মো. রাকিবুল হাসান তামিম, ডিসি প্রতিনিধি
প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রাণের বাংলাদেশ। একের পর এক ঋতুর আগমনে প্রকৃতির নবরূপ বিমুগ্ধ করে মানুষের নয়ন। ষড়ঋতুর এই নবান্নের দেশে হেমন্ত হলো চতুর্থ ঋতু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস নিয়ে হেমন্তকাল। হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রহর। শরতের কাশফুল মাটিতে নুইয়ে পড়ার পরপরই হেমন্তের আগমন ঘটে। এরপরে আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস।
হেমন্তে সকাল বেলা আবছা কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারদিকের মাঠঘাট। আর সেই আবছা কুয়াশার ভোরে হেমন্তের অতিথি হয়ে নিজের রূপ মেলে ধরে শিউলি, কামিনী, মল্লিকা, দেবকাঞ্চনসহ ইত্যাদি নানা ধরনের ফুল। হেমন্তের সকালের শিউলির সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের মেজাজ।
লাল রঙ্গন (ছবি : দৈনিক অধিকার)
এই কথাগুলো শহরাঞ্চলে নিছক গল্প বা রূপকথার ন্যায় মনে হতেই পারে। গল্পের রূপকথা হয়তো কখনো বাস্তবে পরিণত হয় না। কিন্তু হেমন্তের সৌন্দর্যের গল্পটা ঢাকা কলেজে একটু অন্যরকম! প্রজাপতির ডানায় ভর করে সমস্ত গল্পগুলোই যেন বাস্তব হয়ে অন্যরকম সৌন্দর্যে সবার নজর কেড়েছে ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রাচীন এই বিদ্যাপিঠে। বলছিলাম হৈমন্তিক পরিবেশে সুশোভিত ঢাকা কলেজের কথা।
প্রশাসনিক ভবনের সামনের বাগানে ফোটা দৃষ্টিনন্দন ফুলগুলো যেন অদ্ভুত মায়ার মোহনজালে আবৃত করে নেয়। সকালের নরম সোনা রোদে ফুলের ওপর জমে থাকা শিশির বিন্দুতে লেগে ঝলমল করে উঠে।
বাগানের শেষ প্রান্তে সীমানা দেয়াল ঘেঁষে বিস্তীর্ণ ঝাঁকড়া হলদে চুলের গোছা নিয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকা হেমন্তের ফুল চন্দ্রপ্রভা। কী তার রূপ!
ফুলের থোকার মাঝে উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে সবুজ পাতাগুলো (ছবি : দৈনিক অধিকার)
আবার ফুলের থোকার মাঝে উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে সবুজ পাতাগুলো। মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিনন্দন এই চন্দ্রপ্রভা ফুলের আরেক নাম হলদে চন্দ্রপ্রভা। অনেকেই আবার সোনাপাতি বলেও জানেন। এর বৈজ্ঞানিক নাম : Tecoma stans। এটি বিগ্নোনিয়াসি পরিবারের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। ঘণ্টা আকৃতির স্বর্ণাভ হলুদে ফুলে রোদের কিরণ পড়তেই যেন আরও ঝলমলে হয়ে উঠে। আমাদের দেশে হেমন্ত ছাড়াও গ্রীষ্ম এবং বর্ষায় এই দৃষ্টিনন্দন ফুলের দেখা মেলে। হেমন্তের এই অনন্য সাজ প্রকৃতির বাহারি সজ্জায় অনবদ্য ভালোবাসার অনুভূতির ছোঁয়া লাগে মনে।
চন্দ্রপ্রভার পাশেই ফুটেছে বসন্তের আরেক মনোমুগ্ধকর গোলাপী রঙের ফুল রক্তকরবী। বাগানের সৌন্দর্য বহুগুণে মনোমুগ্ধকর আকর্ষণীয় ও শৌখিন করতে রক্তকরবী যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। মাঝারি মানের উচ্চতা বিশিষ্ট গুল্ম জাতীয় ফুলগাছে প্রায় সারা বছর ফুল ফোটে। তবে বেশি ফোটে বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতুতে।
ঘণ্টা আকৃতি ৫ থেকে ৬টি নমনীয় কোমল পাপড়ির সমন্বয়ে করবী ফুলের সৃষ্টি। এ ফুলের রয়েছে বাহারি রং। আমাদের দেশে উজ্জ্বল হলুদ, কমলা, গোলাপী ও পাটকিল রঙের করবী ফুল ফুটতে দেখা যায়। গাছের শাখা-প্রশাখা ঝোপালো এবং নরম প্রকৃতির হয়ে থাকে।
ঘাসের ডগায় হেমন্তের শিশির (ছবি : দৈনিক অধিকার)
পাতার রং গাঢ় সবুজ, চিরল পাতার ফাঁকে উঁকি দেওয়া গাছের শাখা-প্রশাখার অগ্রভাগে অসংখ্য ফুল ফোটে। ফুটন্ত ফুলগাছ দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোরম। করবী শুধু দেখতেই মনোমুগ্ধকর নয় বরং এই ফুলের রয়েছে ভেষজ গুণাগুণ। এ ফুলগাছের বাকল, পাতা বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। সাহিত্যে রক্তকরবী, শ্বেতকরবী ইত্যাদি বিখ্যাত। দেখতে সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিনন্দন এ ফুলের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হতেই হবে।
মূল ফটকের পার্শ্ববর্তী গাছের সারির মাঝেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে রাতের ফুল শিউলি বা শেফালি। সকাল সকাল শিশিরমাখা শিউলি ফুল দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। গাছের নিচে আসতেই একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগে। নিচে তাকাতেই দেখা যায় সদ্য ঝরা সাদা শেফালির অভিমানী মুখ।
এর ফুলগুলো রাতে ফোটে এবং সকালে ঝরে যায়। সুগন্ধি জাতীয় এই ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃতি ও মাঝে লালচে-কমলা টিউবের মতো বৃন্ত। হেমন্তের সকালের শিশির ভেজা ঝরে পড়া শিউলি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে। শুভ্রতার মাঝেও কী এক অপরূপ সৌন্দর্য।
বাগানজুড়ে ফুটেছে বাহারি রঙের ফুল (ছবি : দৈনিক অধিকার)
প্রাচীন শাস্ত্রে একটি গল্পও প্রচলিত রয়েছে এই শিউলি বৃক্ষের! ‘পারিজাতিক নামে এক রাজকন্যা সূর্যের প্রেমে পড়ে তাকে কামনা করেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও পান না। রাগে দুঃখে অভিমানে সেই রাজকন্যা আত্মহত্যা করেন। তার দেহের ভস্ম পারিজাতবৃক্ষ রূপে ফুটে ওঠে। যে কিনা নিরব ব্যর্থ প্রেমের প্রতীক! সূর্যের স্পর্শ মাত্র যে ঝরে পড়ে অশ্রুবিন্দুর মতো। পৃথিবীর বুকে তার দুঃখের চিহ্ন দেখবে শত শত অশ্রুবিন্দুর মতো সে সুগন্ধি ছড়িয়ে থাকে চারদিকে, আমরা এখন তাকে শিউলি রূপে দেখি তার শুভ্র দেহে গৈরিক বসনে।’
বাগানের আরেক কোনায় ফুটেছে শুভ্র নির্মল আরেক ফুল। ঝুপড়ি গাঁথা পাতলা ডাল মৃদুমন্দ বাতাসে নেচে উঠে। আরে এযে সাদা জুঁই! বাতাসে জুঁইয়ের নাচুনি দেখে মনটাও নেচে উঠে। মনে হয় কিছুসময় চুপচাপ চেয়ে দেখি প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যের বন্ধন।
বাগানজুড়ে আরও ফুটেছে সৌন্দর্য বর্ধণকারী রঙ্গন ফুল। লাল রঙ্গনের হাসিটা যেন মনকে বিদগ্ধ করে তোলে। আরও রয়েছে কলাপাতি, টগর, জবাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল। আর পাতা বাহারের বাহারি পোশাক বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে বহুগুণে।
রক্তকরবী ফুল (ছবি : দৈনিক অধিকার)
কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্ত। প্রকৃতিতে এখন প্রভাব বাড়ছে হেমন্তের। সন্ধ্যা ও ভোরে এখন বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া ও কুয়াশা বা শিশির পড়া শুরু হয়েছে। যানজটের এই নগরীতে দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার ফাঁকে এই হেমন্তের অনুভূতি বোঝার কোনো উপায় নেই। প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ঢাকা কলেজে ভোর বেলায় দেখা মেলে হেমন্তের শিশিরের। সবুজ ঘাসের মাঠের ওপর সকালের সোনা রোদের কিরণ পড়তেই ঘাসের ডগায় শিশিরের মুক্তদানার ন্যায় ঝিলিক অন্যরকম এক আভা ছড়ায়। মৃদু বাতাস আন্দোলিত করে মনকে।
একদিন ভোরে অ্যাকাডেমিক ভবনের পেছনের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে খালি পায়ে দূর্বা ঘাসের ওপর হেঁটে যেতে পারেন। অশান্ত মনকে শান্ত করতে অতটুকুই যথেষ্ট।
সর্বোপরি, অনেক না পাওয়ার মাঝেও প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের বন্ধন ঢাকা কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, দর্শনার্থীসহ সবাইকে বিমোহিত করে। অনেক বেদনার মাঝেও মনে হয়, বেশ ভালোই আছি!
ওডি/আরএআর
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড