• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রোমাঞ্চকর মৃত্যুভাবনায় ছিলেন সুনীল

  উত্তম দত্ত

১১ নভেম্বর ২০১৯, ১০:১৬
প্রচ্ছদ
ছবি : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও পার্সি বিশি শেলি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল, নিজের জন্য কেমন মৃত্যুদৃশ্য আপনার পছন্দ? উত্তরে সুনীল বলেছিলেন, ‘আমার স্বপ্নের মৃত্যুদৃশ্যটি অন্য এক কবি অনেক আগেই চুরি করে নিয়েছেন।’

কিছু প্রিয় সুখাদ্য, কিছু মহার্ঘ পানীয় আর কয়েকটি মনের মতো বই নিয়ে নিজস্ব নৌকোয় চড়ে মহাসমুদ্রে ভেসে যাওয়া। তারপর ঝড় আসবে। ভেঙেচুরে উলটে যাবে নৌকো। আহা, সে এক স্বপ্নের সলিল-সমাধি। সেই স্বর্গীয় মৃত্যুদৃশ্য বহুদিন আগে চুরি করে নিয়েছেন এক ইংরেজ তরুণ কবি।

সেই কবির নাম শেলি। অক্সফোর্ডের ছাত্র ছিলেন। নাস্তিকতা প্রচারের অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে। সভ্যতার মহাশ্মশানে বসে এক সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন ‘প্রমেথিউস আনবাউন্ডে’র মতো অলোকসামান্য কাব্য-নাটক। এই বইটি আমাকে প্রথম স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল।

জল ছিল তার অত্যন্ত প্রিয়। মাঝে মাঝেই ভেসে পড়তেন সমুদ্রের বুকে। কিছু বই, কিছু পানীয় আর সুখাদ্য নিয়ে। তার প্রিয় সেই বোটের নাম ছিল ‘ডন জুয়ান’। প্রিয় কবি বায়রনের কবিতার নামে নৌকোর নাম রেখেছিলেন তিনি।

১৮২২ সালের ৮ জুলাই এক ভয়ানক সামুদ্রিক ঝড়ে সেই ‘ডন জুয়ান’ ডুবে যায়। এক সপ্তাহ পরে কবির পচা গলা মৃতদেহ পাওয়া যায় সমুদ্রতীরে। তার বয়স তখন তিরিশেরও কম। তার সমাধিফলকে লেখা আছে Cor Cordium, যার অর্থ Soul out of my soul.

অত্যন্ত সুদর্শন শেলি ছিলেন বহু নারীর স্বপ্নের পুরুষ। ইংল্যান্ডের তরুণরাও শেলিকে অনুকরণ করে হাঁটা অভ্যেস করত। তার মত করে কথা বলত, তাকিয়ে থাকত স্বপ্নময় চোখে।

দর্শন ও সাহিত্যে কৃতবিদ্য রূপবান শেলিকে মেয়েরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ভালোবাসত। কিন্তু শেলি কি কখনও কাউকে ভালোবেসেছিলেন? নাকি মহাভারতের তৃতীয় পাণ্ডবের মতো মাত্র তিরিশ বছরের জীবনে বারংবার সরে গেছেন এক নারী থেকে অন্য নারীতে?

১৯ বছর বয়সে এক ধনী হোটেল মালিকের কন্যা হ্যারিয়েটকে বিয়ে করেন তিনি বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। তিন বছর ঘুরে বেড়ালেন ওয়েলস, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডে। ১৮১৪ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। আয়ানথ ও চার্লসকে নিয়ে হ্যারিয়েটকে সরে যেতে হয় শেলির জীবন থেকে।

ততদিনে শেলির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে দার্শনিক গডউইনের কন্যা মেরির। মেরি ও তার বোনকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যান তিনি। ১৮১৬ তে ফিরে আসেন। এরই মধ্যে মেরির অন্য এক বোন ফ্যানি ইমলে শেলিকে না পেয়ে আত্মহত্যা করে। আর ডিসেম্বর মাসে শার্পেনটাইনের জলে ভেসে ওঠে হ্যারিয়েটের মৃতদেহ। সেটাও আত্মহত্যা।

মেরিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করে বাকিংহামশায়ারের মার্লোতে সংসার পাতেন তিনি। সেইসময় তার যক্ষ্মারোগ ধরা পড়ে। মেরি ও শিশুপুত্র উইলিয়মকে সেখানে রেখে শেলি ইটালিতে গেলেন চিকিৎসার জন্য। সেখানে আলাপ হল কবি কিটসের সঙ্গে।

একই সময়ে পরিচয় ঘটল অসামান্য ইতালিয় সুন্দরী এমিলিয়ার সঙ্গে। আবেগপ্রবণ শেলি এমিলিয়াকে নিয়ে রচনা করলেন সেই আশ্চর্য শাশ্বত রোমান্টিক কবিতা Epipsychidion.. এর অর্থ : প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলন।

এমিলিয়াকে অমর করে রাখলেন তিনি, এই কবিতায় soul's sister নামে, যা থেকে জীবনানন্দ দাশ ‘ক্যাম্পে’ কবিতায় ব্যবহার করেছেন ‘তাহাদের হৃদয়ের বোন’ শব্দবন্ধটি।

ইতোমধ্যে এক বন্ধুপত্নী জেন উইলিয়মসকে নিয়ে চারটি বিখ্যাত কবিতা রচনা করেছেন তিনি : The Indian serenade, To Jane, The recollection, One word is too often Profancd..

জেন এমিলিয়ার মত সুন্দরী ছিলেন না। বরং শরীরী ছিলেন। অথচ সৌন্দর্যবোধই এই কবিতাগুলির প্রাণ।

শেলির অকালমৃত্যুর কথা যখন ভাবি, তখন আমার কেবলই মনে হয়, ভয়ংকর সামুদ্রিক ঝড়ে তার নৌকো যখন টলোমলো, মৃত্যু যখন অনিবার্য, সেই মুহূর্তে কার মুখ ভেসে উঠেছিল কবির মনে?

তাকে ঘিরে একের পর এক নারীর মৃত্যু, হতাশা, আত্মহত্যা আর উন্মাদনাকে কী চোখে দেখতেন তিনি? কখনও কি আত্ম-অনুশোচনা কিংবা বিবেকদংশনে গোপনে দগ্ধ হননি তিনি? একজন সংবেদনশীল কবি কি কখনও এতখানি উদাসীন থাকতে পারেন একদা প্রিয় নারীদের দহন ও মৃত্যুতে? বিশ্বাস হয় না আমার। আমার ধারণা, তিনিও পুড়েছেন আজীবন, আমৃত্যু।

এইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে একদিন লিখেছিলাম এই কবিতাটি। ‘বর্ণমালার দিব্যি’ কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাটি রয়েছে, সেকথা আমার প্রিয় পাঠকেরা সবাই জানেন।

কবিতাটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ বিকেলে শিলিগুড়ি থেকে লেখা সুমনের একটি চমৎকার চিঠি পেয়ে (কতদিন পরে কারো কাছ থেকে ব্যক্তিগত চিঠি পেলাম) এই কবিতাটি লেখার সময়কার নানা লুপ্ত স্মৃতি জেগে উঠল। Suman Mallick (কবি সুমন মল্লিক)

কবির মৃত্যু : একটি স্বপ্নের সমাধি

(কবি শেলির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য )

টাইরেনিয়ান সমুদ্রে ঝড় উঠেছে হ্যারিয়েট মাথার উপরে কালো মেঘ, বিদ্যুতের শিখা আমার বোটের নিচে তোমার চোখের মতো নীল ঢেউ সমুদ্রের গর্জনে আমি শুনতে পাচ্ছি তোমার ভয়ংকর অট্টহাসি আমি জানি, আমার অসহায় স্কুনারের শিকড় আঁকড়ে ধরেছে তোমার মৃত দুই হাত তোমার গর্ভের মৃত শিশুটিও আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে ।

আমার মানব-জন্ম ধূসর, আমি কাউকে সুখী করতে পারিনি আমার প্রেমিক-জন্ম ব্যর্থ, আমি কোনও নারীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকিনি আমার পুত্র–জন্ম এক পরিহাস, জন্মদাতা ঈশ্বরও আমাকে ঘৃণা করেন আমার পিতৃ-জন্ম নিরর্থক, আমি গ্রহণ করিনি কোনো সন্তানের দায়ভার ভালোবেসে চুম্বন করি নি কোনো শিশুকে ।

হ্যারিয়েট, ভালোবাসার জন্য আমি জীবন বাজি রেখেছি বারবার অগ্রাহ্য করেছি বৈভবের মোহ, পুড়েছি যত, পুড়িয়েছি তারও বেশি সম্মিলিত সমস্ত আগুন, সমস্ত নারীর দীর্ঘশ্বাস, আমাকে ঘিরেছে আজ ।

মহামান্য প্লেটো, আপনার দর্শন আজ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না স্যার গডুইন, আপনার নাবালিকা কন্যাকে ফুসলে নিয়ে গেছি বলে আপনি এখনো আমাকে ঘৃণা করেন, আমি জানি, বজ্রের গর্জনে আমি শুনতে পাচ্ছি আপনার ধিক্কার, সিসিলি আর সার্ডিনিয়া থেকে উড়ে আসা মেঘ প্রতিটি বৃষ্টি-বিন্দুতে থুতু ছিটিয়ে বলছে : ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ ....

তুমি কোথায় ফ্যানি? কোন অন্ধকারে বসে তুমি অলীক স্বপ্নের জাল বুনছো? এমিলিয়া তুমি কোথায়? তোমার সঙ্গে আমার প্রবাল-দ্বীপে যাবার কথা ছিল... সমুদ্রের দেবতা জানে, আমি সাঁতার জানি না। আমার ‘ডন-জুয়ান’ জানে, আমি সমুদ্রকে ভালোবাসি, হ্যারিয়েট, কোনো নারীর কাছে আমি আত্মসমর্পণ করি নি আজীবন নারী-ই আমাকে অনুসরণ করেছে, সম্মোহিতের মতো।

এখন আমার নৌকোয় লাফিয়ে উঠছে সমুদ্রের নোনা জল অসংখ্য নারীর অশ্রুর মধ্যে আমার স্বেচ্ছা-মৃত্যু আজ অনিবার্য আমি আশৈশব মানুষের মুক্তি চেয়েছি খুলে ফেলতে চেয়েছি ব্যক্তিগত সোনার শৃঙ্খলও আমি আজীবন স্বপ্ন দেখেছি এক পাপমুক্ত পৃথিবীর আর অসংখ্য দুর্মর পাপের শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী হয়ে গেছি।

হ্যারিয়েট, মৃত্যুকে আমি আর ভয় পাই না খোলা আকাশের নিচে, ভরা বর্ষার যুবতী সমুদ্রের বুকে শুয়ে ঝড়ের রাত্রিতে, বৃষ্টির ধ্রুপদী নাচ দেখতে দেখতে এমন অলোকসামান্য মৃত্যুর ছবি-ই তো আঁকতে চেয়েছি আমরণ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড