মনিরুজ্জামান, নরসিংদী
ভূমধ্যসাগর হয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপ যেতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন ৩০ বাংলাদেশি। এদের মধ্যে ১৫ জনই নরসিংদীর। এ ঘটনায় নিখোঁজদের পরিবারে নেমে এসেছে শোক। তাদের স্বজনরা এখনও আশায় বুক বেঁধে আছেন, নিখোঁজ স্বজনরা বেঁচে আছেন।
শনিবার (৫ মার্চ) সন্ধ্যায় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ নরসিংদীর ডৌকারচর এলাকার আল আমিন ফরাজির (৩৩) বাড়িতে সরেজমিনে গেলে তার মা রুবি বেগম দৈনিক অধিকারকে বলেন, ইতালি রওনা দেয়ার সময় আমার ছেলে আমারে ফোন করে দালালদের পাওনা সাড়ে ৬ লাখ টেহা দেওয়ার লাইগা আমারে কাকুতিমিনতি করে। তা না হইলে হেরে লিবিয়া ফেইল্লা রাইক্কা সবাই গেইমিংয়ে (লিবিয়া থেকে নৌকাযোগে ইতালি) যাইবগা। পোলার কষ্ট হইব যাইন্না আত্মীয়-স্বজনদের কাছেত্তে দার-দেনা ও বাড়ির গয়না বন্ধক রাইক্কা কোনোরকমে সাড়ে ৪ লাখ টাকা জোগাড় করে দালাল তারেক মোল্লার হাতে দেই।
আল আমিন ফরাজির বোন ইতি আক্তার দৈনিক অধিকারকে বলেন, তাদের অভাব অনটনের সংসার। বাবা মারা যাবার পর বড় ভাই আল আমিন সংসারের ভার কাঁধে নেয়। ছোট ৪ ভাই-বোন, মা ও স্ত্রী-সন্তানসহ এত বড় সংসারটি তিনি তার ছোট চাকরির আয় দিয়েই কোনোরকমে টেনে নিয়ে আসছিলেন। তার উপরেই ছিল ইতি ও অন্য ভাইদের পড়ালেখার খরচ।
ইতি জানান, গত কয়েক মাস আগে ভাই ইতালি যাবে বলে তার ভাবী সব গহনা বন্ধক দেয় এবং আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় থাকা আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের আগানগর এলাকার মনি চন্দ্র শীল নামে এক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে আল আমিন ফরাজি। তার মাধ্যমে যোগাযোগ হয় হাসনাবাদ এলাকার বাচ্চু মোল্লার ছেলে তারেক মোল্লার সাথে এবং তার সাথে সকল ধরনের লেনদেন।
পরে তারেকের কাছে ইতালি যাবার জন্য সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেয় আল-আমিন। বাকি সাড়ে ৬ লাখ টাকার মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ টাকা আল-আমিন লিবিয়া থাকা অবস্থায় তার পরিবারের লোকজন তারেকের হাতে দেয়।
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে দেশে ফেরা নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মো. খোরশেদ মৃধার ছেলে ইউসুফ মৃধার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, গত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ার স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে দুই মিসরীয় চালক ১২ ফুটের ছোট একটি বোটে করে তাদের ৩৫ জনকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় মাল্টার কাছাকাছি পৌঁছালে ভোর ৩টার দিকে উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে বোট থেকে একজন পানিতে পড়ে যায়। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে বোট উল্টে ৩০ জন বোট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বেঁচে যাওয়া ইউসুফ মৃধা (২৯) বলেন, ঘটনার ৩৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ভূমধ্যসাগরে এখনও ২৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৫ জনই নরসিংদীর। এত দিনেও নিখোঁজ ২৮ বাংলাদেশির কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, তাদের কেউই হয়ত আর বেঁচে নেই।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে নরসিংদীর ১৫ জনের নাম পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন, রায়পুরা উপজেলার ডৌকারচরের নাদিম সরকার (২২), আলমগীর সরকার (৩৫), আল-আমিন ফরাজী (৩৩), দক্ষিণ মির্জানগরের এস এম নাহিদ (২৫), আমিরগঞ্জের ইমরান মিয়া (২১), আশিস সূত্রধর (২১), সবুজ মিয়া (২৫), হাইরমারার শাওন মিয়া (২২), সেলিম মিয়া (২৪), বেলাব উপজেলার আল আমিন (২৮), নারায়ণপুরের মতিউর রহমান (৩৭), সল্লাবাদের শরীফুল ইসলাম (২৪), সালাউদ্দিন (৩২), মো. হালিম (২৬), বিপ্লব মিয়া (২৪)।
বাকি ১৩ জন ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা।
নিখোঁজ আশীষের পিতা অনিল সূত্রধর জানান, রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদের তারেক মোল্লা নামের এক দালালের সাথে ইতালি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য আট লাখ টাকায় চুক্তি করেন তারা। ছয় লাখ টাকা তার হাতে দেওয়ার পর গত ২৭ ডিসেম্বর তার ছেলেসহ অন্যরা ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। প্রথমে তাদের দুবাই নিয়ে এক সপ্তাহ রাখা হয়। পরে মিসর হয়ে তাদের পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজী শহরে। সেখানে খাদ্যসংকটে আরও প্রায় ১০ দিন থাকার পর ব্যক্তিগত গাড়ির ডেকের ভেতরে ভরে দুইদিনের যাত্রা শেষে তাদের নেওয়া হয় ত্রিপোলি শহরে। সেখানে তারা দেখা পান এই চক্রের মূল দালাল মনি চন্দ্র শীলের সাথে। মনি চন্দ্র শীলের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে।
এ ব্যাপারে নিখোঁজ আশীষের পিতা অনিল সূত্রধর, নাদিম সরকারের পিতা ছোবহান সরকার ও আল-আমিনের ভাই ইয়ামিন ফরাজী পৃথক পৃথকভাবে রায়পুরা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এদিকে স্থানীয় দালাল তারেকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে তার বড় ভাই মামুন মোল্লার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আসলে আমি যতটুকু জানি ইতালি যাওয়ার জন্য নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সকলে লিবিয়ায় অবস্থানরত মনির সাথে যোগাযোগ করেছে। শুধু টাকা পয়সা লেনদেনের জন্য আমার ভাইয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। তারপরেও বলবো আমার ভাই যদি সত্যিকার অর্থে মানবপাচারের সাথে সম্পৃক্ত থাকে তবে তার বিচার হোক, এতে আমাদের বলার কিছু থাকবে না।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান দৈনিক অধিকারকে জানান, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার জন্য যে দেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে, সে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই শীর্ষে। যে জেলাগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ এই ঝুঁকি নেয়, তার মধ্যে নরসিংদী অন্যতম। গত এক দশকে এ পথে কমপক্ষে ৬৫ হাজার বাংলাদেশি শুধু আটকই হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষ। অথচ যে পরিমাণ টাকা দিয়ে তারা এমন ঝুঁকি নেন, এ দিয়ে কিন্তু তারা নিজেদের এলাকাতেই কিছু করতে পারেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দালালদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই প্রবণতা কমবে না।
আরও পড়ুন : কালিয়াকৈরে দলিল লেখকদের কর্মবিরতি
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান জানান, জেলার ১৫ জনসহ মোট ২৮ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগরে ৩৫ দিন ধরে নিখোঁজ থাকার বিষয়টি শুনেছি। এছাড়া নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের কোনো সদস্য এখন পর্যন্ত আমাদের এ বিষয়ে কিছুই জানায়নি। এ বিষয়ে কতটুকু কী করা সম্ভব, তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, অভিবাসনপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের কাছে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য আমাদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বিদেশগামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে আমার অনুরোধ থাকবে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা যেন না করে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান বলেন, অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা কি বৈধভাবে নাকি অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছে সেসব দিক পর্যালোচনা করে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব দালাল তারেককে আইনে আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।
ওডি/এফএইচপি
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: [email protected]
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড