• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

জাদুকর হুমায়ূন

  মাহফুজা মতি জেরিন

২২ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:৫৯
ছবি
ছবি : বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ুন আহমেদ গল্প বলার এক দুর্লভ সম্মোহনী শক্তির সত্তা। গল্প বলায় জাদুকরি এই শক্তির প্রয়োগই তাকে এনে দিয়েছে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তার গালিচা, যাতে চড়ে অতি দ্রুত খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গেছেন তিনি। কথাসাহিত্যের গতানুগতিক ধারা অতিক্রম করে স্বতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠা করেন হুমায়ুন আহমেদ। কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার বিস্তার, রসাত্মকতার সন্নিবেশ, বৈচিত্র্যময় চরিত্র চিত্রায়ন, বর্ণনায় পরিমিতিবোধ এবং সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি তার লেখায় এনে দেয় আলাদা ব্যঞ্জনা। তাই বোধহয় জনপ্রিয় থেকে জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হয়ে উঠতে সময় লাগেনি।

স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ এই কথাসাহিত্যিক তার লেখার জালে আবদ্ধ করেছেন কোটি হৃদয়। অমন নিরাভরণ, অতি প্রাঞ্জল, পরিমার্জিত, শীলিত, সাবলীল, সহজ, প্রাণবন্ত, ঝরঝরে ভাষার লেখনী কোথায় পাওয়া যায়? কয়জনের আছে এই পাণ্ডিত্য? একজন সাধারণ পাঠকের তার লেখা পড়ে যেমন দুর্বোধ্য লাগবে না তেমনি উচ্চশিক্ষিত কেউ বা কোনো সাহিত্য বিশারদও অতৃপ্ত হবে না। বরং সব শ্রেণীর পাঠককে পাঠানন্দ দিতে ও তাদের সাহিত্য তৃষ্ণা মেটাতে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য নাম- হুমায়ুন আহমেদ। সব ধরণের পাঠকেরই দেখা হয় ঐ এক সাঁকোয়। হুমায়ুন সাহিত্য সাঁকো। হুমায়ুন আহমেদের রচনায় কি এমন আছে যে তা এইভাবে মোহান্বিত করে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত সব পাঠক ভাষায় দিতে পারবে না, কিন্তু এমন কিছু তো আছে যা জাদুর মত টানে। কত পাঠক যে তার লেখার জাদুতে আটকে আছে তার হিসেব কষা ভার । আমার জন্য প্রথম জাদুমন্ত্র ছিল হিমু সিরিজের একটি উপন্যাস। যেটির মাধ্যমে সাহিত্য জগতে হুমায়ুন আহমেদের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে যে বইয়ের প্রচ্ছদেই ‘হুমায়ুন আহমেদ’ নামটি দেখেছি, জাদুর মত তা আমাকে টেনেছে। পাঠ্যবই কিনতে লাইব্রেরিতে গেলেও তাঁর বই হাতের নাগালে থাকলে দু’লাইন পড়ে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। বিভিন্ন কারণে তখন খুব একটা গল্প উপন্যাসের বই কিনে পড়াটা সম্ভব হতো না। আমি যে সময় তাঁর লেখার সাথে পরিচিত হই তখন ইন্টারনেটও আমাদের মতো স্টুডেন্টদের কাছে সহজলভ্য ছিল না। মাঝে-মাঝেই তাঁর বইয়ের নেশা চাড়া দিয়ে উঠত।

একদিন আমার স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাইকে দায়িত্ব দিলাম ওর স্কুল লাইব্রেরি থেকে হুমায়ুন আহমেদের বই নিয়ে আসতে। ভাই আমার বই ঠিকই নিয়ে এলো, তবে দুঃখিত স্বরে জানালো- ছোটদের নিয়ে লেখা একটি গল্পের বই পেয়েছে। ঐ যে বললাম প্রচ্ছদে ‘হুমায়ুন আহমেদ’ নামটি থাকলেই হলো। আমি ঐ ছোটদের বইতেই ঝপাং করে লাফ দিলাম। আর এক ডুবেই তলিয়ে গেলাম শেষ অবধি। লেখক আমার কেন এত প্রিয় তার মাঝারি সাইজের একটি লেকচার আমার কাছে শোনার পর ভাইও আকৃষ্ট হয়। বই পড়ে। হয় জাদুগ্রস্ত। ক’দিন পর দেখি সে ‘ফিহা সমীকরণ’(সায়েন্স ফিকশন) নিয়ে হাজির। ‘ফিহা সমীকরণ’ এর উপরও দু’জনে একের পর এক ঝপাং। তারপর বই বিনা আমরা জাদুগ্রস্ত দু’ভাইবোন ‘মনের দুঃখ মনে রইল রে’ করে বসে থাকি।

কখনো-সখেনো দু’একটা পেয়ে গেলেই পড়া হয়ে যেতো। এক সময় প্রযুক্তির প্রসারে বই পড়া সহজ হয়ে যায়। কয়েক বছর পর ভাই মাধ্যমিকের শেষে শহরের কলেজে ভর্তি হয়। সে তখন হাতে পায় অ্যানড্রয়েড ফোন। আর জাদুর রেশে শুরু হয় মোবাইলে একটার পর একটা হুমায়ুন আহমেদের হাতের সুধা পান। শীঘ্রই সে সুধা পানে সেঞ্চুরি পার করে। আর তার ফলাফল স্বরূপ মার্কেট ঘুরে আমাকে কিনতে হয় হিমু রং পাঞ্জাবি। কিছুদিন পর তার টাইমলাইনে দেখি, দরদী ভাই মধ্যরাতে হলুদ পাঞ্জাবি পরে রাস্তায়। বুঝি, ভাইয়ের অবস্থা আমার চেয়েও বেগতিক। তার কথা-বার্তা ও কাজেও লেখকের অনুসরণ চলে বেশ। গ্রীষ্মের একদিনে মা হাঁসের মাংস রান্না করলে তার উচ্চারণ- ‘হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন- হাঁসের মাংস খেতে হয় শীতকালে।’

বুঝুন অবস্থা। আমার কিঞ্চিৎ সন্দেহ- তার নামটা ‘হুসাইন আল সাদী’ না হয়ে ‘হুমায়ূন আল সাদী’ হলে সে বেশি খুশি হতো। সে তো গেল আমাদের দু’ভাইবোনের কাহিনী। এরকম হাজারও মানুষ পাওয়া যাবে; এখনও যাদের পাঠক হৃদয় হু হু করে কাঁদে, হুমায়ুন আহমেদের শূন্যতা যারা কিছু দিয়েই কাটিয়ে উঠতে পারেনি, যারা তার পুরাতন বইগুলোই বারবার বারবার পড়ে- সেই চেনা লেখার গন্ধ, চেনা স্বাদ আর দুর্লভ সেই তৃপ্তির আশায়। তার লেখার অনুপম বৈশিষ্ট্য-ই তাঁকে এমন মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। সহজ ও সংক্ষিপ্ত কিন্তু ভাবের ব্যাপকতা প্রকাশ, এই বৈশিষ্ট্যই তার লেখাকে প্রদীপ্ত করেছে। ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। উপন্যাসটি যেহেতু কেন্দ্রীয় চরিত্র খোকার আত্মকথায় রচিত তাই খোকার কথায় রাবেয়ার মৃত্যুর ব্যাপারটি এভাবে উপস্থাপিত হয়- ‘বেলা ন’টায় চুপচাপ মরে গেল রাবেয়া তখন চারদিকে শীতের ভোরের কী ঝকঝকে আলো।’ মৃত্যুর বর্ণনাও যে এত সংক্ষেপÍ হতে পারে তা হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসেই প্রথম দেখা যায়। এত সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও পাঠকের চোখ ভিজিয়ে দেয়, এর জন্য আলাদা করে নানান আবেগি বাক্য সাজাতে হয় না। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো যেন এমনিই কখন নিঃশব্দ মায়া সৃষ্টি করে।

হুমায়ুন আহমেদের লেখার সাহিত্যমান নিয়ে যারা কথা তুলেন সেসব সমালোচকরা তাদের অতি উচ্চ মানের লেখা ও সীমাহীন জ্ঞান-গরিমা নিয়ে কিন্তু আজও ধোঁয়াশা-ই থেকে গেছেন। অথচ হুমায়ুন আহমেদ সহস্রর পাঠকের অন্তরে এখনও লুব্ধকের মত জ্বলছেন। ঝুপড়ি থেকে শুরু করে মহামান্যদের বুকশেলফে থাকে তার বই। মর্যাদার যে চূড়ায় তিনি আছেন, সমালোচকের সমালোচনা তাকে তা থেকে এতটুকু স্থানচ্যুত করতে পারবে না। বাংলা সাহিত্যে তার সুনাম, তার বৈভব, তার প্রতাপ থাকবে অবিকল। এখানে প্রমথ চৌধুরীর একটি কথা বলতে চাই- ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়।’

হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকে তাঁকে ‘নগণ্য লেখক’, ‘বাজারি লেখক’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। হুমায়ুন আহমেদ তার ‘ফাউন্টেনপেন’ (২০১১) আত্মজীবনীমূলক রচনায় এর যথাযথ জবাব দিয়েছেন- বাজারি লেখক মানে তুচ্ছ লেখক। তেল-সাবান-পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেই বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয় যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধির লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাদের বেশিরভাগের ধারণা, তারা কালজয় করে ফেলেছেন। এরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালবাসেন।.... কালজয়ী এইসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। এমন একজনের সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা- কালজয়ী : কেমন আছেন? আমি: জি ভালো। কালজয়ী: ইদানিং কিছু কি লিখছেন? আমি: একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি। কালজয়ী: (গম্ভীর) আমি: আপনি কি মহান কোনো লেখায় হাত দিয়েছেন? কালজয়ী: আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে।’ হুমায়ূন আহমেদের এমন জবাবের পর আলাদা করে আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না।

মানুষের ট্যালিপ্যাথিক ক্ষমতার কথা হুমায়ূন আহমেদ তার অনেক বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি বুঝি তার লেখার প্রতিটি লাইনকে এই ট্যালিপ্যাথিক ক্ষমতায় মানুষকে ডাকার পদ্ধতি শিখিয়ে গেছেন। তা না হলে তার বইয়ে এত মুগ্ধতা কেন আসবে? এত রোমাঞ্চকরও তো লাগে কারও বই। তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়- এই জায়গায় এই শব্দটাই পারফেক্ট, এই মূহুর্তটাই মানানসই, এই পরিবেশটাই যেন চিরবাস্তব। তিনি যা-ই লিখেন তা-ই মনে হয় সত্যি। মাতালের মতো, উন্মাদ মৌমাছির মতো যে পাঠকগোষ্ঠী বইমেলায় ছুটে যেত তাদেরও কি একই অনুভূতি? যেন সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ না থাকলে জানাই হতো না সাহিত্য আলাদা একটা পৃথিবীর নাম। যেখানকার মানুষের জায়গায় নিজেকেই কখনো কখনো দেখা যায়। যাদের কান্না, আনন্দ, সুখ, বিরহ,পরিণতি মনের গভীর ছুঁয়ে যায়। বইয়ের পাতায় সাজানো কিছু শব্দ যে এইভাবে শিহরিত করতে পারে , তিনি না থাকলে তা হয়ত বোঝাই হতো না কোনোদিন। সব যেন জাদুর মত। যে জাদুর মন্ত্র শুধু জানতেন অপ্রতিসম, প্রাণের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড