• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

নাব্যতা হারাচ্ছে যমুনা

  আলীম আকন্দ, ভুঞাপুর প্রতিনিধি, টাঙ্গাইল

১১ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৪৭
টাঙ্গাইল
যমুনার চরে চাষাবাদ

বাংলাদেশের বড় নদীগুলোর অন্যতম যমুনা। দেশের উত্তরের জেলা জামালপুর থেকে শুরু হয়ে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জের বুক চিরে গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের গোয়ালন্দে পদ্মায় গিয়ে মিলিত হয়েছে এ নদী।

এক সময় যমুনা নদীতে চলত বড় বড় স্টিমার, জাহাজ, লঞ্চসহ অন্যান্য নৌ পরিবহন। কিন্তু কালের বির্বতনে প্রমত্তা যমুনা তার যৌবন হারিয়ে এখন মৃত প্রায়। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে একদিকে যেমন বাস্তুহারা করছে চরাঞ্চলের মানুষকে, অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে যমুনা মরা খালে পরিণত হয়েছে।

তবে স্থানীয় প্রবীণরা জানিয়েছে, ১৯৯৬ সালের আগেও যমুনার পূর্ণ যৌবন ছিল। কিন্তু দেশের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর যমুনা নদী অস্তিত্ব হারাচ্ছে। যে কারণে বঙ্গবন্ধু সেতুর তলদেশে এখন চাষাবাদ হচ্ছে বোরো ধান। শত শত একর জমিতে শোভা পাচ্ছে বোরো ধানের চাষ।

বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে নদী শাসনের কারণে তার স্বাভাবিক গতিপথ সেতুর পিলারের মাধ্যমে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় উজানে অতিরিক্ত ভাঙন দেখা দেয়। যার ফলে নদীর গভীরতা কমে চর পরার প্রবণতা বেড়ে গেছে।

দীর্ঘকাল ধরে নদী শাসন না হওয়ায় গতিপথ পরিবর্তন হয়ে শুষ্ক মৌসুমে ধু-ধু বালুচরে রূপ নিয়েছে যমুনা। আর এসব জেগে উঠা চর গুলোতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ হচ্ছে তিল, তিসি, কাউন, ডাল, চিনাবাদাম, ভুট্টাসহ নানা মৌসুমি ফসল।

সেতুর উত্তরাংশ টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুরের অর্জুনা, গাবসারা, ফলদা, গোবিন্দাসী, নিকরাইল ইউনিয়নের পশ্চিম সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী। এক সময় অথৈ পানিতে থৈ থৈ করা নদী আজ পৌষ মাস থেকেই পানি শুকিয়ে মাইলের পর মাইল ধু-ধু বালুচরে রূপ নেয়।

দৈনিক অধিকার

যমুনার বুকে চর

বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরির পূর্বে টাঙ্গাইল দিয়ে সিরাজগঞ্জ হয়ে উত্তরবঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল এই নদী। ফেরি ও যন্ত্রচালিত নৌকার মাধ্যমে নদী পার হয়ে উত্তরবঙ্গে যাতায়াতের এটাই ছিল একমাত্র অবলম্বন।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর গরুর হাট গোবিন্দাসী গরুর হাট জমে উঠে ছিল যমুনা নদীকে কেন্দ্র করে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে নৌ-পথে গরু আসত এ হাটে। এ হাটটির মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের জীবিকা নির্বাহ হতো। যমুনার নাব্যতা কমে যাওয়ায় এ হাটটিও যেন মরে গেছে। সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।

যমুনার মাছ সারা দেশে সমাদৃত। এখানে পাওয়া যেত লোভনীয় ইলিশ, বোয়াল, চিংড়ী, পাবদা, গোলসাসহ নানা প্রজাতির মাছ। নদীর নাব্যতা কমায়, অতি দ্রুত নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় দেখা দেয় মাছের আকাল। নদীতে মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করত তারা আজ অন্য পেশায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে।

ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরা জেলে ইউসুফ আলী দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘কি আর কমু খারি ভর্তি মাছ ধরতাম, আজ খালের তলাই ভরতে পারি না’। নদীতে পানি থাকে না এবং সঠিক সময় পানি আসেও না, তাই মাছও আসে না। বর্তমানে এ নদীতে মাছের খুব আকাল।

যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর দূরপাল্লার যাতায়াত সহজ হলেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের। নদী তীরবর্তী টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলের লোকজন যেখানে নৌকায় চড়ে বাড়ির ঘাটে ওঠা-নামা করত, সেখানে আজ মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে চলাচল করতে হয় তাদের।

দৈনিক অধিকার

বঙ্গবন্ধু সেতু (ছবি : সংগৃহীত)

বর্ষাকাল ছাড়াও যেখানে এ নদীতে সারা বছর পানি থাকত, সেখানে আজ ধু-ধু বালুচর। নৌকা যোগে অল্প সময়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াতে যে সুবিধা মানুষ ভোগ করত সেখানে আজ পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ।

নৌকার মাঝি রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তিনি দৈনিক অধিকারকে বলেন, ‘প্রমত্তা যমুনা আজ হাহাকার বালুচর। অতিরিক্ত রাত হলে এই নদীতে নৌকা বাইতে সাহস পাইতাম না, সেখানে আজ নৌকার হালও ধরতে হয় না, এমন অবস্থা যমুনার। কী নদী ছিল আজ ক হয়ে গেছে। যে ঘাটে বড় বড় ফেরি বাঁধা থাকত সেখানে আজ গরু বাঁধা থাকে।

যমুনা নদীর ওপর ব্রিজ হওয়ায় ভুঞাপুরের গোবিন্দাসীর ফেরিঘাট উঠে গেছে অনেক আগেই। এখন আর আগের মত নৌকাও চলে না। যাতায়াতের বিকল্প হিসেবে যমুনার চরাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে একমাত্র ভরসা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল।

যমুনার এ চরাঞ্চলে রাস্তা-ঘাট নেই বললেই চলে। কিন্তু তার পরেও ধু-ধু বালু চরে মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে কয়েকশো পরিবার।

ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দসী, নিকরাইল, গাবসারা ও অর্জূনা ইউনিয়নের চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা গেছে- চর ও নদী এলাকার যেসব গ্রামে শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাতায়াত করতে হতো চরের মানুষের। উৎপাদিত পণ্য আনা-নেওয়া করতে হতো পায়ে হেঁটে। সেই সব জায়গায় ঘোড়ার গাড়ির পাশাপাশি মোটরসাইকেলে যাতায়াত করছে লোকজন।

ভূঞাপুর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের চরাঞ্চলে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। স্কুল, মাদরাসা, হাসপাতাল, ব্যাংক-বীমা, কমিউনিটি সেন্টার, এনজিও প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মরত লোকজন প্রতিদিন চরাঞ্চলে যাতায়াত করে। এসব মানুষের যাতায়াতের একমাত্র ভরসা মোটরসাইকেল।

তবে চরের অনেক মানুষ এখনও পায়ে হেঁটেই বিশাল-বিশাল চর পাড়ি দেয়। ঘন বা বেশি বালুর মধ্যে খড় বিছিয়ে মোটরসাইকেল চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। চরের মানুষজন অস্থায়ী ঘাটে নৌকা থেকে নেমে মোটরসাইকেলে চরে যাচ্ছে গন্তব্যে। অন্যদিকে চরের মানুষকে পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করছে কয়েকশত চালক।

গাবসারা ইউনিয়নের রুলীপাড়ার মোটরসাইকেল চালক মোকলেছ দৈনিক অধিকারকে বলেন, সংসারে তার তিন সন্তান রয়েছে। মোটরসাইকেল চালানো তার পেশা। আগে তিনি ইট ভাটায় কাজ করেছেন। এখন তিনি প্রতিদিন মোটরসাইকেল চালিয়ে ৮/৯ শত টাকা আয় করেন।

চরাঞ্চলের অনেকেই জানান, চরে ঘোড়ার গাড়ির পাশাপাশি মোটরসাইকেল চলাচল করায় চরের মানুষের দূর্ভোগ কমেছে।

যমুনার নাব্যতা কমে যাওয়ায় সেখানে এখন প্রায় পানিশূন্য, জেগে উঠা চরগুলোতে চাষাবাদ করছে চরাঞ্চলের চাষিরা। ফলে এখানে মানুষের বসতির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিও চাঙ্গা হচ্ছে। এর সঙ্গে সেখানে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গরু-মহিষের খামার। এতে পাল্টে যাচ্ছে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার চরাঞ্চলের অর্থনীতি।

আজ থেকে ২০ বছর আগেও যমুনার তীব্রতা ছিল ভয়াবহ। তখন কেউ চিন্তাও করতে পারেনি যমুনার বুকে এক সময় চাষাবাদ হবে। কিন্তু যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এর নাব্যতা কমতে থাকে। যমুনার বুক এখন ফসলে ভরা। জেগে উঠা ধু-ধু বালুচরে এখন উঠতি বোরো ধানে শোভা পাচ্ছে।

তবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যমুনার হারানো গৌরব ফেরাতে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

ওডি/আরবি

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড