• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৯ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

ফেনীতে জনস্বাস্থ্যের গভীর নলকূপ প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ

  এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী

১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:১০
ফেনী
সরকারের বাস্তবায়নাধীন গভীর নলকূপ প্রকল্প

আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকারের বাস্তবায়নাধীন গভীর নলকূপ প্রকল্প নিয়ে ফেনীতে লুটপাটসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। জেলার ৩ উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ হাজার ১শ ৮৮টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ চলছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কার্যাদেশের তোয়াক্কা না করে ঠিকাদাররা ইচ্ছেমত কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি নলকূপ ৭ হাজার টাকা জমা দেয়ার কথা থাকলেও আদায় হচ্ছে ১৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

আবার নলকূপ স্থাপনে নিয়োজিত শ্রমিকদের খাওয়া খরচ সহ নানা অজুহাতেও ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। এসব চিত্র জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রহস্যজনক নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এনিয়ে ভুক্তভোগী এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাঝেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

জেলার সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের ভালুকিয়া গ্রাম। এক বাড়িতেই গিয়ে পাওয়া গেছে এ প্রকল্পের ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র। ওই বাড়ির আবদুল লতিফ নলকূপের জন্য ঠিকাদারের লোকজনকে ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। এছাড়া আরো ৩ হাজার টাকা দিয়েছেন শ্রমিকদের খাওয়া বাবদ।

একই বাড়ির বৃদ্ধ এবাদুল হক জানান, তার ছেলে শাহআলম ৯ হাজার ও শেখ আহমদ ১৫ হাজার টাকা নলকূপের জন্য জমা দিয়েছেন। ১৫ মাস আগে ওই টাকা দিয়ে বারবার ঠিকাদারের কাছে ধর্না দিলেও অদ্যাবধি নলকূপগুলো বসানো হয়নি। তবে কিছু পাইপ তার ঘরের আঙিনায় ঠিকাদারের লোকজন রেখে গেছেন।

অপর বৃদ্ধ মকবুল আহমদ জানান, ঠিকাদারের কাছে অন্তত ৫০ বার গিয়ে ট্যাংক ও মোটর আদায় করলেও অদ্যাবধি বৈদ্যুতিক তার দেয়নি। সংযোগের কথা বললেও বারবার নানা অজুহাত দেখান। এমনকি ফোন করলে কথাও বলেননা। অফিসে গিয়ে দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন এ বৃদ্ধ।

ছনুয়া ইউনিয়নের দমদমা গ্রামের ইব্রাহিম জমাদ্দার বাড়ির মো: ইউসুফের স্ত্রী ছবুরা খাতুন জানান. মাস খানেক আগে তার বাড়িতে নলকূপের পাইপ স্থাপন করা হলেও মোটর, ট্যাংক কিছুই পায়নি। ধলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার আহমেদ মুন্সী জানান, তার ইউনিয়নে ১শ ৫০টি নলকূপের মধ্যে মাত্র তিনটি স্থাপন করা হয়েছে।

পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মানিক জানান, তার ইউনিয়নে ১শ ৫০টি নলকূপের মধ্যে কয়েকটিতে পাইপ স্থাপন করা হলেও অদ্যাবধি একটাও চালু করা হয়নি। কোনটিতেই মোটর-ট্যাংক দেয়া হয়নি।

জেলার সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বাদল জানান, তার ইউনিয়নে বরাদ্ধকৃত ৫০টি নলকূপের মধ্যে ইতিমধ্যে ২২টি স্থাপন করা হয়েছে। তবে এগুলোর অধিকাংশই অসম্পূর্ণ।আবার কোন ইউনিয়নে ভিন্ন চিত্রও আছে। ইউপি চেয়ারম্যানদের এড়িয়ে ঠিকাদার নিজেই বাড়তি টাকা নিয়ে ইচ্ছেমত কাজ করেছেন।

সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী বুলবুল আহমেদ সোহাগ জানান, তিনি প্রকল্পের তালিকা জমা দেয়ার আগেই ঠিকাদাররা সরাসরি লোকজন থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় নলকূপ স্থাপন করেছেন। এতে তার প্রকল্পের তালিকা বাদ পড়ে যায়।

শর্শদী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানে আলম ভূঞা জানান, তার ইউনিয়নে কিছুদিন আগেই কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫-৬টি স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় আর্সেনিক প্রকল্পে ৪ হাজার ১শ ৮৮টি গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য বরাদ্ধ হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১ হাজার ২শ ৮৬, দাগনভূঞা উপজেলায় ১ হাজার ৪শ ৫০ ও সোনাগাজী উপজেলায় ১ হাজার ৪শ ৫২টি স্থাপনের কথা রয়েছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছর ও ১৯-২০ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমবিডিএস এবং জামাল এন্ড ব্রাদার্স। প্রতিটি নলকূপে ৭শ ২০ ফুট গভীর, ২২০ বর্গমিটার প্লাটফর্ম পাকাকরণ, একটি দেড় ইঞ্চি মোটর ও ৫শ লিটার ট্যাংক দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।৭২০ফুট গভীরতায় ৮০ ফুটে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ ও বাকী ৬৬০ ফুটে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ পাইপ, ইটের গাঁথুনি করে ৫ ফুট উঁচু ট্যাংকের ফিটিং বেইজ করার কথা রয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কোনটিতে কার্যাদেশ মেনে কাজ করা হয়নি। প্রতিটি নলকূপ স্থাপনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ব্যয় বরাদ্ধ ১ লাখ ১৪ হাজার ৮শ টাকা।

সূত্র আরো জানায়, আর্সেনিক প্রকল্পের নলকূপ স্থাপন শেষ হলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের আরেকটি প্রকল্প শুরুর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ওই প্রকল্পে ১ হাজার ১৪টি সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন করা হবে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩১২টি, দাগনভূঞায় ১শ ৪টি, সোনাগাজী উপজেলায় ২৩৪টি, পরশুরামে ৭৮টি, ফুলগাজীতে ১৫৬ ও ছাগলনাইয়ায় ১৩০টি রয়েছে।মৌখিকভাবে জানালেও এ পর্যন্ত কোন লিখিত অভিযোগ পাননি নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগ ছাড়া আমরা কী করতে পারি। তবে এ সম্পর্কে ফেনীস্থ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এর বেশি বলতে রাজি হননি নির্বাহী প্রকৌশলী সহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সূত্র জানায়, সমুদয় কাজ শেষ না করে সম্পূর্ণ বিল দিতে রাজি না হওয়ায় সম্প্রতি এক ঠিকাদারের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন সদর উপজেলা প্রকৌশলী। ঠিকাদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের নানা অনিয়ম জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকায় রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমবিডিএস এর নামে যুবলীগ নেতা হুমায়ুন এবং জামাল এন্ড ব্রার্দাসের নামে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন ও আরিফ প্রকল্পের কাজ করছেন।

জানতে চাইলে ঠিকাদার হুমায়ুন আহমেদ জানান, তিনি যেসব কাজ করেছেন সবগুলোতে মোটর, ট্যাংক প্রদান সহ যথাযথভাবে সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে। প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজই চলমান রয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক প্রকৌশলীর ঘুষ দাবীর কারণে কাজে ধীরগতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

জানতে চাইলে সোনাগাজী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন বলেন, গভীর নলকূপ প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। অবৈধ সুবিধা নিতে কতিপয় ব্যক্তি তার নাম ব্যবহার করতে পারে। জামাল এন্ড ব্রাদার্স নামে কোন প্রতিষ্ঠানকে তিনি চিনেন না বলেও জানান।

আরও পড়ুন : পাওনা টাকা চাওয়ায় মরতে হল ব্যবসায়ীকে

অপর ঠিকাদার আরিফের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তারা রিসিভ করেননি।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড