• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৫ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে অর্থ আত্মসাৎ

  অধিকার ডেস্ক

১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৩৪
এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তার ভাই মো. আবুল বাসার খান (ছবি : সংগৃহীত)

গ্রাহকদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এহসান গ্রুপ পিরোজপুর-বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও তার এক সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

জানা যায়, রাগীব আহসান নূরে মদিনা ক্যাডেট মাদরাসার অধ্যক্ষ। একসময় তিনি মসজিদের ইমাম ছিলেন। বাড়ি পিরোজপুর সদরের খলিশখালি এলাকায়। একসময় তিনি এমএলএম ব্যবসা শুরু করেন এবং ২০১০ সালে এহ্সান রিয়েল এস্টেট নামে একটি কোম্পানি খোলেন। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলাও হয়েছে।

এর আগে গত রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে গ্রুপটির বিরুদ্ধে ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের পাশাপাশি মাঠকর্মী ও গ্রাহকদের জমাকৃত অর্থ ফেরত দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীদের পক্ষে মাওলানা হারুনার রশীদ বলেন, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্সের পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুফতি রাগীব আহসান এলাকার মানুষের সঞ্চয়ী হিসাব চালু করেন। জমা করা টাকার ওপর মাসিক মুনাফা দেওয়ার কথা বলে পাস বইসহ বিভিন্ন ডকুমেন্ট দিয়ে টাকা জমা নেন।

তিনি বলেন, এলাকার মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কয়েকমাস মাসিক মুনাফা দেওয়ার পর বন্ধ করে দেন। এরপর নানা কথায় সময় পার করতে থাকে। একপর্যায়ে আমরা টাকা ফেরত চাইলে নানা অজুহাতে টালবাহানা শুরু করে। এভাবে প্রায় তিন বছর চলার পর টাকা-পয়সা না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়।

২০১৯ সালে রাতের আঁধারে শের-ই-বাংলা পাবলিক লাইব্রেরির ৪র্থ তলায় এহসান গ্রুপের প্রধান অফিস তালাবন্ধ করে দেয়। পরে জানা যায়, অফিস বন্ধের আগেই তারা অফিসের সব ডকুমেন্ট সরিয়ে ফেলেন।

হারুনার রশীদ বলেন, অফিস সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদিকে পিরোজপুর এহসান গ্রুপের এমডি রাগীব আহসান গ্রাহকদের পাওনা টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তাদের প্রতারণায় পিরোজপুর ও আশপাশের প্রায় লক্ষাধিক গ্রাহক ও মাঠকর্মী ক্ষতির শিকার।

তিনি আরও বলেন, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড প্রতারণার উদ্দেশ্যেই আত্মীয়-স্বজনদের দিয়ে পরিচালিত হতো। ধীরে ধীরে তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাগীব আহসানের স্ত্রী সালমা বেগম চেয়ারম্যান, রাগীব আহসানের শ্বশুর মাওলানা শাহ আলম সহ-সভাপতি, রাগীব আহসানের বাবা আব্দুর রব খান উপদেষ্টা, রাগীব আহসানের বোনের স্বামী মো. নাজমুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার, রাগীব আহসানের ভাই আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহ-পরিচালক, আর এক ভাই মাহমুদুল হাসান প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও বাজার মসজিদের ইমাম, আর দুই ভাই শামিম খান ও খাইরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।

শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান ফোর্সটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান (৪১) ও তার ভাই এহ্সান গ্রুপের সহকারী পরিচালক মো. আবুল বাসার খানকে (৩৭) রাজধানীর তোপখানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা ২০০৮ সালে প্রায় একশ দশ কোটি টাকা প্রাথমিক মূলধন ও দশ হাজার সদস্য নিয়ে ‘এহসান গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে মঈন বলেন, ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে প্রতারণার কথা রাগীব আহসান স্বীকার করেছেন। তার কাছে পাওনা টাকার জন্য গেলে গ্রাহকদের মামলা, মারধর করতেন তিনি। একজন গ্রাহক ২৮ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে পরে টাকা চাইতে গেলে তাকে অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়া হয়েছে। তিনি এর আগেও ২০১৯ সালে একবার গ্রেফতার হয়ে জেলে ছিলেন।

আরও পড়ুন : ১৯৯০ সাল থেকে পত্রিকা বিলি করছেন আব্দুল আলিম

সতেরো হাজার কোটি টাকার বিষয়ে র‍্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের কথা স্বীকার করেছেন। এছাড়াও তার নামে দুটি মার্কেট, সাতটি জমি প্রকল্প ও আরও ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৷ এসব প্রতিষ্ঠান তার আত্মীয়-স্বজনের নামে চলছে। তাকে গ্রেফতারের সময় তার কাছে থাকা ‘এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড’-এর ৪টি রশিদ বই, দুটি মোবাইল ও সঙ্গে থাকা নগদ টাকা জব্দ করা হয়েছে ৷

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাগীব হাসানের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা চলছে। প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করছেন গ্রাহকেরা। অনেক গ্রাহক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করছেন। এসব অভিযোগের ছায়া তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ার পর তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভাউচার বই ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

এহসান গ্রুপ মোট কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি এই র‌্যাব কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যে তথ্য পাওয়া অনুসারে গ্রাহকদের ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে তারা। এমনও ভুক্তভোগী আছেন, যিনি একাই ১৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখবে। রাগীব হাসান প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তিনি ১০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ কোটি টাকা নিয়ে গ্রুপের যাত্রা শুরু করেন। এখন গ্রাহক কত আছে, তা তদন্তের পর বলা যাবে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, গ্রাহক ৫৫ হাজার। আবার কেউ কেউ বলছেন, গ্রাহক এক লাখের বেশি।

র‌্যাবের তথ্যমতে, রাগীব আহসান ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদরাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস এবং ১৯৯৯-২০০০ পর্যন্ত খুলনার একটি মাদরাসা থেকে মুফতি পাস করে পিরোজপুরে একটি মাদরাসায় চাকরি নেন। ২০০৬-২০০৭ সালে তিনি ইমামতির পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। এই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময় তিনি মাল্টিপারপাস কোম্পানির আদ্যোপান্ত রপ্ত করেন। পরবর্তী সময়ে নিজে ২০০৮ সালে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি মাল্টিপারপাস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

রাগীব আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, এহসান গ্রুপে তিন শতাধিক কর্মী রয়েছেন। তাদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। গ্রাহক সংগ্রহ করলে বিনিয়োগের ২০ শতাংশ অর্থ পাওয়ার প্রলোভন দেখানো হতো কর্মীদের। তবে গ্রাহকদের মতো কর্মীরাও প্রতারিত হয়েছেন। তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। তিনি উল্লেখ করেন, তার নিকটাত্মীয়দের মধ্যে শ্বশুর প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি, বাবা আবদুর রব প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এ ছাড়া রাগীব আহসানের তিন ভাইয়ের মধ্যে আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহপরিচালক, অন্য দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের সদস্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে পিরোজপুর পৌরসভার খলিশাখালী এলাকায় এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠা করেন রাগীব আহসান। এরপর পিরোজপুর পৌর শহরের সিও অফিস মোড়সংলগ্ন এলাকায় জমি কিনে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির নতুন নাম দেওয়া হয় এহসান গ্রুপ।

আরও পড়ুন : ‘নগদ’ নিয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান ডাক অধিদফতরের

এখন এই গ্রুপের নামে ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো এহসান এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, নুর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নুরজাহান মহিলা মাদরাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার এবং এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।

ভুক্তভোগীরা দাবি করেন, এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা–জমি করেছেন।

ওডি/এএম

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড