়না। বোধ হয় ইনসমনিয়ার কারণে। অথচ তার স্ত্রী সেলিনা নাক ডেকে ঘুমায়। এনামুল চৌধুরী এই ডাকার শব্দেও ঘুমাতে চেষ্টা করেন। ইদানীং ঘুম না হওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে প্রমা। এই মেয়েটার চিন্তায় সে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকে। তার মাঝেমাঝে মনে হয় প্রমা শুধু তাওসিফের উপর না তার উপর ও প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রমার রাগ যে আছে সেটা সে জানে কিন্তু এই রাগ যে কখন ঘৃণায় পরিণত হলো সেটা টের পায়নি। এনামুল সাহেব ভেবেছিল প্রমা হয়তো তার মায়ের সাথে রাগ করে কখনো যোগাযোগ করেনি। কিন্তু সত্যিই কি সেরকম কিছু! এনামুল চৌধুরী ভাবতে পারছেন না আর। তীব্র মাথা ব্যথা এসে গ্রাস করছে। মনে মনে ভাবেন জীবনে তার সবচেয়ে বড় ভুল কোনটি, সেলিনা কে বিয়ে করা নাকি টাকার পেছনে ছোটা!

প্রতিকদের বাড়িটা শহর থেকে একটু দূরে গাছপালার মধ্যে বলেই হয়তো এখানে শীত এসে গেছে সবার আগে। সিসিলিয়া বিকেলে আজ অনেক টা সময় ঘুমিয়েছিল। তাই আজ রাতে ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করেও ঘুম না আসলে গায়ে চাদর চাপিয়ে জানালার পাশে বসল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্য সময় হলে সিসিলিয়া ছাদে হাটতে যেতো কিন্তু সৈকত আসার পর থেকে সিসিলিয়া ছাদে যায় না। সৈকতের নাম মনে পরতেই কপালে ভাজ পড়ল। ছেলেটা সেই প্রথম দিন থেকে ওর পেছনে পড়ে আছে। তাই যতটা সম্ভব ওকে এড়িয়ে চলে। তবুও হুটহাট দেখা হলে উচ্চস্বরে শিশি ভাবী বলে ডেকে ওঠে।

সৈকতের কথা ভাবতে ভাবতেই আনমনে হেসে উঠলো সিসিলিয়া। আশ্চর্য ব্যাপার ওর এখন আর রাগ লাগছে না কেন! সিসিলিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি তে ওর কোনো বন্ধু ছিলো না। তাছাড়া ছেলেদের সাথে সহজে মিশতেও পারতো না। সেকারণে কি সৈকত কে ওর এতো বিরক্ত লাগছে! হতে পারে। তাছাড়া অনন্যা কিংবা প্রতীক তো সৈকতের আচরণে বিরক্ত হচ্ছে না!

জানালা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গেল সিসিলিয়া। ফোনটা হাতে নিয়ে একবার সেই অপরিচিত নাম্বার টায় ফোন করল কিন্তু বন্ধ পেল। আপনমনে হেসে নিজেই বিরবির করে বলল, তোর একাকীত্ব কখনো ঘুচবে না সিসিলিয়া। কেউ হয়তো তোর জন্য আসবে না!

আজও সেই একই দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে সৈকতের। এক বোতল পানি শেষ করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিলো। এই স্বপ্ন থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে! বেশ কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর দরজা খুলে বাইরে এলো সৈকত। শীত করছে কিন্তু শীতের পোশাক পরতে ইচ্ছে করছে না। এভাবে কিছুক্ষণ বসে মশার কামড় খেল সৈকত। তারপর উঠে গিয়ে গায়ে চাদর চাপিয়ে গিটার নিয়ে বসল। গিটারের সুরে গলা খুলে গান গাইতে শুরু করল, ভালো লাগে, জ্যোৎস্না রাতে! মেঘ হয়ে আকাশে উড়তে!

সিসিলিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ছাদে পৌঁছে দেখল দূরে অনন্যা দাড়িয়ে আছে। ও নিশ্চুপে অনন্যার পাশে দাড়াতেই অনন্যা চাপা গলায় বলল, - তোমার ও ঘুম আসছিলো না বুঝি! - হু।

সৈকত তখনও একমনে গান গেয়ে যাচ্ছে। প্রতিক পাশে বসে আছে।

ভালো লাগে রোদ হয়ে, ওই পাখির ডানা ছুঁয়ে দিতে! এই লাইন টা শেষ হতেই সিসিলিয়া টের পেল তার চোখে পানি এসে গেছে। ভাগ্যিস অন্ধকার ছিলো নাহলে সবাই হয়তো সে চোখের জল দেখে ফেলতো!

(চলবে...)

আরো পড়ুন ৫ম পর্ব- ধারাবাহিক গল্প : এক পলকের একটু দেখায়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড