• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শিশুতোষ

গল্প : যুদ্ধ জয়ের গল্প

  মুহাম্মদ বরকত আলী

১৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:৪২
গল্প
ছবি : প্রতীকী

আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। আনন্দের দিন। উৎসবের দিন। তোপ ধ্বনি দিয়ে শুরু হয় এই মহান দিনটি। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা বাঙ্গালিদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তারপর থেকেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করা হয়।

সকালবেলা স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় শহিদদের প্রতি। স্মৃতিসৌধ হলো শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাবার জন্য স্তম্ভের নাম। ঢাকা সাভারের নবীনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ অবস্থিত। মহান বিজয় দিবস আমাদের উৎসবের দিন। এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় সকল শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রতিটা জেলা স্টেডিয়াম মাঠে শরীর চর্চা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। সারি বদ্ধ হয়ে প্যারেড করে।

মুক্তি যুদ্ধের নাটক প্রদর্শন কারা হয়। শরীর চর্চার মাধ্যমে বিভিন্ন খেলাধুলা করা হয়। মনা, বিপুল ও রিমা ওরা তিন বন্ধু। ওরা তিনজন একই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তিন বন্ধু মিলে আজ সকালবেলা স্টেডিয়ামে এসেছে। ওদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা। লাল সবুজের পতাকা। সেই পতাকা বাতাসে পতপত করে উড়ছে। একেই বলে স্বাধীনতা। অনুষ্ঠান এখনো শেষ হয়নি। সেই সকালবেলা বাড়ি থেকে বের হয়েছে ওরা তিন বন্ধু। সকালে হালকা নাস্তা করে বের হয়েছে। খিদেয় পেটটা চোঁ চোঁ করছে। বাড়ি থেকে নিষেধ করে দিয়েছে বাইরের খোলা খাবার যেন না খায়। আর কতক্ষণ? দুপুর গড়িয়ে এলো। মনা পেটে হাত দিয়ে মুখটা শুকনো করে বলল, ‘বিপুল, আর পারছি না। চল এবার যাই।’ রিমা বলল, ‘দাওয়াত খেতে হলে সময় মত যেতে হয়। যেকোনো সময় গেলে চলে?’

আজ ওদের তিনজনের দাওয়াত আছে। দুইটা দাওয়াত। একটা হলো দুপুরে পোলও মাংস খাওয়ার, আর একটা হলো স্যারের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা। সিরাজুল ইসলাম স্যার ওদের স্কুলের বাংলা শিক্ষক। সিরাজুল স্যার মনা, বিপুল ও রিমাকে খুব ভালোবাসেন। ওরা পড়া লেখায় যেমন ভালো, ঠিক তেমন ব্যবহারেও ভালো। তাই স্যার, ম্যাম সবাই ওদের খুব আদর করেন।

কিছুক্ষণ একে অপরের হাত ধরে টান দিয়ে বলল, ‘চল, এখনি যাই।’ স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে এলো। স্টেডিয়াম থেকে স্যারের বাসা বেশি দূরে না। স্যারের বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে লাগল। স্যারের বাড়ির গেট পেরিয়ে এসে দাঁড়ালো উঠোনে। আনন্দে নেচে উঠল তিনজন। ‘এত সুন্দর করে বাড়িটা সাজিয়েছে স্যার?’ রিমা বলল।

গতকাল ওরাই এই রঙ্গিন কাগজগুলো কেটে দিয়েছিল। সেগুলো দিয়েই স্যার এত সুন্দর করে সাজিয়েছেন। উঠানের মাঝখানে একটা লম্বা বাঁশ খাড়া করে উপরের প্রান্তে দড়িগুচ্ছ বেঁধে দড়ির অন্য প্রান্ত গুলো চারিদিকে ছড়িয়ে বেধে দিয়েছে। দড়িতে নানা রঙ্গের কাগজের ফুল আঠা দিয়ে লাগানো। সিঁড়ি ঘরের সামনে একটা পতাকা টাঙানো হয়েছে। অনেক উপরে। বেশ বড় পতাকা। ঠিক স্কুলের পতাকাটার সমান। মৃদু বাতাসে উড়ছে। পতাকার পাশ কেটে কিছু সাদা কবুতর উড়ে গেল। কবুতর শান্তির প্রতীক। স্বাধীন ভাবে আকাশে উড়ছে। স্যার রুম থেকে বের হয়ে এলেন। ‘তোমরা এসে গেছো? খুব ভালো করেছো। এসো এসো।’ স্যার বললেন। স্যারের সাথে একটা রুমে গিয়ে বসল ওরা। ঘরের ভিতরেও যেন ছোট্ট একটা বাংলাদেশ। দেওয়াল জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ সময়কার ছবি টাঙ্গানো। পুরো ঘর জুড়েই চার দেওয়ালে মুক্তিযুদ্ধের ছবি। মনা, বিপুল ও রিমা খুব আগ্রহের সাথে দেওয়ালের ছবিগুলো দেখতে লাগল। এরই মধ্যে দুপুরের খাবার হাজির। ছবি গুলো দেখে ওদের আর তর সইছে না, এখনি স্যারের কাছ থেকে আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চায়। শুনতে চাই কিভাবে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে স্যার শুরু করলেন যুদ্ধের গল্প বলা। গল্প বলা ঠিক না, এটা আমাদের ইতিহাস। সত্য ঘটনা। স্যার বললেন, ‘তোমরা নিশ্চয় জানো আজ আমাদের মহান বিজয় দিবস?’ ‘জি স্যার।’ সবাই এক সাথে বলল। স্যার আবার শুরু করলেন। ‘আমাদের এই বিজয় সহজে অর্জন হয়নি। কত ত্যাগ, কত মৃত্যু, কত রক্ত, তারপরই পেয়েছি স্বাধীনতা। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে যারা যুদ্ধ করেছে তারাই মুক্তিযোদ্ধা।’ রিমা বলল, ‘জি স্যার, আমাদের পাড়ার কাঙ্গালি দাদু একজন মুক্তিযোদ্ধা।’

স্যার বললেন, ‘তখন আমাদের দেশটার নাম ছিল পূর্বপাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা আমাদের শাসন করত। অত্যাচার করত। আমাদেরকে তারা গোলাম করে রেখেছিল। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ক্ষমতা দিতে না। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলেও তারা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। একের পর এক গড়িমসি করতে লাগল’।

‘৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিলেন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। এই ভাষণকে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বলা হয়। সেই ভাষণেই পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করতে বলা হল। তারপর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা করলো ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের উপর। নির্বিচারে হত্যা করল বহু লোককে। শুরু হলো যুদ্ধ। ভয়ানক যুদ্ধ।’ স্যার একটু থামলেন। তারপর আবারও বলা শুরু করলেন।’

‘যুদ্ধের সময় আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম। পাকিস্তানি মিলিটারিতে চাকুরি করতাম। দেশে শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। দেশের মানুষ যুদ্ধে নেমে পড়ল। সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে লাগল। আমাদের মত বাঙ্গালি মিলিটারিদের ছুটি দেওয়া তো দূরের কথা ওদের চোখে চোখে রাখতো। আমার খুব কষ্ট হত। দেশের এই ক্রান্তি লগনে দেশের জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না। একদিন অর্ডার এলো পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাথে আমাকেও পূর্বপাকিস্তানে যেতে হবে। শুধু কি তাই, আমার নিজের গ্রামের পাশের গ্রামগুলোতে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিতে হবে আমাকেই। দেখিয়ে দিতে হবে আমাদের গ্রাম, আমার পরিচিত গ্রামগুলো। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। খুব রাগ হচ্ছিল। কিন্তু তখন কিছুই বললাম না।’

‘সেই অবস্থাতে ওদের কিছুই করতে পারতাম না। তখন কিছু করতে গেলে আমাকে মেরে ফেলতো, আমি কাজের কাজ কিছুই করতে পারতাম না। মরতে হয় মরবো তবে ওদেরকে সাথে নিয়ে মরবো। তাই বিপদের সময় ধৈর্য ধরলাম। বারবার মনে হতে লাগল, আমার ভাইয়ের বুকে আমি কীভাবে গুলি চালাব? ডাক পড়ল আমার। আমাকে সাথে নিয়ে পূর্বপাকিস্তানে হাজির হলো মিলিটারি বাহিনী। শখানেক মিলিটারি মিলে একটা স্কুল মাঠে ক্যাম্প করা হলো। যে স্কুলে ছোটবেলায় শিখেছি দেশকে ভালোবাসার কথা, মানুষকে ভালোবাসার কথা, সেই স্কুলে বসেই শত্রুদের সাথে পরিকল্পনা করতে হবে নিজের ভাইকে কীভাবে মারতে হবে? বুকের ভিতর কান্না চেপে রাখলাম। নিশ্চয় সময় আসবে। স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদীর এপার ওপার দুইপাশেই গ্রাম। কয়েকটা গ্রাম মিলে এই একটাই স্কুল।’

নদীর ওপারের গ্রামগুলোতে মিলিটারির দল ঢুকতে চায়। গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে চায়। কিন্তু নদী পার হওয়ার মত কোনো ব্রিজ নেই। তখন ছোট ছোট নৌকা ছিল পারাপারের জন্য। নৌকাগুলো সরিয়ে নিয়েছে গ্রামবাসী। কেন সরিয়েছে জানি না। নির্দেশ এলো ড্রাম দিয়ে একটা ভাসমান ব্রিজ করতে হবে।

রাতের আঁধারে আমাকেসহ ৫০ জনকে পাঠানো হলো ভাসমান ব্রিজ তৈরি করতে। যে নদীর কালো জলে শৈশবে খেলা করেছি, যে জলে আজও শরীরের গন্ধ পাওয়া যাবে, সেই জলে আজ আমাকেই ব্রিজ বানাতে হবে আমার গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই ব্রিজ দিয়ে পার হবে শত্রুরা। পার হবে আগ্নেয়াস্ত্র। আমার ভাইয়ের বুকে, মায়ের বুকে, বোনের বুকে চালাবে গুলি। পাখির মত করে মারবে মানুষ। আমি খুব অসহায় হয়ে পড়লাম। জেদ চেপে বসল। মরতে হয় মরব তবুও একটা কিছু করতেই হবে। ড্রামের পরে ড্রাম সাজিয়ে ভাসমান ব্রিজ তৈরি করছি আর ভাবছি কি করবো। ব্রিজটা দিনের বেলা তৈরি করলে গ্রামের মানুষ দেখে ফেলবে আর সবাই পালিয়ে যাবে। এজন্য রাতের আঁধারে কাজ করা হচ্ছে। ব্রিজ তৈরি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আমার হাতে ছিল রশি কাটার ছুরি। পানির তলে ড্রাম বাঁধা রশিগুলো পোঁচাতে থাকলাম। পুরোপুরি না কেটে কিছুটা কাটছে। এভাবে যেখানে সুযোগ পেলাম সেখানেই পোঁচাতে থাকলাম। কাজ করতে করতে ভোর হয়ে এলো। দূর মসজিদের মিনার থেকে আযান ভেসে আসছে। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই প্রস্তুত হচ্ছে ওপারে যাওয়ার। আমি ছিলাম সবার সামনে। আমাকে চিনিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পিছনে ট্যাংক। সবাই যখন নদীর মাঝ বরাবর, ট্যাংকগুলো ব্রিজের উপর, হঠাৎ ভেঙ্গে গেল ব্রিজ। সবাই পড়ল গিয়ে পানিতে। একটা হৈচৈ শুরু হল। অনেকেই সাঁতার জানতো না। তারা নদীর জলেই ডুবে গেল। আমি খুব তাড়াতাড়ি ওপারে উঠে গ্রাম বাসিকে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকলাম। গ্রামের ছোট বড়, নারী পুরুষ সকলেই লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে এলো। দুই পাড়ের যে পাড়েই মিলিটারি উঠার চেষ্টা করছে সে পাড় থেকেই ওদের প্রতিহত করা হচ্ছে। ওদের অস্ত্র তো আগেই পানিতে ডুবে গেছে। কিছুই করার নেই ওদের। একে একে সবাই মারা গেল। যুদ্ধে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু তখন বাইরে বের হওয়াটাই ছিল কষ্টকর। এভাবেই সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধ করেছি। দীর্ঘ নয় মাস পর পেলাম স্বাধীনতা। এক খণ্ড সবুজ ভূমি। একটা লাল সবুজের পতাকা।’

স্যারের চোখে জল। মুখটা হাসি মাখা। স্যার বললেন, ‘যুদ্ধে যেতে পারিনি, কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা যারা এনে দিয়েছে তাদের যদি শ্রদ্ধাভরে স্বরণ না করি, তাদের কথা যদি মনে না রাখি, তাহলে আমরা অকৃতজ্ঞ ছাড়া কিছুই না। তাই প্রতি বছর এই দিবসে আমার খুব আনন্দ হয়। সাজতে ইচ্ছে করে। সাজাতে ইচ্ছে করে।’ হঠাৎ রিমা উঠে দাঁড়িয়ে স্যারকে স্যালুট করল। ‘আই স্যালুট স্যার।’ স্যার রিমাকে পাশে বসিয়ে বলল, ‘শোনো, স্বাধীনতা অর্জন করতে আমাদের যতটা না কষ্ট হয়েছে, রক্ত ঝরাতে হয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তার থেকে স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন। স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে সবার আগে দেশকে ভালোবাসতে হবে।

নিজের স্বার্থের বলি দিয়ে দেশের স্বার্থ দেখতে হবে। আগামীর বাংলাদেশ তোমাদের দিকে চেয়ে আছে। দেশ আমাদের অনেক কিছুই দিচ্ছে। স্বাধীন ভাবে বসবাস করছি নিজের দেশের ভূখণ্ডে। দেশকে আমি কি দিচ্ছি? আমরা সবাই যদি দেশের জন্য, দেশকে ভালোবেসে কাজ করি তবেই সার্থক হবে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড