• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩১ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

সিজারের পর পেটে গজ-ক্লিপ রেখেই সেলাই! রোগীর মৃত্যু

  জে রাসেল, ফরিদপুর

২৮ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:২৪
সিজারের পর পেটে গজ-ক্লিপ রেখেই সেলাই! রোগীর মৃত্যু
সুমি প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোম (ছবি : অধিকার)

সিজারের পর প্রসূতির পেটে গজ কাপড়, টিস্যু ও ক্লিপ রেখে সেলাই, সেই সেলাইটাও ঢিলেঢালা। যেন সবকিছুই দায়সাড়া। এমন ঘটনায় পেটে রক্ত জমাট বেধে পচে দুর্গন্ধ হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনার ১১দিন পরে ঐ প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়েছে।

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলা সদরের সুমি প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি আড়াল করার জন্য মৃত প্রসূতির স্বজনদের মীমাংসার প্রস্তাব দিয়েছে ঐ ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, গত ১৩ এপ্রিল পেটে ব্যথা নিয়ে সুমি ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে যান উপজেলার বাগাট ইউনিয়নের মিটাইন গ্রামের মনিরুল ইসলামের স্ত্রী রত্না বেগম। এক পর্যায়ে তাকে সিজার করার পরামর্শ দেন ঐ ক্লিনিকের সত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তার। পরে ঐদিন রাতেই তার অপারেশন করেন মাগুরা থেকে আসা ডাক্তার মাসুদুল হক।

ঘটনার ১০দিন পর ২৩ এপ্রিল প্রসূতি মায়ের ব্লিডিং শুরু হলে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। ঐ দিনই প্রসূতিকে ঢাকা মেডিক্যালে রেফার্ড করেন কর্তব্যরত ডাক্তার। এরপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ও পেটে ইনফেকশনে ২৪ এপ্রিল মৃত্যু হয় ঐ প্রসূতি মায়ের।

মৃত রত্না বেগমের স্বামী মো. মনিরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ১৩ এপ্রিল সুমি ক্লিনিকে আমার স্ত্রীর সিজার করানো হয়। তখন আমার পুত্র সন্তান হয়। এরপরই বাচ্চা অসুস্থ হওয়ায় ফরিদপুর শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর তারা সেলাই করে বেডে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীকালে কয়েকদিন পরে আমার স্ত্রীর প্রচুর ব্লিডিং শুরু হয়।

তখন ফরিদপুর মেডিক্যালে নিলে ডাক্তার দেখে বলে, সিজারের পরে যে সেলাই করা হয়েছে তার মাঝে ফাঁকা রয়েছে, সুতো মিলে নাই, ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে পচে গেছে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শে রোগীকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাই।

সেখানকার ডাক্তার জানান, যতক্ষণ ব্লাড দেয়া হবে, ততক্ষণই রোগী বাঁচবে। আমি তখন ডাক্তারের কাছে সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন, এই রোগীর যে সিজার করেছে সে ডাক্তার নাকি কসাই? সেলাই ভালো হয়নি, ফুটো রয়েছে। এরপর আল্ট্রাসনোগ্রাম করে অপারেশন করা হলে দেখা যায়, ভেতরে তুলো, গজ কাপড় ও একটা ক্লিপ রয়েছে। এছাড়া বাচ্চার নাড়িও সঠিকভাবে কাটা হয়নি, ভেতরে রয়ে গেছে। যে কারণে, পেটের ভেতর পচে দুর্গন্ধ হয়ে ইনফেকশন হয়ে মারা গেছে।

এ সময় প্রসূতি রত্নার মা বলেন, আমার মেয়ের পেটে ব্যথা উঠলে ডাক্তার দেখাতে যাই। তখন সুমি ক্লিনিকের সুমি আক্তার সিজার করাতে বলে। আমরা চলে আসতে গেলে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাদের এখানে ভালো ডাক্তার রয়েছে, আপনার মেয়ের সমস্যা হবে না। এখন কি করলো ওরা, আমি ওদের বিচার চাই।

এ সময় স্থানীয়রা সুমি ক্লিনিক বন্ধ ও জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, এটা হত্যাকাণ্ড। আমরা সুমি ক্লিনিকের সর্বোচ্চ বিচারের দাবি জানাই। তারা আরও বলেন, সুমি ক্লিনিকতো ক্লিনিক নয়, একটা কসাইখানা। রোগী গেলে তারা ছাড়ে না। জোড় করে রেখে দেয়। এর আগেও এ রকম কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছে।

তারা অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের সত্ত্বাধিকারী সুমি নামের মেয়েটি উন্নত চিকিৎসার জন্য বাঁধা দিয়েছে। সিজারের আগে জানানো হয়েছিলো, এখানে সিজার করবো না কিন্তু গ্রামের মানুষ পেয়ে ভুল বুঝিয়ে সিজার করে।

এ দিকে রত্না বেগমের সিজারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ডা. মাসুদুল হক। তিনি জানিয়েছেন, গত দেড় বছর যাবৎ মধুখালীতে যাওয়া হয় না, আমি কিভাবে সিজার করবো। তবে, ঐ ক্লিনিকের সত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তারের দাবি ডা. মাসুদুল হক সিজার করেছেন কিন্তু তার কোনো স্বাক্ষর রাখা হয়নি। সুমি আক্তার আরও জানান, ডা. মাসুদুল হক ও ডা. সালাম এখানে যে অপারেশন করেন তার কোনো প্রমাণ আমরা রাখতে পারি না। তাদেরকে সই করতে বললে তারা বলে পরে করবো।

গতকাল বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিনে গেলে ডা. মাসুদকে না পাওয়া গেলে মুঠোফোনে কথা হলে বিষয়টি উঠে আসে।

এ সময় এ প্রতিবেদকের সাথে সংবাদ সংক্রান্ত বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন সত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তার। তিনি অপর সত্ত্বাধিকারী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. মুরাদুজ্জামানের (মুরাদ) সাথে কথা বলতে বলেন এবং তাৎক্ষনিক ডেকে আনেন।

এ সময় মুরাদুজ্জামান বলেন, আপাতত বক্তব্যর প্রয়োজন নেই। আমরা রোগীর স্বজনদের সাথে মীমাংসার কথা বলেছি।

এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আ. সালাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ দিকে সরেজমিনে উঠে আসে সুমি ক্লিনিকের বিভিন্ন অনিয়ম। ১০ শয্যা বিশিষ্ট এই ক্লিনিকটিতে মাত্র একজন ডিপ্লোমাধারী নার্স রয়েছে, এমনকি নেই কোনো আবাসিক ডাক্তার। ২৭ এপ্রিল পাঁচজন রোগী ক্লিনিকটিতে ভর্তি থাকলেও ছিল না কোনো ডাক্তার বা নার্স। ভ্রাম্যমাণ ডাক্তার দিয়েই করানো হয় সিজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড