• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

চাকরি দেওয়ার নামে যুবকদের সর্বশান্ত করছে বিএসএন প্রতারক চক্র

  মোঃ শাকিল শেখ, ঢাকা

১৪ মার্চ ২০২৪, ১৫:৩৮
প্রতারক চক্র

ঢাকার সাভারে অসহায় ও নীরিহ বেকার যুবকদের টার্গেট করে চাকরি দেয়ার নামে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র। শুধু তাই নয়, আবাসন সুবিধা দেয়ার নামে বেকার এসব শত শত যুবকদের আটকে রেখে নির্যাতনেরও অভিযোগ আছে নাম সর্বস্ব ভুয়া বিএসএন গ্লোবাল এই প্রতারক কোম্পানির বিরুদ্ধে। থানায় অভিযোগ করেও সুরাহা না পেয়ে অগত্যা ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা বিভিন্ন সময় প্রতারক প্রতিষ্ঠানে ধরণা ধরে লাঞ্ছিত ও মারধরের শিকার হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে খোঁজে পাওয়া যায়, প্রতারিত হওয়া তেমনি একজন, মানিকগঞ্জ জেলার সদর থানার পূর্ব আটি গ্রামের ইউছুব দেওয়ানের ছেলে জাহিদ হাসান। তার খালাতো ভাই একই এলাকার মারুফ দেওয়ানসহ এরকম শত শত ভুক্তভোগীর সন্ধান। এই প্রতারক চক্র ইতোপূর্বে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হলেও নাম ও এলাকা বদলে নতুন নামে শুরু করে প্রতারণা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কখনও ডিএক্সএন আবার কখনও বিএসএনসহ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে অসহায় ও নীরিহ যুবকদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। কয়েক মাস এক এলাকায় অবস্থান করার পর তাদের প্রতারণা জানাজানি হলে ও অফিসে ভুক্তভোগীরা আসতে শুরু করলে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে তারা। সঙ্গে পাল্টে ফেলে প্রতিষ্ঠানের নামও। কোন বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ও নাম মাত্র ভুয়া প্রডাক্ট দেখিয়ে ট্রেনিংয়ের নামে অসহায় যু্বকদের ভর্তি করে টাকা আত্মসাৎ করাই তাদের কাজ। স্থানীয় প্রভাবশালি বাড়ির মালিকদের বেশি ভাড়ার লোভ দেখিয়ে ফ্লোর ভাড়া নেয় চক্রটি। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করলে তাদের হতে হয় লাঞ্ছিত। ঘটে অপ্রীতিকর মারামারির মতো ঘটনাও।

ভুক্তভোগী মানিকগঞ্জের জাহিদ হাসান বলেন, কয়েক মাস আগে জামগড়া এলাকায় তার খালাতো ভাই মারুফ দেওয়ান ও আমি ৭০ হাজার টাকা চাকরির জন্য প্রদান করি। আমাদের মাসিক মোটা অঙ্কের টাকা বেতন প্রদান করবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় কোম্পানির ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম ও লিডার রাকিব হাসান জুয়েল, বাপ্পীসহ বেশ কয়েকজন প্রতারক। এরপর আমাদের একটি মেসে ৪০-৫০ জনকে গাদাগাদি করে রুমে থাকতে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের কোন বেতন ও কাজ না দিয়ে সারাদিন অহেতুক বিষয়ে ট্রেনিংয়ের নামে সময় পার করতে থাকে তারা। পরে আমি বেতনের জন্য তাগাদা দিলে আমাকে নানাভাবে ভয়ভীতি, হুমকি ও লাঞ্ছিত করে। পরে সেখান থেকে পালিয়ে আমি মানিকগঞ্জ আমার বাড়িতে চলে আসি। পরবর্তীতে আশুলিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেও কোন সুরাহা পাইনি।

বরিশালের উজিরপুরের নাসির বেপারী ছেলে নাদিম হোসেন জানান, গত মাসে আমার বন্ধু বাপ্পীর মাধ্যমে বিএসএন গ্লোবাল লিমিটেড নামে আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুত এলাকার একটা কোম্পানিতে চাকরির জন্য আসি। তখন আমাকে ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে কোম্পানির ম্যানেজার তরিকুল ও রাকিবসহ কয়েকজন ৪০ হাজার টাকা নেয়। আমার বন্ধু বাপ্পীও ৪০ হাজার টাকা দিয়েছে। কিন্তু চাকরি না দিয়ে আমাদের উল্টাপাল্টা ট্রেনিং করিয়ে শুধু সময় পার করতে থাকে। বেতন আর কাজের কথা বললে, আরও লোক নিয়ে আসতে বলে। পরে আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে নানা ভাবে ভয়ভীতি ও লাঞ্ছিত করে তারা। এক পর্যায়ে আমি সেখান থেকে পালিয়ে ঢাকার পল্টনে আমার মামার বাসায় চলে আসি।

তিনি আরও জানান, আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুত এলাকার একটি ফ্ল্যাটে আমাদের ১৬-১৭ জনকে আটকে রেখে নামমাত্র খাওয়া দেয়া হতো। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের হুমকি দেয়া হতো। অনেকেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমার মতো পালিয়ে গেছে।

ভুক্তভোগী প্রতারিত নাদিমের মামা ঢাকা সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, আমার ভাগিনা ও তার বন্ধুকে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিএসএন গ্লোবাল একটি নামসর্বস্ব কোম্পানি। পরে ওদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সেখান থেকে কৌশলে ঢাকায় আমার বাসায় পালিয়ে আসে নাদিম। এরপর গত শুক্রবার আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুত এলাকায় ওই প্রতিষ্ঠানে আমিসহ গেলে তারা টাকা পরিশোধ করবে বলে নানা তালবাহানা করে।

তিনি আরও জানান, মূলত বিভিন্ন নাম সর্বস্ব হারবাল প্রোডাক্ট দেখিয়ে চাকরি দেয়ার নামে এই প্রতিষ্ঠানটি অসহায় যুবকদের সর্বশান্ত করছে। এই যুগে এসেও এরকম প্রতারক প্রতিষ্ঠান কিভাবে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। এখনই এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

আরও জানা গেছে, এদিকে প্রায় এক সপ্তাহ আগে আশুলিয়ার ডেন্ডাবর এলাকায় মো. ইদ্রিসের বাড়ির দ্বিতীয় তলার বিএসএন গ্লোবাল লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়ে স্থানীয় সাংবাদিকরা গেলে তাদের প্রথমে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন প্রতিষ্ঠানের লিডার রাকিবসহ কয়েকজন। এসময় ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কথা জানতে পেরে সেখানে আরও ভুক্তভোগী ও তাদের স্থানীয় লোকজন জড়ো হলে ম্যানেজার তরিকুল কৌশলে পালিয়ে যায়। এসময় প্রতারক কোম্পানির পক্ষে ভবন মালিক ইদ্রিস ও তার ছেলে রাকিবসহ বেশকয়েকজন প্রভাবশালীদের রোশানলের মুখে পড়েন তারা। তবে পরবর্তীতে প্রতারক কোম্পানির সত্যতা পেয়ে নিজেরাই তালা ঝুলিয়ে দেয়ার কথা জানান ভবন মালিক ও তার ছেলেরা (ধারণকৃত ভিডিও বক্তব্য)।

এসময় উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রতারক প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে আশুলিয়া থানাকে বিষয়টি অবহিত করলেও পরবর্তীতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এঘটনার পর ভুক্তভোগীদের টাকা লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রতারক কোম্পানির লোকজন স্থানীয় রিয়াজ নামে এক যুবকের বিবাদে জড়িযে পড়লে ঘটে মারামারির ঘটনা। এতে কোম্পানির ম্যানেজার তরিকুল, লিডার রাকিব, ভবন মালিকের ছেলে রাকিব, স্থানীয় যুবক রিয়াজ ও গাউছসহ অন্তত ৮-১০ জন আহত হয়। পরে তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।

তথ্য সংগ্রহ ও প্রতারণার সত্যতা জানতে ওই প্রতিষ্ঠানে যাওয়া এক স্থানীয় সাংবাদিক বলেন, প্রতারণা করে মানুষের কাছে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পেয়ে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক বিএসএন নামে ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে অন্য ভুক্তভোগীর লোকজন, ভবন মালিক ও প্রতারক কোম্পানির দায়িত্বরতরা উপস্থিত ছিলেন। এসময় কোম্পানির লোকজন বৈধ কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি, যেটা ভবন মালিক নিজেও স্বীকার করে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। যদিও ওই সময় তাদের রোষানলে পড়তে হয়েছিলো আমাদের। তাৎক্ষণিক আমরা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করেছি।

প্রতারক কোম্পানির লোকজনের মারধরে আহত স্থানীয় যুবক রিয়াজ জানান, এখানে প্রতারক কোম্পানি খুলে মানুষকে সর্বশান্ত করছে এমন খোঁজ পেয়ে আমি কিছুদিন পূর্বে সেখানে গিয়েছিলাম। আমার পরিচিত মেহেদী নামে একজন ওখানে চাকরির জন্য ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছিলো। কোম্পানির লোকজন সেই টাকা দিবে বলে নানাভাবে তালবাহানা করে আসছিলো। পরে গত শনিবার তাদের অফিসের সামনে থেকে আমাকে তারা ডেকে ভিতরে নিয়ে আটকে মারধর করে। খবর পেয়ে আমার বন্ধু গাউছসহ অন্যান্যরা সেখানে আসলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ভবন মালিকের ছেলে রাকিবসহ তার মার্কেটের লোকজন মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে আমি, গাউছসহ উভয়পক্ষের বেশকয়েকজন আহত হই। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি শান্ত করে।

মারধরে আহত প্রতারক রাকিব হাসান বলেন, রিয়াজ নামের ওই যুবক আমাদের অফিসে প্রবেশ করে টাকা দাবি করে আমাকে মারধর করেছে। এর আগেও তাকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি। যদিও তিনি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।

ইতোপূর্বে বিএসএন কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম নিজেদের বৈধতা আছে দাবি করলেও কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী জাহিদ, মারুফ ও নাহিদসহ প্রতারিত বেশ কয়েকজনের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার কথা জানান তিনি।

তরিকুল জানান, আগে জামগড়ায় আমাদের অফিস ছিলো ডিএক্সএন। ওখানেন জাহাঙ্গীর নামে আমার এক বন্ধু পার্টনার ছিলো। মাস খানেকের বেশি হইছে আমরা ওখান থেকে চলে আসছি। এখন যারা যারা অভিযোগ দিতেছে তাদের টাকা আমরা ফেরত দিব।

এবিষয়ে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ বলেন, প্রতারক কোম্পানিতে টাকা লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। এঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে। তদন্ত করে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড