• রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দিয়ারা জরিপে ব্যাপক অনিয়ম

বাউফলে ভূমি জরিপে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য

  মো. আবুবকর মিল্টন, বাউফল (পটুয়াখালী)

৩০ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৫৯
বাউফলে ভূমি জরিপে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য

পটুয়াখালীর বাউফলে ভূমি জরিপের ২ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতি খতিয়ানের (পর্চা) বিপরীতে নেয়া হচ্ছে ১-৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর এ সকল লেন-দেনে সহায়তা করছেন সরদার আমিন মো. গিয়াস উদ্দিন, অফিস সহকারী মন্টু মিয়াসহ স্থানীয় কিছু দালাল।

তবে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন স্থানীয় ভূমি মালিক। কারণ কর্মকর্তাদের সরাসরি সাহায্য করছেন স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা।

জানা গেছে, ১৯৫৪ সালের পর বাংলাদেশের দক্ষিণের জনপদ বাউফলে আর কোন ভূমি জরিপ হয়নি। দীর্ঘ ৭০ বছর পর বাউফলে চর দিয়ারা কচুয়ার ২৩টি মৌজায় জরিপ কাজ শুরু করে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ (সেটেলমেন্ট) অধিদপ্তর।

৯৮ সালে একটি জরিপ হয় কিন্তু সেটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় আবার জরিপটি পুনরায় চলমান আছে।

মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ করে উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের শৌলা মৌজায় চলছে অ্যাটেস্টেশন বা তসদিক কার্যক্রম। একাজে শৌলা মৌজায় দায়িত্বে ছিলেন কর্মকর্তা (কানুনগো) মো. খলিলুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান (কানুনগো)।

তাদের কাজে সহায়তায় ছিলেন সরদার আমিন মো. গিয়াস উদ্দিন, অফিস সহকারী মন্টু মিয়া। এর পর ৩০ ধারার অভিযোগের শুনানি এবং সর্বশেষ ৩১ ধারার আপিলের শুনানি শেষে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়া হবে প্রকৃত জমি মালিককে।

বাউফল ভূমি অফিসের দেয়া তথ্য মতে, ভূমি জরিপ সম্পূর্ণ সেটেলমেন্ট অফিসের (বরিশালের) কাজ। এর সাথে বাউফল অফিসের কোনো সংযোগ নেই। এই জরিপের কাজ করবেন একজন কানুনগো ও সার্ভেয়ার। তবে এটাই শেষ জরিপ এর পর থেকে ডিজিটাল জরিপের কাজ শুরু হবে। ৩০ ধারায় যারা অভিযোগ করতে পারবেন না তারা ৩১ ধারায় কোন আইনি সহায়তা পাবেন না।

কারণ ৩১ ধারার অভিযোগগুলোর সমাধান না হলে সেগুলোই ৩১ ধারার মাধ্যমে পুনঃ তদন্ত করে অভিযোগের সমাধান দেয়া হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে যদি কোনো গ্রাহক ভুলেও ৩০ ধারা মিস করেন সে তার জমি হারানোর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এ জরিপের গেজেট পাশ হতে ৪/৫ বছর সময় লাগে যেতে পারে বলেও জানান তারা। গেজেটের পর আবার ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল বা দেওয়ানী আদালত বসবে। সেখানেও ভুল-ত্রটির উপর অভিযোগ দাখিল কারা যাবে।

গেজেট পাশ হওয়ার পর আইনি সহায়তার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে। সে ক্ষেত্রে জরিপে বন্দোবস্ত পাওয়া ব্যক্তিরাই এগিয়ে থাকবেন।

কিন্তু মাঠ পর্যায়ে জরিপে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেন গ্রাহক। এরপর শুরু হয় টাকার খেলা। নিজস্ব পৈত্তিক সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পেতেও টাকা গুনতে হচ্ছে প্রতিটি কৃষককে। টাকার লেন-দেন করছেন সার্ভেয়ার গিয়াস উদ্দিন যিনি কাকুনগো খলিলুর রহমানের সহকারী হিসেবে তার টেবিলে কাজ করছেন। স্থায়ী ভাবে জমি হারানোর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না স্থানীয়রা। অপর দিকে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ। কেউ মুখ খুললে জমির রেকর্ড অন্যের নামে হয়ে যাবে বলে ভয় দেখান দালালরা।

দায়িত্বপ্রাপ্ত কানুনগো মো. খলিলুর রহমানের দেয়া তথ্য মতে, শৌলা মৌজার দিয়ারা জরিপে ৮০৮৫টি খতিয়ানের (পর্চা) জরিপ কাজ সম্পন্ন করে ‘দিয়ারা সেটেলমেন্ট অপারেশন অফিস’ বরিশাল। নকশা তৈরি কাজ শেষে শুরু হয় অ্যাটাস্টেশন বা তসদিক কাজ। তসদিক কাজে মোট ১ হাজার ৮৪টি পর্চা বা খতিয়ানের উপর ডিসপুট (আপত্তি) দেয়া হয়।

কৃষকদের অভিযোগ, প্রতিটি পর্চা তসদিক করতে একজন কৃষকের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ১ হাজার করে টাকা নেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ৮ হাজার ৮৪টি পরচার জন্য ১ হাজার করে প্রায় ৮১ লাখ টাকা হাতিয়েছেন ওই ভূমি জরিপ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

প্রথমে মাঠ পর্যায়ে জমির নকশা তৈরির কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। মূল সমস্যা তৈরি হয় এই মাঠ পর্যায়ের নকশা তৈরিতেই। নকশার মাধ্যমে একজনের জায়গা অন্যজনকে মালিকানা ঘোষণা করা হলে শুরু হয় টাকার খেলা। টাকার বিনিময়ে জমি ফেরত পেতে দৌড়-ঝাপ শুরু হয় কৃষকের। নকশা তৈরিতে অনেক রাজনৈতিক নেতাদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

নকশা তৈরি কাজ শেষে শুরু হয় অ্যাটাস্টেশন কাজ। এতে মোট ১ হাজার ৮৪টি পর্চায় ডিসপুট দেয়া হয়। ডিসপুট পরচার কাজ করতে প্রতিটি গ্রাহককে গুনতে হয়েছে ২ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সর্বনিম্ন ২ হাজার করে ১ হাজার ৮৪টি খতিয়ান পর্চায় মোট ২১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা আদায় করেছেন গ্রাহকদের কাছ থেকে। তবে এ সকল গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের টাকা গ্রহণ করেছেন ওই কর্মকর্তা। ৩০-৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত গেছে গ্রাহকের পকেট থেকে।

এ ক্ষেত্রে নকশা পরিবর্তনে কত টাকার লেন-দেন হয়েছে সেটা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি কারণ, নকশার ক্ষেত্রে যারা লাভবান হয়েছেন তারা কোনোভাবেই মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে বড় অংকের টাকা লেন-দেন হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। রয়েছে ৩০ ধারার শুনানি।

টাকার খেলা সেখানেও হতে পারে। এরপর ৩১ ধারায় আপিল। যত উপরে দিকে যাচ্ছে তত টাকর পরিমাণ বাড়তে থাকবে। গত ৩০ জুন অ্যাটাস্টেশন কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এখন অপেক্ষা ৩০ ধারার অভিযোগের শুনানি।

তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, জরিপ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে শৌলা মৌজার গ্রাহকদের কাছ থেকে অনুমানিক ২০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। আর টাকা লেন-দেনে সরদার আমিন গিয়াসকেই দায়ী করেছেন সবাই। রয়েছেন- মাইনুদ্দি, মোফাজ্জেল মাওলানা ওইমদাদ নামের কয়েকজন দালালও। এসব দালালরা রাজনৈতিক ছত্র-ছায়ায় থেকে নিরাপদে টাকা-পয়সার লেন-দেন চালিয়েছেন।

মঞ্জুরুল আলম নামের এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, আমার কাছ থেকে ৩ দফায় ৬০ হাজার টাকা নিয়েছেন গিয়াস। কিন্তু তারপরও আমার কাজ করে দেননি। আমার বাড়ির চলাচলের রাস্তা আমার প্রতিবেশীর নামে রেকর্ড করে দিয়েছেন আরও বেশি টাকার বিনিময়।

কালাইয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শৌলা গ্রামের আমিনুল ইসলাম বলেন, আমার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়েছে গিয়াস। কিন্তু একই বাড়ির অপর এক ব্যক্তি পৈত্মিকভাবে দেড় শতক জমির মালিক অথচ টাকার বিনিময়ে ওই দাগের ৭শতক জমি পুরোটা তার নামে রেকর্ড করে নিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (কবির হাওলাদার) এক ব্যক্তি জানান, জরিপে যে পরিমাণ টাকা তারা (কর্তৃপক্ষ) কামিয়েছে তা গুনতে ওদের এক বছর সময় লাগবে। এত পরিমাণ টাকা তারা স্থানীয়দের কাছ থেকে আদায় করেছেন। কৃষক তাদের গাছ, মাছ বিক্রি করে টাকা দিয়েছে।

তবে অভিযোগ স্বীকার করেছেন কানুনগো সিদ্দিকুর রহমান ও সরদার আমিন মো. গিয়াস উদ্দিন। তারা দৈনিক অধিকার কে বলেন, প্রতিটি খতিয়ান বা পরচার কাজ করে দিয়েছি, বিনিময়ে ভূমি মালিকরা আমাদেরকে চা-পান খেতে কিছু দিয়েছে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড