• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

গরিবের ডাক্তার বাংলার নানী জহিরন

  সুমন খান, লালমনিরহাট

০১ জুন ২০১৯, ১৬:৩৩
লালমনিরহাট
জহিরন বেওয়া

নাম তার জহিরন বেওয়া। প্রায় ৫০ বছর ধরে সাইকেল চালিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন তিনি। গ্রাম বাংলার গরিবের ডাক্তার তিনি। ‘বাংলার নানী’ নামে খ্যাত জহিরন বেওয়া।

জহিরন বেওয়া বয়স নব্বই পেরিয়েছে। এরপরও নিজে সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে বাড়ি গিয়ে নারী-পুরুষসহ শিশুদের হাতে পৌঁছে দেন প্রয়োজনীয় ওষুধ।

তিস্তা উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের আদিতমারী কিংবা এর আশপাশে গেলেই চোখে পড়বে-বিস্ময়কর এক বৃদ্ধা নিজে সাইকেল চালাচ্ছেন! চিকিৎসা সম্পর্কে কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত জহিরন বেওয়া।

সম্প্রতি সেই নানীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে হাসিমুখে মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই তিনি। স্থানীয়রা জানান, নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের ‘চিকিৎসক’ জহিরন বেওয়া প্রায় ৫০ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন। প্রাথমিক ওষুধের পাশাপাশি অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদেরও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে আসছেন তিনি। এলাকায় বিধবা জহিরন এতোটাই জনপ্রিয় যে, স্থানীয় লোকজন তার পরিচয় না জানলেও ‘বাংলার নানী ’ হিসেবে সবাই এক নামে চেনেন ও জানেন জহিরন বেওয়াকে। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সাইকেল চালিয়ে এ গ্রামে ও গ্রামে মানুষকে স্বাস্থ্য পরামর্শ দিয়ে চলে আসছেন প্রতিনিয়ত।

আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের কমলাবাড়ি গ্রামের মৃত সৈয়দ আলীর স্ত্রী জহিরন বেওয়া। তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জননী তিনি। স্বামী ২০০৩ সালে মারা গেছে।

জহিরন বেওয়া আরও বলেন, ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। স্বামী মারা গেছেন। পরপারে চলে গেছে বড় ছেলে দানেশ আলীও। এখন ঘুরে ঘুরে মানুষকে অসুখ-বিসুখের প্রাথমিক চিকিৎসার পরামর্শ দিই। ‘তবে জটিল কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিই। কখনো কখনো জটিল রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেও সহযোগিতা করি।’

তিনি আরও জানান, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে একটি ৬ মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স করেছিলেন। এরপর থেকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি এলাকায়। ‘আগে গ্রামে গ্রামে রোগীদের বাড়ি যেতাম। সেই অভ্যাসটা এখনো রয়ে গেছে। মরার আগে তা ছাড়তে পারব বলেও মনে হয় না।’ যতদিন বেঁচে থাকব মানুষের সেবা দিয়ে যাব। সেই দিন পর্যন্ত আল্লাহ যেন আমাকে সুস্থ রাখেন।

স্থানীয় আদিতমারী উপজেলা সদরের কালীগঞ্জ সড়কের বাসিন্দা বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি নানীকে দেখছি প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে গ্রামে-গঞ্জে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এর জন্য তিনি কোনো টাকা-পয়সা নেন না। ওষুধ দিলে তাও আবার বাজারে যে দাম সেই দামই নেন।

আবার গ্রামের গরিব লোকদের কাছ থেকে ওষুধের টাকাও নেন না। তবে নবজাতক ও মা কিংবা অন্যান্য কাউকে পরামর্শ দিয়েও কোনো সময় তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেন না। মাঝে মাঝে ওষুধও ফ্রি দিয়ে দেন।’

অনেকে জানান, জহিরন খালা ডাক্তার না ঠিক, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা অনেক। তার পরামর্শ নিয়ে আমরা ছোট-খাট রোগ থেকে মুক্তি পাই।’

এই রোগীর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে জহিরন জানালেন, তার আদিভিটা টাঙ্গাইলে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছিল তার। এরপর পরিবারের সঙ্গে লালমনিরহাট চলে আসেন। ৭-৮টি গ্রামের পঞ্চাশটিরও বেশি বাড়িতে যান। প্রতি মাসে আশপাশের ২৫-৩০টি গ্রামে যান তিনি। এতে আয়ও হয় মোটামুটি।

তার ভাষ্য, যা আয় হয় তা দিয়েই চলে যায়। দৈনিক ওষুধ বিক্রি থেকে কমপক্ষে দেড়শ টাকা হয়। ছেলে-নাতিরা নিষেধ করলেও অভ্যাসের বসে কাজটি ছাড়তে পারি না। আমার শেষ ইচ্ছা আমি বিশেষ করে গরিব অসহায় মানুষের সেবা করার। আর শেষ বয়সে কী বাই করব? এক প্রশ্নের উত্তরে জহিরনের হাস্যেজ্জ্বল উত্তর, ‘কবে অসুখে পড়েছিলাম মনে নাই। আল্লাহর রহমতে রোগ-বালাই ধরে না আমাকে বাপু।’

এরপরও বৃদ্ধা দাদিকে নিয়ে বেশ চিন্তিত নাতি মো. সিদ্দিক আলী। বললেন, প্রতিদিনই সাত সকালে সাইকেল নিয়ে দাদি বের হয়ে যান। এ নিয়ে একুট চিন্তা তো থাকেই পরিবারের সবার। পরিবারের লোকজন বলেন, ‘বয়স হলেও নানীর শারীরিক কোনো অসুস্থতা নেই। দিব্বি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ান। মানুষের উপকার করছেন ভেবে আমাদেরও ভালো লাগে। ওনাকে নিয়ে আমাদের গর্ব হয়।

পরিবারের লোকজন তাকে অনেকবার বলেছিল কাজ করার দরকার নেই। কিন্তু তিনি শোনেন না। উত্তরে তিনি বলেন, তার কাজতো শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়। সমাজের জন্যও।

জহিরনের ছেলে বলেন, আমরাও আর নিষেধ করি না। এই কাজ করে যদি উনি শান্তি পান, শরীর সুস্থ থাকে, আমাদের কোনো বারণ নেই। সব শেষে জহিরন অধিকারকে বলেন, সমাজে সাধারণ মানুষগুলোর পাশে থেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান তিনি।

ওডি/আরবি

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড