• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই বহিরাগতরা অপরাধ করছে’

  তুষার আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ

১৫ মার্চ ২০২৩, ১৪:৩১
‘প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই বহিরাগতরা অপরাধ করছে’

প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। মোঘল আমলেরও পূর্বে খিজিরপুর, কদমরসুল ও মদনগঞ্জ ছিল এই ভূখণ্ডের বাণিজ্যিক অঞ্চল এবং আন্তর্জাতিক নদীবন্দর। লক্ষ্মী নারায়ণ ঠাকুরের নামে উৎসর্গকৃত বলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে খিজিরপুর বদলিয়ে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় ‘নারায়ণগঞ্জ’। ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ২৯২ বর্গমাইল আয়তনের এই নারায়ণগঞ্জকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

ভৌগলিক অবস্থান, রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং ব্যবসা বাণিজ্যের আদর্শ স্থান হওয়ায় আদি থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বিচরণ ছিল এখানে। যুগে যুগে পরিবর্তন হওয়া এই জেলার সমৃদ্ধতার পেছনে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের শ্রম রয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠায় ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’ উপাধি পায় নারায়ণগঞ্জ। যা এখন শিল্প নগরীতে সমৃদ্ধ।

প্রবীণরা বলছেন, দীর্ঘ এই পথচলায় নারায়ণগঞ্জের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রয়েছে দেশের প্রতিটি জেলা থেকে আসা কর্মঠে মানুষদের। নিরাপদ হওয়ায় অনেক বনিকরাই এই নারায়ণগঞ্জে এসে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছেন। বহিরাগতরা কালক্রমে এখানে জনপ্রতিনিধিও হয়েছেন। পরিবর্তন করেছেন নিজেদের ভাগ্য। আবার সরকারি কর্মকর্তা, বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাদের মাঝেও প্রতিযোগিতা দেখা যায় নারায়ণগঞ্জে পোস্টিং নিয়ে। যাদের অনেকেই নারায়ণগঞ্জ থেকে অঢেল সম্পদ কুড়িয়ে গেছেন।

দুর্নীতিবাজ ওই কর্মকর্তারা নারায়ণগঞ্জকে আয়ের উৎস বানালেও তারা নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা নন। আসেন বিভিন্ন জেলা থেকে। শুধু কী তাই? ভিক্ষাবৃত্তি বৃদ্ধি পাওয়া এই জেলায় যারা মানুষের দ্বারে হাত পাতেন তারাও এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নন। যাদের অনেকে সচল হয়েও অচলের অভিনয় করে ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছেন।

যদিও শিল্প সমৃদ্ধ এই জেলা গত কয়েক দশক ধরেই গুম, খুন আর আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই নারায়ণগঞ্জকে ভোগের মাধ্যম বানিয়েছেন বলেই এখানে অপরাধের দ্রুত বিস্তার ঘটছে।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জে ঘটে যাওয়া রোম হর্ষক হত্যাকাণ্ড বা নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডে যারা লিপ্ত হচ্ছেন, তারা এই জেলার বাসিন্দা নন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাষায় তারা ‘ভাসমান’ নাগরিক। অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা নন; বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এমন ভাসমান ব্যক্তিরাই এখানে অবস্থান নিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছেন। ‘নিরাপদ’ স্থান হিসেবে তারা বেছে নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জকে। অথচ, বহিরাগতরা এখানে অপরাধে জড়ালেও অভিযোগের আঙ্গুল উঠার পাশাপাশি ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এ জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের।

ঘটনা সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার মধ্য রাতে ফতুল্লার চর কাশিপুর এলাকায় ইউসুফ (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে রড দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তার অটো রিকশা ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে তিন খুনিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত তিনজনই নারায়ণগঞ্জে ভাসমান বা ভাড়াটে।

এদের মধ্যে একজন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর মাস্টারপাড়া এলাকার তোজাম্মেল হকের ছেলে মাহবুব (২৪)। দ্বিতীয় জন ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানার আহম্মদপুরের মো. আয়নাল মিয়ার ছেলে আমিন (২৩) এবং তৃতীয় জন কুমিল্লার মেঘনা থানার মির্জানগরের আক্তার হোসেনের পুত্র কাউছার (২২)। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ইউসুফও নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা নন। তিনি লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর থানার কালকিনি গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে।

তথ্য মতে, নারায়ণগঞ্জে অটো ছিনতাই এবং চালককে হত্যার ঘটনা লাগাম টানা যাচ্ছে না। যদিও বেশ কয়েকটি ঘটনার পর ঘাতকদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। এতে দেখা গেছে, গ্রেফতার হওয়া ঘাতকদের প্রত্যেকেই নারায়ণগঞ্জে ভাসমান অবস্থায় আছেন। যাদের প্রত্যেকে বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা।

এছাড়াও মাদকের বড় বড় চালানসহ গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের স্থায়ী ঠিকানাও নারায়ণগঞ্জে নয়। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ নারায়ণগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছেন।

অতীত বলছে, নারায়ণগঞ্জে সংগঠিত হওয়া বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে লোম হর্ষক ও আলোচিত ঘটনা হলো সাত খুন। যা দেশের বাহিরেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তথ্য বলছে, সাত খুনের কিলিং মিশনে যোগ দেয়া র্যাবের তৎকালীন কর্মকর্তা বা সদস্যদের কেউ-ই নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা নন। র্যাব-১১’তে চাকুরির সুবাদে তারা বিভিন্ন জেলা থেকে নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। যদিও এই কিলিং মিশনের অর্থ যোগান দাতা নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা। তবে নূর হোসেনের দেয়া অর্থের লোভে লোম হর্ষক ওই হত্যাকাণ্ড যারা সংগঠিত করেছেন, তারা বিভিন্ন জেলার মানুষ।

৭ খুনের পর নারায়ণগঞ্জে বড় হত্যাকাণ্ড ধরা হয় পাঁচ খুনকে। যা ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ শহরের বাবুরাইল খানকা মোড় এলাকায় ‘আশেক আলী ভিলা’ নামের একটি বাড়ির নীচতলার সংঘটিত হয়েছিল। ওই হত্যাকাণ্ডের পর নারায়ণগঞ্জকে ভিন্ন ভাবে দেখা হলেও এর ঘাতক ভাগ্নে মাহফুজ নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা নন।

বহিরাগতদের অপরাধের দ্বারা নারায়ণগঞ্জের মানুষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া নিয়ে প্রায় সময়ই নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকেন বিশিষ্ট জনেরা। জানতে চাইলে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহবায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, দেশের একমাত্র জেলা নারায়ণগঞ্জ যেখানে অন্য সমস্ত জেলার মানুষ আসে জীবিকা নির্বাহের জন্য। এটা হয়ে উঠেছে সারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য।

স্থানীয় বলতে যেটা বুঝায় প্রকৃত অর্থে এখানে তার গুরুত্ব খুব একটা নেই। আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলো গার্মেন্টসের কারণে সমৃদ্ধ হয়েছে। এসকল গার্মেন্টসের জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে এখানে বসবাস করছে। উত্তর বঙ্গ দক্ষিণ বঙ্গ থেকে মানুষ এসে এখানে রিকশা চালাচ্ছে। হকার যারা বসে তারা অধিকাংশই নারায়ণগঞ্জের বাহিরের মানুষ।

কিন্তু বিষয় হলো- এসব নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এই জেলায় যারা বসবাস করে তারা আইন মেনে সু-শৃঙ্খল ভাবে চলছে কি-না; তা দেখভাল করার দায়িত্ব প্রশাসনের উপরে থাকলেও দেখা যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জে আসা প্রশাসনের লোকজনই বিভিন্ন সময়ে অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। তারা যখন অপরাধে জড়িত হয় তখন বাহির থেকে আসা অপরাধীরাও এখানে আস্কারা পায়।

রফিউর রাব্বি বলেন, নারায়ণগঞ্জের বাহিরে এমনিতেই প্রচার রয়েছে যে, এখানে অপরাধ করে সহজে পাড় পাওয়া যায়। এর সত্যতাও রয়েছে। যার ফলে অন্য জায়গার অপরাধীরা নারায়ণগঞ্জে আসে এবং অন্য জায়গায় যারা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে তারাও নারায়ণগঞ্জে এসে পরে। ভিন্ন জায়গায় খুন করেও শীতলক্ষ্যায় এসে লাশ ফেলে। এটা হচ্ছে প্রশাসনের পুরোপুরি ব্যর্থতার কারণ।

তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জের মানুষও বিভিন্ন সময়ে অপরাধ করছে। কিন্তু প্রশাসন এই অপরাধীদের সাথে আঁতাত করছে। এ জন্য নারায়ণগঞ্জে অপরাধ কমছে না।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড