• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সাক্ষাৎকার

সাহিত্যে বড় কিছু অর্জনের ক্ষেত্রে আত্মসমালোচনা জরুরি : মামুন মুস্তাফা

  বঙ্গ রাখাল

২৫ জুলাই ২০১৯, ১৫:৩৮
ছবি
ছবি : ‘লেখমালা’ সম্পাদক মামুন মুস্তাফা

সাম্প্রতিক সময়ের কবিতা বিশেষভাবে নব্বইয়ের সময় থেকে জটিল দায়বদ্ধ ও গদ্যকবিতার সঙ্গে শিল্পগুণসমৃদ্ধ, পরিপার্শ্ববর্জিত সমাজনিরপেক্ষ-ঐতিহ্যে অন্তর্মুখীন কবিতার ধারা লক্ষ করা যায়। এ-সময়পর্বের কবিগণ কবিতায় অধিক প্রাণচাঞ্চল্য, মননশীলতা এবং বাস্তবতার আলোকে ব্যাপক আন্তর্জাতিকতাকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের কবিতায় তাই নব্বইয়ের দশক একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অর্জন করে নিয়েছে। এ-সময়পর্বেরই মননবোধে উজ্জীবীত সৃজনশীল কবি হিসেবে চিহ্নিত হন মামুন মুস্তাফা। ৩ জুলাই, ১৯৭১ সালে মামুন মুস্তাফা জন্ম গ্রহণ করেন পিতার কর্মক্ষেত্র বর্তমান বাগেরহাট জেলায়। তার প্রকৃত নাম মুস্তাফা কালিমুল্লাহ আল মামুন। অধ্যাপক পিতা মুহম্মদ গোলাম রসূল ও মা হামিদা রসূলের দুই সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ তিনি। তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান মাগুরা জেলার সদর থানার পারনান্দুয়ালী গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বিএসএস (অনার্স)সহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করছেন। পাশাপাশি দেখছেন দৈনিকটির সাহিত্যপাতাও। কবির প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর ভেতরে রয়েছে কবিতা : সাবিত্রীর জানালা খোলা, কুহকের প্রত্নলিপি, আদর্শলিপি : পুনর্লিখন, এ আলোআঁধার আমার, পিপাসার জলসত্র, শিখাসীমন্তিনী, একাত্তরের এলিজি, শনিবার ও হাওয়াঘুড়ি, ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র ও কফিনকাব্য এবং প্রবন্ধ: এই বদ্বীপের কবিতাকৃতি, মননের লেখমালা ও অন্য আলোর রেখা। সাহিত্যকৃতির জন্যে অর্জন করেছেন ‘চিহ্নসম্মাননা’। কবি মামুন মুস্তাফা বর্তমানে ‘লেখমালা’ নামক একটি ছোটকাগজও সম্পাদনা করছেন। ৩ জুলাই কবির জন্মদিন উপলক্ষে তার সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তরুণ কবি বঙ্গ রাখাল।

বঙ্গ রাখাল : আপনার কোথায় বেড়ে ওঠা? আপনার বেড়ে ওঠাসহ পরিবার, গ্রামের আলো-বাতাস, সর্বোপরি পরিবেশ কীভাবে কবি মামুন মুস্তাফার জন্ম দিয়েছে- সে গল্প জানতে চাই।

মামুন মুস্তাফা : আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা একটি ছোট মফস্বল শহর বাগেরহাটে। সেখানকার সরকারি প্রফুল্ল চন্দ্র মহাবিদ্যালয় সংক্ষেপে যাকে পি. সি. কলেজ বলা হয়- সেখানে আমার পিতা ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। তখন তো বাগেরহাট ছিল মহাকুমা শহর। পরবর্তীতে এরশাদ সরকার ১৯৮৪ সালের দিকে এটিকে জেলা শহরে রূপান্তর করেন।

কিন্তু বাগেরহাট একটি শ্যামল প্রকৃতির জলহাওয়া, গাছপালা-লতাপাতার শহর। খুব নরোম একটি শহর। এখানকার মানুষজনের মনও কোমল। এর প্রকৃতিই মানুষকে ভাবুক করে তুলবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমার বাড়তি পাওনা ছিল আমার পরিবার। একটি সাংস্কৃতিক পরিবার। বাবা ভাল আবৃত্তিকার, উপস্থাপক; পি সি কলেজের বার্ষিক সাহিত্য প্রতিযোগিতার দায়িত্ব অধিকাংশ সময় তাকেই নিতে হতো। আবার কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ধারাভাষ্যকার হিসেবে তাকেই রাখা হতো। আর মা তার ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিনয় ও নাচ করতেন। তাদের কাছ থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রথম পাঠ নেয়া।

তখন সত্তর দশকের শেষ ও আশির দশকের শুরু- এমন সময়টিতে আমার বেড়ে ওঠা। ওই সময়ে প্রতি সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়া ছিল নিয়মের ব্যাপার। আর হারিকেনের আলোয় পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাছে বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ নেয়া ছিল নিত্য দিনের ব্যাপার। তখন তিনি তার প্রিয় নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়রের গল্প করতেন খুব। রবি ঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ তো রয়েছেনই। সেই স্কুল পর্যায় থেকে কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক করে আসছি। অভিনয়, উপস্থাপনাও ছিল আমার ভাল লাগার বিষয়। শুকলাল সঙ্গীত বিদ্যাপীঠ নামের একটি সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ছিল বাগেরহাটে। ছোটদের নিয়ে আয়োজিত বাগেরহাট শিল্পকলা অডিটরিয়ামে তাদের একটি অনুষ্ঠান আমি উপস্থাপনা করি, তখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। উপরন্তু কলেজের বার্ষিক নাটক কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী অথবা পূজা-পার্বণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওই বালক বয়সে আমি অংশ নিতাম। এ-রকম একটি অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ একটি নাটকে (নামটি আজ আর মন নেই) আমি বালক টেপার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। তখন আমার খেলার সাথীরা অনেককাল আমাকে টেপা বলে ডাকত।

কলেজ কোয়ার্টারে থাকায় সব অধ্যাপকদের ছেলেমেয়েরা ্একই পরিবারভুক্ত ছিল। কলেজের বড় মাঠ, পুকুর, বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রেলপথ, ঝিক ঝিক শব্দ তুলে বাগেরহাট-রূপসাগামী কয়লার ট্রেন, রাধাচূড়া-কৃষ্ণচূড়ার মতো বড় বড় গাছগাছালির ছায়াপল্লবে আমাদের দৌড়ঝাঁপ- সে ছিল নিজস্ব চিন্তালোক খুলে দেয়ার এক দিগন্ত বিস্তৃত পরিবেশ। এসব কিছুই কবি মামুন মুস্তাফার জন্মের পেছনে সহায়তা করেছে।

বঙ্গ রাখাল : আপনার পড়ালেখা কোথায় আর কবি হওয়ার পেছনে কি আপনার কোনো শিক্ষকের ভূমিকা রয়েছে? আজকের মামুন মুস্তাফার পরিচিতির ক্ষেত্রে কে কে বেশি ভূমিকা রেখেছে।

মামুন মুস্তাফা : আমি যখন বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তাম। তখন আমার বাংলার শিক্ষক ছিলেন সাহাবুদ্দিন স্যার। উনি সংস্কৃতমনা ছিলেন। স্যার আমাদেরকে দিয়ে দেয়াল পত্রিকা, বই পড়া, কবিতা-গল্প লিখতে উৎসাহিত করতেন। আমরা যারা এসব করতাম তাদেরকে স্যার খুব স্নেহ করতেন। স্যারের উৎসাহ আমকে সাহিত্যের প্রতি টান বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া বাংলাদেশের খ্যাতনামা কবি ও কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিক ছিলেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু। তার নিজের বাড়ি বাগেরহাট। এক সময় শিক্ষকতা করেছেন বাগেরহাট পি সি কলেজে। সেই সূত্রে আমার বাবার সহকর্মী। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। এরও আগে পাঁচের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র হওয়ায় দুজন দুজনকে চিনতেন এবং জানতেন। যা হোক, বাবার বন্ধু হওয়ায় তিনি যখন বাগেরহাটে আসতেন, তখন আমাদের বাড়িতেই তার সিংগভাগ কেটে যেত, কখনো কখনো রাত যাপনও করতেন। কবি আবুবকর সিদ্দিকের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ, উপদেশ কবি মামুন মুস্তাফাকে গড়ে তোলার প্রধান নিয়ামক। তিনিই প্রথম সে-সময় প্রকাশিত ছোটদের পত্রিকা ‘কিশোর কথা’ ও ‘নবারুণ’-এ আমার কবিতা ছাপিয়ে দেন। তখন আমি ৬ষ্ঠ বা ৭ম শ্রেনিতে পড়ি। রাজশাহীর ‘দৈনিক বার্তা’য়ও আমার কবিতা তিনি ছেপেছেন। পরবর্তীতে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম, তখনও তিনি চিঠির পর চিঠি দিয়ে কোন কোন বই আমাকে পড়তে হবে, আধুনিক কবিতার প্রতি সম্পৃক্ত করা এবং ঢাকা এলে সাহিত্যের বিদগ্ধজনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া, পত্রিকা অফিসগুলোতে নিয়ে যাওয়া ও সাহিত্য সম্পাদকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানো- আবুবকর সিদ্দিকের এই নিখাঁদ ভালবাসা আজকের মামুন মুস্তাফার অন্তরালে কাজ করেছে। তিনি আমাকে স্নেহঋণে আবদ্ধ করেছেন, যা খুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আরো পরে ‘ইত্তেফাক’-এর আল মুজাহিদী এবং ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদকম-লীর সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (স্যার) আমাকে দিয়ে অনেক গদ্য লিখিয়ে নিয়েছেন। ‘জনকণ্ঠ’-এ থাকাকালীন নাসির ভাই (কবি নাসির আহমেদ) ও বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘দৈনিক আমার দেশ’-এর ফারুক ভাইও (কবি ফারুক মাহমুদ) আমার অনেক কবিতা, গদ্য ছেপেছেন। তারা রীতিমত আমাকে ফোন দিয়ে দিয়ে লিখিয়ে নিতেন। কবি মামুন মুস্তাফার গড়ে ওঠার পেছনে এঁদের সকলেরই অবদান রয়েছে। তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।

বঙ্গ রাখাল : পৃথিবীতে এত কাজ থাকতে কেন কবিতা লিখতে এলেন? হঠাৎ করেই এ পথে পা বাড়িয়েছেন, নাকি পরিকল্পনা করেই সাহিত্যের কাজে নিজেকে সমর্পণ করেছেন?

মামুন মুস্তাফা : ওই যে বললাম, ছোট্ট মফস্বল শহর বাগেরহাটের শ্যামল প্রকৃতি আর পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহ আমাকে ছেলেবেলায় ভাবুক করে তুলেছিল, কবি হতে সাহায্য করেছে। বাড়িতে প্রচুর বই। তখনো আমাদের বইয়ের শেলফ হয়নি। ১০/১২ ট্রাঙ্ক বোঝাই দেশি-বিদেশী সাহিত্যের বই। বাবার প্রিয় বিমল মিত্র আর মায়ের আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ধাতস্থ হয়ে গেল ক্লাস ফাইভেই। শরৎ, রবি ঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ তো আছেনই। আর বালক বয়সেই চোখের সামনে দেখছি একজন জ্বলজ্যান্ত কবি আবুবকর সিদ্দিককে। নিজের ভেতরেই শিহরিত হই। কেন পারবো না তাদের মতো লিখতে? রক্তে যেন লেখার তাগিদ অনুভব করলাম। ওই আকাক্সক্ষাই আমাকে কবি করে তুলেছে। শুরুতে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে এখন পরিকল্পনা করেই লিখি। তবে এটা মনে রাখা উচিত যে, আমাদের দেশে লেখাকে পেশা হিশেবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই এটি আমার নেশা, কাজ নয়।

বঙ্গ রাখাল : প্রথম প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থের নাম কি? আর এ গ্রন্থটির কীভাবে জন্ম হয়েছিল- সেই গল্প শুনতে চাই।

মামুন মুস্তাফা : আমার প্রথম প্রকাশিত কাব্যের নাম ‘সাবিত্রীর জানালা খোলা’। প্রকাশ সাল ১৯৯৮। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএসএস (অনার্স)-সহ এমএসএস করেছি। সরকারি চাকরির জন্য বিসিএস-সহ বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়েও চলেছি। মৌখিক (ভাইভা) পরীক্ষা পর্যন্ত যাই ঠিকই কিন্তু চাকরি আর হয় না। বেশ হতাশা আমাকে পেয়ে বসলো। তখন আমাকে স্বাভাবিক রাখতে আমার মা-ই বললেন একটি কবিতার বই করতে। খরচ মা দেবেন। প্রকাশনা সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শুধু ১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয় দৈনিকগুলোতে কবিতা ছাপা হচ্ছে। প্রতিটি একুশের বইমেলায় ঘুরে বেড়াই। তখন কেবল কবিতার বই প্রকাশ করে বিশাকা প্রকাশনী। তার কর্ণধার শাহজাহান বাচ্চুর (কিছু দিন আগে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন) সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি রাজী হন। এভাবেই আমার প্রথম কবিতার বই ‘সাবিত্রীর জানালা খোলা’র আত্মপ্রকাশ। বইটি করতে খরচ লেগেছিল ছয় হাজার টাকা।

বলা আবশ্যক আমি সে-সময় ‘মুস্তাফা মামুন’ নামে লিখতাম। আমার প্রথম কাব্যেও কবি হিশেবে ‘মুস্তাফা মামুন’ নামটি ব্যবহৃত হয়েছে। পরবর্তীতে দেখলাম নামের বানানে তারতম্য থাকলেও ‘মোস্তফা মামুন’ নামে একজন ক্রীড়া সাংবাদিক লেখালিখি করেন। পাঠক যাতে ভুল না করেন সেই বিবেচনা থেকে আমি ‘মামুন মুস্তাফা’ নামে লিখতে শুরু করি। আর আমার দ্বিতীয় কাব্য ‘কুহকের প্রত্নলিপি’তেই ‘মামুন মুস্তাফা’ নামটি ব্যবহার করি।

বঙ্গ রাখাল : সাহিত্যে গোষ্ঠীবাজী বা দলাদলিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মামুন মুস্তাফা : সাহিত্যের আধুনিক যুগ থেকেই গোষ্ঠী-প্রীতির সন্ধান মেলে। যেমন- রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কবি-লেখকদের একটি বলয় গড়ে উঠেছিল। আবার কাজী নজরুলকে ঘিরেও তৈরি হয়েছিল একটি বলয়। অন্যদিকে এদের বিরুদ্ধাচারণ করেও শনিবারের চিঠি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কবি-লেখকদের আরও একটি গোষ্ঠীর সন্ধান মেলে। আমাদের এখানে ‘৪৭-এর দেশভাগের পর মূলত দু-ধারায় কবি-সাহিত্যিকরা বিভক্ত হলেন। এক, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ কবি-লেখক; দুই, পাকিস্তানপন্থী ধর্মাশ্রয়ী কবি-লেখক। এটিই চললো স্বাধীনত-উত্তর পর্যন্ত।

মূলত পাকিস্তান-পর্বে পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিংকেন্দ্রিক প্রগতিশীল কবি-লেখক গোষ্ঠী বাংলাদেশের সাহিত্যের আধুনিকতা রচনা করেন। সুতরাং গোষ্ঠী-প্রীতির ইতিবাচকতা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানের গোষ্ঠীবাজী কার্যত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ও প্রমাণে ভূমিকা রাখছে বেশি। প্রকৃত লেখক সৃষ্টির তুলনায় অ-লেখক প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে। যারা এ কাজটি করছেন তাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে অ-লেখকদের দ্বারা নিজের প্রচার ও প্রপাগান্ডা।

তাই বলে কিছু কাজ যে একেবারে হচ্ছে না তাও নয়। কিন্তু তার সংখ্যা নগণ্য। আর যারা তা করছেন তারাও নিজেদেরকে বর্তমান মিডিয়ার ফায়দাবাজী থেকে গুটিয়ে রাখছেন। তারপরও বলব, গোষ্ঠীবাজী ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক- যাই হোক, তাও কিন্তু সাহিত্যের জন্য মঙ্গল, সমাজের জন্য মঙ্গল। অন্তত শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি- নষ্টদের দলে ভীড়ে যাবে না।

বঙ্গ রাখাল : আপনি সাহিত্যের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর নারী চরিত্রগুলো নিয়ে লিখলেন ‘শিখাসীমন্তিনী’ কাব্য। কাব্যটি প্রকাশের পর প্রচুর আলোচিত হয়। এভাবে নারী চরত্রিগুলোকে নিয়ে কবিতায়ন করার চিন্তা এলো কেন? বিস্তারিত জানতে চাই।

মামুন মুস্তাফা : বালক বয়স থেকেই প্রচুর গল্প-উপন্যাস পড়ার ঝোঁক ছিল। যা আজও বর্তমান। বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা, রবি ঠাকুরের বিনোদিনী, শরৎ বাবুর রাজলক্ষ্মী থেকে শুরু করে আবুল বাশারের ফুলবউ কিংবা হাসান আজিজুল হকের দেশভাগের পটভূমিতে লেখা আগুনপাখির নায়িকা উত্তম বচনে লিখিত সেই জননী-জায়া-কন্যা অথবা হুমায়ূন আহমেদের রাবেয়া- এদের সবার অন্তর্দহন আমার কবিসত্তাকে আলোড়িত করে। মনে হলো এসব গল্প-উপন্যাস যেখানে শেষ- সেখান থেকে শুরু করা যায়। কিন্তু গল্প-উপন্যাসের লোক আমি নই। যদি লিখি হবে আনাড়ি লেখা। তাই কবিতাকেই বেছে নিলাম।

লিখতে গিয়ে ওইসব চরিত্রের স্রষ্টাগণের চিন্তালোক ছুঁয়ে গেল আমাকে। তা সমীকৃত হলো আমার চিন্তাচেতনায়। তখন দেখলাম- আদিকাল হতে এই পৃথিবীতে দুহিতা, দয়িতা আর জননী রূপে নারীর আত্মপ্রকাশ। জগতসংসারের আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট, আশা-নিরাশার দোলাচলে- ওই ত্রিবেণী সঙ্গমে নারী কখনো প্রেমাসক্ত, স্নেহপরায়ন আবার কখনো রুদ্র-বিপ্লবী-ভয়ঙ্করী। তবুও সংসারযাত্রার বন্ধুর পথে নারীই হয়ে ওঠে সর্বংসহা। ‘শিখাসীমন্তিনী’ কাব্যে আমি সে কথাই বলতে চেয়েছি।

বঙ্গ রাখাল : আপনার সব কবিতার মধ্যে এক ধরনের হাহাকার নস্টালজিকতা কিংবা ফেলে আসা পেছনের দিকে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখি, কেন?

মামুন মুস্তাফা : আমার স্ত্রী বলেন, ‘তোমার এত বিরহ পছন্দ। আমি যখন থাকব না তখন তুমি বিরহের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো লিখবে’। আসলে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর দিকে যদি তাকাও, দেখবে সেখানে এক ধরনের শূন্যতা, হাহাকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কিট্স যথার্থই বলেছেন যে, মধুরতম সঙ্গীতই হলো বিরহের সঙ্গীত। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও মধুরতম বিরহ তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এই বিরহ শুধু কাছে না থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। খুব প্রেমের ভেতরেও এক ধরনের হাহাকার খুঁজে পাওয়া যাবে। সে হচ্ছে অপূর্ণতা। মানুষের পক্ষে কখনো পরিপূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। ফলে প্রত্যেক মানুষই নস্টালজিক।

আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’-এর কুমুর কথা বলি। স্বামীর সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হলে সে তার পিত্রালয় বা দাদার বাড়িতে চলে আসে। কিন্তু সে সন্তান সম্ভবা। তাই সন্তান জন্মদানের সময় সে স্বামীর বাড়িতে ফেরত যাচ্ছে। যাবার সময় তার দাদাকে বলছে, (হুবহু সংলাপ মনে নেই) দাদা ওদের সন্তান ওদের কাছে দিয়ে আমি আবার ফিরে আসব। এই যে সবকিছু থাকার ভেতরেও যে অপূর্ণতা এটাই সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব। আবার ‘শেষের কবিতা’র অমিত-লাবণ্য-কেতকী-শোভনলাল-সবাই একই শহরে বর্তমান। অথচ কেউ পেয়ে আবার কেউ না পেয়ে এক ধরনের হাহাকার নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সে কারণেই এত পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে ‘শেষের কবিতা’। কবিতাও ঠিক এরকমই। খুব বিখ্যাত কাব্য ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’। টি এস এলিয়টের এ কবিতাগ্রন্থেও রাষ্ট্র, সমাজ-সংসার, ব্যক্তি-মানুষের হাহাকারই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বাংলায় জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘শাশ্বতী’- নস্টালজিক না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিংবা বুদ্ধদেব বসুর ‘চিল্কায় সকাল’-কে যদি খুব সাধারণ ব্যাখ্যায়ও দাঁড় করাই- শীতের একটি সকাল, মাথার ওপর ঝরঝরে রোদ, এই যে প্রকৃতি-পরিবেশ তার মধ্যে মানুষের জীবনদর্শন, সেখানেও কী অফুরন্ত আনন্দের ভেতরে ব্যক্তি-হাহাকার অনুভূত হয়নি? আমার কবিতায়ও তোমরা সেরকম কিছু দেখলেও দেখতে পার, কিন্তু তা আরোপিত নয়, সহজাত।

বঙ্গ রাখাল : আপনার কবিতার নারী চরিত্রগুলো খুব শক্তিশালী এবং একই সঙ্গে বেদনায় ভরপুর-এই রহস্য সম্পর্কে জানতে চাই।

মামুন মুস্তাফা : না, রহস্য কিছু না। দেখ, এই প্রকৃতির সবথেকে শ্রেষ্ঠ প্রাণিই হলো মানুষ। সৃষ্টিকর্তাই তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কেননা তার বিবেক আছে, বুদ্ধি আছে, চিন্তাশক্তি আছে, বিবেচনা বোধ আছে। এগুলোকে সে কাজে লাগাতে পারে। সুতরাং নারীকে নারী নয় মানুষ হিশেবে আমি দেখি। আর প্রতিটি মানুষই শক্তিশালী। নারী তার ব্যতিক্রম নয়। হ্যাঁ, ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজে পুরুষ তার পেশী শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত থাকে বিধায় নারীকে আমরা অবহেলার চোখে দেখে থাকি। কিন্তু নারীও পুরুষের মতো পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই দেদীপ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষকেও ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং আমার কবিতার নারীকে আমি সে-ভাবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। তাই তোমার কাছে মনে হয়েছে সে শক্তিশালী।

অন্যদিকে যে বেদনার কথা বলছো- তার উত্তর এর আগের প্রশ্নেই পেয়ে গেছ। নাগরিক জীবনের অপূর্ণতাই ব্যক্তি মানুষকে আক্রান্ত করে। এ কথা ঠিক, পুরুষের তুলনায় নারীর আবেগ বেশি। তাই সে বিরহকাতর হয় বেশি। আর পুরুষ নিজেকে সংবরণ করতে পারে, ফলে তার বিরহ সচারচার প্রকাশ পায় না। এ জন্যই বোধহয় আমার কবিতার নারীকে তুমি বেদনার্ত বলছো। তবে আমার কবিতার নারীগণ আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত বিধায় যেমন শক্তিশালী, তেমন নস্টালজিক।

বঙ্গ রাখাল : আপনার কবিতা মানেই এক আলাদা বার্তা। একাত্তরের চিঠি অবলম্বনে লিখেছেন ‘একাত্তরের এলিজি’ কবিতাগ্রন্থ। এ কাব্য সম্পর্কে আপনার সুচিন্তিত বক্তব্য জানতে চাই। মামুন মুস্তাফা : আমার জন্মই হয়ছে ঝঞ্ছাক্ষুব্ধ মুক্তিসংগ্রামের সময়। বেড়ে ওঠা স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে। ছেলেবেলা থেকেই স্বাধীনতার ইতিহাস পাঠ করছি। কবিতা-গল্প, প্রবন্ধ পড়ছি। এ-বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ আমার ভেতরে খুব নাড়া দেয়। যেমন- এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’সহ শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ এবং হাসান হাফিজুর রহমানের ‘যখন উদ্যত সঙ্গীন’ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিতে লিখিত একক দুটি কাব্য- এরকম আরো কিছু গ্রন্থ। আর জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি আমার ভেতরের দেশাত্মাবোধকে প্রখর করে তোলে। মনে মনে ভাবি আমাদের স্বাধীনতার পেছনে এদেশের আপামর মানুষের শৌর্য-বীর্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা কম নয়; আর সেই উত্তাল দিনগুলোকে উপলব্ধি করি যখন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনি। তখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে খুব গৌরবান্বিত মনে হয়, নির্ভার মনে হয়, দামী মনে হয়। আর তাই সাহিত্য যখন করি, তখন স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আমার কোনো কাজ থাকবে না, তা আমি মানতে পারিনি। প্রায়ই মনে হতো- যদি শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যের মতো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর একটি একক কাব্য লিখতে পারতাম। এমন সময়ই আমার সংগ্রহে এলো প্রথমা প্রকাশিত রণাঙ্গণ থেকে প্রিয়জনদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের লিখিত চিঠির সংকলন ‘একাত্তরের চিঠি’। চিঠিগুলো পাঠ করতে করতে আমিও ওই সময়ের ভেতরে ঢুকে গেলাম। চারপাশে মর্টারের শেল, গুলি, আহত-নিহত শব, স্বজনদের হাহাকার, অপেক্ষা, মাতৃভূমিকে রক্ষায় যুদ্ধের জন্য বাড়ি থেকে পলায়নরত যুবক- এসব কিছু আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আমাকে খুবলে খুবলে খেতে থাকে। এক মায়াবি শক্তি এসে ভর করে আমার ওপর। লিখে চলি এখান থেকে বাছাইকৃত ৪০টি চিঠি অবলম্বনে কবিতা। যা পরবর্তীতে ‘একাত্তরের এলিজি’ নামে ২০১৪ সালে ধ্রুবপদ থেকে প্রকাশিত হয়।

প্রকাশের পর এ কাব্যটি ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সকল বয়সী পাঠক একে সাদরে গ্রহণও করে। সমকাল, ইত্তেফাকসহ বেশকিছু ছোটকাগজেও এর আলোচনা বের হয়। আমার এক সমকালীন কবি ও ছোটকাগজ সম্পাদক বলেও ফেলেছেন, ‘একাত্তরের এলিজি’র পর আপনার আর না লিখলেও চলবে।’ হা হা হা...।

বঙ্গ রাখাল : আপনার আপাতত সবশেষ কবিতাগ্রন্থ ‘কফিনকাব্য’তেও রয়েছে সমাজের অবহেলিত, দলিত আবার শোষক শ্রেণিকে নানাদিক থেকে মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক বয়ানে উপস্থাপনের প্রয়াস। এ বিষয়টি আপনার মনোজগতে কীভাবে কাজ করেছে? মামুন মুস্তাফা : শোষক কিংবা দলিত শ্রেণি বলে নয়, ‘কফিনকাব্য’র মূল সুর মূলত মৃত্যুদর্শন। জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যু। একে কেউ উপেক্ষা করতে পারবে না। কেউ যদি গভীর ভাবে চিন্তা করে,তার পক্ষে এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নাড়িনক্ষত্র অনুধাবন কষ্টকর হয়ে যাবে। তাহলে কে সেই মহাশক্তি? যার এই অনুভব শক্তি প্রখর তার পক্ষে সেই মহাপরাক্রমশালী শক্তিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সুতরাং জীবন আর মৃত্যুর এই দর্শন আমাকে অন্য লোকে নিয়ে যায়। আর তাই জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যুকে নিয়ে আমার ভাবনার সঙ্গে একাকার হয়ে ওঠে একজন মুচি, মাঝি, ভিক্ষুক, ঢুলী- এমনকি একজন গোরখোদকের মৃত্যুভাবনা। আবার পাশাপাশি একজন বিচারক কিংবা সনাতন জমিদার বাবুর মৃত্যুদর্শন দেখার চেষ্টাও ছিল ‘কফিনকাব্য’ কবিতাগ্রন্থে।

বঙ্গ রাখাল : ‘ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র’ কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশ পায় কলকাতার উত্তর শিলালিপি থেকে ২০১৭ সালের আগস্টে। আমরা জানি এ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। এটি আপনার ও আপনার ওপার বাংলার বন্ধু-কবি শৌভিকদে সরকারের যৌথ কাব্য। এ ধরনের গ্রন্থ করার ভাবনা কেন? এর দ্বারা কি পাঠক কোনা উপকৃত হয়? মামুন মুস্তাফা : ভাল প্রশ্ন। আসলে নয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি আবুবকর সিদ্দিক এবং আমাদের এ কাব্যের ভূমিকার লেখক ওপার বাংলার কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর যৌথ কাব্য ‘নিজস্ব এই মাতৃভাষায়’ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমত আমরা দুই বন্ধু অগ্রজদের এ ধরনের কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হই। বেশ ক’বছর ধরে আমাদের এই পরিকল্পনা চলছিল। এক পর্যায়ে অনুজ কবি ও উত্তর শিলালিপির প্রকাশক অরুনাভ রাহারায় এগিয়ে এলো বইটি করার জন্যে।

তখন আমাদের ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় এ বিষয়টিও উঠে এলো যে, কীভাবে বইটিকে পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়। এ জন্যে বইটিকে খুব সাধারণ আঙ্গিকে কম খরচে প্রকাশ করা হয় যাতে দামটা কম রাখা যায়। সাধারণত কলকাতার বই আমাদের দেশে ব্যাপক হারে এলেও আমাদের বই সেভাবে ওদের ওখানে যায় না। সেই বিবেচনায় এ ধরনের বই করার একটা কারণও বটে। তবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান সময়ের তরুণ কবি ও প্রকাশকরা উভয় দেশের সাহিত্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। ‘ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র’ আমাদের এই যৌথ কাব্যটি কলকাতার পাশাপাশি আমাদের এখানেও বেশ চলেছিল। মূলত দুটি একুশের বইমেলায় আমি এখানে এনেছিলাম। যেটুকু এনেছিলাম সব বিক্রি হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে লাভ-লোকসানের চেয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছেছে এটাই বড় স্বস্তি। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এর ভূমিকা যেমন লিখেছেন ওপারের কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, তেমনি এর প্রচ্ছদ করেছেন আমাদের তরুণ চিত্রশিল্পী আইয়ুব আল আমিন। আর বাংলাদেশে এ বইটির পরিবেশক ‘বেহুলাবাংলা’। আমাদের চেষ্টা ছিল উভয় বাংলার অংশগ্রহণ সমভাবে ঘটুক। সবশেষে বলবো এ কাব্যের নামকরণ (ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র) নির্ধারণ করতে আমি ও আমার বন্ধু শৌভিক রাত ২.৩০ মি. পর্যন্ত ফেসবুকে সময় কাটিয়েছি। এর পরে গিয়ে চূড়ান্ত হলো আমাদের যৌথ কাব্যের নাম হবে ‘ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র‘।

বঙ্গ রাখাল : আপনার তিনটি গদ্যগ্রন্থও রয়েছে। কবিতার পাশাপাশি গদ্যও আপনি সমভাবেই লিখছেন। কবিতা এবং গদ্য দুটোতেই কি আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

মামুন মুস্তাফা : হ্যাঁ আমার তিনটি গদ্যগ্রন্থও রয়েছে- ‘এই বদ্বীপের কবিতাকৃতি’, ‘মননের লেখমালা’ ও ‘অন্য আলোর রেখা’। আমার কবিতার মতো গদ্যগ্রন্থগুলোও বিষয়ের তারতম্যে ভিন্ন। প্রথমটি বাংলাদেশের কবি ও কবিতা সম্পর্কে; দ্বিতীয়টি সমাজ, স্বদেশ ও সংস্কৃতি নিয়ে; এবং তৃতীয়টি প্রকৃতি ও কয়েকটি মুক্তগদ্যর সমন্বয়ে রচিত। মূলত লেখালেখির শুরুতে অগ্রজদের আহ্বানে কিছু কিছু গদ্য লিখতে হয়েছিল। পরবর্তীতে দেখলাম গদ্যভাষা মোটামুটি আয়ত্ত্বের মধ্যে এসেছে। হয়তো পারি বলে ‘কালি ও কলম’-এর মতো পত্রিকাও আমাকে চিঠি দিয়ে গদ্য লিখিয়েছে। তাই এখনো গদ্য লিখে চলেছি। তবে কবিতাই আমার আরাধ্য।

বঙ্গ রাখাল : প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে সেখানে কী আপনার কবিসত্তা প্রভাব ফেলে, নাকি প্রাবন্ধিক আর কবি- দুজন আলাদা আলাদা ব্যক্তি হয়ে ওঠে লেখার সময়।

মামুন মুস্তাফা : প্রবন্ধের ফর্মটাই ভিন্ন। তবে মুক্তগদ্য লিখতে গিয়ে কবিসত্তার প্রভাব পড়েছে বলে মনে করি। কিন্তু যে-কয়টি প্রবন্ধ লিখেছি তার অধিকাংশই সাহিত্যনির্ভর- কবি-লেখক ও তাদের বই; আবার স্বদেশ-সংস্কৃতিমূলক, ফলে সেখানে কবিসত্তাকে প্রশ্রয় দিইনি মোটেই।

বঙ্গ রাখাল : কবিতা লিখতে লিখতে আবার প্রবন্ধ লিখতে কেন আসলেন নাকি কবিতায় যা বলা হয়নি তাই প্রকাশ করার জন্য প্রবন্ধ দরকারি?

মামুন মুস্তাফা : আমি মনে করি না যে, কবিতায় না বলা কথা প্রবন্ধে বলা সম্ভব। কেননা দুটির ফর্ম যেমন ভিন্ন, তেমনি প্রবন্ধ হলো কোনো বিষয়ের নিরেট ও নির্মোহ বিশ্লেষণ। অন্যদিকে কবিতা মূলত গীতিকার‌্য। সেখানে সমাজ-সংসারের যাবতীয় রূপবৈচিত্র্য ফুটে ওঠে। মূলত লেখালিখির শুরুতে যা হয় আর কি- অগ্রজরা ধরিয়ে দিতেন নানা গ্রন্থ। পত্রিকার জন্যে লিখতে হতো তার পাঠ আলোচনা। যা এখনকার তরুণরাও করে থাকে। যা হোক, সে কাজটি করতে গিয়ে এক সময় গদ্যভাষায় কিছুটা স্বকীয়তা অর্জন করেছি বলে মনে হয়। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন দৈনিক, ছোটকাগজ এবং সাময়িকী থেকে গদ্য লেখার অনুরোধ, আহ্বান আসতে থাকে। আর এ কথাও তো ঠিক, যে,আমাদের বাংলাদেশে গদ্য লিখিয়েদের সংখ্যাও খুব একটা বেশি নয়। এভাবেই প্রবন্ধের প্রতি ঝুঁকে পড়ি।

বঙ্গ রাখাল : এ প্রসঙ্গে বলতে হয় কবিতা, প্রবন্ধর পাশাপাশি গল্প কেন লিখছেন না? মামুন মুস্তাফা : গল্প যে লিখিনি তা নয়, দু’চারটি এদিক-সেদিক প্রকাশও হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র দুটি গল্পকে আমার নিজের কাছেই মনে হয়েছে গল্প- একটি, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘এই মহানগরে’ এবং অন্যটি আমার সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘লেখমালা’য় প্রকাশিত ‘স্বপ্ন-মৃত্যুর হাতছানি’। তবে গল্প লিখছি, কিন্তু নিজের কাছেই তা যথাযথ না মনে হওয়া পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখবে না।

বঙ্গ রাখাল : ‘লেখমালা’ আপনার সম্পাদিত ছোটকাগজ। খুব অল্প সময়েই বিষয় ও নিরীক্ষায় কাগজটি পাঠক-লেখকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে। প্রশ্ন হলো সাহিত্য সাধনার শুরুতে না এসে মাঝপথে কেন ছোটকাগজ সম্পাদনায় এলেন?

মামুন মুস্তাফা : একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রথমেই বলতে হয় আমার বন্ধু-কবি ও ‘শালুক’ সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ এ চিন্তাটা মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এরপর আমার আরেক সজ্জন-বন্ধু প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ও ছোটকাগজ ‘চিহ্ন’র সম্পাদক শহীদ ইকবালের সংস্পর্শ আমাকে তাড়িত করে সম্পাদনায় আসার ক্ষেত্রে। তবে ওদের মতো নানামাত্রিক ঢাউস আকারের ছোটকাগজ করার সামর্থ্য আমার নেই। আমি খুব ছোট কলেবরে শুরু করি, শুধু বিষয়ের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করি মাত্র।

বঙ্গ রাখাল : আপনার ছোটকাগজ ‘লেখমালা’র মাধ্যমে আপনি ইতোপূর্বে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনের ব্যক্তিত্বদের সম্মাননা জানিয়েছেন। এ সম্পর্কে বিশদ জানতে চাই।

মামুন মুস্তাফা : আমার সামর্থ্য সীমিত। কেননা ‘লেখমালা’ প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করার মতো যোগাযোগ আমার নেই-ও; আবার কাউকে যে বলবো সেই যোগ্যতা, ক্ষমতা এবং ইচ্ছা আমার নেই। হয়তো তোমাকে একবার বললাম। তুমি হয়তো সাড়া দিলে না। দ্বিতীয়বার আর তোমাকে স্মরণ করাবো না। আমি মনে করি, এটি তোমাকে বিব্রত এবং বিরক্ত করা। ফলে গাঁটের পয়সা খরচ করে ঢাউস আকারের ছোটকাগজ যেমন প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তেমনি বছরে একটির বেশি ছোটকাগজ বের করাও অসম্ভব। সেই বিবেচনায় ছোটকাজ সম্পাদনার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে চিন্তা করে দেখলাম যারা প্রকৃতই সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন, বর্তমান হুজুগে সময়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি, তাদের সম্মাননা জানানো নিষ্ঠ সাহিত্যচর্চার অংশ বলে মনে করি। আর তাই দু’বার একজন সৃজনশীল সাহিত্যে এবং একজন ছোটকাগজ সম্পাদককে ‘লেখমালা’র মাধ্যমে সম্মাননা জানিয়েছি।

এখানে বলা আবশ্যক মনে করছি, আমার সম্পাদিত ছোটকাগজ লেখমালা’য় প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের আধিক্য ঘটবে বেশি। লক্ষ করলে দেখবে অগ্রজদের লেখা খুব কমই স্থান পেয়েছে। সাধারণত বিষয়ের কারণে সাত ও আটের দশকের কেউ কেউ স্থান পেয়েছেন, কিন্তু তার পরিমাণ কম।

বঙ্গ রাখাল : আমরা জানি আপনি একটি দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করছেন। আবার একই সঙ্গে ওই দৈনিকের সাহিত্যপাতাও দেখছেন। দৈনিকের সাগিত্যপাতা আর ছোটকাগজ- দুটি দুই দর্শনের বিষয়। এই দুই সত্তার সঙ্গে নিজেকে কীভাবে সমীকৃত করলেন।

মামুন মুস্তাফা : ভালই বলেছ। প্রথম বলবো- একটি হচ্ছে চাকরি, আরেকটি হচ্ছে নিজের কমিটমেন্টের জায়গা, নিজস্ব ভাবনাচিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্র। সুতরাং কমিটমেন্টের জায়গায় কোনো আপস নেই। কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের অনেক অনুরোধ, আদেশ-নিষেধ মানতে হয়, কোনোটা ফিরিয়েও দেই। তবে সেসব দৈনিক কাগজের স্বার্থেই। কিন্তু ‘লেখমালা’য় সে-সবের সুযোগ নেই। ছোটকাগজে বন্ধুতা থাকবে, কিন্তু দর্শনের জায়গায় শর্তগুলো পূরণ করে নিতে হবে।

বঙ্গ রাখাল : একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আমাদের দেশের অনন্য কবি ও কথাকার আবুবকর সিদ্দিকের সঙ্গে আপনাদের পারিবারিক সম্পর্ক। আবুবকর সিদ্দিক বিভিন্ন সময়ে আপনাকে নিয়ে তার লেখার ভেতরেও বলেছেন। এমনকি শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত তার ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ আপনাকে উৎসর্গ করেছেন। আবুবকর সিদ্দিককে নিয়ে আপনার কি কোনো গ্রন্থ করার পরিকল্পনা আছে। তার সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে আরো কিছু জানতে চাই।

মামুন মুস্তাফা : তোমার এ সাক্ষাতকারের শুরুতে আবুবকর সিদ্দিক সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছি। আবারও বলি আমার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে তার ভূমিকা অনেক। কবিতা কেমন হওয়া উচিত, গদ্যসাহিত্য কি, কার কার লেখা পড়তে হবে ইত্যাদি উপদেশ দিয়ে তিনি কবি মামুন মুস্তাফার ভেতরের সত্তাটিকে তৈরি করে দিয়েছেন। আমার পিতার ব্যক্তিত্ব এবং তার বন্ধু-কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাহিত্যের প্রতি একনিষ্ঠতা আমাকে সৎ ও প্রকৃত সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের স্ট্যান্টবাজি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আবুবকর সিদ্দিকের মতো একনিষ্ঠ পাঠকও আমার চোখে পড়েনি। তিরিশের অন্যতম প্রধান কবি বিষ্ণু দের সঙ্গে তার সখ্য, চিঠির আদান-প্রদান, আবুবকর সিদ্দিককে বিষ্ণু দে-র কাব্য উৎসর্গ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুতা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসু; এদেশে সিকানদার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান- এঁদের সঙ্গে তার কথোপকথনের বিষয় ও আড্ডা কবি আবুবকর সিদ্দিকের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এসব প্রথিতযশাদের ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আমার ভেতরের প্রকৃত সাহিত্যিক সত্তাকে প্রতিষ্ঠা দানে সহায়তা করেছে। আবুবকর সিদ্দিক মনের দিক থেকে শিশুসুলভ। তাই তিনি শাদাকে শাদা, কালোকে কালো বলতে দ্বিধা করেননি। আর এ জন্যই বোধহয় আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিবিধজন তাঁর কবিত্বশক্তিকে কিংবা শক্তিমান কথাকার হিশেবে তাঁকে অনুধাবন করলেও অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করে নিতে পারেননি। আর পারেননি বলেই আজকের মিডিয়াও তথাকথিত বাজার চলতি লেখকদের পেছনে ছুটে বেড়ায়, আবুবকর সিদ্দিকের মতো জাত কবি ও লেখককে তারা খুঁজে পায় না। এটা আমাদের সাহিত্যের জন্যেই ক্ষতি। এমনকি রাষ্ট্রও অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ হয়ে যাওয়ায় আুববকর সিদ্দিকের ভাগ্যে জোটেনি একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পদক। আমি মনে করি, জাতি হিশেবে এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমি আবুবকর সিদ্দিকের কবিতা, গল্প নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। সেগুলোকে একত্র করে এবং আরো নতুন কিছু বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটিয়ে তার ওপর একক একটি গ্রন্থ প্রকাশের ইচ্ছা আছে। কতটুকু পারবো তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।

বঙ্গ রাখাল : পুরস্কার-সম্মাননার বিষয়টি যখন এলো, তখন জানতে ইচ্ছে করছে- আপনি কি কোনো পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন। মামুন মুস্তাফা : যে কোনো স্বীকৃতি লেখককে উৎসাহিত করে, তার কমিটমেন্টকে বাড়িয়ে দেয়। আজকাল রাষ্ট্রের বাইরেও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কিছু পুরস্কার, সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। আবার বিভিন্ন ছোটকাগজও সম্মাননা দিয়ে থাকে। কিন্তু এগুলো প্রায় সবই (দু’একটি ব্যতিক্রম) যোগাযোগ, ব্যক্তিস্বার্থ এবং রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এটি এখন সাহিত্যে নোবেল প্রদানেও কমবেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে সেখানে রাজনীতি বেশি সক্রিয়। তারপরও বলবো কিছু কমিটেট সাহিত্যিকরা স্বীকৃতি পাক, এটাই কাম্য।

আমি ছোটকাগজ চিহ্নর সম্মাননা পেয়েছিলাম ২০১১ সালে। এর বাইরে যে দু’একটি অর্জন করেছি- সেগুলো বন্ধুত্বের স্মারক চিহ্ন। ওগুলোকে আমি সাহিত্যকৃতির জন্যে স্বীকৃতি বলবো না।

বঙ্গ রাখাল : আপনি মূলত কবি। নিজেকে কবিতার সেবাদাস বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। বেশ ক’বছর আগে দৈনিক ইত্তেফাকে কবিতাভাবনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এমনটাই বলেছিলেন। তাই সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইবো যে, কলকাতা ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতার মূল্যায়ন কীভাবে করবেন।

মামুন মুস্তাফা : এ কথা সত্য, আমি কবিতার সেবাদাস, একজন কবিতাকর্মী। দেখ, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ ভূ-প্রকৃতিগত ভাবে বলা চলে একই। এর সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ, এমনকি রাজনীতিও একই ঢঙে পরিচালিত। ফলে মানুষের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই মিলে যায়। সুতরাং দুই বাংলার সাম্প্রতিক কবিতার কাব্যভাষার মধ্যে পার্থক্য খুব একটা করা যাবে না। তবে কবির চিন্তার দর্শন, ভাবগত বোধ অবশ্যই পৃথক হবে এবং এর প্রকাশও হবে ভিন্ন। কিন্তু কবিতার আধুনিকতা ও আন্তর্জাতিকতা সমভাবেই এক। তবে হ্যাঁ, ওদের কবিদের পঠন-পাঠন এখনো আমাদের থেকে উন্নত। আমরা যারা লিখছি, অধিকাংশই পাঠাভ্যাসটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না, আমাদের নিজেদের আত্মসমালোচনা ও নিরীক্ষার জায়গাটিকে করে রেখেছি সীমিত। সাহিত্যে বড় কিছু অর্জন করতে গেলে সৎ ও নিষ্ঠ সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আত্মসমালোচনা জরুরি। এই দৈন্য কাটিয়ে উঠতে না পারলে আমাদের কবিতা ওদের থেকে পিছিয়ে পড়বে ক্রমশই। আমি আশা করি, আমাদের সাম্প্রতিক কবিরা এই দীনতা কাটিয়ে উঠবেন সহসাই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড