• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বই আলোচনা

‘নৈঃশব্দের মায়াহরিণ’ সমাজের বুকে ভিন্ন সমাজ

  খোরশেদ মুকুল

১৬ জুন ২০১৯, ১১:৩৭
প্রচ্ছদ
গল্পগ্রন্থ : নৈঃশব্দের মায়াহরিণ

সমাজে এমন কিছু গলি আছে যেখানে দিনের বেলায় মানুষের আনাগোনা নিষেধ। কিন্তু রাত হলেই মানুষের ভিড়ে মানুষ দেখা যায় না। শুধুই পাওয়া যায় সভ্যনামে কিছু প্রাণি। এমন কিছু সম্পর্ক আছে যার পরিণতি কিংবা সমাধান সমাজের রীতিনীতির বাইরে। এমন কিছু কান্না আছে যা দেখার কিংবা অনুভবের মানুষ নেই। এমন কিছু দুঃখ আছে যা লুকানোর সামর্থ নেই। কিন্তু তার মাঝেও আমরা বেঁচে আছি। সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের এমন দ্বান্দ্বিক ঘটনার অপূর্ব সম্মিলন কবি ও সাহিত্যিক সুজন আহসানের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নৈঃশব্দের মায়াহরিণ’।

সুকন্যা দিদি, হারিয়ে খুঁজি, বনলতা সেন, সাবিত্রী, প্রতিবেশিণী, নৈঃশব্দের মায়াহরিণ, আমার দেখা আরিফুল গল্পগুলো দিয়েই সাজানো হয়েছে ‘নৈঃশব্দের মায়াহরিণ’। নাম ভিন্ন হলেও গল্পগুলোর মধ্যে অভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। তা হচ্ছে কিছু অন্ধকার চিত্র। এছাড়া প্রতিটি গল্পই কোনো না কোনোভাবে ট্র্যাজিক পর্যায়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। বলতে গেলে এটি একটি বিয়োগান্তক গল্পগ্রন্থ।

সুজন আহসান ‘আত্মহত্যার পাণ্ডুলিপি’ কাব্যের মাধ্যমে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ‘নৈঃশব্দের মায়াহরিণ’ পড়ে বুঝা যায় কথাসাহিত্যে কবির দখলদারিত্ব। যেনো আপাদমস্তক কথাসাহিত্যিক। একেই বলে জাত লেখক। ঝরঝরে শব্দের মাধ্যমে তরতরে নির্মাণ করেছে মোহনীয় ক্যানভাস। আছে জৈবিক রসায়ন। মানসিক ব্যবচ্ছেদ। মানবিক আবেদন। কিশোর মনের উঁকিঝুঁকি। মাঝেমাঝে পাওয়া যায় উপমার চাঁদনি। আর্থিক আর সম্পর্কের টানাপোড়ন যেন গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সুকন্যা দিদি। একজন বেকার যুবক মুকুল আর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক্তোর শেষ করা এক নিশি পরীর গল্প। দু’জনই পারিবারিক সম্পর্কে পূর্ব পরিচিত। মুকুল মুসলিম আর সুকন্যা হিন্দু। বয়সে সুকন্যা বড়। গ্রামের বাস চুকিয়ে যান্ত্রিক শহরে এক দিকভ্রান্ত সময়ে দু’জনের সাক্ষাৎ। অসহায়ত্বের করুণ পরিণতি মুকুলকে নিয়ে যায় সুকন্যার বাসায়। ভঙ্গুর সামাজের অসামাজিক ক্যানভসে এগিয়ে যায় গল্পের পরিধি। সুকন্যার আত্মহত্যার মাধ্যমে শেষ হয় সুকন্যা দিদি। গল্পের পরতে পরতে উঠে এসেছে সাম্যের ধ্বনি। লিঙ্গ বৈষম্য। সভ্য সমাজের প্রতি সুকন্যার সুপ্ত ধিক্কার আর অপরিসীম ঘৃণা এবং মুকুলের ডিপেন্সিভ মনোভাব। সাম্যের গান গেয়ে গল্পের শুরুতে মুকুল বলে- ‘এইতো সেদিনও দিদি আমাদের বাড়িতে আসতো পূজার দাওয়াত নিয়ে। আমরাও যেতাম দিদিদের বাড়িতে ঈদের দাওয়াত দিয়ে।’

সুকন্যা যদিও বইপ্রেমি তবুও কাজে যাওয়ার আগে একটু সাঁজগোঁজ তো করতে বাধ্য। তাই একদিন বের হওয়ার আগে সুকন্যার রূপচর্চার দিকে মুকুল তাকিয়ে থাকতে দেখে সুকন্যা প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বলে- ‘ কিরে, কী ভাবছিস? এত রূপচর্চা কেন করি? তোদের পুরুষ সমাজের ভোগ্যণ্য হওয়ার জন্য আমাদের এভাবেই থাকতে হয় সারাজীবন।’ সমাজে পতিতাদের কোনো ঠায় হয় না। তাই বসবাসের জন্য তাদের বস্তিই শেষ ঠিকানা। একরুমের বাসায় তারা দু’জনের আপাত বসবাস।

নারী-পুরুষের অদৃশ্য আকর্ষণ বয়সের দেয়াল মানে না। সুকন্যা গোসল সেরে বাসায় কাপড় পাল্টানোর দৃশ্য মুকুলের চোখ এড়ায়নি। নিষ্পলক চাহনির প্রতিত্তোরে সুকন্যা বলে ওঠে- ‘ কিরে, হা করে কী দেখিস? ঐশ্চর্য দেখি। কেবল ঐষচর্যই দেখলি। ঐশ্চর্যের পেছনে লুকায়িত ধ্বংসস্তুপ দেখলি না।’ রিক্ততা ও সিক্ততার অপূর্ব মোহনা এই বাক্যালাপ। একটু সুস্থ হয়ে মুকুল ফিরে যায় নিজ গন্তব্যে। পরেরবার দেখা হয় সুকন্যার লাশের সাথে। যেখানে ঘুমিয়ে পড়ে মুকুলের অপ্রকাশিত স্বপ্ন। ‘হারিয়ে খুঁজি’ একজন অভিমানী কবি সাইফ সজলের বিয়োগান্তক প্রেমোপখ্যান। ভার্চুয়াল জগতে পরিচিত হওয়া তাহামিনা আফরোজের সাথে সম্পর্কের আল ধরেই এগুতে থাকে গল্পটি। নিবৃত্তচারী কবিকে জনসম্মুকে আনে তাহামিনা। একটি কবিতাগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের মাধ্যমে। প্রেরণা, যোগান সবই তাহমিনার। কিন্তু দূর্ভাগ্য এতই সুপ্রসন্ন যে তাহামিনা সজলকে ছেড়ে চলে যায়। বিষণ্ণ কবি সাগরপাড়ে স্মৃতিরোমন্থন করে বলতে থাকে- ‘কবিরা এই একটাতেই সুখি। প্রেমিকা চলে গেলেও শব্দ কখনও চলে যায় না।’

‘বনলতা সেন’ শিপে কাজ করা গল্প কথকের জীবনের করুণ আলপনা। তিনবছরের কন্যা বনলতাকে ছেড়ে স্ত্রী চলে যায় তারই বন্ধু আফজালের সাথে। সেই থেকে জীবন যুদ্ধে একাই হেঁটেছেন কন্যাকে নিয়ে। আজ কন্যাও বড় হয়েছে। কিন্তু তবুও একা। লেখক এখানে বনলতার প্রস্থানের ব্যাখ্যা না দিলেও ঘটনার আবহে বুঝা যায় ঘটনাটিও সামাজিক ছিল না। নিঃসঙ্গ পথিকের সময় যায় পাশের বাড়ির নিশিতার বাবা-মা আর নিশিতার সাথে একাত্ব হয়েই। আপন হারিয়ে খুঁজে পাওয়া কিছু অতি আপন। সঙ্গিহীন জীবন যে কত নিষ্টুর তা গল্পের প্রতিটি ছত্রে ফুটে উঠেছে খুবই সুচারুভাবে। সেই প্রয়োজন বুঝাতেই লেখক বলে- ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র অনূযায়ী, প্রত্যেক পুরুষ মানুষের একজন সুবোধ সঙ্গিনী দরকার; অবসরে সময় কাটানোর জন্য, ক্লান্তিতে হেলান দেয়ার জন্য, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য একজন নিরেট বন্ধু প্রয়োজন।’

লেখক এখানে পুরুষ শব্দটি উহ্য রাখলে হয়তো বিষয়টি সার্বজনীন হত। এতে মানব জাতির একটা সামগ্রিক প্রয়োজনের দিকেই ইঙ্গিত পাওয়া যেত। হয়তো আপাত প্রয়জনটি পুরুষের তাই লেখকের এমন ব্যবহার। এছাড়া গল্পে বর্তমান সময়ের সবচে’ ভয়াল আগ্রাসন; সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের উল্লেখ করে বনলতার মাধ্যমে তার তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে। যা লেখকের সুপ্ত স্বদেশপেমেরই বহিঃপ্রকাশ।

‘সাবিত্রী’ মালো পাড়ার এক সহায় সম্বলহীন মহিলার গভীর আর্তনাদ। যার একটি পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানও আছে। যাকে বাবার নামের অভাবে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেনি। শ্রেনিবৈষম্যের করুণ চিত্র এখানে প্রতিয়মান। মানুষের বাড়ি কাজ করে এবং তাদের দেয়া বাসি খাবারের মাধমেই চলে তাদের মা-ছেলের সংসার। যদিও গল্প কথক বাড়ি থেকেই বের হতে পারে না সমাজের কটুক্তির ভয়ে। বাড়ি বলতে মাথাগোজার যা ছিল তাকে পৃথিবীর মানচিত্রই বলা চলে। উচ্চবিত্তদের লোলুপ দৃষ্টি আর নির্যাতনের কারণে সাবিত্রী আত্মহত্যাকেই সমাধান মনে করে।

‘প্রতিবেশিনী’ গেস্ট টিচার মুহাম্মদ আলাউদ্দিনের জীবন যুদ্ধের প্রাক-আলাআপন। এখানে সমসাময়িক শিক্ষা এবং শিক্ষার পরিবেশ নিয়েও আলোচনা হয়। বাদ যায়নি শিক্ষকদের রসায়নও। জীবনের তাগিদে মুহাম্মদ আলাউদ্দিন বাঁশখালীর একটি স্কুলে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন করে। পাশাপাশি চলতে থাকে অন্য চাকরির সন্ধান। স্কুলে শিক্ষকদের নামের সংক্ষিপ্ত প্রচলনের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তারও ইঙ্গিত পাওয়া যায় এ গল্পে। এটি একদিকে সুখকর হলেও অন্যদিকে খুব ভয়ানক। কারণ এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের প্রকৃত নামই ভুলে যায়। তাছাড়া সংক্ষিপ্ত রূপ অনেকসময় অস্বস্তিকরও হয়ে থাকে। যেমন মুহাম্মদ আলাউদ্দিনের সংক্ষিপ্ত করে হয়ে যায় ‘MAU’. অনেকে মিয়াউ বলেও ডাকে। সেখানে ঘনিষ্ট হয়ে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া রাবেয়ার সাথে। চেয়ারম্যান বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও রাবেয়ার বাড়িতে প্রায় দাওয়াত খেতে যায় মুহাম্মদ আলাউদ্দিন। একটি নামহীন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পড়ে দু’জনই। তাই তো নতুন চাকরির সুবাধে স্কুল থেকে বিদায়বেলায় রাবেয়া পথিমধ্যে ফুল আর চকলেটের সাথে অশ্রু বিসর্জন দিয়েই বিদায় জানায় মুহাম্মদ আলাউদ্দিনকে।

নামগল্প ‘নৈঃশব্দের মায়াহরিণ’ চকরিয়ার নামকরা ব্যবসায়ী রুহুল আমিনের ছেলে ফরহাদ আর নিশিকন্যা কলির সমাজ অস্বীকৃত রসায়ন। আমাদের সমাজে চলে আসা এক ভয়ংকর রীতিনীতিরও উল্লেখ পাওয়া যায় গল্পে। বাবা-মায়ের অপূর্ণ স্বপ্ন সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করা। যদিও তা দোষের নয়। তবুও এতে সন্তানের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তার বানাতে ব্যর্থ ফরহাদকে এখন বিসিএস অফিসার হিসেবেই দেখতে চায় বাবা রুহুল আমিন। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থতা যেনো মেনে নেয়া যায় না। তাছাড়া ফরহাদ গোপনে কলিকে বিয়ে করে সমাজের আশা আকাঙ্খার বুকে চুরি চালিয়ে দিয়েছে বলেই সবার ধারণা। কিন্তু ফহাদের চোখে তা অপরাধ নয়। এক অসহায়কে সমাজের বুকে পরিচয় দেয়ায় ছিল মূল লক্ষ্য। অবশেষে বাবা সব মেনে নিয়ে কলিকে ঘরে তোলে। কিন্তু অকস্মাৎ ফরহাদের জীবনের প্রাক্তন লিমার সাথে শপিং-এ দেখা পরবর্তি আলাপ কলি শুনে ফেলে। তাই করুণা নিয়ে বেঁচে থাকার ভয়ে পুরোনো পেশায় ফিরে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাতের আঁধারে নিঃশব্দে চলে যায় কলি।

গ্রন্থের শেষগল্প ‘আমার দেখা আরিফুল’ সৎ মায়ের সংসারে বেড়ে উঠা আরিফুল এবং বড় কাকার বাড়িতে বেড়ে উঠা মেঝ ভাই রফিকুল এবং নানার বাড়িতে বেড়ে উঠা বড় ভাই জহিরুলের জীবনাখ্যান। জহিরুলের বিয়েতে অভাব কাটিয়ে উঠা বাবা আসাদ উদ্দিন গরু জবাই করে গ্রামের সবাইকে খাওয়াতে চাইলে দ্বিতীয় স্ত্রী নাসিমা বেগম এতে ঘোর আপত্তি জানায়। যদিও আসাদ উদ্দিন নিজ সিদ্ধান্তে অটল। আরিফুলও বড় ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে খুব খুশি। সেও অনেক পরিকল্পনা করে বিয়ে নিয়ে। বিয়ে ঘনিয়ে এল। হঠাৎ আরিফুলের সখের মোবাইল হারিয়ে যায়। এতে সে মেঝ ভাইকে সন্দেহ করে কিন্তু মেঝভাই নেয়নি বলার পরও তার বিশ্বাস হয়নি। শেষ পর্যন্ত রাগে-ক্ষোভে আরিফ বিষপানের প্রতিই ঝুঁকে পড়ে।

শ. ই. মামুনের নান্দনিক প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছে হরিৎ প্রকাশন’র কর্ণধার ফারুকী ওমর। একুশে বইমেলা’২০১৯ এ প্রকাশিত বইটির মুদ্রিত মূল্য রাখা হয়েছে ১৮০ টাকা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড