• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সিম বিক্রিতে মোবাইল কোম্পানি ও এজেন্টদের জালিয়াতি

  শহিদ রুবেল, উখিয়া প্রতিনিধি কক্সবাজার

০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:২২
রোহিঙ্গা
রোহিঙ্গাদের সমাবেশ (ফাইল ছবি)

বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন কিংবা নিবন্ধন ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ও আশপাশের বাজারগুলোতে দেদারসে বিক্রি হয়েছে বাংলাদেশি মোবাইল ফোন কোম্পানির সিম কার্ড। এমনকি সিম পাচারও হয় মিয়ানমারে। অথচ রোহিঙ্গাদের কাছে সিম বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। আর এ সিমগুলোই এখন আশ্রয় শিবিরগুলোতে মাদক-সন্ত্রাসসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে প্রযুক্তিগত অপরাধের মাত্রাও বাড়ছে। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর নানা ছলচাতুরিতে আশ্রিত রোহিঙ্গারা অবাধে বাংলাদেশি মোবাইল ফোন সিম ব্যবহার করছে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর এসআর ও আউটলেট এজেন্টদের জালিয়াতিতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি মোবাইল সিম ব্যবহার করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

এ দিকে গত ২৫ আগস্ট উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরই সরকার নড়েচড়ে বসেছে। কারণ রোহিঙ্গাদের সংগঠিত হওয়ার পেছনে মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতাও একটি অন্যতম কারণ। এরপরই আসতে শুরু করেছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৩৪টি ক্যাম্পে সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে রদবদলসহ বিভিন্ন নির্দেশনা। সর্বশেষ (১ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সাত দিনের ভেতর মোবাইল ফোন সংযোগ বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ারগুলোর আওতা মিয়ানমারের ভেতরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই রিপোর্টে বলা হয়, এই নেটওয়ার্কের কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সিমকার্ড ব্যবহার হচ্ছে মিয়ানমারের ভেতরেও। তাই সব অপারেটরের টাওয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে সুপারিশ করে গোয়েন্দা সংস্থাটি। পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে নেটওয়ার্কের ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দেওয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়। এ ব্যাপারে পরে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জানা যায়, কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার হাতে ঠিক কত সংখ্যক সিম রয়েছে, তার সঠিক তথ্য কারও কাছে নেই। উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত ১১ লাখ রোহিঙ্গার হাতে অবৈধভাবে ৮ থেকে ১০ লাখের অধিক সিমকার্ড চালু রয়েছে বলে ধারণা করছেন এই ব্যবসার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি ৭০টি সিমকার্ডসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন রাজাপালং গ্রামের আবুল কাশেম (৩৫) ও কুতুপালং গ্রামের মো. হাসান (২৮)। এ দুজন মোবাইল কোম্পানির স্থানীয় এসআর দাবি করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

উখিয়া সদর এলাকার মোবাইল ব্যবসায়ী আমিন সার্ভিস পয়েন্টের স্বত্বাধিকারী মো. নুরুল আমিন জানান, অনেক এজেন্ট বা দোকানের লোকজন কৌশলে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফিঙ্গার নিয়ে রাখে। প্রতিজনের এনআইডি কার্ডের অনুকূলে ২০টি মোবাইল সিম নিবন্ধনের সুযোগ জালিয়াতি করে কাজে লাগাচ্ছে তারা। এগুলো রোহিঙ্গাদের নিকট অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রয় করে থাকে বলে তিনি জানান। কক্সবাজার জেলা ছাড়াও তারা বিভিন্ন জেলা থেকে এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে নিবন্ধিত সিম কার্ড সংগ্রহ করে সেগুলো রোহিঙ্গাদের চড়া দামে বিক্রি করছে বিভিন্ন কোম্পানির এসআর নামধারী একাধিক জালিয়াত চক্র। এমনও অসংখ্য রোহিঙ্গা রয়েছে, যারা একাধিক মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করে। বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ছাড়া এত সিম কার্ড রোহিঙ্গাদের হাতে কীভাবে গেল, এ প্রশ্নের সঠিক জবাব কারো কাছে জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় প্রতিজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশি একাধিক মোবাইল সিমের পাশাপাশি মিয়ানমারের বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল সিম ব্যবহার করে থাকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর অবস্থান যেহেতু বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়, সেহেতু সহজে মিয়ানমারের মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।

কুতুপালং গ্রামের স্থানীয় চাকরিজীবী খায়রুল হক (২৮) ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অনীল বড়ুয়া (৪০) জানান, স্থানীয়দের ব্যবহৃত মোবাইলে নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকলেও রোহিঙ্গাদের মোবাইলে ২৪ ঘণ্টা নেটওয়ার্ক থাকে। তারা ক্যাম্প থেকে সরাসরি রাখাইনে বসবাসরত তাদেরও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলছে নিয়মিত। তারা বলেন, স্থানীয়দের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহারের মাধ্যমে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় স্থানীয়দের ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে। তারা বলেন, একমাত্র মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তারা যতই অপকর্ম করুক না কেন, তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরে আনা কঠিন। কারণ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর ব্যবহৃত মোবাইল সিম দেশের যেকোনো স্থানের বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত।

জেলা ও উপজেলার আইনশৃঙ্খলা সভায় স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়ার কথা বারবার উত্থাপন করে এলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। তাছাড়া কয়েকটি মোবাইল অপারেটর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোবাইল টাওয়ারও নির্মাণ করেছে। ফলে গত জুনে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, পাঁচ লাখের বেশি মোবাইল সিম ব্যবহার করছেন রোহিঙ্গারা। সীমান্তবর্তী স্থানীয়দের অভিযোগ, এখনও মিয়ানমারের ভেতরে ছয়-সাত কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশি বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ভেতরেও মিয়ানমারের মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এর ফলে সীমান্তে মাদক, মানবপাচারসহ জাতীয় নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এখনই সময় এসেছে, এসব মোবাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। না হলে বড় ধরনের হুমকি হতে পারে দেশের জন্য। গত জুন মাসে কক্সবাজার জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় বলা হয়, ৫ লাখের বেশি মোবাইল সিম ব্যবহার করছে রোহিঙ্গারা। মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

সভায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা জানান, শুধু মোবাইল সিম নয়, ক্যাম্পগুলোতে থ্রি-জি নেটওয়ার্কে ইন্টারনেটও ব্যবহার করছে রোহিঙ্গারা। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইনেও বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক সক্রিয় থাকে। ফলে সেখানেও অনেক বাংলাদেশি সিম ব্যবহার হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, জেলা পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১২ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ের মধ্যে সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে ২৫টি অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ মাদক।

ওডি/এসজেএ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড