• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

হিটলারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

  ফেনী প্রতিনিধি

০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৪০
হিটলারুজ্জামান
শিক্ষা কর্মকর্তা হিটলারুজ্জামান (ছবি : দৈনিক অধিকার)

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিটলারুজ্জামানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার কার্যালয়ে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। হিটলার সংঘবদ্ধ একটি চক্রের মাধ্যমে পুরো শিক্ষা অফিসকে অনিয়ম ও দুর্নীতির আঁতুর ঘর বানিয়ে রেখেছেন তিনি। একাধিক জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে তার অনিয়ম ও দুর্নীতির বহু সংবাদ প্রকাশিত হলেও এখনো বহাল তবিয়তে আছেন হিটলারুজ্জামান।

ইতোমধ্যে তার দুর্নীতির তদন্তে গঠিত কমিটি বেশ কয়েকটি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাকে অন্যত্র বদলিসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটির তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়ছে না।

অন্য দিকে চক্রের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা হিটলারুজ্জামান নির্বিঘ্নে সোনাগাজীতে চালিয়ে যাচ্ছে একের পর এক অপকর্ম। তাকে রক্ষায় সোনাগাজীর একাধিক জনপ্রতিনিধি, সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতা ও কথিত কয়েকজন শিক্ষক নেতা উঠে পড়ে লেগেছেন। হয়রানির ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেনা। তার চাঁদাবাজিতে এখন অতিষ্ঠ সোনাগাজীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

শিক্ষক, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিটলারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সাব ক্লাস্টার প্রশিক্ষণের তিন লাখ টাকা আত্মসাৎ, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য উপকরণ কেনার ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ, ‘ছোটদের শেখ হাসিনা’ বইটি ৮০০ টাকার স্থলে এক হাজার টাকা দরে তার অধীন স্কুলসমূহে বিক্রি করে বইপ্রতি ২০০ টাকা হারে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ, চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত কর্মস্থলে অননুমোদিতভাবে অনুপস্থিতি, হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে চলে যাওয়া, উপজেলার দাগনপাড়া মোশাররফ হোসেন ও বাংলাবাজার জয়নাল আবেদীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাত শিক্ষকের কাছ থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ৪৬ জন শিক্ষকের কাছ থেকে সার্ভিস বহি খোলার নামে দুই হাজার টাকা হারে ৯২ হাজার টাকা গ্রহণ, উন্নয়ন মেলার নামে উপজেলার ১০৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি থেকে ৫০০-১০০০ টাকা করে আদায়, চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে আদায়, উপজেলা পরিষদ থেকে পাওয়া চেয়ার, টেবিল, ফাইল কেবিনেট নিজের বাসায় ব্যবহার করা, অভ্যন্তরীণ মডেল টেস্ট গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫০ টাকা হারে প্রায় দুই লাখ টাকা আদায়, শিক্ষক বদলির নামে বাণিজ্য, ১০৯টি বিদ্যালয় থেকে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত স্লিপের অর্থ আদায়।

চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে উপজেলার ২০টি বিদ্যালয়ের সংস্কার কাজের জন্য দুই লাখ টাকা করে বরাদ্দ পাওয়া টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা ও একই অর্থ বছরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য উপজেলার ১৮টি বিদ্যালয়কে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্ধ দেওয়া হয়। বরাদ্দ পাওয়া ১৮টি বিদ্যালয় থেকে ১০ হাজার টাকা করে এবং বিদ্যালয়ে রুটিন মেরামতের জন্য ৪৮টি বিদ্যালয়কে ৪০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়।

সেখান থেকেও হিটলারুজ্জামান গড়ে দুই হাজার টাকা করে অফিস খরচ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকৌশলীসহ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করে প্রতিটি বিদ্যলয় থেকে শিক্ষকদেরকে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

সূত্র জানায়, জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফিরোজ আহাম্মদ ও একই অফিসের সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহ আলমের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি উপজেলার প্রায় অর্ধশত ভুক্তভোগী প্রাথমিক শিক্ষকের লিখিত বক্তব্য সংগ্রহ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উপকরণ কেনার জন্য বরাদ্দ অর্থও হাতিয়ে নিয়েছেন হিটলারুজ্জামান। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উপজেলার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য হুইলচেয়ারসহ নানা উপকরণ কেনার ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হলেও হিটলারুজ্জামান আজ পর্যন্ত কোনো উপকরণ কেনা বা সরবরাহ করেননি বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

গত ২১ মে উপপরিচালকের কার্যালয় চট্টগ্রামে ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দপ্তরে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেশ করা হয়।

এরপর গত ১৯ জুন চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উপপরিচালক সুলতান মিয়া ফেনী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে দেওয়া পত্রে বলেন, ‘সম্প্রতি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয়, সোনাগাজী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিটলারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বেশির ভাগই সঠিক পাওয়া গেছে।’

ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জানান, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ফেনী-৩ (সোনাগাজী -দাগনভূঁঞা) আসনের সাংসদ লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজ আহাম্মদ চৌধুরী হিটলারুজ্জামানকে অন্যত্র বদলি করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বরাবর পত্র পাঠিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যে সাধারণ শিক্ষকরা অতিষ্ঠ। তার পক্ষ হয়ে অনেক জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষকদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। উপজেলা শিক্ষা অফিস মানে অনিয়মই যেখানে নিয়ম এ নীতিতে চলছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য ও জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, ‘তারা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশে হিটলারুজ্জামানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো তদন্ত করেছেন। বেশকিছু অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছেন। যা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।

জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, হিটলারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখালেখি চলছে।

বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. সুলতান মিয়া বলেন, হিটলারুজ্জামানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের কাগজপত্র ও তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়ে তা মহাপরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সোনাগাজী থেকে তাকে প্রত্যাহার করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহাপরিচালকের কাছে লিখিত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। আশা করি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

গত কয়েকদিন আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মঞ্জুর কাদের বলেন, যে সব কর্মকর্তার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতি বা সুনাম নষ্ট হবে। তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যারা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে লেখনীর মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।

তিনি বলেন, ছুটি না নিয়ে কর্মস্থল ত্যাগের বিষয়সহ সকল অনিয়ম ও দুর্নীতর বিষয়ে সোনাগাজীর শিক্ষা কর্মকর্তা হিটলারুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হিটলারুজ্জামান তার বিরুদ্ধে দেওয়া সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। উপজেলার দুই-চারজন শিক্ষক ব্যতীত বাকিরা সবাই তার পক্ষে রয়েছে। এতে তার কোনো সমস্যা হবে না।

তিনি বলেন, ‘স্থানীয় শিক্ষকদের একটি অংশ আরও আগে থেকে দুই-একজন জনপ্রতিনিধির সহযোগিতায় তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

ওডি/এসজেএ

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড