• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

শিকলবন্দি বৃদ্ধাকে মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করলেন ইউএনও

‘আমাকে এভাবে বেঁধে রেখ না, আমার ভালো লাগে না’

  হাসান আরেফিন, ঝালকাঠি প্রতিনিধি

১৭ মে ২০১৯, ১০:২৮
রিজিয়া বেগম
এভাবেই ৪ বছর ধরে শিকলে বাঁধা ছিলেন রিজিয়া বেগম (ছবি: দৈনিক অধিকার)

‘একটু শিকলের বাঁধন খুলে দাও, আমি কোথাও যাব না। আমাকে এভাবে বেঁধে রেখ না, আমার ভালো লাগে না। কেউ ভালো করে খেতেও দেয় না, তরকারি দেয় না। আমায় একটু মিষ্টি খেতে দাও।’

ভাঙা ভাঙা শব্দে এভাবেই বিলাপ করছিলেন ঝালকাঠির রাজাপুরের উত্তর বারবাকপুর গ্রামের বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম (৭৫)। ওই গ্রামের নুর মোহাম্মদের বাড়ির মসজিদ সংলগ্ন পূর্ব পাশের ইউনুচ মৃধার পরিত্যক্ত ভিটায় অরক্ষিত অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন তিনি। খবর পেয়ে বেঁধে রাখা বৃদ্ধা রিজিয়া বেগমকে মুক্ত করে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোহাগ হাওলাদার। বৃদ্ধা প্রাথমিক চিকিৎসায় একটু সুস্থতা বোধ করায় তার স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করছেন এ কর্মকর্তা।

গত ১৩ মে সকালে উপজেলার উত্তর বারবাকপুর ইউনুচ মৃধার পরিত্যক্ত ভিটায় অরক্ষিত অবস্থায় শিকলবন্দি বৃদ্ধ রিজিয়ার কাছে যান ইউএনও সোহাগ। এ সময় তিনি খুলে দেন বৃদ্ধার কোমড়ের শিকল ও তালা। পরে সেখান থেকে স্বজনদের সহায়তায় রিজিয়াকে রাজাপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়।

দীর্ঘ ৪ বছর ধরে সত্তোর্ধ রিজিয়া বেগমকে শিকলবন্দি করে রেখেছেন তার সন্তানরা। কোমড়ে লোহার শিকলে তালা দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে বেড়াবিহীন একটি জীর্ণ ঘরে। প্রতিদিন দুপুরে নামমাত্র তরকারি দিয়ে খেতে দেওয়া হয় এক বাটি ভাত। রাতে ও সকালের জন্য ভাত দেওয়া হলেও থাকে না কোনো তরকারি। সেই ভাতে পড়ে থাকে পিঁপড়ার দল। কোনোদিন পিঁপড়া সরিয়ে সেই ভাত খান, কোনোদিন সেভাবেই পড়ে থাকে। এভাবে খেয়ে না খেয়ে পরিত্যক্ত ভিটায় জীর্ণ খুপড়ি ঘরে কাঠের চৌকিতে তার দিনরাত কাটে। দীর্ঘ ৪ বছর এভাবে তালাবদ্ধ রাখায় কোমড়ে ঘা হয়ে গেছে তার। নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন কয়েকটি কাঁথা ও কাপড়-চোপড় ব্যবহার করছেন দিনের পর দিন। শিকলে বাঁধা থাকায় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়াও দিতে হয় ওই ঘরে বসেই।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মশার কামড়, গরম কিংবা শীতে এখানেই পড়ে থাকেন রিজিয়া বেগম। ঘরটি বসবাসের অযোগ্য। ঘরে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধযুক্ত বিছানা। সেখানে দুর্গন্ধের কারণে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। বিছানার ওপর রাখা একটি মগ, পানির জগ, খানিকটা লবণ ও ময়লাযুক্ত একটি বাটিতে দেওয়া ভাত।

স্থানীয়রা জানান, ৪ বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোক করেন রিজিয়া। সন্তান ও স্বজনরা অর্থাভাবে তার চিকিৎসা করাতে না পারায় আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকেন তিনি। এখন কথাও বলতে পারেন না ঠিকমতো।

রাজাপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. মাহবুবুর রহমান দৈনিক অধিকারকে জানান, দীর্ঘদিন বন্দি থাকায় বৃদ্ধ রিজিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাকে ভিটামিন ও ঘুমের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। তার এখন প্রচুর বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তার মানসিক পরিস্থিতি বুঝে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হবে।

বৃদ্ধা রিজিয়ার ছেলে রাজ্জাক শেখ দৈনিক অধিকারকে জানান, চার বছর আগে তার মা হঠাৎ ব্রেইন স্ট্রোক করেন। পরে তাকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন চিকিৎসকদের দেখাতে গিয়ে রাজ্জাক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। এরপর তিনি অর্থাভাবে তার মাকে আর চিকিৎসা করাতে পারেননি। এ অবস্থায় তার মা দিন দিন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরুপায় হয়ে প্রায় চার বছর ধরে লোহার শিকলে তালা লাগিয়ে বেঁধে রাখেন।

রাজ্জাক তার মাকে নিজ ঘরেও রেখেছিলেন কিন্তু সেখানে তিনি আসবাবপত্র ভাঙচুর করতেন ও পায়খানা-প্রস্রাব করে নোংরা করতেন। এ জন্য নিরুপায় হয়ে পরিত্যক্ত ওই ঘরেই মাকে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তার অভাবের সংসার চালিয়েও সাধ্যমতো মায়ের সেবা করেছেন বলেও জানান রাজ্জাক।

ইউএনও সোহাগ হাওলাদার দৈনিক অধিকারকে বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বৃদ্ধ রিজিয়াকে মুক্ত করি। পরে সেখান থেকে ব্যক্তিগত খরচে ওই বৃদ্ধাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এনে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা পেয়ে কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রিজিয়াকে চিকিৎসাসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। এরইমধ্যে তাকে সমাজসেবার পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা ও যাবতীয় সুবিধা দেওয়া হবে। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তার আবাসন ও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।

ওডি/এএন

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড