• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩২ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

বন বিভাগের জমি দখল করে নগরায়ন

প্রতিমাসে প্রায় কোটি টাকা ভাড়া আদায়

  আব্দুর রউফ রুবেল, গাজীপুর

২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:২৩
বন বিভাগের জমি দখল করে নগরায়ন

গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর রেঞ্জ ভাওয়াল গড়ের একটি অংশ। শাল গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সবুজে আচ্ছাদিত ছিল চারপাশ। কিন্তু অবৈধ দখলদার ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে দিন দিন বেহাত হয়ে যাচ্ছে সবুজ বনায়ন এবং সরকারি সম্পদ।

সরকারি বন বিভাগের জমি দখল করে নির্মাণ করেছে স্থাপনা এবংনসেখান থেকে প্রতিমাসে প্রায় কোটি টাকা ভাড়া আদায় করে দখলদাররা।

সরকারি হিসেবে কালিয়াকৈরে রেঞ্জ সাড়ে ২৯ হাজার একর বনভূমি থাকলেও বাস্তবে এর পরিধি দিন দিন কমে আসছে। বন উজাড় করে তৈরি করছে আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণ এবং কাঁচা পাকা বাণিজ্যিক ভবন। বিশেষ করে কালিয়াকৈর রেঞ্জের চন্দ্রা বিটের মাটিকাটা এলাকায় এক দশক আগেও এই বনাঞ্চলে পশু পাখির অভয় আশ্রম ছিল।

অবৈধ দখলদাররা নির্বিচারে জীবিত গাছগুলোকে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে মেরে ফেলছে। বিগত সময় গুলোতে রাতের অন্ধকারে এক শ্রেণির কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও বনের দালালদের সহযোগিতায় সেই স্থানগুলোতে তৈরি করছে দোকান ও বাসা বাড়ি। তৈরিকৃত স্থাপনা বিভিন্ন মূল্যের স্ট্যাম্পের মাধ্যমে এককালীন বিক্রি ও চুক্তিপত্র করে মাসিক ভাড়া দিচ্ছে।

সেই দালালদের সহযোগিতায় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের কিছু অর্থলোভী কর্মকর্তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করছে। কিছু কিছু বাসা বাড়িতে রয়েছে তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বৈধ গ্যাস সংযোগ।

গভীর অরণ্য আজ সবুজের অস্তিত্ব সংকটে। বিশেষ করে উপজেলার মাটিকাটা রেলগেট এলাকায় রাতারাতি দখলদারিত্ব হয়েছে বেশি। ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা পল্লীবিদ্যুৎ এলাকা থেকে মাটিকাটা আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে । এই সড়কের দুপাশে বন উজাড় করে দোকান নির্মাণ করেছেন বনভূমি দখলে থাকা ব্যক্তিরা।

যানবাহন ও পথচারী চলাচলে বাধা তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। স্থানীয় বন কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযানের প্রস্তাবনা করে। অজানা কারণে উচ্ছেদ অভিযান পন্ড হয়ে যায় । চাপা পড়ে যায় উচ্ছেদ প্রস্তাবনার কাগজপত্র।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ প্রস্তাবনা বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে প্রেরণ করা হলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে এই বন উজাড় হওয়ার আগ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে কিনা বলে সন্দেহ রয়েছে মনে করে স্থানীয়রা।

গত কয়েক বছর আগেও দুইবার অবৈধ দখল উচ্ছেদের বিভিন্ন প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রথমবার তৎকালীন বিট অফিসার অবৈধ দখলদারদের মৌখিকভাবে নোটিশ করে পরে ছয় মাস পর্যন্ত কোন খোঁজ খবর ছিল না। পুনরায় বিট কর্মকর্তা ও তার সহকারীদের নিয়ে নতুন করে মৌখিক নোটিশ ও সরেজমিনে দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে।

এরপর আবার অজানা কারণে থেমে যায় উচ্ছেদ কার্যক্রম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা অনেকেই বলে বনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও উপজেলা প্রশাসন উচ্ছেদে নিরুৎসাহি।

অপরদিকে উচ্ছেদের কথা বলে বন কর্মকর্তা ও বনের দালালেরা বিভিন্ন উপায়ে সুবিধা গ্রহণ করে আসছে। বিগত সময়ে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বন বিভাগের জমি অবৈধ দখলের উপর সংবাদ উপস্থাপন করলে সেই স্থানটি উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদের কিছুদিন পর বন বিভাগের সহযোগীতায় মাটিকাটা রেলগেট এলাকায় অবৈধ দখলদারদের বিভিন্ন ধরনের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে টাকা গ্রহণের অভিযোগ উঠে।

এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই উচ্ছেদের কথা বলে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বনের দালালেরা দোকানদারদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। দোকানদারদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা এ বিষয়ে স্বীকার না করলেও চোখে মুখে মিথ্যার আশ্রয় ফুটে উঠে।

সরেজমিনে দেখা যায়, চন্দ্রা বিটের এপেক্স হোল্ডিং ও ফারইস্ট কারখানা থেকে রেলগেট পর্যন্ত আঞ্চলিক সড়কের দুপাশে বন বিভাগের গাছ নিধন করে প্রায় ৫ সহস্রাধিক দোকান ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছে। রাস্তার পাশে ৮০ থেকে ১০০ স্কয়ার ফিট কাঁচা বা আধাপাকা দোকানের অবস্থান বুঝে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জামানত দিয়ে ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়া প্রদান করতে হয়।

এছাড়াও ওই সমপরিমাণ শুধু দখল এককালীন কিনতে চাইলে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা গুনতে হয়। এরপরে ঘর নির্মাণ করার সময় বিভিন্ন সময় দালালদের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করতে থাকে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। একেকজন দখলদারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রায় শতাধিক দোকান।

আর মাটিকাটা এলাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা দখলদারের সংখ্যা রয়েছে ১৫ থেকে ২০ জন। তাদের ভয়ে মুখ খুলতে পারে না স্থানীয়রা। আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশ দিয়ে দোকান প্রসারিত করে সড়ক দখল করে ফেলেছে।

প্রতিনিয়তই এই এলাকার রাস্তাগুলোতে যানবাহনের জটলা লেগেই থাকে। যার কারণে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এর কারণ হিসেবে এলাকার সচেতন মহল, পথচারী ও এলাকায় বসবাসকারীরা মনে করছেন রাস্তার পাশ দিয়ে বনের জমি দখল করে অবৈধ দোকানপাট গড়ে ওঠার কারণে এখানে যানজটের সৃষ্টি হয়।

স্থানীয়রা জানান, রাস্তার পাশ দখলের পাশাপাশি ওই পুরো এলাকার বনের জমি প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন ভাবে স্টাম্পের মাধ্যমে চুক্তি করে বিক্রি করেছে। প্রতিটি প্লটের জন্য ৫০ হাজার থেকে ৫ লক্ষ টাকা অগ্রিম জামানত নেয়া হয়।

দোকান ছেড়ে চলে গেলে অনেক সময় জামানতের টাকা ফেরত দিতে নানা তালবাহানা করে। এমনকি ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে।প্রত্যেক প্লটের জন্য ভাড়া বাবদ ২ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেয়া হয় বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় ব্যাক্তি জানায় , দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিভিন্ন সময় থেকে দখলদারিত্ব করে আসছে। তাদের একেকজনের নামে বন বিভাগের একাধিক প্লট বরাদ্দ রয়েছে। তারাই এই দখলদারিত্বের সাথে জড়িত। বাড়ি ঘর ও দোকানপাট নির্মাণ করে ভাড়া আদায় করছে।

বন বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই বিষয়ে অবগত থাকলেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনা। বনের কর্মকর্তাও কর্মচারীরা তাদের অফিস ও দোকানে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতে দেখা যায়।

অবৈধ দখলদার সোহরাব হোসেন জানান, এগুলো আমি একা নিচ্ছি না। এখানে প্রায় দুই হাজার দোকান আছে। যে যেরকম ভাবে দখল করেছে সে অনুপাতে একেকজনে ভাড়া নিচ্ছে।

গাজীপুরের সহকারী বন সংরক্ষক রেজাউল করিম বলেন , দীর্ঘদিন ধরে বনের জমির অবৈধভাবে দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে আসছে। বর্তমানে এরা এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে পারছে না। অবৈধ দখলের বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে। এ বিষয়ে আমার তেমন জানা নেই।

কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ জানান, চন্দ্রা বিটে বেশকিছু স্থানে অবৈধ দখলদাররা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। সরকারি বিধি মোতাবেক উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড