• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বেঁচে থাকতেই স্বামীর বীরত্বের স্বীকৃতি চান স্ত্রী

  ইউনুস আলী, ধনবাড়ী প্রতিনিধি, টাঙ্গাইল

২৬ মার্চ ২০১৯, ১৮:৪৪
টাঙ্গাইল
মো. সেকান্দর আলী আকন্দ ও তার স্ত্রী ফাতেমা

আর দশজন দামাল ছেলের মতোই তিনিও স্বাধীন দেশমাতৃকার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সহযোগিতা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। দাঁড়িয়েছেন নির্যাতিতদের পাশে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক অধিনায়কের স্বাক্ষর করা যোদ্ধা হিসেবে একটি স্বীকৃতিপত্র অর্জন তার একমাত্র প্রমাণ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পূর্ণ স্বীকৃতি তার কপালে জুটেনি। অতৃপ্ত মনেই তিনি পৃথিবী ছেড়েছেন।

যুদ্ধজয়ী অথচ স্বীকৃতি প্রাপ্তির যুদ্ধে পরাজিত এ যোদ্ধার নাম মো. সেকান্দর আলী আকন্দ। ঘাটাইলের রামচন্দ্রপুর গ্রামের মানিক উদ্দিন আকন্দের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দর আলী আকন্দ টাঙ্গাইলের মধুপুর পৌর শহরের মাস্টার পাড়ার স্থায়ী ঠিকানার বাসিন্দা হিসেবে গত ২০১৮ সালের ১১ মে নানা রোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।

৪৮ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে কাগজের ওই স্বীকৃতিটুকু ছাড়া তার পরিবার সরকারের দেয়া মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মানের ছিটে ফোঁটাও পায়নি। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকায় নাম ওঠেনি তার। মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার পাননি। বেঁচে থাকাকালীন তালিকাভুক্তির নানা চেষ্টায় অর্থের সংকটে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন পদে পদে।

পরিবার জানিয়েছে, অর্থের বিনিময়ে তালিকাভুক্তি করিয়ে দেয়ার অনৈতিক সুযোগ প্রত্যাখান করেছেন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব উপজেলা পর্যায়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দর আলী আকন্দ। মধুপুর রাণী ভবানী মডেল (বর্তমানে সরকারি) উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে তিনি ২০০৩ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

পরিবার ও স্থানীয়দের ভাষ্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আপদমস্তক একজন সৎ ও অনুসরণীয় মানুষ ছিলেন সেকান্দর আলী আকন্দ। তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল মানব ও দেশ প্রেম। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দানের পাশাপাশি যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অবিরাম চেষ্টা ছিল তার। নিজে ঠকেছেন কিন্তু কাউকে ঠকিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত কারো কাছে নেই।

ঘাটাইল উপজেলার দেউলাবাড়ী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের মানিক উদ্দিন আকন্দের ছেলে সেকান্দর আলী আকন্দের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১ নভেম্বর। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সেকান্দর আলী আকন্দ ছিলেন চতুর্থ। শৈশবে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনায় তার হাতেখড়ি। পরে পাকুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন করেন।

টাঙ্গাইলের কাগমারী এমএম আলী কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীতে চাকরি নেন। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে ছিল তার কর্মক্ষেত্র। বিয়ের জন্য ছুটি নিয়ে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাড়িতে এসে ২১ ফেব্রুয়ারি ফাতেমাকে বিয়ে করেন। চাকরিতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে দেশের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আর ফিরে যাওয়া হয়নি। যোগ দেন স্বাধীনতার যুদ্ধে।

নতুন বিয়ে করায় ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যেতে না পারলেও মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্নেল তাহেরের কমান্ডিং ১১নং সেক্টরের অধীনে গোয়েন্দাগিরি ও সিগন্যাল ম্যানের কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা স্বীকৃতি ছাড়া তিনি আর কোন খোঁজ খবর নেননি। তাই স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম কখন কিভাবে হয়েছে তা অজানা ছিল। তাছাড়া এ নিয়ে কেউ পাশেও দাঁড়ায়নি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মী হিসেবে একাত্তরে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত যেমন করেছেন স্বাধীনতার পর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত দেশের জাতি গঠনের জন্য এলাকায় গার্লস স্কুল গড়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করা শুরু করলেন।

পাঁচ বছর পর অন্যের উপর দায়িত্ব দিয়ে যোগ দেন মধুপুরের গাংগাইর আহম্মদ আলী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানেও স্থায়ী না হয়ে ১৯৮৩ সালে মধুপুর রাণী ভবানী পাইলট (বর্তমানে সরকারি) উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন। ২০০৩ সালে তিনি মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলায় শ্রেষ্ঠ মাধ্যমিক শিক্ষক নির্বাচিত হন।

সাদামাটা জীবন যাপনকারী মানুষ গড়ার কারিগর একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে গেল নীরবে নিভৃতে। তিন ছেলে-এক মেয়ে ও স্ত্রীর জন্য কোন অবলম্বন তিনি রেখে যাননি। স্বামীর সেইসব দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী বৃদ্ধা ফাতেমা। স্বামীর সেই ত্যাগের স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় বিভিন্নজনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো কাজ হয়নি স্ত্রী ফাতেমা বেগমের।

আবেদন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হকের কাছে। “মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্তি অনলাইনে আবেদন না করে থাকলে কিছুই করণীয় নেই” সিলে এমন লেখার নিচে মন্ত্রী স্বাক্ষর করে দিয়েছেন গত ২০১৫ সালে। ফলে নিয়মের বেড়াজালে আবেদন সেখানেই থমকে গেছে। তবুও আশা জাগিয়ে রেখেছে পরিবারটি।

বৃদ্ধা ফাতেমা আক্ষেপ করে জানান, বেঁচে থাকতে মুক্তিযোদ্ধা স্বামী স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি। কষ্ট বুকে চেপে তাকিয়ে আছেন ভাগ্যের দিকে, অন্তত মৃত্যুর আগে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত তথা স্বামীর স্বীকৃতিটুকু দেখে যাওয়ার ইচ্ছা তার।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড