• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গল্প : এক জোড়া কেডস

  অদ্বিতীয়া রায়হান

১২ নভেম্বর ২০১৯, ১৪:৫০
গল্প
ছবি : প্রতীকী

ছুটির দিন বলে তাহমিনা নিজেই বাসার কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলো। কয়েক রকমের সবজি, ডাল, মুরগির মাংস রান্না করা; দুপুরের জন্য খিচুড়ি রান্না করা; দুটো রুমের বিছানার চাদর ধোয়া আর বারান্দার গাছগুলোর পাতা ছেঁটে ফেলা- এই হলো তাহমিনার ভাগের কাজ।

মেহুল আজকে ঘরের জিনিসপত্র ঝাড়ামোছা করা, বারান্দা পরিষ্কার করা আর বুকশেলফ গোছানোর কাজ নিয়েছে। দু’জন মিলে যখন নিজেদের কাজে তুমুল ব্যস্ত ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো। মেহুল চমকে দেয়ালঘড়িতে চোখ রাখে। এমন অসময়ে সাধারণত কেউ আসে না এবাসায়। তাহমিনা দ্বিতীয় বার কলিং বেলের আওয়াজে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ইশারায় মেহুলকে রুমে যেতে বলে নিজে এগুলেন দরজার দিকে।

দরজা খুলে একটু অবাক হলেন তাহমিনা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে।বেশ লম্বা মেয়েটির পরনে গাড় সবুজ লং কামিজ আর কালো চুড়িদার। হাতে একটা ছোট ট্রে নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে চেয়ে আছে তাহমিনার দিকে।

- হ্যালো ম্যাম, সরি টু ডিস্টার্ব ইউ এট দিস মোমেন্ট। আমি তিনতলায় থাকি।

মুখে হাসি ধরে রাখা মেয়েটির দিকে আরো কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইলেন তাহমিনা।

- আরে বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? আসুন ভিতরে আসুন।

- ভিতরে আসতে পারি এক শর্তে যদি আপনি আমাকে তুমি করে বলেন। আমার নাম ত্রয়ী। আপনার চেয়ে আমি বয়সে অনেক ছোট।

- আচ্ছা, এসো। ভেতরে এসো।

লিভিং রুমের সিঙ্গেল সোফাটা দখল করে বেশ আরাম করে বসে ত্রয়ী, পায়েসের বোলটা তাহমিনার হাতে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘আপনারা নতুন এলেন তাই ভাবলাম একটু দেখা করে আসি।’

তাহমিনা কিছু বলে ওঠার আগেই মেহুল দ্রুতগতিতে হামলে পড়ে পায়েসের বাটিতে, ‘ওয়াও আপু, ইট হ্যাজ আ গ্রেট টেস্ট। যদিও চিনি কম কিছুটা কিন্তু দারুণ হয়েছে। থ্যাংকস ফর দ্যা ফুড।’

ত্রয়ী মুচকি হেসে জবাব দেয়, - ইটস আ প্লেজার।

তাহমিনার সাথে টুকটাক কথা চলতে থাকে। মাঝে মাঝে মেহুলও রেসপন্স করতে থাকে। কিন্তু ত্রয়ীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন আরো একজনের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে এবাসায়। কথা প্রসঙ্গে যদিও মেহুল বলেছে তার কেডসের ভীষণ শখ। তবুও ত্রয়ীর মনে হচ্ছে এবাসায় আরো একজন থাকে।

রাতে অকারণেই ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে বারবার ক’দিন হলো। বেডসাইড টেবিল থেকে পানির বোতল টেনে নিয়ে গলা ভেজানোর পরও যেন তৃষ্ণা মিটলো না। এমন সময় দরজায় দুম-দাম কিল পড়ছে। কিছুটা ভয় কিছুটা বিস্ময় মেশানো অনুভূতি নিয়ে কি হোলে চোখ রাখতেই মেহুলকে দেখা গেল। দরজা খুলতেই বছর পনেরোর মেহুলের আতঙ্কিত চেহারা সামনে এলো। - আপু আম্মু... এটকু চলো।

সময় নষ্ট না করে কি হয়েছে দেখার জন্য দ্রুত পায়ে দোতলায় ছুটলাম। লিভিং রুমে তাহমিনা ম্যাম মেঝেতে পড়ে রয়েছেন। উনি নিজে পেশায় শিক্ষিকা তাই সম্বোধনটা ম্যামেই রয়ে গিয়েছে। মেঝেতে বসে পালস, ব্রিদিং চেক করে দেখলাম ।সোফা থেকে চট করে দু-তিনটে কুশন টেনে পা উঁচু করে দিলাম। চোখ মুখে পানির হালকা ঝাপটা দেবার জন্য মেহুলকে বলে নিজের রুমে ছুটলাম আমার কিট বক্সটার জন্য। প্রেশার খানিকটা লো হয়ে গিয়েছিলো।জ্ঞান ফিরে আসার পর উনাকে মেহুল আর আমি মিলে ধরে উনাকে রুমে নিয়ে গেলাম। মেহুল ঘর ছাড়তেই তাহমিনা ম্যাম ব্যস্ত হয়ে গেলেন যেন। - ত্রয়ী, আমার কিচ্ছু হয়নি। মেহুল শুধু শুধু টেনশন করছে। - আপনার কোনো কথা আমি শুনছিনা ম্যাম। আপনি কিছু খাবেন আগে আমার সামনে তারপর আপনাকে সিডাটিভ দিয়ে দেব। ইড নিড রেস্ট। - আরে ওসবের দরকার নেই।

অনেক কষ্টে ম্যামকে কিছু খাইয়ে সিডাটিভ ইনজেক্ট করে পিছনে ঘুরতেই এক জোড়া চোখে আটকে গেল সমস্ত সময়,এই ব্রহ্মাণ্ড। ঘন অক্ষিপল্লবের বহু রাতজাগা একজোড়া বিষণ্ণ কিন্তু ভীষণ সুন্দর চোখ।যে চোখের দৃষ্টি আমার উপর টিকলো মাত্র কয়েক সেকেন্ড তারপরই ফিরে গেল বিছানায় শোয়া মানুষটির দিকে। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের সেই মানুষটা আস্তে করে বিছানার একপাশে গিয়ে বসলো।অসুস্থ তাহমিনার ম্যামের একহাত জড়িয়ে ধরল আলতো করে। চাপা কান্নার দমকে হালকা কেঁপে উঠতে থাকলো সুন্দর চোখের সেই মানুষটি।ওদিকে তাহমিনা ম্যামের দু’চোখে ঘুমের রাজ্য নেমে আসতে চাইছিলো কিন্তু সেই কান্নারত মানুষটির জন্য তিনি প্রাণপন চেষ্টা করছিলেন সজাগ থাকার কিন্তু একসময় আস্তে আস্তে তাহমিনা ম্যাম ঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন। মেহুল কিছুটা ধাতস্থ হলেও সেই সুন্দর চোখের মানুষটি তখনো চাপা কান্নায় মগ্ন। কোনো মতে নিজের গলা থেকে শব্দ টেনে বের করে বললাম, - ম্যামের তেমন কিছু হয়নি।রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবেন উনি।চিন্তার কোনো কারণ নেই।

আগামী সপ্তাহের সোমবারের ফ্লাইটে দেশ ছাড়ছি আমি।অনেক বছরের পরিকল্পনা মোতাবেক ফরেইনে পড়াশোনা শেষে সেটেল হবার সিদ্ধান্তেই অটল ছিলাম সেদিনো।সে রাতের পর কয়েকবার তাহমিনা ম্যামের খোঁজখবর নিতে ওখানে হিয়েছি ঠিকই কিন্তু সেই মানুষটির দেখা পাইনি আর। হসপিটালের ইমারজেন্সিতে তখন তুমুল ঝড় বইছে। চিৎচার চেঁচামেচি আর নার্সিং স্টাফদের ভিড় ঠেলে যখন ভেতরে ঢুকলাম তখন বোধহয় তৃষিত নয়ন একটু তৃপ্তি পেল। সেই অবয়ব, সেই চোখজোড়া আবার দেখার সৌভাগ্য হলো আমার। কিন্তু সেদিনের সেই চুপচাপ মানুষটি আজ অশান্ত। বাম হাত কেটে রক্তের ধারা সাদা টাইলস ভিজিয়ে পিচ্ছিল করে দিচ্ছে অথচ এমন সেনসেটিভ ইস্যুকে পাত্তা না দিয়ে সেই নাম না চেনা মানুষটি ডান হাতে সার্জিক্যাল এক ইন্সট্রুমেন্ট উঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছে সবাইকে।

- খবরদার কেউ আসবেনা এদিকে।আই উইল কিল অল অফ ইউ। দ্যা ব্লাডি নার্সেস, গো এওয়ে। যাস্ট গেট লস্ট।

সবাইকে বাইরে যেতে বলে আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম তার দিকে। - দেখুন নার্সরা সবাই চলে গিয়েছে। - আপনি কে? - আমি? আমি মেহুলের বন্ধু

মেহুলের নাম বলায় বোধহয় কাজ হলো।উৎসুক গলা শোনা গেল তার, - মেহুলের বন্ধু? - জ্বি, ওই যে তাহমিনা ম্যাম অসুস্থ হয়ে গেলেন ওইদিনই তো মেহুল আমায় ডেকে এনেছিলো আপনাদের বাসায়। - আমার বাসা? - জ্বি। আপনার কি বাসায় যেতে মন চাইছে না? - হ্যাঁ চাইছে তো - তাহলে চলুন বাসায় যাই - আপনি আমায় বাসায় নিয়ে যাবেন? - অবশ্যই নিয়ে যাবো।কিন্তু আপনি এ অবস্থায় বাসায় গেলে কি হবে বলুন তো?

সেই মানুষটি তখন ভাবনায় ডুবে গেল।ডান হাতটা খালি করে শার্ট ঝাড়তে লাগলো যেন ধুলোভরা শার্ট ঝাড়ছে সে।আমি আমার পায়ের দিকে দেখতে তাকে ইশারা করলাম তাকে। - কেডস্? নতুন কেডস্? বিস্ময় মাখানো কন্ঠটি বলে উঠলো।

- হু,নতুন। কিন্তু আগে যদি আপনি আমাকে ব্যান্ডেজ করতে দেন আপনার হাতে তাহলে এগুলো আপনাকে দিয়ে দেব। - আপনি কে? - মেহুলের বন্ধু।

সেই মানুষটি হাত বাড়িয়ে দিলো, - তাত্তাড়ি ঠিক করে দাও আমার হাত, বাসায় যাবো। নতুন কেডস্ নিব।

সেই মানুষটির ভেতরের সরলতা আর জমানো কষ্টগুলো যেন অশুভ সংকেত দিয়ে চললো।

তাহমিনা ম্যাম যেদিন আমার ফ্ল্যাটে এলেন ফ্লাইটের আগের দিন।নিজের দেশের শেষ বিকেলটা সূর্যাস্তের আলোয় রাঙা না হয়ে নিঠুর বাস্তবতার কড়াঘাতে রাঙা হয়ে উঠলো। আমার মুখোমুখি বসে তাহমিনা ম্যাম অকপটে বলে চললেন সেসব কথা।

- বুঝলে ত্রয়ী তখন আমার বড়ভাই ইএসএ তে সেটেল হয়েছে।ভার্সিটি শুরুর পরের বছরই রোজার ছুটিতে ভাইয়ের কাছে বেড়াতে গেলাম।।দীপ্র তখন বছর পাঁচেকের বাচ্চা।তো ভাইয়ের বাসায় পা দিয়ে বুঝলাম কিছু ঠিক নেই।আমার ভাবী শয্যাশায়ী।ছোট্ট দীপ্র ভয়ানক রকম শান্ত থাকে সবসময়।আমি ভাবলাম পরিস্থিতির জন্য ও এমন।ভাবীর অসুস্থতার কথা আমাদের বাসার কেউ জানতো না। ফোনে টুকটাক দুচারটে কথা চলতো ভাবীর সাথে মাঝে মাঝে।কিন্তু ভাইয়া প্রায়ই যোগাযোগ রাখতো বাসায়।ভাইয়ের ভাষ্যমতে ভাবীর অসুস্থতার কথা শুনলে দেশে আমরা সবাই চিন্তা করবো তাই কিছু জানায়নি। কিন্তু কি যেন একটা ঠিক নেই।দীপ্র যেন একটা রোবোটিক লাইফ লিড করছিলো ওই অতটুকু বয়সেই।একদিন ভাবীর অবস্থা বেশি খারাপ হলে হসপিটালে নেয়া হলো ভাবীকে।কিন্তু আমি পেলাম অন্য একটা সুযোগ।দীপ্রকে বাসায় নিয়ে যাবার নাম করে ওই হসপিটালের চাইল্ড সেকশনে ওকে দেখানোর ব্যবস্থা করলাম।কিন্তু বিনিময়ে যা জানতে পারলাম সেটা ভয়াবহ।দীপ্র চাইল্ড অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছে অনেকদিন হলো।একটা সোশাল অ্যাসোসিয়েশনে এ ব্যাপারে কথা বলার পর আস্তে আস্তে সত্য বের হয়ে আসলো।ভাবীর দেখাশোনার জন্য রাখা নার্স ছিল মেইন কালপ্রিট।আরো বেশি ধাক্কা পেলাম যখন দেখলাম বড় ভাই দীপ্রর পক্ষে না থেকে সব মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়ে সেই নার্সের সঙ্গেই বাকি লাইফ কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। অনেক কষ্টের পর দীপ্রকে তো ফিরিয়ে আনলাম কিন্তু ছেলেটাকে একটা সুন্দর লাইফ দিতে পারলাম না।

- তারপর?

- দীপ্র তখন কিছুটা ভালোর দিকে, আমার বিয়ে হলো কিন্তু মেহুলের বাবা দীপ্রকে মানতে নারাজ।তাই আর একসাথে নেই আমরা।

- নিজের বাবা যে দায়িত্ব নেয় নি আপনি সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এতকিছুর মোকাবেলা করলেন?

- ত্রয়ী, বাচ্চারা একটা আশ্রয় খোঁজে, নিরাপত্তা খোঁজে। জরুরী এটাই যে দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলো সে যেন হাত না ছাড়ে।সবসময় যেন পাশে থাকে। তাই না?

তাহমিনা ম্যামের প্রশ্নের উত্তরে সেই বিষণ্ণ চোখের মানুষটার কথা বারবার মনে হতে থাকলো, সেই মানুষটার নীরবতার প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে জড়িয়ে থাকা কষ্টগুলো যেন জলের রুপ নিয়ে চোখের কোণে বাসা বাঁধলো। কষ্টের বিষবাষ্প যেন আমার শহরকে ছেয়ে ফেলতে শুরু করলো নিমিষে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড