• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

এক টাকার মাস্টার নামেই পরিচিত তিনি

  রফিকুল ইসলাম রফিক, গাইবান্ধা

২৩ আগস্ট ২০১৯, ১২:০৪
গাইবান্ধা
বাড়ির আঙ্গিনায় শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন মাস্টার লুৎফর রহমান

গ্রামের শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে থেমে নেই এক টাকার মাস্টার লুৎফর রহমান। ৪৪ বছর আগে এক টাকার ফি নিয়ে পাঠদান শুরু করেন তিনি। সব কিছুর দাম বাড়লেও বাড়েনি এক টাকা মাস্টার লুৎফর রহমানের পাঠদানের ফি।

প্রতিদিন পায়ে হেঁটে শিক্ষার্থীদের বাড়ীতে গিয়ে পাঠদানের পর প্রতিজনের কাছ থেকে মাত্র এক টাকা করে নিতেন বলে এলাকায় পরিচিতি এক টাকার মাষ্টার নামে। এক টাকার মাষ্টার নামে পরিচিত ৭০ বছর বয়সী এই গৃহশিক্ষকের নাম মো. লুৎফর রহমান। বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারি ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামে। অভাবে সংসার পারেনি শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেয়া থেকে দুরে রাখতে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, লুৎফর রহমান ১৯৫০ সালের ৭ আগস্ট ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। সেসময় প্রায় শত বিঘা জমি, পুকুর ভর্তি মাছ ও গোয়াল ভরা গরু ছিল।

১৯৭২ সালে স্থানীয় গুনভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগ দেন লুৎফর রহমান। সেসময় ছেলে মেয়েরা তেমন একটা বিদ্যালয়মুখী ছিল না। তিনি শিশুদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিতেন। সেসময় বিদ্যালয় ছুটির পর বিনা পয়সায় বাড়িতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো শুরু করেন লুৎফর রহমান। সেই থেকেই শুরু।

ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনের কবলে ১৯৭৪ সালের দিকে বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হলে লুৎফর রহমান পরিবারসহ আশ্রয় নেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারি ইউনিয়নের ডাকাতিয়া গ্রামে। এই গ্রামে এসেও লুৎফর রহমান ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া শেখানো চালিয়ে গেছেন। বিনিময়ে এখানেই প্রতিজনের কাছ থেকে নেওয়া শুরু করেন এক টাকা করে।

এখানেও ঠাঁই হয়নি তার। এ বাড়িও নদীভাঙ্গনের কবলে পড়লে ১৯৮৭ সালের দিকে ঠাই হয় একই ইউনিয়নের বাঁধের বাগুড়িয়া গ্রামে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দু ধারে নদীভাঙা মানুষের বসবাস। বাঁধে বেশি ভাগ মানুষের একচালা টিনসেডের ঘর। এখানকারই একটি ঘর তার। সেখানে আজ অবধি আছেন তিনি। সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায় আঙিনায় বসে পড়াচ্ছেন তিনি।

পরিবারে স্ত্রী লতিফুল বেগম গৃহিনী, দুই মেয়ে লিম্মি ও লিপির বিয়ে দিয়েছেন। আর দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে লাভলু মিয়া এসএসসি পাশ করার পর অর্থাভাবে আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তিনি এখন ইজিবাইক চালিয়ে সংসার দেখাশোনা করেন। আর অপর ছেলে লিটন মিয়া একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন।

লুৎফর রহমান বাগুড়িয়া, কিশামত ফলিয়া, ফুলছড়ি উপজেলার মদনের পাড়া, চন্দিয়া এবং পৌর এলাকার পূর্বপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাঠদান দিয়ে যাচ্ছেন। চলার পথে রাস্তায় দেখা হলে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা তাকে সাইকেল-মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বর্তমানে একটি বাইসাইকেল নিয়ে চলাচল করেন তিনি। তিনি চার দফায় প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান।

কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা লুৎফর রহমানের কাছে পড়েন। এখানে পড়তে এক টাকা লাগে । কম টাকা লাগার কারণে বাবা মায়েরাও আগ্রহ হয়ে ছেলে মেয়েদেরকে পড়তে পাঠান। কম খরচে পড়তে পেরে খুশি শিক্ষার্থীরা। পড়াশুনা বেশ ভালো হচ্ছে।

বড় ছেলে লাভলু মিয়া বলেন, শিক্ষার্থীরা আগে পড়াশেষে বাবাকে এক টাকা করে দিতো । এখন কেউ তিন টাকা আবার কেউবা চার-পাঁচ টাকা করে দেন। তিনি টাকার জন্য কাউকে চাপ দেন না। যে যা পারেন সেভাবেই দেন।

বাগুড়িয়া গ্রামের কাঠমিস্ত্রি আব্দুল মজিদ মিয়া (৩৮) ও মাছ ব্যবসায়ি ডাবারু বর্মণ (৪৬) বলেন, মাসে চার-পাঁচশ টাকা খরচ করে ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়ানোর সামর্থ্য নেই। তাই লুৎফর স্যারের কাছে অল্প টাকায় পড়াচ্ছি। এতে আমাদের অনেক উপকার হচ্ছে।

কেন এক টাকা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ান জানতে চাইলে লুৎফর রহমান বলেন, নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব হওয়া গরীব এলাকা এটি। বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের পড়াতেই চাইতেন না। তাই মাত্র এক টাকা করে নিয়ে পড়ানো শুরু করি আমি। দিনমজুর, রিকসা-ভ্যান চালকের ছেলে-মেয়েরা তো মানুষ হবে। আমার কাছে পড়াশোনা করে অনেকেই আজ ভাল চাকরি করছে। এটাই আমার সার্থকতা। তিনি আরও বলেন, ডিসেম্বর মাসে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে পারি না। ফলে অর্থ কষ্টে ভুগতে হয়।

বাগুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, লুৎফর রহমান অল্প টাকায় পড়ানোর ফলে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক উপকার হচ্ছে। তা না হলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় যেমন ভালো ফলাফল করতে পারতো না, তেমনি বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে যেত।এতে তার কোন লাভ না হলেও গরিব ছেলে মেয়ে শিক্ষিত হচ্ছে । এটার তার লাভ ।

ওডি/আরবি

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড